
জহুরুল ইসলাম:
নানা কারণে চলতি শতকের দ্বিতীয় দশক বাংলাদেশী মুসলমানদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই দশকে ইসলামকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ইতিবাচক ও নেতিবাচক ইস্যু যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি ইসলাম-চর্চার গতিধারা নানা বাঁকবদল ও মোড় পরিবর্তনও করেছে।
একইভাবে এই দশক ধর্মীয় বড় বড় মনীষীর ইহকাল ত্যাগের বেদনাময় ইতিহাসের সাক্ষী। এ-ক্ষণে আমরা আলোচ্য দশকের ক’জন প্রয়াত মনীষীকে নিয়ে অল্প-বিস্তর কথা বলব।
শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ.
(০০.০১.১৯১৯—০৮.৮.২০১২ইং)
বাংলাদেশের ইতিহাসে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টিকারী এক তারকাপুরুষ হচ্ছেন শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ.। ইলমের প্রাঙ্গনে যেমন তিনি ছিলেন সম্রাটতুল্য, সংগঠন মানবসেবা ও রাজনীতির ময়দানেও ছিলেন সাহসী ঘোড়সওয়ার। তার নব্বইয়োর্ধ্ব জীবনের পুরোটাই মেহনত, সাধনা ও বহুমাত্রিক দান অবদানে পরিপূর্ণ। আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.–এর সান্নিধ্যে ছাত্রজীবনের লম্বা সময় কাটানোর পর কর্মজীবনে এসেই তিনি অভাবনীয় চমক সৃষ্টি করেন। শিক্ষা ও রাজনীতি— উভয় ময়দানে তিনি আমৃত্যু সরব ছিলেন। ইলমি ময়দানে তার সবচেয়ে বেশি অবদান হাদিসশাস্ত্রে। তার রচিত (দশখণ্ডের) বুখারি শরিফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ বাংলাভাষী মুসলমানদের জন্য এক বিশাল নেয়ামত। তার কাছে হাদিস পড়া ছাত্রদের সংখ্যাও কম নয়। তার নিজ হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়াসহ অন্যান্য মাদরাসা মিলিয়ে সেসব ছাত্রের সংখ্যা পাঁচ হাজারেরও বেশি।
হাফেজ্জি হুজুর রহ.–এর রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনে তিনি ছিলেন সিনিয়র নায়েবে আমির ও দলের প্রধান মুখপাত্র। তবে হুজুরের ইন্তেকালের পর তিনি দল থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস নামে নতুন দল গঠন করেন এবং আমৃত্যু এর নেতৃত্ব দান করেন।
সমমনা ইসলামি দলগুলো নিয়ে তিনি আরো গঠন করেছিলেন ইসলামী ঐক্যজোট। তিনি ছিলেন এই জোটের সভাপতি। তার নেতৃত্বে ইসলামি ঐক্যজোট ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং ১টি আসনে জয়লাভ করে।
১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিবাদে ১৯৯৩ সালের ২–৪ জানুয়ারি অযোধ্যা অভিমুখে এক ঐতিহাসিক লংমার্চে তিনি নেতৃত্ব দেন। তার এই লংমার্চে ৫ লক্ষ মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এই লংমার্চ ফলাও করে প্রচার করা হলে তিনি একজন মুজাহিদ আলেম হিসেবে খ্যাতি পান। লংমার্চ-পরবর্তী সময়ে মদিনা সফরে গেলে তাকে লংমার্চের নেতা হিসেবে ব্যাপক সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
মুহাম্মদ (স.)-কে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্যের প্রতিবাদে ১৯৯৬ সালে তার আহ্বানে দেশব্যাপী সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ১ জানুয়ারি ২০০১ তারিখে হাইকোর্ট থেকে ফতোয়া বিরােধী রায় প্রদান করা হলে এর প্রতিবাদে তিনি ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তােলেন।
কওমি শিক্ষার স্বীকৃতির পেছনেও তার বড় অংশের অবদান অনস্বীকার্য। ২০০৬ সালে তিনি হাজার হাজার ছাত্র নিয়ে কওমি স্বীকৃতি আদায়ের জন্য মুক্তাঙ্গনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছিলেন।
ধারণা করা হয়, তিনি ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব।
মুফতি ফজলুল হক আমিনি রহ.
(১৫.১১.১৯৪৫—১২.১২.২০১২ইং)
বাংলাদেশে মুসলিম জনগণের আরেকজন দরদি অভিভাবক ছিলেন মুফতি ফজলুল হক আমিনি রহ.। তিনিও জনগণের ব্যক্তিজীবন থেকে রাষ্ট্রীয়জীবন পর্যন্ত সব ধরনের দ্বীনি সমস্যার তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
জামিয়া কোরআনিয়া লালবাগ থেকে দাওরায় হাদিস ও দারুল উলুম করাচি থেকে ইফতার সম্পন্ন করে প্রথমত কামরাঙ্গীরচর নুরিয়া মাদরাসা ও পরে লালবাগ মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবনের শুরু এবং হাফেজ্জি হুজুরের ইনতেকালের পর আমৃত্যু লালবাগ মাদরাসার প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশের ইসলামভিত্তিক ইস্যুতে তিনি আজীবন ছিলেন সোচ্চার। শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে তার হাত ধরে অনেক বড় বড় আন্দোলন প্রাণ পেয়েছে। ৯০ দশকের শুরুতে ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিবাদ শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ.–এর আহ্বানে যে ঐতিহাসিক লংমার্চ পালিত হয়েছিল, আমিনি সাহেব ছিলেন এর দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা ও প্রধান কার্যনির্বাহী।
১৯৯৪-এ তুমুল সমালোচিত উগ্রপন্থী লেখিকা তাসলিমা নাসরিন পবিত্র কোরআনে পরিবর্তন আনার যে মত দিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে মুফতি আমিনি সাহেব বিরাট হুংকার তুলেছিলেন। দেশব্যাপী আন্দোলনের চাপে সরকার সেই নাস্তিকপন্থী লেখিকাকে নির্বাসনে বাধ্য করে।
২০০১ সালে হাইকোর্ট থেকে ফতোয়া নিষিদ্ধ আইন ঘোষিত হলে তিনি এর বিরুদ্ধেও আওয়াজ তোলেন এবং সফল আন্দোলন পালন করেন। এ-ছাড়াও সরকারপ্রণীত ইসলামি শরিয়তবিরোধী নারীনীতি ও শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন।
দীন ও শরিয়তের পক্ষে তার এই কঠোর অবস্থানের কারণে শেষ জীবনে তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয় এবং গৃহবন্দী অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ.
(১৫.৬.১৯৩৩—১৫.৭.২০১৩ইং)
মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ. এদেশের কওমি মাদরাসা অঙ্গনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জাগরণের এক পুরোধা পুরুষ। ওলামা-তলাবাদের বাংলা ভাষার সাথে সম্পর্ক গড়ে দেয়ার ক্ষেত্রে তার চেষ্টা ও অবদান অনেক। বলা হয়, যে সময় মাদরাসাগুলোতে উর্দুতে পাঠদান ছিল বিধিবদ্ধ, তখন তিনি সর্বপ্রথম বাংলায় পাঠদানের রীতি চালু করেন। তাছাড়া কওমি অঙ্গনের ছাত্রদের বাংলার বহুমুখী চর্চার এক সুন্দর মানচিত্র তিনি এঁকে দেন। বাংলা ভাষায় দেয়ালিকা, ভাষণ-বক্তৃতা চর্চার পরিবেশ তিনি তৈরি করে দেন। তার দেখানো পথে হেঁটে শতশত বরং হাজারো মাতৃভাষাপ্রেমী আলেম মাদরাসা-অঙ্গন থেকে বের হয়েছেন ও হচ্ছেন।
মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ. পড়ালেখা শেষ করেন দারুল উলুম দেওবন্দে। সেখানে তিনি অনেক বড় বড় মনীষীর সোহবত লাভ করেন। তাদের মধ্যে হযরত হুসাইন আহমদ মাদানি, ইজাজ আলি আমরুহি, ইবরাহিম বলিয়াভি, কারি মুহাম্মদ তৈয়ব রহ. প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
দেওবন্দ থাকাকালীনই তার মাঝে সমাজ সংস্কারের প্রতিভা ফুটে ওঠে। ফলে তার শায়খ ও মুরশিদ কুতুবে আলম শায়খুল ইসলাম সায়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. তাকে রসিকতা করে ‘চৌদা সদি-কা মুজতাহিদ’- চতুর্দশ শতকের মুজতাহিদ বা সমাজ সংস্কারক বলে সম্বোধন করতেন।
দীর্ঘদিন তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সম্পাদনা বোর্ডের সদস্য ছিলেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে তার সম্পাদিত বইয়ের সংখ্যা ৪২ টি। রিভিউ গ্রন্থ সংখ্যা ৫১ টি।
তিনি স্বাধীনতার একজন অকুণ্ঠ সমর্থক ছিলেন। গোপনে সুসংগঠিত করেছেন যোদ্ধাদের। স্বাধীনতা পরবর্তী বন্ধ হয়ে যাওয়া মাদরাসাগুলো খুলে দেয়ার পদক্ষেপ তিনিই প্রথম গ্রহণ করেছিলেন।
তিনি ছিলেন রিজাল গড়ার সুনিপুণ কারিগর। আকাবিরে দেওবন্দের চিন্তা-চেতনায় উজ্জীবিত যুগ সচেতন নির্ভেজাল ইসলামের খাদেম গড়েছেন অসংখ্য।
তার উল্লেখযোগ্য ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন: আল্লামা মাহমুদুল হাসান, মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস, মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ, মাওলানা আবদুল জাব্বার জাহানাবাদী, মাওলানা আযহার আলী আনোয়ার শাহ, মাওলানা আতাউর রহমান খান, মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া প্রমূখ।
ছাত্রজীবনে তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তবে কর্মজীবনে এসে জমিয়তে উলামায়ে যোগ দেন। ১৯৬৬ সালে তিনি অল পাকিস্তান জমিয়তের কেন্দ্রীয় ও গঠনতন্ত্র প্রণয়নের সাব কমিটির সদস্য হন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। যুদ্ধোত্তর ভেঙ্গে পড়া বাঙালি মুসলিম ও ওলামাদের কল্যাণে তিনি কাজ করেছেন।
অধ্যাপক গোলাম আযম
(০৭.১১.১৯২২—২৩.১০.২০১৪ইং)
অধ্যাপক গোলাম আযমের জন্ম ১৯২২ সালে, ঢাকার লক্ষীবাজারস্থ একটি দীনি পরিবারে।
তিনি ১৯৪৪ সালে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে ঢাকা বোর্ডে দশম স্থান অধিকার করেন এবং ১৯৫০-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পরীক্ষা দেন। ১৯৫৫ পর্যন্ত তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি প্রথমে দাওয়াতে তাবলিগ ও পরবর্তীতে তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে যুক্ত হন।
১৯৫৪-তে তিনি বাংলাদেশ জামাতে ইসলামীতে যোগদান করেন এবং ৫৫-তে কারাবরণ করেন। কারাবন্দী অবস্থায় তিনি জামাতের রোকন পদে উন্নীত হন। এরপর ধীরে ধীরে বিভাগীয় প্রধান ও সবশেষে পূর্ব পাকিস্তানের আমির হিসেবে নিযুক্ত হন। ২০০০ সালে তিনি জামাতের আমিরের পদ থেকে অব্যাহতি লাভ করেন।
স্বৈরাচার, একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে অধ্যাপক গোলাম আযম আগাগোড়া বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। দলের পক্ষে তার আন্দোলনী তৎপরতা ছিল ব্যাপক। তার অক্লান্ত পরিশ্রম ও সাহসী পদক্ষেপই তাকে নেতৃত্বের আসনে আসীন করেছে।
আন্দোলন ও সাংগঠনিক কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও অধ্যাপক গোলাম আযম লেখা এবং চিন্তার জগতে তার অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তাফসির, নবী-জীবন, ইসলাম, সংগঠন, আন্দোলন, রাজনীতি ইত্যাদি নানা বিষয়ে এ পর্যন্ত ১০৭ টি বই লিখেছেন তিনি। অধ্যাপক গোলাম আযম লিখিত কিছু বই ইংরেজি ছাড়াও উর্দু, তামিল ও অহমিয়া ভাষায় অনুদিত হয়েছে। এ ছাড়া অধ্যাপক গোলাম আযমের জীবনী নিয়ে ইংরেজি ভাষায় একটিসহ ৮টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী
(৩১.৩.১৯৪৩—১১.৫.২০১৬ইং)
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর জন্ম পাবনায়, ১৯৪৩ সালে। তিনি ১৯৬৩-তে ঢাকা মাদ্রাসা-ই-আলিয়া থেকে কামিল ও ৬৭-তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেন।
ছাত্রজীবন থেকেই তিনি বিপ্লবমুখর ছিলেন। ফলত ইসলামিক ছাত্রসংঘে যোগ দিয়ে বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং পর্যায়ক্রমে একজন ছাত্রনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ১৯৭১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন। তিনি পর্যায়ক্রমে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরীর আমীর ও কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য হিসেবে ১৯৭৯-১৯৮২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি সংগঠনের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল মনোনীত হন এবং ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত থাকেন।
১৯৮৮ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত একটানা ১২ বছর মাওলানা নিজামী জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ সালের ১৯ নভেম্বর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর নির্বাচিত হন। শাহাদাতের পূর্ব পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ছিলেন আপাদমস্তক এক বিপ্লবী নেতা। সরকারকর্তৃক গৃহীত ৭১-এর যুদ্ধপরাধীদের শাস্তিদান কর্মসূচির আওতায় তাকে ২০১৬ সালে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।
মাওলানা আবদুল জব্বার জাহানাবাদি রহ.
(১৯৩৭—১৮.১১.২০১৬ইং)
মাওলানা আবদুল জব্বার জাহানাবাদী রহ. ছিলেন একইসঙ্গে আলেম, লেখক, সংগঠক ও শিক্ষাবিদ। এই মনীষীর জীবনের সবচেয়ে আলোকিত দিক হলো তার অপরিমের শিক্ষানুরাগ। ১৯৭৮ থেকেই তিনি বাংলাদেশের কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক)–এর সঙ্গে যুক্ত এবং আজীবন এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব বিশ্বস্ততার সঙ্গে আঞ্জাম দিয়েছেন। বেফাককর্তৃক প্রকাশিত প্রায় সকল পাঠ্যপুস্তকই তার দক্ষ হাতে সম্পাদিত হয়ে দেশের বিরাট সংখ্যক দীনি শিক্ষার্থীর পাঠ-চাহিদা পূরণ করছে।
কওমি স্বীকৃতির পক্ষেও তার জোরদার অবস্থান ছিল। বলা হয়, আল্লামা নূরুদ্দীন গহরপুরি রহ.–এর অনুমতিক্রমে তিনি সর্বপ্রথম এই স্বীকৃতির দাবি উচ্চারণ করেন।
মাওলানা আবদুল জব্বার জাহানাবাদি রহ. ছাত্রজীবনে উসতাদদের ও কর্মজীবনে সহকর্মীদের আস্থা ও প্রিয়ভাজন ছিলেন। তার ইনতেকালে বাংলাদেশ কওমি শিক্ষাজগত এক দরদি মুরব্বিকে হারিয়েছে।
মাওলানা শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফ রহ.
(১৯৪২—২৩.০২.২০১৮ইং)
বাংলাদেশে ইসলামি রাজনীতির ইতিহাসে অনন্য নজির স্থাপনকারী কিংবদন্তি মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জি হুজুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র হলেন মাওলানা শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফ রহ.।
মুজাহিদে আযম মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.–এর তত্ত্বাবধানে বড়কাটারা, লালবাগ ও মুস্তফাগঞ্জ মাদরাসায় তার ছাত্রজীবনের সময়গুলো কাটে। পরবর্তীতে তিনি করাচির জামিয়া ইসলামিয়া বিননুরি টাউন মাদরাসায় ভর্তি হন।
পাকিস্তান থেকে ঢাকায় ফেরার পর ১৯৬৩ সালে জাতীয় মসজিদ বাইতুল মুকাররমে প্রধান মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব নেন। তিনি ঢাকার জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া, আমীনবাজারস্থ মদিনাতুল উলুম মাদরাসা ও লক্ষীপুরের লুধুয়া এশাআতুল উলুম মাদরাসায় একই সঙ্গে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন।
হাফেজ্জি হুজুরের ইনতেকালের পর তিনি বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের ভারপ্রাপ্ত আমির নিযুক্ত হন এবং টানা সাতাশ বছর এই ইসলামি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব প্রদান করেন। ২০১২ সালে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে রাজনৈতিক দলের সাথে রাষ্ট্রপতির সংলাপে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের পক্ষে তিনি নেতৃত্ব দেন।
৯২-এ বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার বিরুদ্ধে আন্দোলন, ৯৪-এ উগ্রপন্থী লেখিকা তসলিম নাসরিনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ২০০১-এ ফতোয়াবিরোধী আন্দোলন, ২০০৭-এ প্রথমআলো কর্তৃক নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যঙ্গ কার্টুন প্রকাশের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও ২০১৩তে হেফাজতে ইসলামের নাস্তিক বিরোধী আন্দোলনসহ গত দুই দশকের প্রায় সবগুলো ইসলামি আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।
বলা হয়, ২০১৩-এর নাস্তিকবিরোধী আন্দোলনে তিনিই সর্বপ্রথম আওয়াজ তুলেছিলেন
এছাড়াও বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অংশগ্রহণ ছিল। বাইতুল মোকাররম এলাকায় পাকবাহিনীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি অবস্থান নিয়েছিলেন। ফলে তাকে যাত্রাবাড়ী এলাকায় কারাবরণ করতে হয়।
মাওলানা এটিএম হেমায়েত উদ্দিন রহ.
(১৯৫৫—১১.১০.২০১৯ইং)
মাওলানা এটিএম হেমায়েত উদ্দিন মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা থেকে কামিল ও ঢাবি থেকে ইসলামিক স্টাডিজে এমএ সম্পন্ন করে অধ্যাপনা জীবন শুরু করেন। তিনি ঢাকার মালিবাগে আবু জর গিফারী কলেজ ও রামপুরা একরামুন্নিসা ডিগ্রী কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। দীর্ঘ ৪২ বছর ফার্মগেট পশ্চিম রাজাবাজার জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব ছিলেন। অনেক সংখ্যক মসজিদ-মাদরাসা প্রতিষ্ঠার সঙ্গেও তিনি জড়িত।
ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি ১৯৮১—১৯৮৩ পর্যন্ত ছাত্র সংগঠন জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার উদ্যোগে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের স্বায়ত্তশাসনসহ আলিয়ার ছাত্রদের ১৭ দফা দাবি আদায়ে জাতীয় সংসদ ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এ আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের স্বায়ত্বশাসনের দাবি আদায় হলে পরবর্তীতে স্বায়ত্বশাসিত মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যান বাকিবিল্লাহ খানের উপস্থিতিতে তাকে সংবর্ধিত করা হয়।
বাংলাদেশের ইসলামি রাজনীতির পথিকৃৎ মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জির সাথে তিনি তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা করেন। হাফেজ্জির রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। হাফেজ্জির মৃত্যুর পর তিনি সৈয়দ ফজলুল করিমের নেতৃত্বে ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলন বর্তমানে ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের সাথে যুক্ত হন। তিনি ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করে সর্বশেষ অবিভক্ত ঢাকা মহানগরীর সভাপতি ও পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৯১ ও ৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ইসলামি ঐক্যজোটের অন্যতম শরীক দল ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলনের পক্ষে মিনার প্রতিকে বাগেরহাট-৪ আসন থেকে নির্বাচন করেন। ২০০১ সালে ইসলামি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বাগেরহাট ৩-৪ আসনে নির্বাচন করেন। ২০০২ সালে ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলনের হয়ে অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন।
বাবরি মসজিদ ভাঙ্গনের প্রতিবাদ করে তিনি দীর্ঘসময় কারাভোগ করেছেন। ভারতের ফারাক্কা ও টিপাইমুখ বাঁধ বিরোধী আন্দোলন, বাবরি মসজিদ রক্ষার আন্দোলন, মায়ানমার, ফিলিস্তন, কাশ্মীর ও উইঘুরে মুসলিম নির্যাতন বিরোধী আন্দোলন, ফতোয়া বিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে তার সম্পৃক্ততা ছিল।
মাওলানা আশরাফ আলী রহ.
(০১.৩.১৯৪০—৩১.১২.২০১৯ইং)
গত দশকে বাংলাদেশি মুসলমানদের আরেকজন ধর্মীয় অভিভাবক ছিলেন মাওলানা আশরাফ আলী রহ.।
ছাত্রজীবন থেকে তিনি রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন৷ কাসেমুল উলুম কুমিল্লায় লেখাপড়ার সময় থেকেই তিনি মাওলানা আতাহার আলী রহ.-এর নেজামে ইসলাম পার্টির জেলা সেক্রেটারি ছিলেন এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর নেজামে ইসলাম পার্টিকে সংগঠিত করেন ও কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি নিযুক্ত হন৷
তিনি হাফেজ্জি হুজুরের সম্মিলিত জোটেও যোগদান করেন৷ তারপর কিছুদিন রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকার পর শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকে রহ.-এর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে তিনি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি দলটির অভিভাবক পরিষদের চেয়ারম্যান হন এবং আমৃত্যু এই পদে সক্রিয় থাকেন৷ ১৯৭৯ সালে তিনি সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন৷
মাওলানা আশরাফ আলী ছিলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের একজন। তিনি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের (বেফাক) সিনিয়র সহ-সভাপতি, জামিয়া শারঈয়্যাহ মালিবাগের প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদিস এবং কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ সংস্থা আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশের কো-চেয়ারম্যান পদে আসীন ছিলেন।
তিনি ছিলেন ইসলামি চিন্তাবিদ, ইসলামি ধারার উঁচুমনের রাজনীতিক, সর্ববিষয়ে পারদর্শী উস্তাদ এবং দীনের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। তিনি আজীবন ইসলামের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। বহু দীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে গেছেন। ইসলামি ধারার কল্যাণকে প্রাধান্য দিয়ে তিনি রাজনীতি করেছেন। তার কর্মময় জীবনাদর্শ তাকে এক অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছে।
ডক্টর প্রফেসর মুহা. ইলিয়াস আলী
(১৯৪৯—১৫.৫.২০২০ইং)
ডক্টর প্রফেসর মুহা. ইলিয়াস আলী ১৯৪৯ সালে চাঁপাই নবাবগঞ্জে এক আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মাওলানা আব্বাস আলী একজন বড় মাপের আহলে হাদিস আলেম ছিলেন।
১৯৭৭ সালে তিনি ঢাকা আলিয়া থেকে প্রথম বিভাগে কামিল পাশ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে এম.এ ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৮০ সালে তিনি জাতিসংঘ কর্তৃক বৃত্তিপ্রাপ্ত হয়ে আমেরিকার ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে পরিসংখ্যানে ডিপ্লোমা করেন।
২০০৬ সালে তিনি নিউইয়র্কের স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ‘বাংলাদেশের ইসলামি মাদরাসাসমূহের সমস্যা ও সম্ভাবনা’ বিষয়ে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ‘যুগে যুগে শিক্ষা কমিশন ও শিক্ষার উত্তরণ’ বিষয়ে তাঁর একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে তিনি বিভিন্ন বিভাগে চাকুরী করেন। সর্বশেষ ব্যানবেইস-এর পরিচালক হিসেবে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তিনি বেসরকারী দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি ও বাংলাদেশ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যাপনা করেন।
তিনি ২০১০-২০১৬ সাল পর্যন্ত ‘বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীসে’র সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত জমঈয়তের উপদেষ্টা ছিলেন।
মুফতি ওবায়দুল হক নঈমী
(১১.৩.১৯৪৩—০৬.৭.২০২০ইং)
মুফতি ওবায়দুল হক নঈমী একই সঙ্গে ছিলেন আলেম, শিক্ষাবিদ ও সংগঠক। তিনি ‘শেরে মিল্লাত’ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন।
তিনি বাংলাদেশের ইসলামি দল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি ২০১৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত উক্ত পদের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনার প্রতিষ্ঠাতা পৃষ্ঠপোষক ও রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও আনজুমান ট্রাস্টের নির্বাহী সদস্য ছিলেন। লন্ডনভিত্তিক সংগঠন ওয়ার্ল্ড ইসলামিক মিশনের সদস্য হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে মাওলানা কাযী নুরুল ইসলাম হাশেমীর সাথে ভূমিকা পালন করেন।
তিনি মাসিক তরজুমানসহ বিভিন্ন পত্রিকা ও প্রকাশনায় লেখালেখি করতেন। এছাড়া তিনি বেশ কিছু বই লিখেছেন। উল্লেখযোগ্য হলো— ‘দালায়েলুল কিয়াম লি মিলাদি খাইরিল আনাম’, ইমাম মুহাম্মদ (রা.) এর মুয়াত্তা গ্রন্থের ব্যাখ্যা ‘কাশিফুল মুগাম্মাদ শরহে মু’আত্তা ইমাম মুহাম্মদ’।
তিনি সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ থেকে কাদেরিয়া তরিকার দীক্ষা নেন।
আল্লামা শাহ আহমদ শফি রহ.
(১৯১৬—১৮.৯.২০২০ইং)
বলা যায়, স্মরণকালে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ধর্মীয় মুরুব্বি হলেন আল্লামা শাহ আহমদ শফি রহ.। তার সুদীর্ঘ জীবন নানা কর্ম, খেদমত ও অবদানে সিক্ত।
ইলমে দীন অর্জন ও বিতরণে কেটেছে তার জীবনের সিংহভাগ সময়। বাংলাদেশের দীনি মাদরাসাসমূহের মূল মূল যিম্মাদারি ছিল তার কাছে। তিনি তা সুনিপুনভাবে ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে আঞ্জাম দিয়েছেন। এভাবে আগে থেকেই তিনি দীনি মহলে পরিচিত ও পরম শ্রদ্ধেয় হয়ে ছিলেন।
সর্বশেষ ২০১৩-তে হেফাজতে ইসলাম গঠন ও তার কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে তার আলোচনা আরো ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশীয় গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে তিনি আলোচিত হন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে কিছু নাস্তিক-ব্লগারের কটুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের আপামর জনতা যখন সীমাহীন ক্রোধে ফেটে পড়েছিল এবং উপর্যপুরী বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষায় অধীরে অপেক্ষমান ছিল, সেই সময়টিতেই ধর্মপ্রাণ জাতির মুখপাত্র হয়ে তিনি সরব হয়ে ওঠেন এবং এই মহিরুহের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েই ধর্মপ্রাণ জনতা অধর্মের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে এক নতুন বিপ্লবের ধারা সূচনা করে। এই বিপ্লব শুধু উপমহাদেশের আঞ্চলিক ইতিহাসের অংশ ছিল না, বরং তা ছিল সমগ্র মুসলিম বিশ্বের প্রাণের আওয়াজ।
আল্লামা শাহ আহমদ শফি রহ. ইতিহাসের এমন এক নাজুক সময়ে এমন এক বীরের ভূমিকা পালন করেছেন, যে বীরত্বের স্বীকৃতি বাংলাদেশের ইসলামি ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
আল্লামা নূর হুসাইন কাসেমী রহ.
(১০.০১.১৯৪৫—১৩.১২.২০২০ইং)
গত দুই দশক জুড়ে আল্লামা নূর হুসাইন কাসেমী রহ. ছিলেন এ-জাতির একজন অবিসংবাদিত নেতা।
একই সঙ্গে তিনি ছিলেন ইসলামি চিন্তাবিদ, রাজনীতিক, সংগঠক ও আদর্শ শিক্ষক। তার হাতে গড়া অনেক ছাত্র দেশের বিভিন্ন স্থানে দীন-ঈমানের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
কর্মজীবনের শুরুতে তিনি শরিয়তপুর, ঢাকার জামিয়া এমদাদিয়া দারুল উলুম ফরিদাবাদ জামিয়া, শরঈয়্যাহ মালিবাগ ইত্যাদি মাদরাসায় খেদমত করেন।
এরপর ১৯৮৮ সালে তিনি জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা ও ১৯৯৮ সালে জামিয়া সোবহানিয়া মাহমুদনগর প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর আমৃত্যু পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানের শাইখুল হাদিস ও মহাপরিচালক ছিলেন। এছাড়াও তিনি প্রায় ৪৫টি মাদরাসা পরিচালনার কাজে যুক্ত ছিলেন।
২০২০ সালের ৩ অক্টোবর তিনি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। আইন অনুসারে একই সাথে তিনি আল হাইআতুল উলয়ার কো-চেয়ারম্যান ছিলেন।
২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর তিনি অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব নির্বাচিত হন। এর আগে তিনি হেফাজতের ঢাকা মহানগরীর সভাপতি ছিলেন।
১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি খতমে নবুয়ত আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
১৯৭৫ সালে তিনি জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৯০ সালে তিনি জমিয়তের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে চলে আসেন এবং ৭ নভেম্বর ২০১৫ সালে তিনি এর মহাসচিবের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৩ ডিসেম্বর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। তিনি মহাসচিবের দায়িত্ব নেয়ার পর দেশব্যাপী সংগঠন বিস্তৃত লাভ করে।
তথ্যসূত্র :
*মাসিক আল কাউসার
*মাসিক রহমত
*মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ. স্মারকগ্রন্থ
*বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ওয়েবসাইট
*দৈনিক যুগান্তর, দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক নয়া দিগন্ত, আওয়ার ইসলাম ডটকম
*উইকিপিডিয়া