আশ্রয়

আমিনুল ইসলাম হুসাইনী:

দরজাটা খুলতেই এক ঝাপটা হীম এসে আছড়ে পড়ে আব্দুল আলিমের নাকে-মুখে। তিনি ডানহাত দিয়ে কুয়াশার ঘনত্ব মাপার চেষ্টা করেন। পাশ থেকে জুবাইদা বেগম বলেন, এই ঠাণ্ডার ভেতর না বেরুলে হয় না? আজকের ফজর নামাজ না হয় ঘরেই আদায় করে নিলেন।

আব্দুল আলিম এক চিলতে হাসি দিয়ে বলেন, দুনিয়ার এই ঠান্ডার ভয়েই যদি কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘরে বসে থাকি, তাহলে কবরের ঠান্ডার কী হবে?

স্বামীর এমন আধ্যাত্মিক কথার পৃষ্ঠে জুবাইদা বেগম আর কথা তুলতে চাইলেন না। আব্দুল আলিম ডান পা বাড়িয়ে মসজিদের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরেন। হাঁটতে হাঁটতেই মুখে গুনগুন সুর তুলেন, মনে বড় আশা ছিল যাব মদীনায়/সালাম আমি করব গিয়ে নবীজির রওজায়…

শেখ বাড়ির সামনে আসতেই হঠাৎ ব্রেক কষেন তিনি। অস্পষ্ট একটা আওয়াজ এসে বাড়ি খায় তার কানে। আব্দুল আলিম খরগোশের মতো কান খাড়া করে আওয়াজের উৎস খোঁজার চেষ্টা করেন। খানিক পরেই আওয়াজটা পুনরায় শেখবাড়ির পূবের ঝোঁপ থেকে উঠে আসে। আব্দুল আলিম সেদিকেই এগিয়ে গেলেন। গিয়ে যা দেখলেন, তাতে তার অন্তরাত্না কেঁপে ওঠে। ছেঁড়া কাঁথায় মোড়ানো ফুটফুটে একটি বাচ্চা। বাচ্চা তো নয়, যেন এক টুকরো চাঁদ। এমনই এক টুকরো চাঁদের জন্য গত ছয়টি বছর কতো জায়গায়ই না মাথা ঠুকেছেন তিনি আর তাঁর স্ত্রী জুবাইদা বেগম। দু’ তিন বছরের বাচ্চারা যখন জুবাইদা বেগমের সামনে দৌড়াদৌড়ি করতো, তখন চৈত্রের মাটির মতো হাহাকার করে ওঠতো তার মাতৃত্ব। একটি সন্তানের জন্য কতো ডাক্তার কবিরাজের কাছে ছোটাছুটি করেছেন। করেছেন মাজারে মাজারে মানত। কিন্তু ফলাফল বরাবর শূন্য। একদিন এক মাওলানা আব্দুল আলিমকে বলেন, মৃত মানুষের কাছে না চেয়ে, আল্লাহর কাছে চাও। তিনিই একমাত্র ভরসা। সেদিন থেকেই জুবাইদা বেগম আর আব্দুল আলিম আল্লাহর ইবাদতে মনোনিবেশ হন। অতঃপর আল্লাহ তাদের প্রার্থনা শুনলেন। জুবাইদা বেগমের কোলও ভরে দিলেন এক ফালি চাঁদে। নতুন অতিথির আগমনে আনন্দের হিল্লোল বয়ে গেল আব্দুল আলিমেরর আত্মীয় স্বজনদের মাঝে। আব্দুল আলিম ছেলের নাম রাখলেন স্বপ্ন।

আব্দুল আলিমের চোখ ভিজে ওঠে ঝোঁপে পড়ে থাকা শিশুটির জন্য। তিনি মনে মনে ঠিক করেন এই নিষ্পাপ শিশুটিকে জুবাইদা বেগমের কোলে তুলে দেবেন। স্বপ্নের সাথে তাকেও লালনপালন করবেন। আহা! বেচারি জুবাইদা এই চাঁদেরকণা পেয়ে কী খুশিটাই না হবে! খুশির এক ঝিলিক ফুটে ওঠে আব্দুল আলিমের চেহারায়ও। কিন্তু পরক্ষণেই বোশেখের মেঘ এসে ছেয়ে যায় তাঁর ভেতর-বাহিরে। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে, পরিচয়হীন এই শিশুর জন্যে তার ছেলের ক্ষতি হয়ে যাবে না তো!

এম. এ. পাশ করার পরপরই ‘স্কাই গ্রুপ’-এ স্বপ্নের ভালো একটি চাকরি হয়। প্রথম মাসেই সেলারি ধরা হয় ৩৫ হাজার টাকা। সেই সাথে ফ্ল্যাটেরও সু ব্যবস্থা। তবে ফ্ল্যাট পেতে হলে বিয়ে করতে হবে। আব্দুল আলিম সাহেব পাত্রী দেখা শুরু করেন। পচ্ছন্দও করেছেন কয়েকজনকে। কিন্তু সেসব মেয়ে পছন্দ হল না স্বপ্নের। হবেই বা কেমন করে? ওর যে পছন্দ করা মেয়ে আছে। কথাটা শুনে আব্দুল আলিম প্রথমে কষ্ট পেলেও পরে স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেন। ছেলের পছন্দের মেয়ের সাথেই বিয়ের দিন নির্ধারিত করেন ২২ শে শ্রাবণ, শুক্রবার।

একমাত্র ছেলের বিয়ে, তাই আব্দুল আলিম সাহেব আড়ম্বরতার কমতি রাখেননি। জুবাইদা বেগমও পুত্রবধূর হাতে সংসারের চাবি তুলে দিয়ে বলেন, আজ থেকে লক্ষ্মীকে তোমার হাতে তুলে দিলাম। এই ঘর, এই সংসার সবই এখন তোমার। আমার এবার ছুটি।

মধ্যবিত্ত আব্দুল আলিম সাহেব ছেলে স্বপ্নকে নিয়ে কতোই না স্বপ্ন দেখেছিলেন। নিজের যা কিছু ছিল তার সিংহভাগই বেঁচে দিয়েছিলেন ছেলের উচ্চ শিক্ষার জন্যে। ছেলের কাছে খুব কি বেশি চাওয়ার ছিল তাঁর? শেষ ক’টা দিন ছেলের পিঠে হেলান দিয়ে কাটিয়ে দেয়ার প্রত্যাশাটা কি আব্দুল আলিম সাহেবের অন্যায় ছিল?

বিয়ের পরের বছরই পুত্রবধূ জেরিন স্বপ্নকে নিয়ে উড়াল দেয় সুইডেন। স্বপ্ন প্রথম প্রথম বাবা মায়ের খোঁজখবর রাখলেও মাস ছয়েক পর
যোগাযোগের তারটা কেটে দেয়। আব্দুল আলিম সাহেব শত চেষ্টা করেও সেই তার আর জোড়া লাগাতে পারেননি। তাই স্বপ্ন হারিয়ে গেল স্বপ্নের মতোই। আব্দুল আলিম একা হয়ে গেলেন আবারও।

সম্বলহীন আব্দুল আলিম আর জুবাইদা বেগম কচুরিপানার মতো এ ঘাটে ও ঘাটে ভাসেন। ঠাঁই হয় না কোথাও। এমনই দুঃসময়ে মাসুম সাহেব তাদের পাশে এসে দাঁড়ান। মাসুম সাহেবের সাথে তাদের দেখা হয় বিমানবন্দর রেলস্টেশনে। সহায় সম্পত্তির যতটুকু ছিল তা দিয়ে বছর দুয়েক চলার পর আর কোনো কূল না পেয়ে আব্দুল আলিম স্ত্রী জুবাইদা বেগমকে নিয়ে ঢাকায় চলে এসেছিলেন। ঢাকায় এসে বুঝতে পারেন এই সমাজে অচল পয়সার মতোই জরাজীর্ণ বুড়োদের কোনো মূল্য নেই। দিন কয়েক বিভিন্ন মিল কারখানায় ঘুরেও যখন কোনো কাজ জুটাতে পারলেন না, তখন বাধ্য হয়েই মানুষের কাছে হাত পাতেন। কিন্তু সেটাও ঠিকমতো করতে পারলেন না অনভিজ্ঞতার কারণে। তার এই অনভিজ্ঞতা ধরা পড়ে মাসুম সাহেবের চোখে। তিনি আব্দুল আলিমকে জিজ্ঞেস করেন, চাচা! আপনাকে দেখে তো স্বভাবজাত ভিক্ষুক বলে মনে হচ্ছে না।

এতটুকু বলার পরই আব্দুল আলিম হু হু করে কেঁদে ওঠেন। ওনার কান্না দেখেই মাসুম সাহেব বুঝতে পারেন নিশ্চয় কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে তিনি এ পথে নেমেছেন। আব্দুল আলিমের কাহিনী শুনে মাসুম সাহেব শ্রদ্ধার সাথে বললেন, ইচ্ছে করলে আপনি আমাদের সাথেই
থাকতে পারেন। আপনার মতো আরো অনেকেই আছেন আমাদের সাথে। আমরা সবাই একে অপরের গল্প শুনি। সুখ দুঃখ ভাগ করি।

মাসুম সাহেব সেদিনই আব্দুল আলিম ও জুবাইদা বেগমকে একটি সি এন জি’তে করে তার বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। বাড়িতে পাঠানোর আগে মাসুম সাহেব আব্দুল আলিমকে বলেন, এক সাপ্তাহর সফরে লন্ডন যাচ্ছি। তাই আপনাদের সাথে যেতে পারছি না। আল্লাহ চাহে তো ফিরে এসে অনেক গল্প করব।

এক সাপ্তাহের সফর শেষে মাসুম সাহেব ফিরে আসলে ‘ওয়ালিদাইন’ মঞ্জিল উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। মাসুম সাহেব প্রথমেই আব্দুল আলিম সাহেবের সাথে দেখা করেন। সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কেমন আছেন চাচা? এখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?
আব্দুল আলিম সাহেব সালামের জবাব দিয়ে বলেন, আলহামদুলিল্লাহ! বেশ ভালো আছি বাবা। আপনি কেমন আছেন?
-চাচা, আমি আপনার ছেলের বয়সী। আমাকে তুমি করেই বলুন।
-না না, সে কি করে হয়। আপনি সম্মানী মানুষ।
-না চাচা, আমি সাধারণ এক মানুষ।
-আপনি অনেক মহান। সত্যিই আপনার বাবা মা ধন্য, আপনার মতো সন্তান পেয়ে। খুব ইচ্ছে হয় আপনার বাবা মা’কে এক নজর দেখার।

আব্দুল আলিমের কথা শুনে মাসুম সাহেবের মুখটা কিঞ্চিৎ মলিন হয়ে ওঠে। ছোট্ট একটি শ্বাস ছেড়ে বলেন, আমার বাবা মা’কে তো আমিই দেখিনি চাচা। আপনি দেখবেন কীভাবে?
-দুঃখিত বাবা! না জেনে তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম। আল্লাহ ওনাদের জান্নাত দান করুন।
-আমিন।
-আচ্ছা কীভাবে মারা গেলেন?
-মারা গেছেন নাকি বেঁচে আছেন তার কিছুই তো জানি না চাচা। আসলে আমি আমার জন্ম পরিচয়ই জানি না। কে আমার বাবা আর কে আমার মা, তার কিছুই জানি না আমি।

মাসুম সাহেবের এমন কথায় বিস্মিত আব্দুল আলিম বলার মতো কথা খুঁজে পান না। অতচ মাসুম সাহেব নির্দ্বিধায় বলে যাচ্ছেন, বুঝ হওয়ার পর জানতে পারি আমি যাদের বাবা মা বলে ডাকি তারা আমার আসল বাবা মা নন। আমাকে তারা এক ঝোঁপ থেকে কুড়িয়ে পেয়েছেন। আমার মা’ই হয়তো আমার জন্য সমাজে কলঙ্কিতা হতে চাননি, আবার নাড়িছেঁড়া সন্তানকে গলা টিপে মারতেও পারেনি চোখের মায়ায়। তাই রাতের আঁধারে শেখ বাড়ির ঝোঁপঝাড়ে টুপ করে রেখে আসেন।
-কী বললেন! শেখবাড়ি!
-জ্বি চাচা। আমি যাঁদের কাছে বড় হয়েছি তারা আমাকে এ কথা’ই বলেছেন।
– তারা কারা?
– মাওলানা শরিফুল ইসলাম। তিনিই ওই ঝোঁপ থেকে আমাকে তুলে নিয়েছিলেন। নিজের সন্তানের মতো লালন পালন করেছেন। লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করেছেন। তিনিই আমায় বলেছিলেন সমাজে জন্ম পরিচয়হীনদের জারজ বলে মানুষ গালি দেয়। মানুষের ধারণা, জন্ম পরিচয়হীন এইসব সন্তানেরা মানুষ হতে পারে না । আমি সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত করতে চাই তোকে দিয়ে। তুই এটাই প্রমাণিত করবি জন্ম হোক যথাতথা কর্ম হোক ভালো।
আব্দুল আলিম পূণরায় মাসুম সাহেবকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি কি নোয়াপাড়া গ্রামে ইমামতি করতেন?
-জ্বি। কিন্তু আপনি জানেন কি করে?

আব্দুল আলিম সাহেবের চোখ গড়িয়ে নোনা পানি নেমে আসে। তাঁর স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে সেই ২৬ বছর আগের দৃশ্যটি। যেদিন তিনিই ওই ঝোঁপঝাড়ে এই মাসুমকে প্রথম দেখেছিলেন। নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তারই বাড়িতে। কিন্তু সেদিন ছেলে স্বপ্নের কথা ভেবে তার ঘরে আশ্রয় দেয়নি মাসুমকে। অথচ সেই মাসুমের ঘরই আজ তাঁদের আশ্রয়।

আগের সংবাদবিষাদের পথ মাড়িয়ে
পরবর্তি সংবাদআল-হামরার শেষ পুরুষ