মুনশী নাইম:
ইসলামি ইমারাত আফগানিস্তানের প্রধান বিচারপতি শায়েখ আবদুল হাকিম হক্কানি একটি বই লিখেছেন: الإمارة الإسلامية ونظامها । ১৪৪৩ হিজরিতে প্রকাশিত বইটির পৃষ্ঠা ৩১২। অনেক বিশেষজ্ঞ এবং গবেষকরা বলছেন, বইটি মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের পর ক্ষমতায় আসা তালে-বান সরকারের জন্য একটি সংবিধান। ছাত্র-আন্দোলনের অধিকাংশ নেতা শাসন ও রাজনীতির ক্ষেত্রে যে দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন, এ বইতে তাই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, লেখক এখানে নতুন কোনো তত্ত্ব তুলে ধরেননি। বরং ইসলামি ইমারাতের সংবিধান হিসেবে যা গৃহীত হতে পারে, লেখক তার উপরই আলো ফেলেছেন।
বইটির গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো, এই বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন ইসলামি ইমারাত আফগানিস্তানের আমির শেখ হেবাতুল্লাহ আখুন্দ জাদা। ভূমিকায় তিনি লিখেন, ‘বইটির কিছু অংশ দেখেছি। ইসলামি রাজনীতির ময়দানে বইটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আমি পড়ার পর বইটি আলেম-উলামাদের কাছেও পাঠানো হয়েছে। তারাও বইটিতে সংশোধনী দিয়েছেন। এই হিসেবে বইট দুদিক থেকেই পর্যবেক্ষণে শক্তিশালী হয়েছে। প্রথমত আমার পাঠ, দ্বিতীয়ত আলেমদের পাঠ।’
তালে-বান আন্দোলন বুঝার জন্য বইটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে দাবি করেছেন গবেষকরা। বইটি বেশ আলোচনারও জন্ম দিয়েছে। এটাও বলা হচ্ছে, বইটি ইসলামি ইমারাত আফগানিস্তানের সংবিধান।
আবদুল হাকিম হক্কানি কে?
তিনি আব্দুল হাকিম ইসহাক জাই নামে পরিচিত। তিনি তালে-বানের একজন নেতা, ইসলামি ইমারাত আফগানিস্তানের প্রধান বিচারপতি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শান্তি আলোচনার প্রতিনিধি দলের প্রধান। পাশাপাশি তিনি তালেবানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। শায়েখ হক্কানি ১৯৯৪ সালে তালেবান প্রতিষ্ঠাকারী মোল্লা মুহাম্মাদ ওমরের ঘনিষ্ঠ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সহযোগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২০১৩ সালে তার ইন্তেকালের খবর তিনিই প্রথমে পেয়েছিলেন। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে তালে-বানের প্রথম সরকার গঠনের সময় তিনি কেন্দ্রীয় দারুল ইফতার প্রধান ছিলেন। ২০২০ সালে শেখ হেবাতুল্লাহ আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণের পর তিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।
তালে-বানের রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশল নির্ধারণে প্রধান বিচারপতি মোল্লা আব্দুল হাকিম হক্কানির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছ। তিনিই তালে-বানকে স্থানীয় আন্দোলন থেকে বৈশ্বিক গ্রুপে পরিণত করেন। স্থানীয় কমান্ডার ও সেইসাথে প্রতিবেশী দেশের ইসলামপন্থী গ্রুপগুলোর সবাই তাকেই ধর্মীয় উস্তাদ হিসেবে মান্য করে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাকে দোহা আলোচনার প্রতিনিধিদলের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করে তালে-বান।
হক্কানি ১৯৬৭ সালে কান্দাহার প্রদেশের (দক্ষিণ) বানজওয়াই জেলার তোলোকান বান্দ তাইমুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। উলুমে শরিয়া অধ্যায়ন করেন তার পিতা শেখ খাদায়দাদের কাছে। যিনি ‘মোল্লা সাহেব’ নামে পরিচিত ছিলেন।১৯৭৭ সালে তিনি পেশোয়ারের দারুল উলূম হাক্কানিয়াতে ভর্তি হন। ১৯৮০ সালে স্নাতক এবং আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেট অর্জন করেন। তারপর তিনি কুরআন তাফসির অধ্যয়নের জন্য বেলুচিস্তানে যান। ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত প্রত্যাহারের পর তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং কান্দাহার, হেলমান্দ রাজ্যের মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মুহাম্মদ ওমর তাকে কান্দাহার শহরে ফিরে সেখানের মাদরাসায় শিক্ষকতার নির্দেশ দেন। ২০০১ সালে তালে-বান সরকারের পতনের পর শেখ হক্কানি আবার পাকিস্তানে চলে যান এবং কোয়েটা শহরে বসতি স্থাপন করেন। পাকিস্তানের কোয়েটায় প্রতিষ্ঠা করেন মাদরাসা। এই প্রতিষ্ঠান থেকে বেশ কয়েকজন একনিষ্ঠ তালেবান সামরিক কমান্ডার গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেছে। মরহুম তালেবান নেতা মোল্লা মুহাম্মাদ ওমরের ছেলে ও ইসলামি আমিরাতের বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোল্লা মুহাম্মাদ ইয়াকুবও তার ছাত্রদের মধ্যে আছেন।
আরবিতে লেখালেখি
তালে-বান নেতারা সাধারণত বইটই লিখেন না। হক্কানিই প্রথম কর্মকর্তা, যিনি ইসলামিক আমিরাত সম্পর্কে তার উপলব্ধি নিয়ে বই লিখেছেন। বইটি লিখেছেন তিনি আরবি ভাষায়। আফগানের ভাষা আরবি না হবার কারণে বইট নিয়ে বেশ ভুল বুঝাবুঝিও হয়েছে। এদিকে ইঙ্গিত করেই ইসলামি ইমারাত আফগানিস্তানের আমির শেখ হেবাতুল্লাহ আখুন্দ জাদা বইয়ের ভূমিকায় লিখেন, মিডিয়া বইট নিয়ে বেশ হইচই করেছে। যেহেতু বইটির ভাষা আরবি, তাই ভুল বুঝাবুঝিও তৈরী হয়েছে। তাই বইটির উপর প্রকাশিত বেশিরভাগ গবেষণা-পর্যালোচনা এবং বিশ্লেষণ বিকৃত। সেগুলোতে বুদ্ধিবৃত্তিক মৌলিকতার অভাব রয়েছে। ’
কিছু আইন বিশেষজ্ঞ বইটিকে নতুন আফগান সরকারের একটি সরকারি দলিল হিসাবে দেখেন এবং এটি আন্দোলনের তাত্ত্বিক ও আদর্শিক ভিত্তি ব্যাখ্যাকারী হিসেবে গণ্য করেন। তবে অনেকে মনে করেন, বইট সরকারি কোনো দলিল নয়, বরং হাকিম হক্কানির নিজস্ব চিন্তার ফল। বিচার মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আবদুল হামিদ জিহাদ ইয়ার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সংবিধান লেখা একটি বিশেষ কমিটির কাজ এবং একজন ব্যক্তি, সমাজে তার অবস্থান যাই হোক না কেন, সংবিধান লিখতে পারেন না। তাছাড়া, ইসলামি ইমারাত আফগানিস্তানের আমির শেখ হেবাতুল্লাহ বইটি বিচার বিভাগের কাছে পাঠাননি। এটা ইসলামী আমিরাতের কোন সরকারী দলিল নয়।’
এ বইট ছাড়াও তিনি আরও বই লিখেছেন। তার বইয়ের সংখ্যা ২৭টি।
বইয়ৈর গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলাপ
বইটিতে ফিকহি মাসআলার একটি অধ্যায় রয়েছে। তাতে বেশিরভাগই ফিকহি কিতাব থেকে উদ্ধৃতি। যেমন শেখ ওয়াহবা আল-জুহাইলির الفقه الإسلامي وأدلته এবং আবুল হাসান মাওয়ারদির الأحكام السلطانية থেকে বেশি উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। ডক্টর মেসবাহুল্লাহ আব্দুল বাকী বলেন, বইট পড়লে মনে হয় আমরা বোধহয় জুহাইলি এবং মাওয়ারদির যুগে বসবাস করছি।
আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের পর তালেবান যোদ্ধাদের কাজ কি শেষ হয়ে গেছে? হাক্কানি বলেছেন, না শেষ হয়নি। আমেরিকান এবং তাদের মিত্রদের তাড়িয়ে দিলেই ইসলামী আমিরাতের মুজাহিদিনদের জি-হা-দ বন্ধ করে দেয়া জায়েজ নেই। শুধু আমেরিকানদের তাড়ানোই আফগান জিহাদের লক্ষ্য নয়। বরং লক্ষ্য হলো, শরিয়তের পতাকাতলে আফগান জনগণের জীবনে আল্লাহর আহকাম বাস্তবায়ন। এটা আফগানিস্তানে ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম ছাড়া সম্ভব না।
বইটিতে নারী নেতৃত্ব ও খেলাফত নিয়েও আলাপ রয়েছে। খেলাফতকে মুসলমানদের সাধারণ নেতৃত্ব আখ্যা দিয়ে এটিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলির মধ্যে একটি গণ্য করা হয়েছে। তবে খেলাফত বিষয়ে কেবল তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলাপ করেছেন, বাস্তবায়ন কিভাবে হবে, তার বর্ণনা করেননি বলে সমালোচনা করেছেন ডক্টর মেসবাহুল্লাহ আব্দুল বাকী। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের দ্বারা আরোপিত কাল্পনিক সীমানা এবং জাতীয় রাষ্ট্র ধারণাকেও অস্বীকার করা হয়েছে এখানে। বইতে বলা হয়েছে, ইসলামী রাজ্যে ইসলামী রাষ্ট্র এবং এর ভূমি সংরক্ষণ করা ইমামের অন্যতম কর্তব্য। ইমামকে অবশ্যই রাজ্যকে খণ্ডিত হওয়া থেকে রক্ষা করতে হবে।
বইটির মূল বার্তা হলো, মানবসৃষ্ট আইন অকার্যকর। এখানে কেবল আল্লাহ তায়ালার নিয়ম-কানুন চলবে। তাই বইটতে ইসলামী সরকার, ইসলামী আইন, স্বাধীনতা, বিজয়ের পদ্ধতি, নীতিমালা, রাজনীতি, আমীরের নির্বাচন, আনুগত্যের পথ, সমসাময়িক গণতান্ত্রিক নির্বাচন ইত্যাদি ইসলোমের আলোকে বইটিতে বর্ণনা করা হয়েছে। এ ছাড়াও ইমামের শর্ত ও বিশেষত্ব, নারী ও রাজনীতি, ইসলামী খেলাফত ও গণতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য, বিচার বিভাগ, অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
সূত্র: আল জাযিরা অবলম্বনে