আকীদা শাস্ত্রের রেনেসাঁ ব্যক্তিত্ব ইমাম আবু মানসুর মাতুরিদী রহ.

জাফর সাদেক আরাফাত:

মজমা বসেছে সমরকন্দে। উপস্থিত আছেন নেতৃস্থানীয় আলেমগণ। এসেছেন সাম্মানীয় সুলতানের আহ্বানে। রাজ্যপতি আমীর নুহ আঞ্চলিক প্রশাসক মারফত শাহি ফরমান পাঠিয়েছেন। ইতোমধ্যে দেশের উপর বয়ে গেছে প্রলয়ংকরী ঝড়। অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড একদম ভেঙে পড়েছে। বাজারের ঊর্ধ্বগতি চরমে। রাষ্ট্রীয় কোষাগার পর্যন্ত আমলাদের বেতনভাতা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এই মহাবিপদ থেকে পরিত্রাণ কল্পে সরকার নিয়েছেন অর্বাচীন ও স্বৈরাচারী এক সিদ্ধান্ত—জনগণের উপর কর আরোপ। এর পক্ষে তিনি দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও আলেম সমাজের সমর্থন চান। সেজন্য এই আয়োজন–সেমিনার।

উপস্থিত আলেমদের সামনে বার্তাবাহক শাহি ফরমান পড়ে শুনালেন। অনেকে ঘাবড়ে গেলেন। টুঁটি চেপে ধরার ভয়ে কথা বললেন না। কিন্তু মজলিসের একজন বর্ষীয়ান আলেম, তিনি চুপ থাকতে পারলেন না। গর্জে উঠলেন শার্দূলের মত। জবাব দিলেন, ‘বার্তাবাহক, তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছো। পৌঁছে দিয়েছো শাহি ফরমান। কিন্তু আমাদেরও একটা জবাব আছে৷ আমরা সরকারকে বলতে চাই, আপনি জুলুম বৃদ্ধি করতে থাকলে আমরাও শেষ রজনির দুআ বাড়িয়ে দিব।’ এই বলে তিনি ক্ষ্যান্ত হন। সত্য উচ্চারণে তিনি তৃপ্ত হন। কথিত আছে, সেই শাসক পরবর্তীতে কোনো আঁততায়ীর হামলায় নিহত হন৷ বর্শার আঘাতে হত্যা করা হয় তাকে। ঘটনাটি ছিল হিজরী তৃতীয় শতকের। [১]

এই মহান ব্যক্তি রাজা-বাদশাহর দরবারে আসা-যাওয়াকে পছন্দ করতেন না। উমাইয়্যা ও আব্বাসী প্রশাসকদের প্রতি তার ছিলো অসম্ভব বীতশ্রদ্ধা। তার তাফসীর গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেন-

‘যে সকল আলেম রাজা-বাদশাহদের নিকট আসা-যাওয়া করে, তাদের উচিত, বাদশাহদেরকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করা। যেমনটি করেছিলেন হযরত মুসা আ. কারুনের সাথে। যদি তারা এটা মেনে নেয়, তাহলে তো ভালোই। অন্যথায় উলামায় কেরাম তাদের দরবারে আসা-যাওয়া থেকে বিরত থাকবেন। তা না হলে রাজা-বাদশাহদের (অন্যায়-অন্যায্য) কার্যক্রমে তারাও অংশিদার।’ [২]

জাকার্দিয কবরস্থানে তার শিষ্য শায়খ আবুল হাকীম সমরকন্দী রহ. আপন উস্তায সম্পর্কে সমাধির ফলকে লিখেছেন, ‘এটা হচ্ছে ঐ মহান ব্যক্তির সমাধি, যিনি জ্ঞানবিজ্ঞান অর্জনে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। ইলমের সুধা অকাতরে বিলিয়ে গেছেন। ফলে দ্বীন-ইসলামে তার কীর্তিসমূহ প্রশংসিত হয়েছে। তার সাধনা হয়েছে শতভাগ সফল।’

আমি ইমাম আবু মানসুর মাতুরিদী রহমাতুল্লাহি আলাইহির কথা বলছি। ইতিহাসের পাতায় তার কীর্তি আজো অমর অমলিন ও অক্ষয় হয়ে আছে। তিনি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। ইমামুল হুদা-হেদায়াতের পথপদর্শক হিসেবে পরিগণিত। ইলমুল কালামে তার পাণ্ডিত্য সুবিদিত। বাতিলের অসার ভ্রান্তি অপনোদনে সদা নিয়োজিত। প্রতিভার অনন্য স্বাক্ষরে সমকালীন উলামায়ে কেরামের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়েছেন। তাঁর বিশিষ্ট শাগরিদ আবুল হাকীম সমরকন্দী রহ. বলেন, ‘তাঁর মধ্যে এমনসব গুনাবলীর সমাবেশ ঘটেছিল, সমকালীন অনেকের মধ্যে যা দুষ্কর ছিল। এই কারণেই হয়ত তার উস্তায আবু নসর বায়াদী রহ. তিনি উপস্থিত হলে দরসের আলোচনা শুরু করতেন। কোনোদিন দেরী হলে তাঁর জন্য অপেক্ষা করতেন। দূর থেকে যখন দৃষ্টিগোচর হত, আশ্চর্যজনক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। আর এই আয়াত পাঠ করতেন وربك يخلق ما يشاء ويختار অর্থাৎ আপনার রব যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং নির্বাচন করেন।’

আল্লামা মুর্তজা যাবিদী রহ. উল্লেখ করেন, ‘আমি তরিকতের শ্রদ্ধেয় কতক শায়খের লেখায় পেয়েছি, ইমাম আবু মনসুর মাতুরীদি রহ. তৎকালীন সময়ে ছিলেন এই উম্মতের ইমাম মাহদী।’[৪]

তিনি ইমাম আবু মানসুর মাতুরিদী নামেই সমধিক পরিচিত। তবে তার মূল নাম মুহাম্মদ। আবু মানসুর উপনাম। উপনাম ‘আবু মনসুর’ থাকায় ধারণা হতে পারে, ‘মানসুর’ নামে তার কোনো ছেলে ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই নামে তার কোনো ছেলের কথা ইতিহাসে পাওয়া যায় না। এজন্য স্রেফ আবু মনসুর নামের উপর ভিত্তি করে মানসুর নামে ছেলে থাকার দাবি অবান্তর। তার তাফসীরগ্রন্থে আছে, কেউ যদি নিজের নাম আবু মানসুর এজন্য রাখে যে, তার ছেলে হলে নাম রাখবে মনসুর। তাহলে শুভলক্ষণ হিসাবে রাখা যায়। এ থেকে কেউ কেউ অনুমান করেন, হয়ত শুভলক্ষণ হিসাবেই তিনি নিজের উপনাম আবু মানসুর হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

ইতিহাসবিদ কেউ কেউ তাকে বিখ্যাত সাহাবি আবু আইয়ুব আনসারী রাদি.-এর বংশধর বলতে চেয়েছেন। অর্থাৎ তিনি আরব বংশম্ভূত। কিন্তু বাস্তবতা হল, তিনি জন্মগতভাবে পারস্যের অধিবাসী। যারা তাকে আনসারী বলেছেন অথবা আরব বংশম্ভূত বলেছেন, তাদের দলীল খুবই দুর্বল।

তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী। তাঁর চারিত্রগুণ, ইলমী গভীরতা, চিন্তা-চেতনার বৈচিত্র্য পাওয়া যায় তার রচিত কিতাবাদিতে। একদিকে ছিলেন কালামি ব্যক্তিত্ব, অন্যদিকে ছিলেন প্রান্তিকতামুক্ত সুফি সাধক। তিনি কখনো সরকারি কোনো পদে চাকরি গ্ৰহণ করেননি। বরং স্বৈরাচারি শাসকের বিরুদ্ধে সত্য উচ্চারণে সবসময় সোচ্চার ছিলেন। রাজা-বাদশাহদের দরবারেও যেতেন না। অধিকন্তু তিনি তাদেরকে সৎকাজের আদেশ অসৎকাজ থেকে নিষেধ করার ব্যাপারে অনড় ছিলেন। তাদের থেকে কোনো ভাতাও গ্ৰহণ করতেন না। তিনি দীনের তালীম দিয়ে কোনো পারিশ্রমিক নিতেন না। এটাকে অবৈধ মনে করতেন। তার লিখিত তাফসীরগ্রন্থে বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যায় বিষয়টি দিবালোকের ন্যায় প্রতিভাত হয়।

তিনি ছিলেন ইমাম আযম রহ. এর প্রতি দুর্বল। সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন তার অনুসরণ-অনুকরণের। তাঁর অন্যতম ভাবশিষ্য শায়খ আবুল মুঈন নাসাফী রহ. বলেন, ‘ইমাম আবু মনসুর মাতুরীদি রহ. মৌলিক ও শাখাগত মাসআলায় ইমাম আবু হানীফা রহ. এর অত্যাধিক অনুকরণকারী ছিলেন।’ [৩] হানাফি মাযহাব সম্পর্কে তার ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। ইলমের প্রায় সকল শাখায় তার সরব পদাচারণা ছিলো।

প্রতিভার অনন্য স্বাক্ষর হিসেবে রেখে যান অনেক কিতাব। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো:
• তাবীলাতু আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত।
• কিতাবুত তাওহীদ
• কিতাবুল মাকালাত
• কিতাবু আওহামিল ম’তাজিলা
• রদ্দু আওয়ায়িলিল আদিল্লা
• রিসালাহ ফিল ঈমান
• কিতাবু মা’খাসিস শারায়ে’
• কিতাবুল জাদাল ফি উসূলিক ফিকহ

এছাড়া আরো অনেক কিতাব রয়েছে। সেগুলোর অনেক কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। কিছু তাতারিদের হামলায় লীন হয়ে গেছে। অনেক কিতাবের শুধু নাম জানা যায়। সেগুলোর অস্তিত্ব হয়ত কোনো মিউজিয়ামে আছে।

এই মহান মনীষী দীর্ঘ ৯০ বছর কর্মক্লান্তি শেষে ৩৩৩ হিজরীতে আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন করেন। উম্মাহকে শোক সাগরে ভাসিয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত হন জাকার্দিয কবরস্থানে। রহিমাহুল্লাহু তাআলা। এখানে সমরকন্দের অনেক বড় বড় আলেম ও মাশায়েখদের কবর রয়েছে। বর্তমানে এটি মারাকান্দা অঞ্চলের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত।

তথ্যসূত্র:

১. আন নাফাহাতুস সালাফিয়্যাহ-৫২
২. তাফসীরে মাতূরীদি-৮/১৯৮
৩.তাবসিরাতুল আদিল্লাহ-৩৫৯/১
৪.ইতহাফুস সাদাতিল মুতকীনিন-২/৫
৫. সাদ্দূস সুগুর বি সীরাতি আলামিল হুদা আবী মনসুর

 

 

আগের সংবাদস্মরণে দেওবন্দের তিন সূর্যসন্তান
পরবর্তি সংবাদআফগান ঐতিহ্য ‘বাচা পোষ’ : সম্ভবনার স্বপ্ন নাকি স্বপ্নভঙ্গের কাতরতা