আমার কলমকাল : যে যৌবন লেখকের

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর

 

আমার মনে আছে, আমি তখন ধামরাই ইসলামপুর মাদরাসায় পড়ি। ঢাকায় একটা সাহিত্যপুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠানে যোগদানের সুযোগ হয়েছিল। ২০০১ সালের দিকের ঘটনা। ওই পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বিভিন্নজন কবিতাপাঠ করছিলেন। যিনি উপস্থাপক ছিলেন তিনিও কোনো এক কবি। নাম মনে নেই। তিনি উপস্থাপনার মধ্যে মাঝে মাঝে বলছিলেন, ‘এখন কবিতা পাঠ করবেন শূন্য দশকের কবি অমুকআমি তখন বুঝতে পারছিলাম না শূন্য দশক জিনিসটা কী। পরবর্তীতে আরেকটু বয়স হওয়ার পর নানাজনের কাছে শুনে বুঝতে পারলাম, একুশ শতাব্দীর প্রথম দশককে বলা হয়শূন্য দশক

আশা করি এই ঘটনা দ্বারা বুঝতে পারবেন এই শতাব্দীর প্রথম দশকে আমার সাহিত্যজ্ঞান ঠিক কোন পর্যায়ের ছিল।

যাক সে কথা। প্রথম দশকে সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি বিচার করার মতো বিজ্ঞতা আমার ছিল না। আমি তখন কেবলই ছাত্র, সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক। বিশেষত দশকের প্রথমদিকে লেখালেখি বলতে যা বুঝায় তার কিছুই শুরু করিনি। যৎসামান্য কবিতা লিখতাম। সেগুলো জোর করে ভাইবোন বা ক্লাসের বন্ধুদের গলধঃকরণ করাতাম। তবে পড়তাম খুব। পড়ার নেশা হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি কিংবা মাদরাসা, হাতে কোনো বই ছাড়া কখনো থাকতাম না। পড়ার ব্যাপারে কোনো বাধানিষেধ মানতাম না। সামনে যা পেয়েছি তাই পড়েছি।

পড়ার জন্য আমি নিজেই একটা নিয়ম বানিয়ে নিয়েছিলাম। কোথাও যদি পাঁচটা মিনিট অহেতুক আড্ডা বা বসে বসে সময় নষ্ট হতো, নিজেকে বলতাম, এই পাঁচটা মিনিট একটা বই পড়লে পাঁচটা পৃষ্ঠা পড়া যেত। সত্যি বলতে কি, ক্লাসের পড়া, ঘুম নাওয়াখাওয়া এসব নিত্যকার কাজ ছাড়া আমার কোনো অবসর ছিল না। আমার অবসর বলতে ছিল বই। আড্ডা দেয়া আমি বরাবর অপছন্দ করি, এখনও। অনেকে আড্ডার নানা গুণাগুণ বর্ণনা করে থাকেন, কিন্তু আড্ডায় বসলেই তখন আমার মনে হতো, এই সময়গুলো অনর্থক নষ্ট হচ্ছে। আমি বই নিয়ে অন্য কোথাও বসে যেতাম। তখন আমার পণ ছিল, পাঁচ মিনিটের বেশি কোথাও বই ছাড়া থাকব না।

দুই

শতাব্দীর প্রথম দশকটামাদরাসাসাহিত্যেরজন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়। কেন, সেটা বলছি। সময়টা ছিল ইসলামি ম্যাগাজিনের সুবর্ণকাল। মাসিক রহমত, আদর্শ নারী, কাবার পথে, মদীনা তো আগে থেকেই ছিল, মুসলিম জাহান ততদিনে বন্ধ হয়ে গেলেও তার রেশটা রয়ে গিয়েছিল, রাহমানী পয়গাম, মুঈনুল ইসলাম প্রভৃতি ম্যাগাজিনসহ আরও কিছু নতুনপুরাতন পত্রিকা তখন সদর্পে রাজত্ব করেছে। প্রতিটি মাদরাসায় পত্রিকাপাঠ ছিল আবশ্যিক একটা বিষয়। বিশেষত মাসিক রহমত (অধুনা জাগো মুজাহিদ) ছিল মাদরাসাসাহিত্যের জন্য যক্ষের ধনের মতো। এটা কেবল পত্রিকা ছিল না, ছিল পত্রিকার চেয়ে বেশি কিছু। এটা পড়া হতো না, বিনম্র ভালোবাসায় পাঠ করা হতো।

জাগরণের একটা খোলামেলা কারণ ছিল। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার ধ্বংস এবং তৎপরবর্তী আমেরিকা কর্তৃক আফগানে আক্রমণ, বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের প্রতিবাদী আচরণ, আমেরিকা পশ্চিমাদের প্রতি তীব্র ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ; এসব কিছু মাদরাসাসাহিত্যকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল। যখন কোথাও কোনো আলোড়ন উঠে, আলোড়নপরবর্তী তার একটা প্রভাব চারপাশে রয়ে যায়। হাজারও মানুষের মাঝে এই প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। এসব পত্রিকা হাজারও মানুষের মাঝে সেই প্রতিবাদী মানসিকতা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল।

মাদরাসাসাহিত্যের একটা চরিত্র হলো, প্রতিবাদী আচরণ। এখনও স্যোসাল মিডিয়ায় দেখা যায়, সমাজের যে কোনো অনাচারে মাদরাসার ছাত্রশিক্ষকরা দারুণ প্রতিবাদী। হোক সেটা ধর্মীয় কিংবা জাতীয় ইস্যু, কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো অন্যায়অনাচার, সবখানে মাদরাসাসংশ্লিষ্টদের প্রতিবাদী উপস্থিতি লক্ষ করা যাবে। তাদের ভাষা, উপস্থাপনা, আচরণ হয়তো অনেক ক্ষেত্রে দৃষ্টিকটূ, কিন্তু প্রতিবাদ তাদের করতেই হবে। প্রতিবাদী এই আচরণের অন্যতম পুরোধা মাসিক রহমত। সেটাকে আপনি দোষ বলুন আর গুণ বলুন, মাদরাসাসাহিত্যে এই প্রবণতা অনেকাংশে পাকাপোক্ত করেছে ঝঞ্ঝাকালীন সময়ে প্রকাশিত মাসিক রহমত। আমি বলছি না যে রহমত যারা পড়েছে তারাই প্রতিবাদী আচরণ লালন করে। রহমত যে প্রজন্মটা তৈরি করেছিল সেই প্রজন্মের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল অন্য আর সবার মাঝে। এটা সময়ের একটা আপেক্ষিক তত্ত্ব। সময়ের সঙ্গে এর রেশ অনেকদিন পর্যন্ত রয়ে যায়।

সেই সময়ের ঘুর্ণিঝড় থেকে যেসব লেখককলামিস্ট উঠে এসেছেন, তাদের অধিকাংশ প্রতিবাদী মানসিকতা লালন করে বেড়ে উঠেছেন। এই প্রতিবাদী মনোভাবাপন্ন তরুণ তুর্কিরা মাদরাসাসাহিত্যে একটা বড় সম্পদ হতে পারতো। কিন্তু হয়নি।হয়নিনা বলে আমি বলব, হতে পারেননি। কারণ তাদের ভেতরে প্রতিবাদের ক্ষোভ ছিল, ক্রোধ ছিল, চোখের ভেতর আগুন ছিল। কিন্তু সেগুলো যথাযথভাবে প্রকাশের ভাষা তাদের ছিল না। তাদের ভাষা ছিল দরিদ্র, তাদের চিন্তার পরিধি ছিল সীমিত এবং প্রকাশের মাধ্যম ছিল হাতেগোনা। তদুপরি ধর্মীয় প্রাতিষ্ঠানিক বিধিনিষেধ তো ছিলই। যদি সে সময় তারা যোগ্য সহযোগিতা পেতেন তবে এতদিনে বাংলাসাহিত্যে মাদরাসাসাহিত্য স্বমহিমায় আসন করে নিতে পারতো।

এই তরুণ তুর্কিরা কেন প্রস্ফুটিত হতে পারেনি, তার কারণ সেই পুরোনো কাসুন্দি। মাদরাসাগুলো কখনোই প্রতিবাদী মানসিকতাকে তোয়াজ করেনি। প্রতিবাদী আচরণকে দমিয়ে রাখার ব্যাপারে মাদরাসাগুলোর সুদীর্ঘ সুনাম(!) রয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটা কওমি মাদরাসায় পড়ানো হয় ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের ইংরেজবিরোধী প্রতিবাদী আন্দোলন, দেওবন্দ আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলনসহ অনেক ইতিহাস। মাদরাসার পাঠ্যসূচি তৈরিই হয়েছে প্রতিবাদী মানসিকতা পরিপুষ্ট করতে। অথচ সেই মাদরাসাগুলো থেকে যদি কেউ অন্যায় বা অনাচারের বিরুদ্ধে কলম ধরে তখন তাকে নিবৃত্ত করার ব্যাপারে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ বরাবর মুন্সিয়ানা দেখিয়ে আসছে। কিন্তু প্রথম দশকে মাদরাসা থেকে উদ্ভূত ওইঅ্যাংরি জেনারেশনকে যদি সুষমভাবে পরিপুষ্ট করা যেতো, মাদরাসার লৌকিক চৌহদ্দির তল থেকে তাদের যদি খোলা আকাশের নিচে প্রতিস্থপন করা যেতো; তবে মাদরাসাসাহিত্যে এতদিনে আলি মিয়া নদভি, শিবলি নোমানি, ইকবাল কিংবা নসিম হিজাজির ভ্রুণে উজ্জীবিত বহুসংখ্যক চারাগাছ মাথা তুলে দাঁড়াতো।  দুঃখের বিষয় হলো, পরিপালনের অভাবে মাদরাসাসাহিত্য এখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। এর দায়ভার বাংলাদেশের আলেমসমাজ কোনোদিনই এড়িয়ে যেতে পারবেন না।  

তিন

প্রথম দশকের শেষ দুতিনটে বছর আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। পড়াশোনার জন্য আমি ঢাকায় আসি ২০০৩ সালে। ২০০৩ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত পড়াশোনা করি মাদ্রাসায়ে দারুল উলুম মিরপুর এ। ২০০৭ সালে ভর্তি হই লালবাগ মাদরাসায়। লালবাগ মাদরাসায় ভর্তি হওয়াটা আমার জন্য বেশ ফলদায়ক ছিল। বাংলাদেশের সুপ্রাচীন মাদরাসা বলে এখানকার একটা ঐতিহ্য আছে। এই ঐতিহ্যটা আমি অনুধাবন করার চেষ্টা করতাম। এর মধ্যে ছাত্রদের স্বাধীনতার একটা ব্যাপার আছে। লেখালেখির ব্যাপারেও স্বাধীনতা এর মধ্যে গণ্য। অনেক শিক্ষক লেখালেখির ক্ষেত্রে উৎসাহও দিতেন।

তো, এখানে এসে মাসিক রহমতে নিয়মিত লেখালেখি শুরু করি। রহমতের অফিস কামরাঙ্গীরচর, লালবাগের কাছেই। শুধু জানতাম, কখনো সাহস করে যাওয়া হয়নি। লালবাগ থেকেই চিঠি কুরিয়ারের মাধ্যমে কামরাঙ্গীচরে রহমতএর ঠিকানায় পাঠাতাম। অথচ হেঁটে গেলে বড়জোর আধা ঘণ্টার পথ। কিন্তু যেতে আমার ভীষণ শরম লাগত। আমি কে না কে, সম্পাদক সাহেব উটকো ঝামেলা মনে করবেন।পাঠকের কলাম’- দুচারটা লেখা ছাপা হয়েছে বলেই হুট করে অফিসে যাওয়া যায় নাকি!

রহমতের পাঠকের কলামটা তখন বেশ জনপ্রিয়। আমি, সালাহুদ্দীন মাসউদ, নোমান বিন আরমান, নোমান আহমদ, শাব্বির আহমদএরা তখন পাঠকের কলামে নানা বিষয়ে জোর বিতর্কমূল কলামপাল্টা কলাম লিখতাম। দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল কলামগুলো।

যাক, এর মধ্যে একদিন হলো কি, রহমতএর অফিসে আসাযাওয়া করে এমন কে একজন যেন এসে জানাল, রহমতসম্পাদক মনযুর আহমদ আপনাকে দেখা করতে বলেছে। কথা শুনে তো আমি আকাশ থেকে পড়লাম। আমাকে কোত্থেকে দেখা করতে বলবে? আর আমি যে লালবাগ মাদরাসায় পড়ি, তথ্যই বা তিনি কীভাবে জানলেন? পরে বুঝতে পারলাম, আমার পাঠানো চিঠির মধ্যে তো আমার ঠিকানা লেখা থাকে।

একদিন সুযোগ করে আমি আর তামীম ভাই (তামীম রায়হান) মনযুর আহমদের সঙ্গে দেখা করলাম। তার সঙ্গে কথা হলো, তিনি উৎসাহ দিলেন, নিয়মিত লিখতে বললেন। আমার তো আনন্দ ধরে না। ফিরে এসে মনের আনন্দে লিখতে শুরু করলাম। কয়দিন পর মনযুর ভাই পাঠকের কলাম থেকে আমার লেখা মূল কলামে নিয়ে গেলেন। দেখে আবার অভিভূত হই। যাদের লেখা পড়ে পড়ে শিহরিত হতাম, মাসুদ মজুমদার, যাইনুল আবিদীন, শরীফ মুহাম্মদ আরও বিজ্ঞ কলামিস্টের পাশে নিজের কলাম দেখে তাজ্জব তাজ্জব লাগত।  

মনযুর ভাই মাসিক রহমতে লিখিয়ে যে সাহস তৈরি করে দিয়েছিলেন, ওটার কোনো তুলনা নেই। আমার লেখালেখিজীবনে মনযুর ভাইয়ের অবদান অনেক। হাতেকলমে ধরে শেখানো যাকে বলে, তিনি আমার হাতে সেভাবেই কলম ধরিয়ে দিয়েছিলেন। যখনই লেখার প্রয়োজন হতো লেখার ক্ষেত্রে তিনি কোনো বাধ্যবাধকতা দিতেন না। সবসময় বলতেন, লিখেন আপনার মতো করে। এই অভয়বাণী আমাকে পরবর্তী জীবনে সাহসী হতে সাহায্য করেছে। এখনও আমি যা লিখি, সাহসের সঙ্গে লিখি। ভয়, পরাধীনতা, সীমাবদ্ধতার জিঞ্জিরে আবদ্ধ রেখে আপনি কখনোই সুসাহিত্য আশা করতে পারেন না।

মনযূর ভাই যখন সাপ্তাহিকজাগো প্রহরীনামে নতুন পত্রিকা বের করেন, আমাকে সেটার সহকারী সম্পাদক পদে বসিয়ে দেন। ২০০৮ সালের শেষের দিকের কথা এটা। কেবলই লালবাগ থেকে দাওরা শেষ করে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি হয়েছি। রীতিমতো সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক বনে গেলাম।

মাঝখানে বলতেই হবে, লালবাগ পড়াকালীন তামীম ভাই, ইমরান ভাই আরও দুএকজন মিলেনবধ্বনিনামের ছোট্ট একটা পত্রিকা বের করলেন। আমাকেও সঙ্গে নিলেন। সেটা নিয়েও আমাদের কর্মযজ্ঞের শেষ নেই। নবধ্বনির গল্পটা না হয় থাক আজকে। সেটা নিয়ে বলতে গেলে আরেক রামায়ণ হয়ে যাবে। আরেকদিন সুযোগ হলে বলব। বিরাট বিস্তৃত কাহিনি নবধ্বনি নিয়ে রচিত হবে একদিন।

যাকগে, সম্পাদকপক্ষ আর মালিকপক্ষের নানা জটিলতায় জাগো প্রহরীটা শেষমেশ প্রকাশের কিছুদিন পরই বন্ধ হয়ে গেল। আমি হয়ে গেলাম ভবঘুরে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করি আর পার্টটাইম এটা সেটা লিখি। কখনো কারো খ্যাপের লেখা লিখে দেই, কোনো মাদরাসারা স্মারক বা ডায়েরিএসব করেই চলেছে। এর মধ্যে লালবাগ পড়াকালীন গ্রাফিক্স ডিজাইন কিছুটা শিখেছিলাম। জাগো প্রহরীতে থাকার সময় হামীম কেফায়েতের হাতে কিছুটা তালিমও নেয়া হয়েছিল। কেফায়েত ভাই তখন নামী ডিজাইনার। মূলত কেফায়েত ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় জাগো প্রহরী অফিস থেকেই। তো, সেই বিদ্যা দিয়ে টুকটাক ডিজাইনের কাজ শুরু করলাম। পেট চালাতে হবে তো।

তখন থাকতাম ঢাকা আলিয়ার পেছনে খাজে দেওয়ান লেনে। চকবাজার এবং লালবাগের মাঝামাঝি একটা এলাকা। প্রায় বছর চারেক ছিলাম সেখানে। সেখানে ছোট্ট এক রুমের বাসায় তিন বন্ধু থাকতাম। সানাউল্লাহ, আবদুল মুমিন, তামীম ভাই, আসাদ, ইমরান ভাই মাঝে মাঝে সারারাত আড্ডা দিতাম। এতটুকুন বাসা, গাদাগাদি করে থাকতাম। শীতের রাতে বেশ লাগত, গাদাগাদির কারণে খুব একটা শীত বসতো না গায়ে।

চার

এভাবে বোহেমিয়ান হয়ে কাটালাম ২০১০ সাল পর্যন্ত। পল্টনে নিয়মিত আসা যাওয়া হতো। পল্টন তখন মাদরাসাসাহিত্যের ভালো একটা আঁতুড়ঘর হয়ে উঠছিল। অধুনালুপ্ত জাগো প্রহরীর অফিসে বিশ্বকল্যাণ পাবলিকেশন্সের সাইফুল ভাইয়ের অফিস স্থানান্তর হওয়ায় সেখানে ভালো আড্ডা জমতো। বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম গঠিত হয় সময়েরই কিছু আগে পরে। সাইফুল ভাইয়ের অফিস ছিল লেখক ফোরামের অস্থায়ী কার্যালয়। জহিরুদ্দীন বাবর, মুফতি এনায়েতুল্লাহ, মুনীরুল ইসলাম, আবদুল মুমিন, এহসান সিরাজসহ আরও তরুণরা তখন দাপিয়ে বেড়াতেন পল্টন। নোয়াখালী হোটেল আর ভাই ভাই হোটেলে প্রায় সন্ধ্যায়ই তাদের দর্শন পাওয়া যেত। তাছাড়া, জমিয়তে ইসলাম, মুসলিম লীগসহ আরও দুএকটা ভাঙনপ্রিয় দলের অফিস ছিল পল্টনের জামান ম্যানশনে। জামান ম্যানশনও তখন রমরমা। পল্টনের সাহিত্যসেবীদের পদচারণা ছিল ভাঙাচোরা বিল্ডিংয়েও।

এর মধ্যে একদিন পল্টনের রাস্তায় দেখা হয়ে গেল নামী সাংবাদিক শাকের হোসানই শিবলি ভাইয়ের সঙ্গে।আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজেবহুল আলোচিত বিরাটাকার গ্রন্থ লিখে তিনি তখন বেশ পরিচিতমুখ। সদাহাস্য এবং আড্ডাবাজ শিবলি ভাইয়ের সঙ্গে পরিচিত হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। একদিন তার অফিসে যাওয়ার দাওয়াত দিলেন। এহসান সিরাজের সঙ্গে আমার পরিচয় শিবলি ভাইয়ের অফিসেই। জামান ম্যানশনেই ছিল শিবলি ভাইয়ের অফিস।

শিবলি ভাই তখন নতুন একটা প্রকাশনী প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ব্যাপক তোড়জোড় করছিলেন। প্রকাশনীর নামধামও ঠিক করে ফেলেছেনমাহফিল, দিলরুবা, সুবহে সাদিক। একসঙ্গে ত্রয়ী প্রকাশনা। অভিনব এবং সাহসী ব্যাপার। একসঙ্গে খানেক পাণ্ডুলিপি জমা করছিলেন। বই যখন প্রকাশ করবেন তখন একসঙ্গেই সবগুলো বাজারে নিয়ে আসবেন। বাজারে একটা হুলস্থুল লাগিয়ে দেবেন। এমনই ছিল শিবলি ভাইয়ের ইচ্ছা। আমাকে বললেন তার সঙ্গে ভিড়ে যেতে। আমার না করার তেমন কোনো গুরুতর কারণ ছিল না। ভিড়ে গেলাম।  জামান ম্যানশনের ঘিঞ্জি কোঠা ছেড়ে অফিস নিলেন পল্টন টাওয়ারের পেছনের গলিতে। তিন রুমের বিরাট অফিস। আমার থাকবার জায়গাও হয়ে গেল সেখানে। খাজে দেওয়ানের সেই ছোট্ট রুম ছেড়ে কাঁথাবালিশ আর বইকম্পিউটার নিয়ে উঠে এলাম পল্টনের নতুন ঠিকানায়।

শিবলি ভাইয়ের সঙ্গে দুই বছর ছিলাম। অনেক কিছু শিখেছি শিবলি ভাইয়ের কাছ থেকে। জীবনে তার ঋণ অশোধযোগ্য। সম্পাদনা, লেখার মন্দভালো, একটা যোগ্য শিরোনাম, লেখার খুঁটিনাটি অনেক বিষয় শেখা হয়েছে তার সঙ্গে থেকে। তাছাড়া শিবলি ভাই দারুণ সাহসী মানুষ এবং স্বপ্নবাজ মানুষ। কখনো ছোট স্বপ্ন দেখতেন না। তার কাছ থেকে এই গুণটি আমি সযত্নে হরণ করেছি। স্বপ্ন যদি দেখো তবে বিরাট বিশাল কিছু দেখো। স্বপ্ন দেখতে কখনো কার্পণ্য করো না। নিজেকে কখনো ছোটখাটো মূল্যে বিকিয়ে দিয়ো না। আগে নিজেকে বাজারের জন্য মূল্যবান করে তৈরি করো, তারপর নিজেকে বাজারে উঠাও। ভালো দাম পাবে।  সস্তা মূল্যে বিকোলে সারাজীবন সস্তা হিসেবেই বিক্রি হবে, কেউ আর দাম বাড়াবে না।

বলতে ভুলেই গেছি, আমার প্রথম বই প্রকাশ হয় শিবলি ভাইয়ের মাহফিল প্রকাশনী থেকে। অবশ্য মাহফিল প্রকাশনীরও প্রথম বই ছিল ওগুলো। আমার বই দিয়েই মাহফিল প্রকাশনীর যাত্রা শুরু। একসঙ্গে চারটি গল্পের বইসোরাকার মুকুট, মৃত্যুবাগিচার বীর, হাজার বছরের ভালোবাসা, গেরিলাযুদ্ধের নায়ক। ২০১২ সালে সম্ভবত।  বেশ একটা লেখক লেখক ভাব এসে গেল। কোথাও গেলে এখন খানিকটা দাম পাওয়া যায়। পরিচয়টরিচয় দিতে সুবিধে হয়।

অবশ্য আমার চেয়ে আমার লেখক হওয়ার পরিচিতি বেশি বিতরণ করেছে এহসান সিরাজ। শিবলি ভাইয়ের অফিসে প্রথমদিকে পরিচয় হওয়ার পর থেকে ওর সঙ্গে জোরদার খাতির তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ওর প্রথাগত কোনো কাজ ছিল না। এক চাচার সঙ্গে জমির ব্যবসা করতো আর বিভিন্ন লোকজনদের নিয়ে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করতো। এহসানের এই এক বিশেষ গুণ। লোকজনকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া। হাসপাতাল সম্পর্কিত তার জ্ঞান এনসাইক্লোপিডিয়ার মতো। কারণে আত্মীয়স্বজন বা এলাকার লোকজন কিংবা বন্ধুবান্ধব, কারো রোগবালাই হলে প্রথমে ডাক পড়ে এহসানের। এহসান মনের আনন্দে অসুস্থ রোগী নিয়ে হাসপাতাল অভিমুখে রওনা হয়।

এই এহসানই একদিন কানে কানে খবর দিল, শাহ ইফতেখার তারিক ভাইয়েরা তো পত্রিকা করছে। সাপ্তাহিক পত্রিকা। অফিস টফিস নিয়েছে, ডেকোরেশনের কাজ চলছে। লোকজন কিছু নিয়েছে, আরও নিবে। চিন্তাভাবনা কর।

প্রকাশনী নিয়ে শিবলি ভাই তখন একটু দম নিয়েছেন। সেটা আরেক কারণ। এই ফাঁকে আমি শিবলি ভাইকে বলে তারিক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করলাম। কিছু বুঝতে না বুঝতেই লিখনীর সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম। চোখভরা স্বপ্ন। নিজেদের একটা সাপ্তাহিক হবে। প্রতি সপ্তাহে যাবে আমাদের নিজস্ব কথা, আমাদের স্বপ্ন আর ভালোবাসার কথা। এমন স্বপ্ন দেখার তালিমই দিয়েছিলেন শিবলি ভাই। আমি সেটারই সদ্ব্যবহার করলাম।

লিখনী নিয়ে বলতে হলে অনেক কথা বলতে হবে। ছোট পরিধিতে লিখনীর হালহকিকত বয়ান করা সম্ভব না। সময় হলে বলে ফেলব একদিন। তবে এটা সত্য, সাপ্তাহিক লিখনীতে কাটানো সময়, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। সাংবাদিকতা, হাজারো স্বপ্নের বাস্তবায়ন, অনেক কিছু শেখা, অনেক স্বপ্নের মৃত্যু, স্বপ্নভঙ্গের বেদানসব একাকার হয়ে আছে স্মৃতির বারান্দায়। সময় সুযোগ হলে না লিখে শান্তি পাব না।

দুই বছর পর লিখনী বন্ধ হয়ে গেল। কেন? সে প্রশ্ন ভবিষ্যতের জন্য তোলা রইল। প্রকাশ করব শিগগিরই। লিখনী বন্ধ হওয়ার পর আমি জবরদস্তভাবে ভিড়ে গেলাম হামীম কেফায়েত ভাইয়ের সঙ্গে, গ্রাফিক্স হাউজ গালায়। প্রকাশনা আর পত্রিকার সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে ডিজাইনের হাতটা সবসময়ই মশকোর ওপর থাকতো। গালায় তাই চিফ ডিজাইনার হিসেবে চাকরি করলাম বছরখানেক। কিন্তু সেখানেও মন টিকছিল না। হাত নিশপিশ করে রাত হলেই। লিখতে না পারলে হয় না কিছুই ঠিকমতো।

কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তামীম ভাই কাতারে। একদিন ফোন দিলামকী করা যায় বলেন তো? নবপ্রকাশ তখন কেবল লালবাগের ছোট্ট স্টেশনারি দোকান ছেড়ে বাংলাবাজারের ইসলামী টাওয়ারে পসরা সাজিয়ে বসেছে। গোটা দুইতিন বই নিয়ে তার সংসার। আসাদ বইটই বিক্রি করার চেষ্টাতদ্বির চালিয়ে যাচ্ছিল। তামীম ভাই বললেন, আপনি তাহলে নবপ্রকাশের হালটা ধরেন। বেতনটেতন থাকলো, আর আপনি  নিজেও বই লেখা শুরু করেন। হোক না হোক, কিছু একটা তো হবে। তামীম ভাইয়ের ব্যবসায়িক জ্ঞান মারাত্মক। তার চেয়েও প্রখর তার ব্যবসা পরিচালনার কৌশল।

২০১৬ সালের দিকে নবপ্রকাশে। শুরু থেকে আমি কেবল হালটাই ধরে রাখলাম, যাবতীয় ঠ্যালাধাক্কা, উজানভাটি, মাঝিমাল্লা সব সামলেছেন তামীম ভাই আর আসাদ। আজকে নবপ্রকাশকে দুচার লোক নিজস্ব স্বয়ম্ভরতার জন্য যতটুকু চেনে, তার সিংহভাগ প্রশংসার হকদার তামীম ভাই। আর আসাদের নিরলস শ্রম ছিল জ্বালানির মতো।

নবপ্রকাশ শুধু নয়, সেই লালবাগ থেকে আজ পর্যন্ত, প্রায় দশএগারো বছর ধরে তামীম ভাইয়ের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্ব। আমার লেখালেখিজীবনে তামীম ভাইয়ের সহযোগও তেমন অবিচ্ছেদ্য। ফেসবুকে তামীম ভাইয়ের সঙ্গেই আমার সবচে বেশি কথা হয়। পুরোনো চ্যাটহিস্ট্রি যদি কখনো খুলি, আটদশ বছর আগের কথাবার্তা পড়লে হাসি আসে। জীবন কোথায় থেকে কোথায় চলে আসে। কত কথা তবু রয়ে যায়।

পাঁচ

লেখালেখির ক্ষেত্রে নিজেকে আমি ভাগ্যবান মনে করি। লেখক হওয়ার মেধা বা যোগ্যতা কতটুকু আছে, সেটা নিজে বিচার করি না। তবে ভাগ্য আমাকে সবসময় এমন জায়গায় প্রতিস্থাপন করেছে, যেখানে আমার হওয়া দরকার ছিল। যেখান থেকে আমার যা শিক্ষা করার দরকার ছিল, সময় আমাকে সেখানেই নিয়ে গিয়েছে। হয়তো সময়ের সঙ্গে আমি যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছি, সেগুলো সঠিক ছিল। যার কারণে আমি সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে থাকতে পেরেছি। জীবনে সিদ্ধান্ত নিতে আমি সিদ্ধান্তহীনতায় খুব কম ভুগি। তবে আমি যতটুকু ব্যর্থ, তা একান্ত আমার নিজের অলসতা এবং অক্ষমতা।

আরেকটা ব্যাপার। নিজেকে আমি কখনো পরাজিত ভাবতে শিখিনি। যখন যে অবস্থায় থেকেছি, সেখানে থেকেই সফলতার স্বপ্ন দেখেছি। ব্যর্থ, পরাজিত, আশাহত হওয়ার হাজারো কারণ চারপাশে ঘুরঘুর করেছে, আমি তবু সফলতার টিমটিমে আলোকদণ্ড ধরে দাঁড়িয়ে থেকেছি। এখনও আছি। হেরে যাবার প্রশ্নই আসে না।

আমি জানি আমাকে কী করতে হবে। আমার নিজেকে আমি জানি, নিজের সক্ষমতা কতটুকু, আমি আসলে কী করতে পারিসে ব্যাপারে নিজের ওপর আমার পূর্ণ আত্মবিশ্বাস আছে। মানুষের কথায়, সমালোচনায়, গালমন্দে আমি কান দেই না। আমি অনেক ঝড় পার করে আমার পথে অনবরত হাঁটছি, মানুষের সমালোচনার ভয়ে পথ থেকে ছিটকে যাবার মতো বোকা আমি নই। যে সংগ্রাম করে এই লেখালেখির পথ ধরে হাঁটছি, এখন যদি অন্যের কথায় পিছিয়ে যাই তবে নিজের অতীত সংগ্রামকে চরমভাবে অপমানিত করা হবে। অতীতের যে ভিত্তির ওপর আমার নিজের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত, আমার সে অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যাবে। সো, নো কম্প্রোমাইজ!

আমাকে লেখালেখি করতে হবেএটা আমি নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলাম। এই বোধ কোথা থেকে আমার ভেতরে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল, সেটা এখন আর মনে করতে পারি না। জীবনের তেত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে, অনেকটা সময়। অনেক কিছু করার ছিল, পারিনি। পারা উচিত ছিল। হয়তো তেমন শক্ত একটা মেরুদণ্ড থাকলে আরও কিছু করা যেতো। তবে, এখন যেমন আছি, আমি নিজেকে হতাশ ভাবি না। এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি। প্রত্যেকটা দিন নতুন সম্ভাবনার জন্য আমাকে তৈরি করে। আমি প্রতিদিন বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখি।

পড়তে পড়তে লিখতে শিখেছি। লিখতে লিখতে মনে হয়েছে, তাহলে লেখকই হবো। কাজটাই আমি করতে ভালোবাসি। জীবনের অসংখ্য টানাপোড়েন দু হাতে তলে চাপা দিয়ে কলম ধরা হাত উঁচু করে রাখি। ভালোবাসার স্বপ্নে যেন পৃথিবীর বৈষয়িক কোনো দাগ না লাগে। নেই, কোনো ভয় নেই। পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া!

লেখক : সাহিত্যিক ও গদ্যলেখক

আগের সংবাদঈদে ঢাকা ছাড়ছে এক কোটি ৪৭ লাখ মানুষ
পরবর্তি সংবাদশ্রীমঙ্গলের পর্যটন বৃত্তান্ত