রাগিব রব্বানি
ভারত উপমহাদেশ ভাগের বাহাত্তর বছর পূর্ণ হলো। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা দুইশো বছরের উপনিবেশ শাসন গুটিয়ে চলে যাবার সময় পুরো ভারতকে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দুইভাগে ভাগ করে দিয়েছিল। ফলে ৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটো স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের জন্ম হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান আর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে ভারত।
দেশ ভাগের সময় সিলেট অঞ্চল ছিল আসাম রাজ্যের অধীন। আর আসাম পড়েছিল ভারতের ভাগে। কিন্তু সিলেট ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই প্রশ্ন দেখা দেয় সিলেট কার সঙ্গে যুক্ত হবে, ভারতের সঙ্গে নাকি পাকিস্তানের সঙ্গে?
কংগ্রেস এবং অখণ্ড ভারতের পক্ষে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো সিলেটকে ভারতের সঙ্গেই রাখতে চাচ্ছিল। আর মুসলিম লীগসহ পাকিস্তানের পক্ষের রাজনীতিবিদগণ চাচ্ছিলেন সিলেটকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করতে।
কংগ্রেসের যুক্তি ছিল, আসাম ভারতের অংশে পড়েছে আর সিলেট আসামেরই অন্তর্ভুক্ত, অতএব সিলেটের হকদার ভারত। আর মুসলিম লীগ বলছিল, সিলেট আসামের অংশ হলেও এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান, তাই সিলেটকে পাকিস্তানের ভাগেই দিতে হবে।
এখানে বলে রাখা দরকার, সিলেট কিন্তু একসময় বাংলার অন্তর্ভুক্তই ছিল। অনেকে মনে করেন, সিলেটকে বোধহয় দেশভাগের সময় আসাম থেকে কেটে এনে বাংলার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ধারণাটি সঠিক নয়। সিলেট বাংলারই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশরা বঙ্গভঙ্গ করে, বাংলাকে ভাগ করে ফেলে। ওই সময় তুলনামূলক অনুন্নত আসামের প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বাংলা থেকে সিলেটকে কেটে আসামের সঙ্গে জুড়ে দেয় ব্রিটিশরা। শিক্ষায়-সম্পদে সিলেট তখন অগ্রসর ছিল। আসামের সচিবালয়ের প্রাণশক্তি ছিলেন সিলেটীরা। সিলেটকে আসামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া তখন মেনে নিতে পারেননি বাঙালিরা, প্রতিবাদ করেছিলেন।
যাই হোক, ৪৭ সালে এই অঞ্চল নিয়ে যখন কংগ্রেস-মুসলিম লীগের টানা-হ্যাঁচড়া শুরু হলো, তখন এর মীমাংসার ভার সিলেটের জনগণের ওপরই ছাড়তে বাধ্য হয় ব্রিটিশরা।
ব্রিটিশ সরকার মুসলমান আর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ভারতকে ভাগ করার দায়িত্ব দিয়েছিল লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ওপর। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন এক ঘোষণায় তিনি সিলেটের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য গণভোট অনুষ্ঠানের কথা জানান। ৬ ও ৭ জুলাই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। এই তারিখে ভোটাধিকার প্রয়োগ করার মাধ্যমে সিলেটের জনগণ জানাবে, তারা কার সঙ্গে থাকতে চায়, পাকিস্তান না ভারত?
পাকিস্তান যেহেতু মুসলমানদের আবাস-ভূমি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল, আর সিলেটের জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যেহেতু মুসলমান, তাই স্বাভাবিকভাবেই গণভোটের রায় পাকিস্তানের পক্ষে আসার কথা ছিল। কিন্তু শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানি রহমতুল্লাহি আলায়হি ভারতের পক্ষে থাকায় এবং সিলেটে তাঁর বিপুল জনসমর্থন থাকবার কারণে পাকিস্তানের নিশ্চিত বিজয় অনেকটা হুমকির মুখে পড়ে। তাই মুসলিম লীগকে নির্বাচনে জোর প্রচারণায় নামতে হয়।
মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ থেকে নিয়ে মুসলিম লীগের বড় বড় নেতাকে প্রচারণার জন্য আসতে হয়েছিল সিলেটে। এ দিকে স্থানীয় ওলামায়ে কেরাম ও ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যেও দুটো ভাগ হয়ে গিয়েছিল। একদল হোসাইন আহমদ মাদানি রহমতুল্লাহি আলায়হির অনুসরণে কংগ্রেসের পক্ষে ছিলেন, আর আরেকদল মুসলমানদের স্বাধীন আবাসভূমি ও ইসলামি রাষ্ট্র কায়েমের স্বপ্নে বিভোর হয়ে মুসলিম লীগকে সমর্থন করেছিলেন।
এদিকে হিন্দুরা ব্যাপকভাবে কংগ্রেসকে সমর্থন করলেও তাদের মধ্যে নমোশূদ্ররা ছিল মুসলীম লীগের পক্ষে।
অবশেষে ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ই জুলাই গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। এতে মোট ভোটার ছিল ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৮১৫ জন। ভোট দিয়েছিল ৭৭ শতাংশ মানুষ। ২৩৯টি ভোটকেন্দ্রে বড় কোনো ঝামেলা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবেই ভোট হয়েছিল।
নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ হলে দেখা গেল পাকিস্তানের পক্ষে ২ লাখ ৩৯ হাজার ৬১৯ ভোট পড়েছে আর ভারতে যোগদানের পক্ষে পড়েছে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৪১ ভোট। মুসলীম লীগ ৫৫ হাজার ৫শ ৭৮ ভোট বেশি পেয়ে জয় লাভ করে।
গণভোটের ফলে সিলেট যুক্ত হলো পাকিস্তানের সঙ্গে। পেল মুসলিম ভূখণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হবার স্বীকৃতি এবং আজাদি। কিন্তু সম্পূর্ণ সিলেটকে দেওয়া হলো না পাকিস্তানের অংশ হতে। একটি এলাকা, করিমগঞ্জ মহকুমা, রেখে দেওয়া হলো ভারতের আসাম রাজ্যের সঙ্গে। যদিও করিমগঞ্জের মানুষ পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হবার পক্ষেই ভোট দিয়েছিল। এটা ঘটল র্যাডক্লিফের কারসাজিতে।
দেশভাগের সিদ্ধান্ত নেবার সময় দুটি রাষ্ট্রের সীমানা নির্ধারণের জন্য স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেছিল ব্রিটিশ সরকার। সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ ছাড়াও সিলেটের আরেকটি মহকুমা হিসেবে স্বীকৃত ছিল করিমগঞ্জ। র্যাডক্লিফ সীমানা নির্ধারণের অজুহাতে করিমগঞ্জসহ সাড়ে তিনটি থানা রেখে দেয় ভারতের সঙ্গে। এগুলো এখন ভারতের অংশ।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। ওই সময় করিমগঞ্জ মহকুমার এসডিপিও ছিলেন এম এ হক। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশের ভূমিমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছিলেন। তিনি জানান, ভারত স্বাধীনতা লাভের পর এক সপ্তাহ পর্যন্ত করিমগঞ্জকে তিনি তাঁর দখলে রেখেছিলেন। পরে ভারতীয় বাহিনী চলে আসায় তাঁকে বিদায় নিতে হয়। (সূত্র : করিমগঞ্জ যেভাবে ভারতের, মাহবুবুর রহমান, প্রথম আলো, ১২ এপ্রিল ২০১৯)
এম এ হক ১৪ আগস্ট করিমগঞ্জ মহকুমা পুলিশ কার্যালয়ে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করেন এবং সিলেটে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ঘন ঘন তারবার্তা পাঠাতে থাকেন সামরিক সাহায্য পাঠানোর জন্য। ওই সময় সিলেটের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন সিলেটেরই সন্তান সৈয়দ নবীব আলী। বিয়ানীবাজারের আলীনগরে তাঁর বাড়ি।
এম এ হক বলেন, ‘প্রতিদিন আমি অপেক্ষায় থাকি, এই এল বুঝি ফোর্স। না, আসে না। এভাবে একদিন/দুদিন করে সাত দিন কেটে গেল। এ দিকে ভারতীয় বাহিনী চলে এল করিমগঞ্জ শহরে। আমি তখন নিরুপায়। আর কিইবা করতে পারি। মহকুমা পুলিশ কার্যালয় থেকে পাকিস্তানের পতাকাটা নামিয়ে গুটিয়ে নিলাম। তারপর চলে এলাম এপারে অর্থাৎ পাকিস্তানে।’ (সূত্র : প্রাগুক্ত)
এম এ হক চলে আসার মধ্য দিয়ে করিমগঞ্জ, রাতাবাড়ি, পাথারকান্দিসহ সিলেটের সাড়ে তিনটি থানা ভারত পুরে নেয় নিজের উদরে। আর সিলেট হারায় নিজের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ। যেখানকার ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে থাকতে চেয়েছিল মুসলিম আবাস-ভূমি পাকিস্তানের সঙ্গেই।