আইনত নিষিদ্ধ, তবু বাংলাদেশে আশংকাজনকভাবে বাড়ছে গর্ভপাত

মুনশী নাঈম:

বাচ্চা পেটে আসার ২৮ সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চা নষ্ট করলে সেটাকে এবরশন বা গর্ভপাত বলে। আমাদের দেশে আইন অনুযায়ী, এবরশন বা গর্ভপাত নিষিদ্ধ হলেও এর সংখ্যা দিনে দিনে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। গর্ভপাতকারীদের মধ্যে যেমন নবদম্পতি আছেন, তেমনি আছেন এক কিংবা একাধিক সন্তানের মা-বাবাও। চিকিৎসকরা বলছেন, বর্তমানে গর্ভপাত করাতে যারা আসছেন তাদের মধ্যে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণীর সংখ্যা বেশি। লোকলজ্জার ভয়ে এ ধরনের তরুণীরা গোপনে বিভিন্ন ক্লিনিকে গিয়ে গর্ভের ভ্রুণ নষ্ট করেন।

গত এক দশকের বিভিন্ন পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে আগের চেয়ে গোপন গর্ভপাতের সংখ্যা বেড়েছে অনেক। শুধু গর্ভধারণ করা নারী নন, আইনি বিধিনিষেধের কারণে বিষয়টি গোপন রাখছেন গর্ভপাতসংশ্লিষ্ট চিকিৎসাকর্মীরাও। একই সঙ্গে অনিরাপদ গোপন গর্ভপাতে জীবনসংকটে পড়ছেন অসংখ্য নারী।

পরিসংখ্যান কী বলছে?

যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা গুটমাকার ইনস্টিটিউটের করা একটি জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ২০১০ থেকে ২০১৪, এই পাঁচ বছরে দ্বিগুণ বেড়েছে গর্ভপাত। ২০১০ সালে ৬ লাখ ৪৬ হাজার ৬০০টি গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে বাংলাদেশে। পাঁচ বছরের ব্যবধানে সংখ্যাটি প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে হয়েছে ১১ লাখ ৯৪ হাজার। গুটমাকার ইনস্টিটিউটের জরিপের এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে।

ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অন সেক্সুয়াল রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ এন্ড রাইট ভলিউম ১২, ২০০৪ এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, বাংলাদেশে ২০০০ সালে ৫ লাখ নারী গর্ভপাত ঘটায়। অর্থাৎ প্রতি হাজারে ১৫ জনের নিচে নারী গর্ভপাত ঘটায়। যেখানে ২০০০ সালে ৫ লাখ নারী গর্ভপাত করায়,২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ লাখ এবং ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ লাখ। ১ লাখ ৫৩ হাজার গর্ভপাতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে সময় লাগে ১০ বছর এবং এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৫ লাখ ৫০ হাজার হতে সময় লাগে মাত্র ৪ বছর। অর্থ্যাৎ দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে গর্ভপাতের হার জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশ মানবধিকার নেটওয়ার্কের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৭৮ হাজার অবৈধ গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে। গর্ভপাতের কারণে এর মধ্যে ৮ হাজার নারী মৃত্যুবরণ করে। অবৈধ এসব গর্ভপাতের বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটে রাজধানী ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকায়। আইসিডিডিআরবি’র কয়েক বছর আগের এক গবেষণার তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ১৮টি অবৈধ গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে থাকে। এসব নারীদের বয়স ১৫ থেকে ৪৪ বছরের মধ্যে। এ সবের মধ্যে ৩.৩ শতাংশ গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে বিবাহ-বর্হিভূত সম্পর্কের কারণে।

এমআর-এর মোড়কে গর্ভপাতের বৈধতা!

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যলয়ের গ্রাজুয়েট নার্সিং বিভাগের এসোসিয়েট প্রফেসর হারুনুর রশিদ ফাতেহকে বলেন, ‘দেশে এখন গর্ভপাত তিনভাবে করা হয়। ভ্রুণ যদি ৬ সপ্তাহের হয়, সেটাকে ইনজেকশান দিয়ে গর্ভপাত করা হয়। ভ্রুণ যদি ৮ সপ্তাহের হয়, সেটাকে এমআর বা মিনস্ট্রুয়াল রেগুলেশনের মাধ্যমে গর্ভপাত করা হয়। এর উপরে হলে সেটাকে এবরোশন বলে। বর্তমানে ইনজেকশানের মাধ্যমে গর্ভপাতের সংখ্যা কমেছে। কমেছে এবোরোশনের মাধ্যমে গর্ভপাতের সংখ্যাও। তবে বেড়েছে মিনস্ট্রুয়াল রেগুলেশনের মাধ্যমে গর্ভপাত। সবাই এখন এটাই নিচ্ছে।’

দেশে এমআর বা মিনস্ট্রুয়াল রেগুলেশনের মাধ্যমে গর্ভপাত করা এক জনপ্রিয় মাধ্যম। এমআর বা মিনস্ট্রুয়াল রেগুলেশনের মাধ্যমে গর্ভপাত করা হয় এক ধরণের লম্বা নল জরায়ুতে ঢুকিয়ে গর্ভের শিশুটিকে প্রথমে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়। পরে ভ্যাকুয়াম সাকারের মাধ্যমে শিশুটিকে শুষে আনা হয়। এই পদ্ধতিতে অনেক ঝুঁকিও থাকে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে এমআর-কে বৈধতা দেয় সরকার৷ প্রতিটি সরকারি হাসপাতালেই এমআর-এর আলাদা বিভাগ আছে৷ প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোও বৈধভাবেই এমআর করছে৷ এমআর-এর মাধ্যমেই বাংলাদেশে গর্ভপাতকে কি এক ধরনের বৈধতা দেয়া হয়েছে জানতে চাইলে প্রফেসর হারুনুর রশিদ বলেন, ‘সামাজিক এবং ধর্মীয় কারণে হয়ত সরাসরি গর্ভপাতকে বৈধতা দেয়া যায় না, কিন্তু অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ এড়াতে এর প্রয়োজন আছে৷’

চিকিৎসকরা জানান, মাসিক বন্ধ হয়ে গেলে সেই মাসিক নিয়মিত করার এক ধরনের চিকিৎসার নামই এমআর৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গর্ভধারণের কারণেই মাসিক বন্ধ হয়৷ তবে বাংলাদেশের এমআরের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। এটি ব্যবহার হচ্ছে অনাকাঙিক্ষত সন্তানকে হত্যা করতে।

বাংলাদেশী আইন কী বলে

দণ্ডবিধিতে গর্ভপাত সম্পর্কে বলা হয়েছে, ভ্রূণ গর্ভে স্থিতি লাভের পর থেকে গর্ভকাল পূরণ হওয়ার আগে গর্ভস্থিত ভ্রূণ অপসারণ করাকে গর্ভপাত বলে। দেশের আইনে গর্ভপাত দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে দণ্ডবিধিতে (ধারা ৩১২-৩১৬) বলা আছে, শুধু মায়েরজীবন রক্ষার প্রয়োজনে গর্ভপাত করানো যেতে পারে। অর্থাৎ, গর্ভধারণ অব্যাহত থাকলে যদি মায়ের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ে, তাহলে মায়ের জীবন রক্ষায় গর্ভপাত করানো যায়।

৩১২ ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে গর্ভবতী স্ত্রীলোকের গর্ভপাত করায়, এবং যদি সে গর্ভপাত সরল বিশ্বাসে উক্ত স্ত্রীলোকের জীবন বাঁচাবার উদ্দেশ্যে না করা হয়ে থাকে, তবে সে ব্যক্তি তিন বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে, অথবা অর্থ দণ্ডে, অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে; এবং যদি স্ত্রীলোকটি শিশুর বিচরণ অনুভব করে, তবে সে ব্যক্তি সাত বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে, এবং তদুপরি অর্থ দণ্ডেও দণ্ডিত হবে।

এই ধারাটির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, যে স্ত্রীলোক নিজে থেকে গর্ভপাত করে সে স্ত্রীলোকও অত্র ধারার তাৎপর্যাধীন হবে।

৩১৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি যদি পূর্ববর্তী ধারায় বর্ণিত অপরাধটি সংশ্লিষ্ট স্ত্রীলোকের সম্মতি ছাড়া সম্পাদন করে-স্ত্রীলোকটি আসন্ন প্রসবা হোক বা না হোক- তবে সে ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে অথবা দশ বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থ দণ্ডেও দণ্ডিত হবে।

৩১৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি যদি কোন গর্ভবতী স্ত্রীলোকের গর্ভপাত করানোর উদ্দেশ্যে কৃত কোন কাজের ফলে সে স্ত্রীলোকটির মৃত্যু ঘটায়, তবে সে ব্যক্তি দশ বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে, এবং তদুপরি অর্থ দণ্ডেও দণ্ডিত হবে।

৩১৫ ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি যদি কোন শিশুর জন্মের পূর্বে এমন কোন কাজ করে, যাতে শিশুটি জীবিত অবস্থায় ভূমিষ্ট হতে না পারে বা জন্মের পরে তার মৃত্যু হয় এবং অনুরূপ কাজের ফলে শিশুটি জীবিত অবস্থায় ভূমিষ্ট না হয় বা ভূমিষ্ট হওয়ার পর তার মৃত্যু হয়- এবং যদি কাজটি মাতার জীবন রক্ষার জন্য সরল বিশ্বাসে কৃত না হয়, তবে সে ব্যক্তি দশ বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে, অথবা অর্থ দণ্ডে, অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।

৩১৬ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোন ব্যক্তি এমন কোন কার্য করে, যদ্ধারা সে কোন মৃত্যু ঘটালে তা হলে সে অপরাধজনক নরহত্যা অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হত এবং অনুরূপ কার্যের সাহায্যে একটি জীবন্ত অজাত শিশুর মৃত্যু ঘটায়, তবে উক্ত ব্যক্তি যে কোন বর্ণনার কারাদণ্ডে যার মেয়াদ দশ বৎসর পর্যন্ত হতে পারে, দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে।

‘বাড়াতে হবে নজরদারি’

বৈধ কোনো কারণ ছাড়া স্বেচ্ছায় গর্ভপাতকে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া পাপের মহামারী বলে উল্লেখ করেছেন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, আলেম লেখক ও গবেষক আ.ফ.ম খালিদ হোসাইন। তিনি বলেন, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের কারণে এই গর্ভপাত তো হারামই। বৈধ কোনো কারণ ছাড়া যদি বিবাহিতরাও স্বেচ্ছায় গর্ভপাত করে, সেটাও হারাম। কেউ যদি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে, ডাক্তার যদি বলে, ধারাবাহিকভাবে গর্ভধারণ করলে তার জন্য ঝুঁকি হতে পারে, সে গর্ভপাত করাতে পারে। এছাড়া গর্ভপাত হারাম, পাপ।

এই পাপ রুখতে ধর্মীয় বোধ শাণিত করা এবং নজরদারি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন এই আলেম চিন্তক। তিনি বলেন , যেহেতু দেশীয় আইনে গর্ভপাত নিষিদ্ধ, তাই রাষ্ট্রকে আইন বাস্তবায়নে কঠোর হতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বাড়াতে হবে নজরদারি। কদিন পর পর ডোবায়, ডাস্টবিনে, ম্যানহোলে নবজাতক শিশু পাওয়া যায়। সেই শিশুকে খুবলে খায় কুকুর, কিট-প্রতঙ্গ। এটা মানবতার সবচেয়ে নিকৃষ্ট রূপ।’

অভিভাবকদের দায়িত্বের কথা উল্লেখ করে এই আলেম লেখক বলেন, সন্তানরা কোথায় যাচ্ছে, কী করছে তা পর্যবেক্ষণ করা অভিভাবকদের দায়িত্ব। আলেম ও ওয়ায়েজদের দায়িত্ব হলো, জনগণকে এই পাপের ব্যাপারে সতর্ক করা, তাদের সামনে এর ভয়াবহতা তুলে ধরা। কারও একক প্রচেষ্টায় এই পাপের ধারা বন্ধ করা সম্ভব নয়। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা লাগবে।’

আগের সংবাদফুটবল বিশ্বকাপ সামনে রেখে কাতারে ইসলামিক আর্ট মিউজিয়াম চালু
পরবর্তি সংবাদ‘জামিনে মুক্ত রুবেল’ : বিশ্বাস-অবমাননা নিয়ে প্রশ্ন বাড়ছে