আমার বাড়ি বৌডুবি

মনযূর আহমাদ:

[এটি আত্মপরিচয়মূলক রচনা। আত্মজীবনীমূলক নয়। আমি কে, তা সন্ধান করার চেষ্টা। এই অঞ্চল সম্বন্ধে নৃতাত্ত্বিক আলাপ তেমন হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠতার বিষয়টিরও গভীর থেকে কেউ সুলুক সন্ধান করেছে বলে আমি জানি না। একাত্তরের পরে আমার দেখা শৈশব থেকে এই এলাকার মানুষ দু দু বার দুজন আলিমকে এমপি নির্বাচিত করার সূত্র থেকে ভাবছিলাম, জনমণ্ডলীর এই ইসলামপ্রীতির শিকড় কোথায়! এর আগে এবং পরেও যারা জননেতা নির্বাচিত হয়েছেন, তারা আলিম না হলেও নিজেদের মুসলিম পরিচয় উচ্চ করে তুলে ধরেছেন এবং নিজেদের ধার্মিক প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। আমি ভেবে কূল পাচ্ছিলাম না, এই অঞ্চলে চিশতিয়া ধারার প্রতি মানুষের সহজাত যে আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়, তার নাড়ি কোথায়! মানুষগুলোর চরিত্রে যে বেশি আবেগ লক্ষ্য করা যায়, তা-ই কেন? উপরন্তু এদের পরস্পর প্রতিবাদগুলো প্রতিঘাতে পরিণত হয় কেন? আদিতে অস্তিত্বের সংকট ও সংঘাতের মোকাবেলা করে জয় ছিনিয়ে এনে হানাদারদের হারিয়ে দেওয়ার যে উচ্ছ্বাস, একি তারই আবেগতাড়িত প্রকাশ! একটু এগিয়ে দেখি, সত্যটা জানা যায় কিনা!]

মাদারাসায়ে এমদাদিয়ার মক্তব থেকে পড়ালেখা শুরু। এটি আমাদের এলাকার প্রাচীন ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর প্রতিষ্ঠাতা আমার বাবা। ১৯৬১-এ মাদরাসাটির প্রতিষ্ঠা। আমাদের সময়ের প্রথম দিকে এর শিক্ষক ছিলেন মাওলানা মাকসুদুল্লাহ সাহেব। আমার নানার শাগরেদ হওয়ার সুবাদে আমাদের প্রতি তার এবং তার প্রতি আমাদের পরিবারের আলাদা মমত্ব ছিলো। তার সঙ্গে আমাদের পরিচয়ও নানার সঙ্গে তার সম্পর্কের সুবাদে।

হুজুরের খাবারের ব্যবস্থা ছিলো আমাদের বাড়িতে। তখন বাড়ির পাঞ্জেগানা মসজিদটি ছিলো টং ঘরের মতো। গোলপাতার ছাউনি, কাঠের পাটাতন। যতটুকু মনে পড়ে তিনি রাতে মাদরাসায় ঘুমাতেন। তবে তিন বেলা খেয়ে যেতেন।

মাদরাসা থেকে আমাদের বাড়ির দূরত্ব আট-দশ মিনিটের পথ। মেঠো পথ। জায়গার নাম বৌডুবি। কী জানি, কোনকালে এখানে নৌকায় কারো বউ ডুবে ছিলো কিনা! অসম্ভব না। তিন খালের মোহনা। প্রচণ্ড স্রোতস্বিনী। জোয়ারের সময় ত্রিমোহনার স্রোতের ঘূর্ণির শো শো শব্দ আমাদের মনে ভয় ধরিয়ে দেত।

আমাদের গ্রাম নলবুনিয়া, এর লাগোয়া টেংড়াখালি, ছোটখালের ওপারের হেগলাবুনিয়া ও বড় খালের ওপারের শংকরপাশার মোহনায় বৌডুবি। বৌডুবি থেকে পশ্চিমে লাহুড়ির দিকে এক কিলোর ব্যবধানে তিনটি গ্রামের মোহনায় বটতলা। এই বটতলা ব্রিজের খালটি আমাদের বাড়ি ঘেঁষে পশ্চিমে এসে এখানে বলেশ্বর থেকে বেয়ে আসা ছোট একটি খালের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই ছোট খালটি হচ্ছে খুলনা-বাগেরহাটের সঙ্গে আমাদের আঞ্চলিক ভাষা-সামাজিকতার বিভাজন রেখা। এই ব্রিজের পশ্চিম দিকের ভাষা খুলনার আঞ্চলিকতায় পরিপুষ্ট। আর পূর্ব দিক থেকে বরিশালের আঞ্চলিকতার সূচনা। আমরা পূর্ব দিকের বাসিন্দা। বরিশালের আঞ্চলিকতার সূচনা-ক্ষেত্রে আমাদের বেড়ে ওঠা।

আমাদের নলবুনিয়া গ্রামের উত্তর পাড়ার মসজিদ খোলার যে প্রাচীন মসজিদটি এখনো জীর্ণ শরীরে দাঁড়িয়ে আছে এবং বটতলা থেকে আধা কিলো পশ্চিম-উত্তরে বাড়ৈখালির শিরিশ তলায় যে দীঘিটি ছিলো, তা প্রমাণ করে, এখানে পনেরো শতকের শুরুতেই খানজাহান আলির সময়ে ইসলামের বিজয় ঘটেছে। এই গ্রামের প্রাচীন পরিবারটির আকন্দ পরিচয় এই সম্ভাবনা আরো দৃঢ় করে। আকন্দ মানে ধর্মীয় শিক্ষক। এরাই যে এই এলাকায় ইসলামের শিক্ষার আলো জ্বালিয়েছেন তা এই উপাধি প্রমাণ করে। এই দীঘি ও মসজিদগুলো সাক্ষী দেয়, এই এলাকা খান জাহান আলি কর্তৃক বিজিত ও শাসিত ছিলো। খান জাহান আলি বাগেরহাট জয় করেছিলেন পনেরো শতকের শুরুর দিকে।

এখানেও আমরা অনুভব করি মহান আধ্যাত্ম-সাধক ও ইসলাম-প্রচারক নুর কুতুবুল আলমের স্পর্শ। কেননা খান জাহান আলি নুর কুতুবুল আলমের খলিফা ও মেয়ের বর ছিলেন। এই ধারার উত্তর পুরুষ পরিচয়ে আমরা গর্বিত। এর পাশাপাশি এই দীঘি ও প্রাচীন মসজিদগুলো এ কথাও প্রমাণ করে, এখানে ইসলাম আবির্ভূত হয়েছে পাঁচশত বছর পূর্বে।

এখন এই এলাকার মানুষ যেহেতু খান জাহান আলিকে একজন গতানুগতিক পীর মনে করেন, তাই তার সম্বন্ধে খানিক জেনে নেয়া যাক।

বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে যেসকল ওলি-আউলিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তাদের মধ্যে স্মরণীয় একটি নাম খান জাহান আলি। একাধারে তিনি ছিলেন সৈনিক, সাধক, ধর্ম প্রচারক ও শাসক। দক্ষিণ বঙ্গে খান জাহান আলি একটি পবিত্র নাম। পাঁচ শত বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও সেই নাম এতটুকু ম্লান হয়নি। বাগেরহাটের বিখ্যাত ষাট গম্বুজ মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা খান জাহান আলি রহ.।
তিনি প্রায় চল্লিশ বছর দক্ষিণবঙ্গে ইসলাম প্রচার ও শাসন পরিচালনা করেছেন। তার সমাধি ফলকের শিলালিপি থেকে জানা যায়, তিনি তুরস্কের খাওয়ারিজমে জন্মগ্রহণ করেন, যার বর্তমান নাম খিবা।

ঐতিহাসিকদের মতে, তার বাল্যনাম ছিল কেশওয়ার খান। বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের অনেক পরে চৌদ্দ শতকের শেষের দিকে খান জাহান বাল্যকালে পিতা-মাতার সাথে গৌড়ে আগমন করেন। খান জাহান আলির পিতা আজওয়ার খান কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি না হলেও বিদ্বান ছিলেন। গৌড়ের নিকটবর্তী নবিপুরে তিনি বসবাস করতেন। পুত্র খান জাহানকে সুশিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে বিখ্যাত ওলি হজরত নুর কুতুবুল আলমের মাদ্রাসায় পাঠান। এখানে অধ্যয়নরত অবস্থায় তার পিতা আজওয়ার খান মৃত্যুবরণ করেন।

মা আম্বিয়া বিবি বহু কষ্টে তাকে লালন পালন করতে থাকেন। এই সময়ে তার প্রতি বাদশাহ হোসেন শাহের সুদৃষ্টি পড়ে। বাদশাহ তার প্রতিভা ও বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে তাকে নিজ দরবারে জায়গা দেন। এখানেই বড় হতে থাকেন খান জাহান আলি। বাদশাহর মৃত্যুর পর দরবারের লোকেরা খান জাহান আলির সাথে বিরুপ আচরণ শুরু করে। এমনকি তার মায়ের জন্য নির্ধারিত শাহি বেতন-ভাতাও বন্ধ করে দেয়। নিরুপায় খান জাহান তার ওস্তাদ নুর কুতুবুল আলমের কাছে পরামর্শ চান। ওস্তাদ তার কষ্ট অনুধাবন করে জৌনপুরের প্রতাপশালী সুলতান ইব্রাহিম শর্কির কাছে তাকে চিঠিসহ পাঠান। চিঠিতে তিনি খান জাহানের সচ্চরিত্র ও প্রতিভার কথা উল্লেখ করেন।

সুলতান ইব্রাহিম শর্কি নুর কুতুবুল আলমকে অনেক শ্রদ্ধা করতেন ও তার কথার খুব গুরুত্ব দিতেন। তার চিঠি পেয়ে তিনি খান জাহানকে সৈনিকের চাকরি প্রদান করেন। এখান থেকে খান জাহান আলির সৈনিক জীবনের শুরু। নিজ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে তিনি কিছুদিনের মধ্যে একজন সাধারণ সৈনিক থেকে প্রধান সেনাপতির পদে উন্নীত হন।

এ সময় গৌড়ের সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থা বড় করুণ ছিল। গৌড়ের শাসক ছিলেন রাজা গণেশ। মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর রাজা গণেশ খড়গহস্ত ছিলেন। গণেশের অত্যাচার যখন মাত্রা ছাড়ায় তখন নুর কুতুবুল আলম ইব্রাহিম শর্কির নিকট পত্র লিখে ইসলাম ও মুসলিমদের রক্ষার্থে রাজা গণেশকে দমন করার আহবান জানান। সুলতান তার বিশ্বস্ত সেনাপতি খান জাহান আলির নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক সৈন্য রাজা গণেশের মোকাবেলায় অভিযানে পাঠান। অভিযান শেষে খান জাহান আলি সুলতানের অনুমতি নিয়ে তার ওস্তাদ কুতুবুল আলমের কাছে কিছুদিন থাকার জন্য যান। কিন্তু সেই ছুটি শেষ করে তিনি আর ফেরেননি। সুলতানের বারবার আহবান সত্ত্বেও খান জাহান আলি জৌনপুরে ফিরে না গিয়ে চাকরিতে ইস্তফা দেন। শেষ হয় তার সৈনিক জীবন।

হজরত নুর কুতুবুল আলম তার প্রিয় শিষ্যকে ফিরে পেয়ে অনেক খুশি হন। তিনি তাকে কামালিয়াৎ ও বেলায়িয়াতের দীক্ষা দেন। খান জাহানের সততা ও নিষ্ঠায় মুগ্ধ হয়ে তিনি তার সাথে নিজ কন্যার বিয়েও দেন। কিছুদিন স্বাচ্ছন্দ্যে দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করেন খান জাহান আলি। কিন্তু চারিদিকে ইসলাম ও মুসলিমদের দুরবস্থা দেখে বেশিদিন স্থির থাকতে পারেননি। স্ত্রীকে শ্বশুরের খেদমতে রেখে সমাজ সেবা, ইসলাম রক্ষা ও ইসলাম প্রচারের কাজে বেরিয়ে পড়েন।

খান জাহান আলি ঠিক কত সালে দক্ষিণবঙ্গে আসেন, তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে এটা জানা যায় যে তিনি যখন বঙ্গে আসেন, তখন গৌড়ের সুলতান ছিলেন জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ শাহ। এ সময় দক্ষিণবঙ্গে আগমনের একমাত্র পথ ছিল ভৈরব নদী। খান জাহান আলি গৌড় থেকে পদ্মা নদী ধরে কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের নিকটবর্তী ভৈরব নদী বেয়ে চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ হয়ে যশোহরের বারোবাজারে উপনীত হন। পথিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে ইসলাম প্রচারের কাজ করেন। এগার জন অলি নিয়ে তিনি যশোহরের বারোবাজারে কিছু দিন অবস্থান করেন। এখান থেকেই তার দক্ষিণবঙ্গ জয়ের সূচনা।

এখান থেকে তিনি মুরলী চলে আসেন। যেখানে এখন গড়ে ওঠেছে আধুনিক যশোহর শহর। এখান থেকে তিনি তার সহচরদের কয়েকজনকে সুন্দরবন অঞ্চলে পাঠান। আরেক দল, যার নেতৃত্বে তিনি নিজে ছিলেন, তাদের নিয়ে ভৈরব তীরের পায়গ্রাম কসবায় গিয়ে পৌঁছান। এখানে অল্প কিছুদিন অবস্থান করার পর ভৈরবের তীর ধরে সুন্দরঘোনা আসেন। এই স্থানে এক নতুন শহরের পত্তন করেন, এর নাম দেন খলিফাবাদ। এরই বর্তমান নাম বাগেরহাট। তার প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই শহর। যাত্রাপথের বহু এলাকায় তিনি ইসলাম প্রচার করেন এবং প্রত্যেক এলাকায় একজন করে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। এভাবে তার অনুসারী বাড়তে থাকে।

খান জাহান আলির আগমনকালে দক্ষিণবঙ্গের বেশিরভাগ জায়গা ছিল বনাঞ্চল। বন-জঙ্গল সাফ করে তিনি ও তার অনুসারীরা দক্ষিণবঙ্গকে বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলেন। পুরো দক্ষিণাঞ্চল একরকম তার রাজ্য ছিল। কোনো বাধা ছাড়া এই এলাকা তিনি শাসন করতেন। জনগণও তার নেতৃত্ব মেনে নেয়। তবে আঞ্চলিক শাসক হলেও শাসকসুলভ জীবনযাপন কখনোই করেননি তিনি। বাদশাহদের মতো তিনি চলতেন না। এমনকি নিজের নামে কোনো মুদ্রার প্রচলনও করেননি। তিনি গৌড়ের সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের সময় তার সনদ নিয়ে দক্ষিণবঙ্গ শাসন করেছেন। খান জাহান আলির মৃত্যুর পরে তার প্রতিষ্ঠিত খলিফাবাদেই গড়ে ওঠে ঐতিহাসিক টাকশাল। পরবর্তী ৪০-৫০ বছর এই টাকশালে বাংলার স্বধীন সুলতানদের মুদ্রা তৈরি হতো। বিখ্যাত ষাট গম্বুজ মসজিদ ছিল তার দরবারগৃহ। ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ছিল তার বসতবাড়ি। এখন সেটির কোনো অস্তিত্ব নেই।

খান জাহান আলি তার দীর্ঘ শাসনামলে এই অঞ্চলের ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন। এখানে তিনি থানা, কাচারি, বিভিন্ন সরকারী দফতর, বিচারালয়, সেনানিবাস ইত্যাদি নির্মাণ করেন। প্রশাসনিক সুবিধার্থে দক্ষিণবঙ্গকে তিনি কয়েকটি ভাগে ভাগ করেন, ঘরে ঘরে পৌঁছে দেন সুশাসন। তার এই ছোট রাজ্যে তিনি ইসলামি শাসন কায়েম করেন। তিনি খলিফাবাদ বা বাগেরহাট এলাকায় ইসলাম প্রচারের সময় স্থানীয় প্রভাবশালী হিন্দুদের বাধার সম্মুখীন হন। তাদের বিরোধিতার কারণে ঐ এলাকার রণবিজয়পুর, ফতেহপুর, পিলঙ্গজ প্রভৃতি স্থানে হিন্দুদের সাথে তার যুদ্ধ হয়। খান জাহান আলি তাদের পর্যুদস্ত করে নিজের শাসনক্ষমতা কায়েম রাখতে সমর্থ হন।

প্রায় ৪০ বছর স্বাচ্ছন্দ্যে দক্ষিণবঙ্গে রাজত্ব করেন খান জাহান আলি। এই পুরো এলাকায় ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেন এই মহান সাধক। তার সুশাসন ও বিনয়ী স্বভাবে আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। এই মহান শাসক ও ধর্ম প্রচারক ৮৬৩ হিজরির ২৬ জিলহজ্জ মোতাবেক ইংরেজি ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ অক্টোবর ইন্তেকাল করেন।

বৌডুবিতেই পারেরহাট ইউনিয়ন পরিষদ (কমিউনিটি সেন্টার), ভোট ঘর, ফ্রি প্রাইমারি স্কুল ও মাদরাসায়ে এমদাদিয়া। কয়েকখানা দোকানও ছিলো। আমরাও বৌডুবির ফ্রি প্রাইমারির শিক্ষার্থী ছিলাম। আমরা ফাইভের ক্লাস শুরু করেছিলাম পাকা ভবনে। এর আগে এখন যেখানে ঈদগাহ, আধুনিক ইউনিয়ন পরিষদ ও প্রাইমারি স্কুল ভবন সেখানটা ছিলো মাঠ। সেখানে শীতকালীন সবজি চাষ হত। এখানেই ফুটবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন খেলা হত। এর পূর্ব দিকটায় কাঠের ঘরে স্কুলের ক্লাশ হত। এই স্কুলের প্রবীণ শিক্ষক ছিলেন জনাব মকবুল মাস্টার, তাঁর কথা খুব মনে পড়ে। তিনি ছিলেন আমার বাবারও প্রাইমারির শিক্ষক। তিনি আমাদের দাদাদের সমবয়সী ছিলেন। শংকরপাশার কাজি বাড়ির সেকেন্ড স্যারের কথাও বেশ মনে পড়ে। ছোটখাট পাঞ্জাবি-টুপি পরা মানুষটির কথা ভোলা যায় না। নামাজি ছিলেন। তখন একজন রাগি হেড মাষ্টার ছিলেন। টেংরাখালির ফকির বাড়িতে যার লজিং ছিলো। তার নাম মনে পড়ছে না। বহুদিন চাকুরি করেছেন এই স্কুলে। এরপর আসেন চিতলমারির একজন হিন্দু হেড মাষ্টার। তিনি সব মৌসুমে সাথে ছাতা রাখতেন। উচ্চ শিক্ষিত ও সৌম্য-শান্ত স্বভাবের লোক ছিলেন।

আমাদের ফাইভের বছর প্রথম বোর্ড পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।

সেজ দাদার ছোট মেয়ে খাদিজা ফুফুর হাত ধরে প্রথম স্কুলে গিয়েছিলাম। তখন কমিউনিটি সেন্টারে ক্লাশ হতো। কাঠের স্কুল ঘরটা ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছিলো, হয়ত সে কারণে। তালপাতায় লিখতে হতো। নিচের ক্লাশের ছাত্ররা কঞ্চির কলম দিয়ে তালপাতায় লিখত। সেজ দাদা কঞ্চির কলম বানাতে বেশ দক্ষ ছিলেন। কালিও তিনি বানিয়ে দিতেন।

তবে আমরা বেশি দিন তালপাতায় লিখেছি বলে মনে পড়ে না। তখন এই চলটা বিদায় নেওয়ার অবস্থা। বাড়িতে আমরা খাতা-কলমেই বেশি লিখতাম। তখন লেখার প্রতি বেশ গুরুত্ব দেওয়া হত। সুন্দর হাতের লেখার বেশ কদর ছিলো। এটিকে শিল্প মনে করা হত।

একাত্তরে ক্লাশ থ্রিতে ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের কারণে এক বছর স্কুল বন্ধ ছিলো। স্কুল খুললে থ্রি থেকে ফাইভে ভর্তি করে নেয়া হলো। তবে আমাদের মাদরাসা-মক্তব খোলা ছিলো।

একদিন হুজুর পড়াচ্ছিলেন। সকাল নয়টা-দশটার দিকে পাক সেনারা আসলো। তারা রাস্তা দিয়ে হেঁটে পশ্চিম দিকে চলে গেলো। আমরা তাকিয়ে দেখলাম। সুঠাম দেহের খাকি পরা হাতে বন্দুক ধরা লোকগুলোকে দেখে কি আমরা ভয় পেয়েছিলাম! মনে পড়েনা।

ঐদিন আমার সুরা আলাক সবক ছিলো। পাক সেনারা একটু দূরে চলে যাওয়ার পর মাদরাসা ছুটি দেয়া হলো। নিজ চোখে পাক বাহিনী দেখলাম। মুক্তি বাহিনী দেখেছি স্বাধীনতার পরে।

তখন রাস্তা ঘেঁষে মাদরাসার সামনে ডোবার মতন একটি পুকুর ছিলো। সেখানে অজু করা হতো। ডোবার পাড়ে রাস্তা-লাগোয়া প্রকাণ্ড একটি তালগাছ ছিলো। ঠিক এখন যেখানটায় মাদরাসার জমিনদাতা মৌলভি ইয়াসিন সাহেব ও তাঁর স্ত্রীর পাকা কবর।

পরিবেশটা ছিলো মন মাতানো।

আমাদের গ্রামে সরাসরি পাক সেনাদের অত্যাচার-অপারেশনের কথা আমরা জানিনা—কুটি নামে পরিচিত লোকটির হত্যাকাণ্ড ছাড়া। বৌডুবির কাছেই হোগলাবুনিয়ার বালা বাড়ির ঘরগুলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিলো, কয়েক দিন পরে এক বিকেলে আমি, মাহবুব ও ফরাজি বাড়ির মহসিন তা দেখতে গিয়েছিলাম। মনে পড়ে, তখনো পোড়া ঘরের পাশে জবা ও গাঁদাসহ কত জাতের ফুল ফুটে ছিলো।

বালা বাড়ির দু একটি ছেলে তো আমাদের সাথেও পড়ত। তবে এদের অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে পারেরহাট স্কুলে যেত। কাছের হলেও এরা বৌডুবি কম আসত। আমার মনে হত, এরা এলাকার মুসলিমদের সাথে কম মিশে। এরা আগে থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের থেকে রহস্যজনক দূরত্ব বজায় রাখত। তবে, সে সময় তো বটেই, এখনো হিন্দুরাই পারেরহাটের ব্যবসার নিয়ন্ত্রক। এখানে হিন্দুদের প্রভাব ঐতিহ্যগতভাবে প্রতিষ্ঠিত। পারেরহাটে প্রতাপশালী হিন্দু জমিদারের কাচারি ছিলো। যে কারণে বড় বন্দর হওয়া সত্বেও এখানে এখনো পর্যন্ত একটি মাত্র মসজিদ দেখতে পাচ্ছি। পারেরহাট বড় মসজিদের ডানে-বামে হিন্দুদের বাড়ি। মাগরিবের সময় আপনি মসজিদে বসে একই সাথে শোনবেন সিঙা-উলু ও আজানের ধ্বনী। কোনো মুসলিম কোনোদিন এর প্রতিবাদ করেছে বলে শুনিনি। ৭১-এর অসময়টুকু ছাড়া পড়শিদের দ্বারা ধর্ম বিশ্বাসের কারণে কোন হিন্দু কখনো নিগৃহীত হয়েছে বলে শুনিনি। ৭১-এর স্বাধীনতায় এরাই খেসারাতের শিকার হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তারপরও তাদের এই দেশটিকে সেকেন্ট হোম মনে করার কী কারণ, আল্লাহ মালুম। আমার সীমিত পর্যবেক্ষণে তাদের থেকে এই ধারনাই পেয়েছি।

আমাদের বাড়ির সামনের খালের ওপারে আমির খাঁর বাড়িটিও জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিলো। এর পাশের বাড়ির মোকসেদ মাদবারের ভাই খসরু মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে বলে তার ঘরটিও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। তবে পারেরহাট বন্দরে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়ি জ্বালানো ও ব্যাপক লুটপাটের খবর সবার মুখে মুখে ছিলো। এখানের ব্যবসাটা মূলত একচেটিয়া হিন্দুদের দখলে ছিলো। যে কারণে পারেরহাটকে, আমরা শোনতাম, সোনার খনি বলা হতো।

তখন এর ভয়বহতা উপলব্ধি করার বয়স হয়নি। লেখাপড়ার শিথিলতার সুযোগে কাজ ছিলো ক্লান্ত না হওয়া ও ক্ষুধা না লাগা পর্যন্ত অবিরাম খেলাধুলায় মগ্ন থাকা।

যদিও আমাদের পরিবার রাজনীতির সাথে জড়ায় না। স্থানীয় নির্বাচনেও সাধারণত সরাসরি কোন প্রার্থীর পক্ষে সমর্থন ব্যাক্ত করে না। যদিও প্রায়বছর আমাদের ঘনিষ্ট আত্মীয়দের কেউ না কেউ চেয়াম্যানপ্রার্থী হয়ে থাকেন।

তবুও ৭১-এ আলিম পরিবার হিসেবে যে কেউ তাদের ফাঁসাতে পারে এই আশংকা করছিলেন। দু চারখানা উড়ো চিঠিও পেয়েছিলেন। তাতে টাকা পয়সা দাবি করা হয়েছিলো। ফলে ঘরের দামি আসবাবগুলো সরিয়ে ফেলা হলো। বাবা ও কাকা আত্মগোপনে চলে গেলেন।

স্বধীনতার পর ভয়টা বেশি ছিলো। আমরা প্রায় দু মাস দাদির বড় ভগ্নিপতি আকন বাড়ির মানিক মাষ্টারের বাড়িতে থাকলাম। দিনের বেলা বাড়ি এসে ঘুরে যেতাম। দাদি-দাদাও পাশের কোন এক বাড়ি যেয়ে রাত কাটাতেন।

মানিক মাস্টার সাহেব এলাকার সবচেয়ে মান্য ও সচ্ছল ব্যক্তি ছিলেন। তার বড় ভাই জজ ছিলেন। উচ্চ শিক্ষিত দুই ছেলে কাষ্টমস অফিসার। আমরা ঘনিষ্ট আত্মীয় হিসেবে এদেরই জানতাম। মাস্টার সাহেবের ঘরের মুখোমুখি ঘরটি ছিলো দাদির ছোট ভাইয়ের। মূলত ওটিই দাদির বাবার বাড়ি। দাদির বড় ভাই ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার। তিনি বাড়ি করেছিলেন বাড়ৈখালির শিরিশ তলার কাছাকাছি। আমরা ছোট সময় দাদির সাথে সেই বাড়ি বেশি বেড়াতাম। তাদের পুকুরে ছিলো প্রচুর মাছ। তারা কী ভালো মানুষ ছিলেন, আমাদের যে কত আদর-যত্ন করতেন, আপ্যায়নের কত যে আয়োজন করতেন, যেন ফুরায় না।

কিন্তু কিছু দিন আগে গিয়ে দেখলাম, তাদের বাড়ির ছোট জুমা মসজিদ ঘরটি নেই, নামাজের ব্যবস্থা তো নেই-ই, মসজিদের ফাঁকা ভিটায় দাঁড়িয়ে এলাকার ছেলেরা ক্রামবোর্ড খেলছে!

এখন আর সেই লোক নেই, আত্মীয়দের পরস্পর ঘনিষ্টতা নেই, সৌহার্দের পরিবেশ নেই, ঐতিহ্যের প্রতি যত্ন নেই; সর্বত্র ‘রাজনীতির’ গন্ধ। রাজনীতি দিয়ে মাপা হয় আত্মীয়-অনাত্মীয়। দলকানাদের জ্বালায় এখন কথা বলাও বিপজ্জনক।

বাড়ৈখালির শিরিশ তলায় ছিলো এলাকার সবচেযে বড় ঈদগাহ। এখানে বিরাট ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হত। এই ঈদগাহ ও দীঘির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন দাদির বড় ভাই মাস্টার সিরাজুল ইসলাম। তিনি তাঁর যোগ্য আলিম-ভাগ্নে আমার বাবা-কাকার দ্বারা এখানের ঈদের জামাতের আয়োজন করতেন। প্রথম দিকে আমার বাবাই এখানের ইমামতের দায়িত্ব পালন করতেন। বাবা খুলনায় মসজিদের চাকরি নেওয়ায় ও সেখানের খালিশপুরের আলম ডাঙ্গায় মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করায় ওখানেই ঈদের নামাজ পড়াতেন। এরপর থেকে বহু বছর কাকা শিরিশ তলার ইমামত করেছেন।

আমাদের সময়ে বৌডুবি ঈদের জামাত ভালো জমত না। তখন এখানে ঈদের জামাত অনুষ্ঠানের ভালো ব্যবস্থাও ছিলো না। এখন তো দেয়াল ঘেরা টাইলস সাজানো ঝকঝকা ঈদগাহ। কিছুটা উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু গতবার দেখলাম, ছেলেরা সেখানে ব্যাডমিন্টন খেলছে। বলেছিলাম, তোমরা কি মসজিদে এভাবে খেলার সাহস পাবে? যদি না পাও, তবে এখানেও পারো না। জানা উচিত, মসজিদ ও ঈদগাহ সমান সম্মানের জায়গা। চেয়ারম্যান সাহেবকেও বলে এসেছিলাম, ঈদগাহ টাইলস করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। সকলকে সাথে নিয়ে এর মর্যাদাও রক্ষা করতে হবে।

আমরা বুঝতে শেখার সময় থেকে বৌডুবির রাস্তাটি পাকা দেখে আসছি। চালনা-লাহুড়ি সড়ক। চালনা বলতে ‘রাঙা পুল’ বোঝতাম। বৃটিশ-কালে নির্মিত লাল রঙের বেইলি ব্রিজ। এই ব্রিজটি পারেরহাট-পিরোজপুর সড়কে অবস্থিত। পারেরহাট এ অঞ্চলের বড় বন্দর বাজার। জিয়া নগর (ইন্দুরকানি) তখন ছোট একটি হাট মাত্র। এখন উপজেলা সদর। ধান চাল ও নারকেল সুপারির বড় বাজার হিসেবে পারেরহাটের বেশ খ্যাতি ছিলো।

বৃটিশ আমলে মঘ ও পর্তুগিজদের উৎপাত রোধে পিরোজপুরের দক্ষিণে প্রথম যে থানাটি গড়ে ওঠে সেটি জলথানা এবং এটি স্থাপিত হয়েছিলো ১৭৯৭ সালে কচা নদীর টগড়া মোহনায়। পাড়েরহাট ছিল টগরা থানার প্রধান কেন্দ্র। বর্তমান পিরোজপুর, ভান্ডারিয়া, কাঠালিয়া, বামনা, পাথরঘাটা, মঠবাড়িয়া ছিলো এ থানার অন্তর্গত। স্বাধীনতার পরে প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পেলে জলথানাটি পারেরহাটে স্থানান্তরিত হয়। জলথানার লাগোয়া ছিলো লঞ্চ টার্মিনাল। বিশাল চরের কারণে এখন পারেরহাটে টার্মিনাল নেই। লঞ্চ ভেড়ে না। বড় কোন নৌযান বাজার-ঘাটে প্রবেশ করতে পারে না। সেই চরে এখন ভূমিহীনদের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে বিপুল আবাসন।

পারেরহাট এখন প্রায় নির্জ্জীব।

সাগর থেকে শিকার করে আনা মাছের আড়তটিও আগের মতো সরগরম নয়। এক সময় এ অঞ্চলের মাছের যোগান দিত পারেরহাটের মাছের আড়ৎ। এই সূত্রে এখানে বেশ কয়েকটি বরফ কল গড়ে ওঠেছিলো। এখনো আছে, তবে আধমরা অবস্থা।

এখন এ এলাকায় ফল-ফসল মোটেই ভালো জন্মে না। সিডরের পরে নারকেল সুপারির উৎপাদন কমেছে পঞ্চাশ ভাগ। সিডর দুমড়ে-মোচড়ে দিয়েছে প্রায় সব গাছ। এ এলাকার ধানী জমিন এখনও এক ফসলি। কৃষক ও কৃষি-গৃহস্থ্যগুলোর জান যায় দশা। কোন রকম টিকে থাকা।
জেলা শহর পিরোজপুরে এখনও মিল-কারখানা গড়ে না ওঠায় কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে না। অন্য জেলাগুলোর তুলনায় এখানে প্রবাসীও হাতে গোণা। অতএব রেমিটেন্স নেই। নগদ টাকা নেই। অধিকাংশের ভরসা সুপারি ও ধান চাষ। অধিকাংশ গৃহস্থ্য বছরের খোরাকি গোলায় তোলতে পারেনা। এক কালের সক্ষম গৃহস্থ্যের সুখ-মুখরিত সজীব জনপদটি ক্রমে ধূসর-মলিন ও স্বপ্নহীন মানুষের আবাসে পরিণত হয়েছে।

আমাদের শৈশবে সুখ ও সম্প্রীতির কী মাখামাখি ছিলো! সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়ার সে কী উৎসব! সে সময়ও অভাব ছিলো, দুঃখ ছিলো, তবে যন্ত্রণা ও বেওফায়ি ছিলো না। সবাই আদব-লেহাজ বজায় রেখে চলত। বড়কে মান্য করত। বিপদে-আপদে পরস্পর পাশে দাঁড়াত। অভাবের সময়, বিশেষত কার্তিক মাসে দাদা সাধ্যমত সাহায্যপ্রার্থীদের হাতে চাল-ডাল তুলে দিতেন। অনেককে চাল ধার দিতেন। দাদার প্রতি পড়শিদের কৃতজ্ঞতার কথা আমরা এখনো অনুভব করি। দাদার মৃত্যুতে আফসার পেয়াদার অঝোর কান্না তার প্রতি লোকদের আস্থা ও শ্রদ্ধার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি আমাদের রক্তের আত্মীয় ছিলেন না। কিন্তু তারসহ অনেকের সাবলম্বি হওয়া ও প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পেছনে দাদার সাহায্য ও উদারতার কথা তারা এখনো চোখের পানি ঝড়িয়ে স্বীকার করেন।

তখন সব পরিবারে ছোটদের লেখাপড়ার প্রতি তাকিদ ছিলো। দলবেঁধে ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যেত। স্কুল-মাদরাসা ছুটি হলে সে কী হৈচৈ। বিকেলের খেলার মাঠ ছিলো উচ্ছ্বাসের জোয়ারে টলমল।

সে সময়ের কিশোর-যুবকদের মনে স্বপ্ন ছিলো। বড় হওয়ার স্বপ্ন। চাকরি পায় না বলে এখন আর লেখাপড়ার প্রতি যুবকদের আগ্রহ দেখা যায় না। স্বপ্নহীন শিক্ষিত যুবকদের ভারে সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার পালা।

কেবল চাকরির জন্য লেখাপড়া—সুস্থ নৈতিকতা এই চিন্তা সমর্থন করে না। যে কারণে, এখন শিক্ষার হার বাড়লেও, উচ্চ শিক্ষার সুযোগ অবারিত হলেও, এই শিক্ষা বড় মানুষ গড়তে পারছে না। উন্নত নৈতিক মানুষ তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছেনা। অথচ রাষ্ট্রের দরকার উন্নত নৈতিক মানুষ। যে আমানতদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু প্রশাসনের কোথাও আমানতদারির ছিটেফোঁটাও আছে? এই দৈন্যের কারণ আমাদের দুর্বল শিক্ষা ব্যবস্থা। এই শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত মানুষ তৈরি করতে পারছে না।

আমাদের বাড়ির বেশ কয়েকজন ছিলাম প্রায় সমবয়সী। এক সাথে ঘুমাতে যাওয়া, ঘুম থেকে জেগে ওঠা, মসজিদে যাওয়া, সকালে মাদরাসা, দশটায় স্কুল, হুজুরের কাছে অংক কষাসহ হাতের লেখা এবং বিকেলে খেলা ছিলো প্রতিদিনের রুটিন।

বিশাল একটি ঘরে তিন দাদার তিনটি পরিবার আলাদা থাকলেও আসলে তারা ছিলেন একই পরিবারের মতো। দাদারা সবাই শিক্ষিত ছিলেন। সেজ দাদা উত্তর ভারতের সাহারানপুর থেকে মেশকাত পড়ে এসেছিলেন। তিনি বেশ কয়েক বছর থানুভি রাহ.-এর সান্নিধ্যেও ছিলেন। আমার বাবা-কাকাও গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় দাওরা হাদিস পড়েছেন গত শতকের পঞ্চাশের দশকে। সেই সুবাদে দক্ষিণবঙ্গের আলিম-ওলামার সঙ্গে আমাদের পরিবারের বেশ সখ্যতা ছিলো। সদর সাহেব শামছুল হক ফরিদপুরি রাহ. বেশ কয়েক বার আমাদের বাড়ি ও মাদরাসায় মেহমান হয়েছেন। পীরজি হুজুরও আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছেন। শহিদ আওলাদে রাসুল মোস্তফা মাহমুদ আল-মাদানি রাহ.-এর বেড়ানোর কথা তো আমারও মনে আছে। তার মাখানো কোর্মা-পোলাও খেয়েছিলাম বরকতের উদ্দেশ্যে। তার ফেরেশতার মতো চেহারা-সুরত এখনো আমার চোখের তারায় ভাসে। পুরুষ এতো সুন্দর হতে পারে! সাদা ত্বক, তরবারির ফলার মতো নাক, টলোমলো উজ্জ্বল চোখ, সাদা দাড়ি, সাদা জুব্বা, সাদা রুমাল, মুক্তোর মতো ঝলকিত দাঁতসহ নিটোল দীর্ঘ দেহ—তিনি ছিলেন এ সময় পর্যন্ত আমার দেখা সব চেয়ে সুন্দর পুরুষ। বরিশালের মাহমুদিয়া মাদরাসা তাঁরই হাতে প্রতিষ্ঠিত।
স্বাধীনতার পর পর ঢাকার অদূরে মোস্তফাগঞ্জের এক সভায় তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছিলো। কারা মেরেছিলো ফেরেশতার মতো এই লোকটিকে? এই আওলাদে রাসুলকে?

১৭, ৭, ২০২১
[অসমাপ্ত]

আগের সংবাদঢাকা
পরবর্তি সংবাদপ্রধান ধর্মসমূহে আকিদা : সাধারণ প্রতিতুলনা