রুপান্তর : আবদুল্লাহ মারুফ
মসজিদে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। কানায় কানায় ভরে গেছে। এইমাত্র যারা আসছেন, যারা একটু চালাক ভীড় ঠেলে দৌড়ে উপর তলায় গিয়ে ছাদে একটুখানি জায়গা তালাশ করছেন সিজদা দেবার জন্য; কিন্তু নেইㅡ সব লোকে লোকারণ্য। নিচে নেই, উপরে নেই, কোথাও নেই একটুখানি জায়গা, সব পূর্ণ!
হ্যাঁ, এই হলো কানপুর মসজিদ। হযরত থানবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এই মসজিদে তারাবির নামাজ পড়ান। তিনি নিজে তিলাওয়াত করেন, নামাজে দাঁড়িয়ে, তাদাব্বুরের সঙ্গে প্রতিটি হরফ, আয়াত উচ্চারণ করে অত্যন্ত ভক্তি নিয়ে পড়তে থাকেন কালামুল্লাহ শরীফ। তখন মনে হয় যেনো এই বুঝি নাজিল হচ্ছে ঐশ্বরিক কোনো বার্তাㅡ তিনি ইতমিনানের সঙ্গে আবৃত্তি করতে থাকেন, ধীরেসুস্থে। আর তাকওয়ার ঐশ্বর্যপূর্ণ এই জামাতে শরিক হবার জন্য ঢল নামে মানুষের।
কেউ যদি ইফতার করে মাগরিব পরপরই কানপুর মসজিদে ছুটে যায়, তবেই কেবল সম্ভব মসজিদে জায়গা ধরা। নইলে, একটু যদি দেরি হয়ে যায় তাহলে মসজিদ চত্বরে পা ফেলারও জায়গা পাবে না আর। এমন ছিলো প্রতিযোগিতা।
হযরত থানবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রায়সময় নিজেই তারাবি পড়াতেন। প্রথম দিকে সোয়াপারা একপারা করে পড়ে সাতাশ রমজানে খতম শেষ করতেন। মালুমাতে আশরাফিয়াতে লেখা হয়, হযরত থানবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহির কুরআন কারীম এই পরিমাণ ইয়াদ ছিলো, একটি শব্দ বা আয়াত যদি জিজ্ঞেস করা হতো, সঙ্গে সঙ্গে বলে দিতেন অমুক পারায় অমুক পৃষ্ঠায় এতো নম্বার আয়াতে এটি রয়েছে। যেনো সমগ্র কুরআন কারীম তাঁর চোখের সামনে মেলে ধরা!
রমজান এলে কুরআন কারীমের সঙ্গে সম্পর্ক হতো আরো গাঢ়। সর্বদা মুখে-ঠোঁটে লেপটে থাকত কুরআন কারীমের আয়াত। তারাবিতে তারতিলের সঙ্গে পড়তেন। কখনো যদি দ্রুত পড়তেন, তবুও প্রতিটি হরফ পষ্ট বোঝা যেতো। মদ-গুন্নাহ সব ঠিক থাকত। এভাবে সোয়াঘন্টা বা আরেকটু বেশি-কম সময়েরর মধ্যে তারাবি শেষ করতেন।
আড়ম্বর নেই খতমের দিন
সাতাশ রমজানে এইযে মসজিদ ভরে যায়, নতুন মুসল্লিদের আগমন আর হরেক রকম আয়োজনㅡ ফিরনি মিঠাই বিতরণㅡ এইসবের বালাই ছিলো না হযরত থানবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মসজিদে। সাতাশ রমজানে যেই চিত্র, শুরুদিন থেকেই একই চিত্র মসজিদের। সেদিন বিশেষভাবে কোনো আয়োজন করা হতো না।
একলোক একবার হযরত থানবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহিকে বললেন, হুজুর, আমি একটু মিঠাই-ফিরনি খাওয়াতে চাই, যদি অনুমতি হয় তো ব্যবস্থা করি। হযরত থানবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, তুমি আজকে নয়; কালকে সবাইকে খাওয়াও।’ এই বলে তাকে সান্ত্বনা দেন।
খতম এবং তার পরের দিনগুলো
হযরত থানবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি খতমের দিন সুরা আলাকের শুরুতে বিসমিল্লাহ জোরে পড়তেন। তারপর খতম শেষ করে সুরা বাকারার কয়েক আয়াত পড়তেন, মুফলিহুন পর্যন্ত। খতম শেষ হয়ে যাবার পর বাকি তিনদিনের তারাবির রুটিন ছিলো, প্রথমদিন সুরা দোহা থেকে শেষপর্যন্ত পড়তেন; দ্বিতীয় দিন ‘আলাম তারা কায়ফাফা’ দিয়ে শুরু করে শেষপর্যন্ত, আর তৃতীয় দিন, অর্থাৎ ত্রিশতম তারাবিতে সুরা নাবা দিয়ে শুরু করে অর্ধপারা পর্যন্ত পড়তেন।
তারাবির মধ্যে সিজদার আয়াতে কখনো সিজদা করতেন, কখনো আবার রুকু করতেন। আর প্রতি তারাবির পর বিশবার দরূদ শরীফ পড়তেন। এই ছিলো তারাবির রুটিন।
ইফতার
সাধারণত মাদরাসায় ইফতার করতেন। মেহমান নিয়ে, জামাতের সাথে ইফতার করতেন। ইফতারিতে ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম ছিলো না যে খেজুর লাগবেই, জমজমপানি বা এই এই লাগবে। বরং ইফতারির সময় সামনে যা পেতেন, যেটা সহজ হতো তাই দিয়ে ইফতার করতেন।
ইফতারি করতেন একটু ধীরেসুস্থে, তবে ঠিক ঠিক সময়ে আজান হয়ে যেতো মাগরিবের। ইফতারির পর কুলি করতেন, তারপর নামাজে দাঁড়াতেন। আর এই সময়টায় মহল্লাবাসী আরামের সঙ্গে এসেও তাকবীরে উলা ধরতে পেতো। মাগরিবের পর আউয়াবিন পড়তেন। সাধারণত ছয় রাকাত পড়তেন। কখনো বসে পড়তেন, কখনো আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
তাহাজ্জুদ
হযরত থানবি রাহমাতুল্লাহি আলিইহির সারাবছরের রুটিন ছিলো, রাতের অর্ধেক পেরিয়ে যাবার পর তাহাজ্জুদের জন্য উঠতেন; বা আরো পরে, কখনো কখনো রাতের শেষাংশে নামাজে দাঁড়াতেন। আট রাকাত করে তাহাজ্জুদ পড়তেন। কিন্তু রমজান রুটিন ছিলো এই, তারাবির পর ঘরে গিয়ে ঘরের লোকদের নিয়ে চার রাকাত নামাজ পড়তেন। এই করে বারোটা। তারপর একটু শুয়ে দুইটার দিকে আবার তাহাজ্জুদের জন্য দাঁড়িয়ে যেতেন। নিত্য একপারা বা আরো বেশি করে পড়তেন।
হযরত থানবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি যখন তাহাজ্জুদে দাঁড়াতেন, তখন তাঁর শরীর থেকে একটি আলো বের হয়ে উপরের দিকে উঠতো। এবং আলোটির ঔজ্জ্বল্যে হযরত থানবী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির শরীর ঝকমক ঝকমক করতে থাকতো। শুভ্রআলোর নাচন শুরু হয়ে যেতো পুরো অঙ্গে। এবং সাদারশ্মি উপরের দিকে উঠতো। (মালুমাতে আশরাফী)
মসজিদে তাহাজ্জুদে দাঁড়ালে কেউ কেউ পেছনে সারিবদ্ধ হতো। কিন্তু হযরত থানবী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাহাজ্জুদে জামাতের ইহতিমাম করতেন না। তাই দেখা যেতো, লোকেরা দাঁড়ালে দুই রাকাত পড়ে বলতেন, চলো সাহরী খেয়ে নিই। তারপর বলে দিতেন, সাহরী খেয়ে বাকি নামাজগুলো তোমরা একাকি পড়ে নিয়ো। তবে, মাঝেমধ্যে আবার জামাতের সঙ্গেই পড়তেন।
ইতিকাফ
হযরত থানবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি শেষ দশকের পুরো সময়টাই ইতিকাফে কাটাতেন, বা, কখনো কখনো আবার শুধু তিনদিন ইতিকাফ বসতেন। ইতিকাফে বসেও তিনি লেখালেখি চালু রাখতেন। ‘কসদুস সাবিল’ কিতাবটি ইতিকাফে বসেই আটদিনে সমাপ্ত করেছেন। এবং এই কিতাবের সঙ্গে একই সময়ে আরো একটি কিতাব লিখেছেন।
হেঁটে চলেন আল্লাহর অলি
আমরা সাধারণত মনে করি অলি-দরবেশ তারাই, যারা সর্বদা তাসবিহ হাতে বসে থাকেন। এই সম্পর্কে হযরত থানবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ‘আওয়াম সাধারণত তাদেরকেই দরবেশ মনে করে, যাদেরকে তারা অধিক তিলাওয়াত করতে দেখে, বা জিকিররত দেখে। মসজিদে বসে থাকলে আর সর্বদা হাতে তাসবিহদানা নিয়ে ঘুরলে লোকে তাকে কামেল দরবেশ মনে করে।
আর যেইসমস্ত হযরতগণ অন্যের উপকার করতে গিয়ে, খিমদতে খালকে সময় ব্যয় করে অতটা সময় সুযোগ পান না তিলাওয়াত করবারㅡ লোকে তাদেরকে অসম্পূর্ণ এবং কম আমলদার মনে করে। অথচ তারা যে গলত ফায়সালা করে একজন নেককার মানুষকে গোমরাহ বলে চিহ্নিত করে নিজেদের আখেরাত খারাপ করছে, এটা তারা নিজেরা বুঝতে পারছে না।’
এরপর হযরত থানবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘ফজরের পর নিজের জায়গায় বসে তাসবিহ-তাহলিল ও তিলাওয়াতে মশগুল থেকে ইশরাক পড়ে কেউ যদি উঠে, হাদীসের ভাষ্যমতে সে একটি হজ ও উমরার সাওয়াব পায়। তবে এছাড়া আরো কিছু আমল আছে। আমার যওক হলো, ফজরের পর চল্লিশ কদম হাঁটা এবং তিলাওয়াত করা।’
এই হিসেবে হযরত থানবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহির প্রত্যেহ নিয়ম ছিলো, ফজরের পর প্রায় দুই মাইল হাঁটতেন। হেঁটে হেঁটে কুরআন কারীমের এক মনজিল তিলাওয়াত করতেন, মুনাজাতে মকবুলের এক মনজিল পড়তেন। তারপর গিয়ে ইশরাকের নফল নামাজ পড়তেন। যেহেতু তিলাওয়াতের এই অংশটুকু তাদাব্বুরের সঙ্গে হতো, তাই ফিকহি অনেক মাসআলা, তাসাউফের অনেক জবাব এবং প্রশ্ন আয়াত তিলাওয়াতের মাধ্যমে হল হয়ে যেতো। হাঁটাচলা অবস্থায় যেহেতু এগুলো ভুলে যাবার সম্ভাবনা থাকে, তাই কাগজে টুকে রেখে রুমে গিয়ে বিস্তারিত লিখে ফেলতেন।
বাহ্যত একে যদিও হাঁটাচলা মনে হতো, অথচ এটি ছিলো ইলমি এবং ইসলাহি জ্ঞানের অনেক বড় অধ্যয়নস্থল। আল্লাহর অলি হেঁটে যেতেন, তাঁর পা দুটো এগোতো, রাস্তার লোকদেরকে তিনি হালপুরসি করতেন, জিজ্ঞাসা করতেন, সমস্যার সমাধান দিতেন; সেই সঙ্গে সমাধান বের করতেন জটিল জটিল মাসআলার। রাহিমাহুমুল্লাহ।