রাকিবুল হাসান নাঈম:
সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপে মুসলিম ও ইসলাম বিদ্বেষ, অভিবাসন বিরোধিতা, কট্টর ডানপন্থী মনোভাব ও ফ্যাসিবাদী আচরণ-এর উত্থান ঘটেছে। উপসাগরীয় ও আরব অঞ্চলে ফুটবল বিশ্বকাপের মতো অনুষ্ঠান আয়োজনকে ইউরোপ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না। সম্প্রতি ফ্রান্সে ইসলামফোবিক একটি ম্যাগাজিনের একটি কার্টুনে কাতার জাতীয় ফুটবল দলকে সন্ত্রাস হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। সেখানে কাতারের ফুটবল দলের সদস্যদের পিস্তল ও বন্দুক বহন করতে দেখা যায়। তাদের পরনে টুপি এবং দাঁড়ি ছিল। যারা দাঁড়ি ও টুপি পরে তারা সন্ত্রাসী এ ধরনের মনোভাব ওই কার্টুনে ফুটে উঠে।
২০১০ সালে বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হিসেবে নির্বাচিত হয় কাতার। এই বিডিংয়ে কাতারের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার দৌড়ে বরং যুক্তরাষ্ট্রই এগিয়ে ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত ভোটাভুটিতে ১৪-৮ ব্যবধানে জয় পায় কাতার। বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বত্ব পাওয়ার পর থেকেই কাতারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণায় লিপ্ত হতে দেখা যায় পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোকে। মূলত কাতারে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, নারী স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে দেশটির অবস্থান, ইসলামি শরীয়াহ আইন, সমকামিতার বিপক্ষ অবস্থান ও অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি দেশটির আচরণ বিষয়ে অভিযোগ তুলে তারা। বিবিসি, গার্ডিয়ানের মতো গণমাধ্যম প্রায়ই নানা ইস্যুতে কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের নেতিবাচক দিক তুলে ধরে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গবেষক মাহমুদ আলুশ আল জাজিরার এক নিবন্ধে বলেন, পশ্চিমাদের এই প্রচারণা এবং বিষোদগার কাতার মুসলিম হবার কারণে। তিনি পশ্চিমাদের এই আচরণকে ইসলামফোবিক বলেও অভিহিত করেন।
পশ্চিমাদের ডাবল স্টান্ডার্ডবাজি
মাহমুদ আলুশের মতে, গত দুই দশক ধরে পশ্চিমাদের মধ্যে এই ধারণা প্রবল হয়েছে, আরব এবং মুসলিম মানেই সন্ত্রাসবাদের একটি সম্ভাব্য উৎস। একই ঘটনা ঘটছে কাতার ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজনের এই সময়েও। তারা বলছে, আরবে স্বাধীনতা নেই, মানবতা নেই, জঙ্গি হামলার আশঙ্কা আছে। এখানে বিশ্বকাপ করা যাবে না। অথচ এই অভিযোগগুলো পশ্চিমাদের ওপরই বেশি বর্তায়। আধুনিক যুগের আগে পশ্চিমের অন্ধকার ইতিহাস রক্তাক্ত ইতিহাস। এখন তারা বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিতে এবং রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের ধারণার বিকাশে আশ্চর্যজনকভাবে সফল হয়েছে। কিন্তু তারা প্রায়শই অন্য বিশ্বের উপর সাম্রাজ্যবাদ অনুশীলন করে এবং তার উপর বিতর্কিত সামাজিক মূল্যবোধ আরোপ করার চেষ্টা করে। ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেবল ইসরায়েল এবং তাদের স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে আরব অঞ্চলকে দেখে। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক ও আফগানিস্তানে দুই দশক ধরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চালিয়েছে। সিরিয়া ও ইরাকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। লাখ লাখ বেসামরিক নাগরিক হত্যা করেছে।
মাহমুদ আলুশ লিখেন, ইসলামোফোবিয়ায় আচ্ছন্ন একটি ফরাসি সংবাদপত্র কাতারি জাতীয় দলকে নিয়ে একটি কার্টুন প্রকাশ করেছে। যেখানে বন্দুক বহনকারী কাতারি খেলোয়াড়দের মুখে রাগ ও বর্বরতার চিহ্ন রয়েছে। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা যখন বিশ্বকাপের আয়োজক ছিল তখন আমরা এমন সমালোচনা শুনিনি। রাশিয়া যখন বিশ্বকাপের আয়োজক ছিল, তখন রাশিয়ার জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের সশস্ত্র হিসাবে চিত্রিত করে এমন একটি কার্টুন দেখিনি। অথচ রাশিয়া বিশ্বকাপের ৩ বছর পরই বলপ্রয়োগ করে ইউক্রেনীয় ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে দখল করে।
বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগের দিন ফিফার সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো কাতারের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের আচরণকে কড়া ভাষায় তুলে ধরেন। কাতারে মানবাধিকারের অবস্থা নিয়ে পশ্চিমাদের মায়াকান্নাকে স্রেফ ‘ভণ্ডামি’ বলে অবিহিত করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘গত ৩ হাজার বছরে ইউরোপিয়ানরা সারাবিশ্বে যা যা করেছে, তাতে আগামী ৩ হাজার বছর তাদের শুধু ক্ষমা চেয়ে বেড়ানো উচিত।’
কাতারের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগকে পশ্চিমাদের ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’ বলে মনে করেন ‘দ্য হেরাল্ড’ -এর সাবেক উপসম্পাদক কেভিন ম্যাককেনা। পত্রিকাটির এক নিবন্ধে তিনি লিখেন, গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, যৌন স্বাধীনতার অভাব, অভিবাসী শ্রমিকদের নির্যাতনের একই অভিযোগ রাশিয়া বা চীনের বেলাতেও থাকলে তাদের বেলায় পশ্চিমারা চুপ থাকে।
পশ্চিমাদের মুসলিমবিরোধী নগ্নরূপ
দ্য ইকোনমিস্ট-এর এক লেখায় বলা হয়েছে, পশ্চিমারা কাতারকে যেভাবে স্বৈরাচারী রাষ্ট্র মনে করে, সেখানে গলদ আছে। কাতার কিংবা আরব রাষ্ট্র নিয়ে অনেক সিদ্ধান্তই তারা নেয় কুসংস্কার বা ভুল ধারণা থেকে। এমনকি, পশ্চিমারা ধনী কিংবা মুসলমান দেশ বলেই কাতারকে অপছন্দ করে। চীন ও রাশিয়ার গণতন্ত্রহীনতার সঙ্গে কাতারের রয়েছে সুস্পষ্ট পার্থক্য। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি কোন ধরনের চাপ ছাড়াই এক ধরণের নির্বাচন প্রক্রিয়া অন্তত চালু করেছেন। কাতারের আছে আল জাজিরার মতো আন্তর্জাতিক মানের গণমাধ্যম। সে তুলনায় রাশিয়া বা চায়নায় গণতন্ত্র বা গণমাধ্যমের বিষয়টি আরও বেশি অনুপস্থিত। চীন দুবার অলিম্পিক আয়োজন করেও দেশটিতে গণতন্ত্রের কোন উন্নতি হয়নি। রাশিয়া বিশ্বকাপ আয়োজন করেও অন্যদেশের ওপর সাম্রাজ্যবাদ চর্চা করছে।
অভিবাসী শ্রমিক নিয়ে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করেছেন মাহমুদ আলুশ। তিনি লিখেন, কাতারের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১২ ভাগ কাতারি। বাকিদের সবাই মূলত দেশটিতে কাজ করতে আসা অভিবাসী শ্রমিক। ইউরোপ বা আমেরিকার তুলনায় কাতারে কাজের সুযোগও বেশি। শ্রমিক ব্যবস্থাপনার বিষয়টি পুরোপুরি আদর্শ না হলেও এখানে কাজ করে যা আয় করে তারা, তাতে তাদের জীবনও বদলে গেছে। উপসাগরীয় অঞ্চলের কাজ অনেক এশিয়ান শ্রমিকের একটি নতুন জীবন গঠনে সহায়তা করেছে। কিন্তু অভিবাসীদের সাথে ইউরোপীয় দেশগুলো কী করছে? ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টা করার সময় হাজার হাজার অভিবাসী সমুদ্রে মারা গেছে। ইচ্ছাকৃতভাবে ইজিয়ান সাগরে অভিবাসীদের ডুবিয়ে দেয় গ্রীস। আমরা কাউকে এই নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি করতে দেখিনি।
কাতারের বিরুদ্ধে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টের অভিযোগও করেছে পশ্চিমারা। উষ্ণ মরুর দেশ হওয়ায় কাতার বিশ্বকাপ উপলক্ষে স্টেডিয়ামগুলোয় ব্যবস্থা করেছে কুলিং সিস্টেমের। যার কারণে প্রচুর কার্বন নিঃসরণ হবে বলে অভিযোগ তুললেও ফিফা বলছে , কাতার বিশ্বকাপে হওয়া কার্বন নিঃসরণ এ বছর হওয়া বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের মোটে ০.০১ শতাংশ। মাহমুদ আলুশ লিখেন, যদি কার্বন নিঃসরণ নিয়ে কথা বলা হয়, তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলির সমালোচনা করা আরও বেশি যুক্তিযুক্ত হবে, যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের পরে কার্বন নির্গমনের ক্ষেত্রে বিশ্বের তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। আর কাতার রয়েছে ৫৮ তম তালিকায়।
হোমোফোবিয়া বা সমকামিতা নিয়েও অভিযোগ তুলেছে পশ্চিমারা। ইকোনমিস্ট-হেরাল্ডের মতো গণমাধ্যমে বলো হয়েছে, সমকামিতা যে কাতারে নিষিদ্ধ, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে শুধু কাতার নয়, প্রায় সব মুসলিম দেশেই নিষিদ্ধ সমকামিতা। একইভাবে বিয়ের বাইরে যে কোন সম্পর্ক অবৈধ দেশটিতে। তবে কাতারে এসব আইন ভঙ্গের দায়ে বিচারের ঘটনা কম। মাহমুদ আলুশের মতে, খেলাধূলায় সমকামিতার প্রসঙ্গ আসারই কথা না। কিন্তু আনা হচ্ছে খেলাধুলাকে রাজনীতিকরণের একটি নির্লজ্জ প্রচেষ্টা হিসাবে। সমাজ ও জাতির মধ্যে বিভাজনমূলক মূল্যবোধ আরোপ করার জন্য। কাতার তার সীমার মধ্যে থেকে আয়োজনটিকে বৈচিত্রপূর্ণ করার চেষ্টা করেছে। তবুও পশ্চিমাদের কাতারবিরোধী এই প্রচারণা কেবল মুসলিম হবার কারণে।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা