মুনশী নাঈম:
এমরি অ্যান্ড্রু টেটকে নিশ্চয়ই সবাই চিনেন। তিনি একজন বিখ্যাত আমেরিকান-ব্রিটিশ অনলাইন ব্যক্তিত্ব এবং প্রাক্তন পেশাদার কিকবক্সার। কিকবক্সিং ক্যারিয়ার থেকে অবসর নেওয়ার পর টেট তার ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিভিন্ন অনলাইন কোর্স করানো শুরু করেন এবং এভাবেই পরবর্তীতে একজন বিখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। টিকটকে তার ফলোয়ার ছিল ১১.৬ বিলিয়ন, টুইটারে ছিল ৪ মিলিয়ন এবং ইনস্টাগ্রামে ৪.৭ মিলিয়ন। শুধু তাই নয়, ট্রাম্প এবং রানী এলিজাবেথের পরে ২০২২ সালে তিনি গুগলে তৃতীয় সর্বাধিক অনুসন্ধান করা ব্যক্তি ছিলেন।
পশ্চিমা মিডিয়া তাকে ‘নারীবিদ্বেষী’ বলে অভিহিত করে। এই অভিযোগে স্থায়ীভাবে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম থেকে তাকে নিষিদ্ধ করেছে এর মূল প্রতিষ্ঠান মেটা। বিবিসি জানায়, টেটের অফিশিয়াল অ্যাকাউন্টগুলো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ, অ্যান্ড্রু টেট বলেছেন, ‘আমি ‘নারীবিদ্বেষী’ নই। মিডিয়া তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে।’ চলতি বছর অক্টোবরে ২৪ তারিখ অ্যান্ড্রু টেটের ইসলাম গ্রহণের পর সাড়া পড়ে যায়। মুসলিমরা তাকে অভিবাদন জানায়। কারণ, ইসলাম গ্রহণ করার আগেও তার মুসলিম অনুসারী ছিল।
এই সময়ে টেটের মেধা এবং জনপ্রিয়তা দেখে মনে পড়ে যায় কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আন্দোলনের সোচ্চার এক কর্মী ম্যালকম এক্সের কথা। তিনিও একজন আমেরিকান। ইসলাম গ্রহণ করার পর তিনি বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। এক্স এবং টেটের মধ্যে বেশ কিছু বিষয়ে মিল আছে। এ লেখায় তা তুলে ধরব কিঞ্চিৎ।
ম্যালকমের উত্থান
তিনি শৈশবে শেতাঙ্গদের হাতে পিতাকে হারান। এদিকে স্বামীর শোক ও সন্তানদের সামলে নেবার চাপ সইতে না পেরে তাঁর মাতা মানসিক ভারসম্য হারিয়ে ফেলেন। একটু বড় হয়ে স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু স্কুলে বর্ণবৈষম্যের শিকার হয়ে তিনি লেখাপড়া ছেড়ে দেন এবং পরপর কয়েকটি শ্বেতাঙ্গ দত্তক পরিবারে প্রতিপালিত হয়ে বেড়ে উঠতে থাকেন। তারা তাকে ডাকতো নিগ্রো বলে। এভাবে একসময় তিনি বেছে নেন অন্ধকার পথ। হয়ে ওঠেন মাদক কারবারী। কিন্তু তার অদৃশ্যে লেখা ছিল ভিন্ন কিছু। তাই তিনি কিছুদিনের মধ্যেই পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। জেলে যান। সূচিত হয় তার জীবন বদলে যাওয়ার প্রথম অধ্যায়।
জন্মসূত্রে তিনি একজন খৃস্টান ছিলেন। জেলে গিয়ে ‘ন্যাশন অব ইসলাম’ সম্পর্কে অবগত হন। সংগঠনটি আমেরিকার কালো মানুষদের অধিকার আদায়ে কাজ করে। কিন্তু তারা ছিল কট্টর বর্ণবাদী ও শেতাঙ্গ বিদ্বেষী। তিনি জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যোগ দেন ন্যাশন অব ইসলামে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নিজের প্রবল প্রতিভা ও দক্ষতার বলে ন্যাশনের একজন প্রভাবশালী নেতা ও দলের মুখপাত্র হয়ে ওঠেন।
কিন্তু ১৯৬৪ সালে হজে গিয়ে এমন ইসলামের খোঁজ পান, যা বৈষম্যমুক্ত একবিশ্বের স্বপ্ন দেখায়। দেখায়, ইসলাম শুধু কালোদের ধর্ম নয়, বরং তা পুরো মানবজাতির ধর্ম, সাদাকালো সকলের। মক্কার স্মৃতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ইসলামি বিশ্বে কাটানো বারো দিনে আমি একই পাত্র হতে খাবার খেয়েছি, একই পানপাত্র হতে পান করেছি, একই বিছানায় ঘুমিয়েছি, এক মহান প্রভূর ইবাদত করেছি এমন মুসলিমদের সাথে যাদের চোখ সবুজ, চুল সাদা ও চামড়া সাদা। তাদের আন্তরিকতায় পেয়েছি ঠিক একই আবহ যা পেয়েছি নাইজেরিয়া, সুদান ও ঘানা হতে আগত মুসলিমদের মাঝে। মনে পড়ে মুযদালিফার ময়দানের খোলা আকাশের নিচে রাত্রি যাপনের কথা। মনে হলো, পৃথিবীর বিভিন্ন ভূখণ্ডের বিভিন্ন চেহারার ও বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ যেন একই সারিতে ঘন-নিবিড়ভাবে সদলবলে উপস্থিত। এ ভূখণ্ডে আমি যা দেখেছি, তা আমার চিন্তা-চেতনাকে পুরো পরিবর্তন করে দিয়েছে। আমার পূর্ব-অভিজ্ঞতা হতে সহজেই মুক্ত হতে পারছি। এটা হলো নিষ্পাপতা ও মায়া-মমতার বিশ্ব, যেখানে ম্যালকম এক্স তার সকল পূর্ব-চিন্তা-চেতনা বিসর্জন দিয়ে উপনীত হয়েছে।’
অ্যান্ড্রু টেটের উত্থান
২০১৭ সালে হলিউড প্রযোজক হার্ভে ওয়েইনস্টেইনের যৌন কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসে। তখন বিশ্বজুড়ে ‘মি টু’ নামে একটি নারীবাদী প্রচারণা শুরু হয়। সবদেশের নারীরা পুরুষদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের বলতে থাকেন। এই প্রচারণায় টনক নড়ে সবার। প্রশ্ন উঠে, পুরুষরা কেবলই নির্যাতন করে? সুবিধা নেয়? নারীরা কেবলই বঞ্চিত?
অথচ পরিসংখ্যান বলে, পশ্চিমা বিশ্বে ২০০০ সালের পর থেকে পুরুষরা মহিলাদের তুলনায় স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিচ্ছে কম। তাদের শ্রমশক্তির অংশ সঙ্কুচিত হয়েছে। এমনকি হতাশায় পুরুষরা আত্মহত্যা করছে। পরিসংখ্যান বলে, শিল্পোত্তর যুগে পুরুষদেরও নারীদের মতোই অনেক সমস্যা রয়েছে। নারীদের নির্যাতিত হবার কারণ কেবল পুরুষের আধিপত্য নয়। যদিও নারীবাদীদের সিংহভাগই বলে, পুরুষদের সুযোগ-সুবিধা আছে এবং নারীরা সুবিধাবঞ্চিত। হিসেব কষলে দেখা যাবে, বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত পুরুষদের এই সংখ্যা ২০ শতাংশও হবে না।
এন্ডু টেট তখন পুরুষদের পক্ষে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘নারীরা যে ধর্ষিত হয়, তার পেছনে কেবল পুরুষরাই দায়ী না, বরং নারীদেরও দায় রয়েছে।’ তার এই বক্তব্যের পরই মূলত তার উত্থান ঘটে। চারদিকে তাকে ‘নারীবিদ্বেষী’ বলা শুরু হয়। তাকে নিষিদ্ধ করা হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন চলতি বছরের ২৪ অক্টোবর।
বক্তৃতায় এক্স ও টেটের মিল
ম্যালকম এক্স-এর সময়ে ‘কালো’কে কদর্যতার সমার্থক হিসাবে দেখা হত। কিন্তু ম্যালকম বলতেন, ‘আমরা কুৎসিত নই, কিন্তু আপনি বর্ণবাদী।’ তার সবচে বড় শক্তির জায়গা হলো, তিনি তার দুর্বলতা এবং কষ্ট দেখাতে লজ্জিত হতেন না। কিন্তু অ্যান্ড্রু এক্ষেত্রে বিপরীতে; তিনি সবসময় নিজেকে একজন অদম্য সুপারম্যান হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেন।
ম্যালকম ছিলেন তার তার সমবয়সীদের মধ্যে সবচেয়ে শিক্ষিত এবং সুপঠিত। তাকে আলাদা করে তুলেছিল তার বিশুদ্ধ চিন্তা অনুশীলন করার ক্ষমতা। তার ধারনা উপস্থাপনের পদ্ধতি ছিল দুটি ভিতের উপর দাঁড়িয়ে। প্রথমত, তিনি এমন তথ্য উপস্থাপন করেছেন যেগুলি সম্পর্কে লোকেরা চিন্তা করে এবং খোলাখুলিভাবে কথা বলতে ভয় পায়। দ্বিতীয়ত, প্যারাডক্স এবং কমেডি আকারে যুক্তি তৈরি করার ক্ষমতা। তার পুরো জীবনে এ বিষয় দুটি স্পষ্ট।
এন্ড্রু টেট একই কারণে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তার তর্ক করার ক্ষমতার কারণে। বিশেষত, যেখানে লোকেরা প্রকাশ্যে তর্ক করতে খুব লজ্জা পায়, সেখানে। যেমন উদারতাবাদ এবং নারীবাদ প্রশ্নে। তাই পশ্চিমা মিডিয়া তাকে ‘নারীবিদ্বেষী’ বলে আখ্যা দেয়।
পশ্চিমা মিডিয়া বিশেষ করে দুটি বক্তব্য নিয়ে অ্যান্ড্রুর উপর তাদের ক্রোধ প্রকাশ করে। প্রথমটি হল: ‘নারীরা পুরুষদের মালিকানাধীন’। দ্বিতীয়টি হল: ‘নারীরা যে ধর্ষিত হয়, তার পেছনে কেবল পুরুষরাই দায়ী না, বরং নারীদেরও দায় রয়েছে।’ এ দুটি লাইন দিয়ে তাকে ‘নারীবিদ্বেষী’ বলে অভিহিত করে। প্রথমটির জবাবে এন্ড্রু বলেন, এখানে মালিকানা কথাটি খ্রিস্টধর্মের ঐতিহ্যবাহী পরিবার-রূপের একটি ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা কাঠামোর মধ্যে এসেছিল। যেখানে বলা হয়েছে, মালিকানা বলতে এখানে সুরক্ষা ও দায়িত্ব বলা হয়েছে। অর্থাৎ বাবার জন্য মেয়েকে সুরক্ষা দেয়া কর্তব্য। স্বামীর জন্য স্ত্রীকে সুরক্ষা দেয়া কর্তব্য। এখানে প্রকৃত মালিকানা উদ্দেশ্য নয়। দ্বিতীয়টির জবাবে তিনি বলেন, একটি মেয়ে পরিচিত কারো ঘরে যাবে, মাদক নেবে, মাতাল হবে, ধর্ষিত হবে। এখানে ছেলে-মেয়ে দুজনের দায় রয়েছে। পরিবার এখানে না জানার ভান করে থাকতে পারে না।
মজলুুম ধারণায় মিল
গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ফিরে আসি। ম্যালকমের চিন্তাধারার মূল স্তম্ভ ছিল কৃষ্ণাঙ্গপ্রেম। তিনি মনে করতেন, কৃষ্ণাঙ্গরা মজলুম। এক ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের বলেছেন, কে আপনাকে আপনার চুলকে ঘৃণা করতে শিখিয়েছে? আপনার ত্বকের রঙকে অপছন্দ করতে বলেছে? কে আপনার আপনাকে ঘৃণা করতে উদ্বুব্ধ করেছে? যেখানে আল্লাহ আপনাকে এমনভাবে বানিয়েছেন।’ এই ধারণাটি ম্যালকমের চিন্তাধারার একটি বড় অংশ দখল করেছিল। এই বিন্দুর ওপর পরবর্তীতে অনেক চিন্তাবিদ কাজ করেছেন। ফলে এই একবিংশ শতাব্দীতে ‘কালো’ কদর্যতার সমার্থক ধারণাটি অনেক কমে গেছে। ম্যালকম বলেছেন, বিশ্ব আমাদের ভালবাসে না। তাই আমাদের সবার আগে নিজেদেরকে ভালবাসতে হবে। বিশ্বের মানদণ্ডের কাছে নতি স্বীকার করতে করা যাবে না।
এন্ড্রুও মনে করতেন, পুরুষরা মজলুম। যারা কথা বলতে ভয় পায়। বঞ্চনার কথা স্বীকার করতে পারে না প্রকাশ্যে। ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার আগে অ্যান্ড্রু তার পুরুষ দর্শকদের সম্বোধন করে বলেছিলেন, ‘মেয়েরা শক্তিশালী এবং ধনবান পুরুষদের ভালবাসে। দুর্বলদের ঘৃণা করে। পরিসংখ্যানও এটিই বলে। তাই আপনাকে ধনী এবং শক্তিশালী হতে হবে। বডি বিল্ড করতে জিমে যেতে হবে, পেশী তৈরি করতে হবে, যাতে মহিলারা আপনাকে ভালবাসে।’ এন্ড্রুর বক্তৃতা বিপ্লবী বা বিদ্যমান মতাদর্শিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নয়, বরং এই ব্যবস্থার সবচেয়ে উগ্র ও খোলামেলা অভিব্যক্তি। অ্যান্ড্রু স্পষ্টভাবে বলেছেন, আমরা যে পশ্চিমা বিশ্বে বাস করি, তার কেন্দ্রবিন্দেুতে থাকে নারী। তাই একজন পুরুষ তার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করতে পারে, তা হল নারীকে প্রভাবিত করা এবং তার প্রশংসা পাওয়ার জন্য তাকে শারীরিক এবং আর্থিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করা।
তবে ইসলাম গ্রহণের পর তার এ ধারণার পরিবর্তন ঘটেছিল। ইসলাম গ্রহণের পরে এন্ড্রু তার অনেক সংলাপে জোর দিয়েছিলেন, পুরুষদের সুখ আনতে পারে কেবল আধ্যাত্মিক সমাধান এবং ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ।
অ্যান্ড্রুর বুদ্ধিমত্তা, তীক্ষ্ণতা এবং তার ধারণা উপস্থাপনে কমেডির ব্যবহার আমেরিকান দর্শকদের ম্যালকমের এক ঝলকের কথা মনে করিয়ে দেয়। ম্যালকমের মতো তার চারপাশেও ভীড়। তিনি বলেন, ‘এখনও তার নতুন ধর্ম সম্পর্কে অনেক কিছু শেখার আছে। তিনি শেখার এবং পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত।’ তার ইসলাম গ্রহণের পর অনেক মুসলিম আশা করেছিল, এন্ডুর পাবলিসিটি মুসলমানদের কাজে লাগবে। তার মাধ্যমে ফিলিস্তিনের বিষয়টি আরও টাইমলাইটে আসবে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের মুসলিম প্রচারকরা তার ইসলামের বিষয়টি নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। আসলে, আরও সময় গেলে বুঝা যাবে, অ্যান্ড্রু ইসলামটাকে আসলেই মন থেকে গ্রহণ করেছেন, নাকি নিতান্তই পাবিলিসি পাওয়ার জন্য করেছেন।
সূত্র: আল-জাজিরা