ইন্দোনেশীয় অঞ্চলে ইসলাম : আগমন ও বিকাশ

মাহদি হাসান:

ইন্দোনেশিয়া। জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। ঐতিহাসিক মাসউদি এ অঞ্চলের নাম উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছিলেন ‘জুযুরুল মাহারাজ’ মানে মহারাজার দ্বীপপুঞ্জ। অপর ঐতিহাসিকগণ এ অঞ্চলের পরিচয় দিয়েছেন সুমাত্রা, জাভা প্রভৃতি বিভিন্ন দ্বীপের মাধ্যমে। কেউ বলেন, ইন্দোনেশিয়া শব্দটি ইন্দো এবং নেশিয়া এ দুটি শব্দের মাধ্যমে গঠিত। ইন্দো মানে হচ্ছে হিন্দু এবং নেশিয়া মানে হচ্ছে দ্বীপপুঞ্জ। এমনিভাবে অনেক ঐতিহাসিক এ অঞ্চলকে হিন্দুস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় দ্বীপপুঞ্জ হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। কেউ এর নাম দিয়েছেন সবুজ ভূখণ্ড। তবে খ্রিস্টীয় উনবিংশ শতাব্দী থেকে এ অঞ্চলটি ইন্দোনেশিয়া হিসেবে পরিচিত লাভ করে। [১] ভৌগোলিকভাবে এ অঞ্চলে বড় ছোট মিলিয়ে প্রায় সতের হাজার দ্বীপ রয়েছে। এর পাশাপাশি ঐতিহাসিকভাবে মালয়েশিয়া এবং মালদ্বীপ প্রভৃতি রাষ্ট্রগুলোও ছিল এ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। ছয়শটি দ্বীপে জনবসতি রয়েছে। যেখানকার ৯৭ থেকে ৮৫% জনগণই মুসলিম।

বৃহৎ এই অঞ্চলে ইসলামের আগমন ঘটেছিল কোনো যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং তীর-তলোয়ারের নিগ্রহ ব্যতিরেকেই। ইতিহাসের বিকৃত উপস্থাপনকারীরা জোর গলায় দাবি করেছে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং তলোয়ারের জোরে। ইন্দোনেশিয়া অঞ্চলে ইসলাম আগমন তাদের এই দাবিকে মিথ্যা প্রমাণিত করে।

এ অঞ্চলে ইসলামের আগমন ঘটেছিল প্রায় আট অথবা নয় শতাব্দী আগেই। ঐতিহাসিক সূত্রগুলো বলছে, হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষে অথবা তৃতীয় শতাব্দীর শুরুলগ্নে সুমাত্রা এবং মালয় দ্বীপপুঞ্জের কিছু বন্দরে মুসলিম ব্যবসায়ীগণ নিজেদের ব্যবসায়িক ঘাঁটি স্থাপন করেন। আম্মান, হাজরামাউত এবং ইয়ামানের দক্ষিণ উপকূলের ব্যবসায়ীগণ সবার আগে এই অঞ্চলে আগমন করেন এবং সুমাত্রার পশ্চিম উপকূলে নিজেদের ব্যবসায়িক ঘাঁটি স্থাপন করেন। এই ব্যবসায়ীগণ ছিলেন শাফেয়ী মাজহাবের অনুসারী। [২]

কতক সূত্রের ভাষ্য হচ্ছে, আব্বাসি খলিফা হারুনুর রশিদের সময় কজন ইন্দোনেশীয় ব্যবসায়ী বাগদাদে সফর করেন। সফর থেকে ফেরার পথে তারা নিজেদের মধ্যে ধারণ করে নিয়ে যান ইসলামের শ্বাশ্বত আকিদা-বিশ্বাস। অতঃপর নিজ নিজ অঞ্চলে পৌঁছে তারা ইসলামের দাওয়াতকে বিস্তৃত করার মহতি মিশনে নিবেদিত হন। [৩]

এদিকে প্রাচ্যবিদ টমাস আরনল্ড ‘দ্য প্রিচিং অব ইসলাম’ গ্রন্থে বলছেন, ‘খ্রিস্ট্রীয় সপ্তম শতাব্দীর শেষদিকে এসে শ্রীলংকার পথ ধরে চীনের সাথে মুসলিমদের ব্যবসায়িক প্রসার ঘটে। এর ফলে অষ্টম শতাব্দীতেই সেখানে আরব ব্যবসায়ীদেরকে দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করতে দেখা গেছে। পর্তুগিজ ফিরিঙ্গিদের আগমনের আগ পর্যন্ত খ্রিস্টীয় দশম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়ে প্রাচ্যের আরবরাই ছিল এ অঞ্চলের বাণিজ্যে শীর্ষ অবস্থানে। ছিল না তাদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী। এ থেকে আমরা জোরালোভাবেই এই ধারনা পেতে পারি যে, আরবরা বেশ আগেই এ অঞ্চলে তাদের ব্যবসায়িক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছিল।’ [৪]

জাভা দ্বীপ: ইসলাম প্রচারের ঘাঁটি

ঐতিহাসিক সূত্রগুলো থেকে এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে হাজরামাউত এবং আম্মান অঞ্চলের মুসলিমদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা জানা যায়। সেই হিজরি প্রথম শতাব্দীতে ইসলাম প্রচারের ঊষালগ্ন থেকে দশম হিজরি শতাব্দীতে পর্তুগিজ ফিরিঙ্গিদের আগমন পর্যন্ত সহস্র বছর ধরে এই সামুদ্রিক নাবিক এবং ব্যবসায়ীগণ এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। এমনকি তাদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের ভিটে মাটি ত্যাগ করে মালয় দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন স্থানে বসতি গেড়েছেন। এমনকি তারা জাভা দ্বীপপুঞ্জে তারা পৃথক পৃথক স্বাধীন প্রতিষ্ঠা করতেও সক্ষম হন। [৫]

জাভার পশ্চিমাঞ্চলে রাজা হাসানুদ্দিন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বানতাম রাজ্য। এদিকে জাভার পূর্বাঞ্চলে সানাকানি নামক এক সামরিক ব্যক্তি প্রতিষ্ঠা করেন মাতরাম রাজ্য। এভাবেই জাভা দ্বীপটি হয়ে উঠে এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের প্রধানতম কেন্দ্র। এখানে থেকেই অন্য দ্বীপগুলোতে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও সুমাত্রা দ্বীপের উত্তরে গড়ে উঠেছিল আতশিহ রাজ্য এবং দক্ষিণে গড়ে উঠে বালমাবাং রাজ্য। এদিকে ৮৩২ হিজরিতে এসে ফাতেমীয়রা জাভা দ্বীপের মধ্যাঞ্চলে দিমাক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। [৬]

এভাবেই চলতে থাকে ইন্দোনেশীয় অঞ্চলে ইসলামের যাত্রা। এক দ্বীপ ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ে আরেক দ্বীপে। এবং কোনো যুদ্ধ বিগ্রহ ছাড়াই। এই বিশাল অঞ্চলে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছিল তার সুবিমল আহ্বান নিয়ে। মুসলিম ধর্মপ্রচারক এবং ব্যবসায়ীদের সুন্দর জীবনাচার এবং উত্তম আচরণ দেখে এ অঞ্চলের লোকদের মনে ইসলাম গেড়ে নেয় স্থায়ী আসন। যার ফলশ্রুতিতে তারা লাভ করে সর্ববৃহৎ মুসলিম জনপদের খেতাব। [৭]

বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন: ইসলাম প্রচারের অন্যতম মাধ্যম

হাজরামাউত এবং আম্মান অঞ্চলের আরব ব্যবসায়ীগণ এ অঞ্চলে আগমনের পর ভারতবর্ষের দক্ষিণ উপকুল এবং মালাবার অঞ্চলের সম্ভ্রান্ত মহিলাগণের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এ অঞ্চলে ইসলামকে মজবুত এবং প্রোথিত করার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে মধ্য জাভা রাজ্যের রাজার সঙ্গে মুসলিম রাজকুমারী আত্তাশামবিনার বিবাহ ছিল এক্ষেত্রে একটি বিরাট মাইলফলক। এই বিদূষী মুসলিম রাজকুমারী শর্ত দিয়েছিলেন তাকে বিয়ে করতে হলে আগে রাজাকে মুসলিম হতে হবে। তার কথা অনুযায়ী রাজা ইসলাম গ্রহণ করে নেয়। এই রাজার ইসলাম গ্রহণের মধ্য দিয়ে সূচনা হয় একটি নতুন ইসলামি বসন্তের। এ সময় মধ্য জাভা থেকে ইসলাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এবং আশপাশের অঞ্চলে গড়ে উঠতে শুরু করে ছোট ছোট ইসলামি রাজ্য। অতঃপর ১৫১১ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজ উপনিবেশের কয়েক মাস পূর্বে এই রাজ্যগুলো একীভূত হয়ে যায়। [৮]

টমাস আরনল্ড জানাচ্ছেন, ‘মুসলিম ব্যবসায়ী এবং মুহাজিরগণ ভেবেচিন্তে দেখলেন যে, এ অঞ্চলের লোকদের মনে ইসলামকে প্রবিষ্ট করার সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি হচ্ছে তাদের স্থানীয় ভাষা ও রীতিনীতির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলা এবং স্থানীয় মহিলাদেরকে বিয়ে করা। অবশেষে তারা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মনে ইসলামের সুমহান আদর্শ এবং গেঁথে দিতে সক্ষম হন এবং তারা একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জীবনযাপন শুরু করেন। এমন সখ্যতা স্থানীয় ব্যক্তিদের পরস্পরের মধ্যেও খুব একটা দেখা যেত না। মুহাজির মুসলিমগণ স্থানীয়দের সঙ্গে এমনভাবে মিশে যাওয়ার পিছনের উদ্দেশ্য ছিল সুউচ্চ। এ অঞ্চলের মূর্তিপূজারী জনপদের মনে ইসলামকে সহজে প্রবেশ করানোর জন্যই তারা এই পন্থা বেছে নিয়েছিলেন। [৯]

এভাবেই তাদের সম্মিলিত এবং সুবিন্যস্ত প্রচেষ্টার ফলে সে সময়কার শাইখ আবদুল্লাহ আল-আরিফ এবং তার শাগরেদ শাইখ বুরহানুদ্দিনের প্রচেষ্টায় ইসলামের পতাকা গেঁথে যায় সুমাত্রা দ্বীপের আতশিহ রাজ্যে। এ দুজন মনীষী ইসলামি আকিদার প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। শাইখ আল-আরিফ রাজ্যের অভ্যন্তরে এবং পরবর্তী সময়ে শাগরেদ বুরহানুদ্দিন দ্বীপটির উপকূলীয় অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে অবদান রাখে। খ্রিস্টীয় একবিংশ শতাব্দী মোতাবেক হিজরি ষষ্ঠ শতাব্দীর সময়কাল তাদের এই প্রচেষ্টার সাক্ষী হয়ে আছে। বিখ্যাত ইতালীয় পর্যটক মার্কো পোলো ১২৯২ সালে সুমাত্রা দ্বীপে পাঁচ মাস অবস্থান করেছিলেন। তিনি উল্লেখ করেন, এ সময় দ্বীপটির উত্তর-পূর্ব প্রান্তে তিনি বারলাক নামের ছোট্ট একটি মুসলিম রাজ্য দেখেছেন। যা মূলত আরব ব্যবসায়ীদেরই অবদান। কারণ, এ সময় এ অঞ্চলে তাদের ছিল সরব পদচারণা। [১০]

ইবনে বতুতার সাক্ষ্য

ঐতিহাসিক সূত্রগুলো থেকে জানা যায় যে, জাভা দ্বীপের মারাসিলু অঞ্চলের রাজা ‘সামাদরাহ’ খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে একদল মুসলিম ধর্মপ্রচারকের হাতে সর্বশেষ ইসলাম গ্রহণ করেন। যাদের নেতৃত্বে ছিলেন শাইখ ইসমাইল নামক একজন মনীষী। এই রাজাই পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষের দক্ষিণে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মালাক্কা প্রণালী সংলগ্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে অবদান রাখেন। ইসলাম গ্রহণের পর এই রাজা ‘আল মালিকুস সালিহ’ নামধারণ করেন এবং নিকটবর্তী বারলাক রাজ্যের রাজকুমারীকে বিয়ে করেন। তাদের ঔরসে জন্ম নেয় দুটি পুত্রসন্তান। জ্যৈষ্ঠ পুত্রের নাম ছিল আল-মালিকুজ জাহির। [১১]

৭৪৩ হিজরি মোতাবেক ১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা এ অঞ্চলে সফর করেন এবং আল-মালিকুজ জাহিরকে জাভার বাদশাহ হিসেবে অধিষ্ঠিত দেখতে পান। ইবনে বতুতা তার সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি ছিলেন সম্মানিত এবং সম্ভ্রান্ত বাদশাহ। শাফেয়ী মাজহাবের অনুসারী। ফকিহগণের কাছে তিনি ছিলেন আস্থার এক নাম। ফকিহগণ তার কাছে এসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন। এই বাদশাহ অনেক জিহাদ এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। পায়ে হেঁটেই তিনি জুমার নামাজে এসে হাজির হতেন। তার প্রজারা ছিল শাফেয়ী মাজহাবের অনুসারী এবং জিহাদের প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী। স্বেচ্ছায় তারা তাদের বাদশাহর সঙ্গে জিহাদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যেত এবং বিপক্ষের কাফিরদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করত। কাফিররা তার সঙ্গে সন্ধি করে জিজিয়া কর আদায় করত।’ [১২]

ইবনে বতুতার এই সাক্ষ্য থেকে বুঝা যায় যে, এ অঞ্চলের অধিবাসীদের ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম প্রজন্ম মুসলিম প্রচারকদের হাতে স্বেচ্ছায় ইসলামের ছায়াতলে প্রবেশ করে। এই প্রচারকদের অনেকে ছিলেন ব্যবসায়ী, অনেকে ছিলেন আলিম। কেউ ছিলেন আরব, কেউ ছিলেন ভারত অথবা পাকিস্তান অঞ্চলের। পরবর্তী সময়ে তাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম এসে ইন্দোনেশিয়া এবং পার্শ্ববর্তী মালয়েশিয়া অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেয় এবং এ লক্ষ্যে জিহাদেও অংশগ্রহণ করে। তাদের শাফেয়ী মাজহাবের অনুসারী হওয়া প্রমাণ করে যে, তাদের কাছে প্রথম দাওয়াত পৌঁছেছিল হাজরামাউত অঞ্চলের শাফেয়ী মুসলিমদের মাধ্যমে। এমনিভাবে ভারতবর্ষের দক্ষিণের মালাবার অঞ্চলের মুসলিমদেরও ছিল ইসলাম প্রচারে প্রশংসনীয় অবদান। তারাও ছিল শাফেয়ী মাজহাবের অনুসারী। মালয় দ্বীপপুঞ্জ এবং বর্তমান ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে তাদেরও ছিল অগ্রগণ্য অবদান।

ইবনে বতুতার এই সাক্ষ্যের মধ্যে দিয়ে আমরা সুমাত্রার রাজা আল-মালিকুস সালিহ এবং জাহিরের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী মুসলিম মোগল সাম্রাজ্য এবং আরবের ইয়ামান ও আম্মান অঞ্চলের সঙ্গে বিদ্যমান সুসম্পর্কের প্রমাণও দেখতে পাই।

ইসলামের বিকাশ

সুমাত্রার শাসকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং দ্বীপটির উপকূলীয় অঞ্চলে ইসলামকে মজবুত করার মধ্যে দিয়ে এ অঞ্চলের ইসলামের বিকাশে নতুন মোড় আসে। ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে যেতে থাকে দ্বীপসমূহের অভ্যন্তরে। মক্কার শরিফের প্রেরিত প্রচারকদল এবং তাদের নেতা শাইখ ইসমাইল যে প্রচেষ্টা ব্যয় করেছিলেন, তার ফলাফল হয় অত্যন্ত চমৎকার। ১৪১৩ খ্রিস্টাব্দে এক চীনা পরিব্রাজক এই দ্বীপের অভ্যন্তরে লাম্ব্রি নামক এলাকায় ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি বলেন, এখানে একহাজার পরিবার ছিল। যাদের সকলেই ছিল মুসলিম। তাদের চরিত্র ছিল খুবই সুন্দর। এ অঞ্চলের শাসকরা ছিল ইসলামে বিশ্বাসী। এভাবেই সুমাত্রার মধ্যভাগ এবং পূর্বাঞ্চলে ইসলাম ক্রমান্বয়ে জায়গা করে নিতে শুরু করে। [১৩]

আরনল্ড বলেন খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে ডাচদের উপনিবেশের সময়েও ইসলামের বিকাশের এই তরঙ্গ স্তিমিত হয়নি। ইসলাম এখানে শান্তিপূর্ণভাবে নিজের বিস্তৃতি ঘটাতে থাকে। পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতাব্দীতে জাভা এবং সুমাত্রা থেকে পার্শ্ববর্তী কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড এবং পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ইসলাম ছড়াতে শুরু করে। আধুনিক সময়ে এসে এ অঞ্চলের মানুষ ইসলামের প্রতি আরও সচেতন হয় এবং নিজ সন্তানদেরকে উচ্চশিক্ষার জন্য আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ শুরু করে। সেখান থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত আলিমগণের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শাইখ জহির জালালুদ্দিন আল-আজহারি। সুমাত্রা এবং মালয়েশিয়ায় ইসলাম প্রচারে তিনি অগ্রগণ্য অবদান রেখেছিলেন। ১৯৫৬ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। [১৪]

তবে বিকাশের এই পথে এ অঞ্চলের ইসলাম এবং মুসলিম জনপদকে কম চড়াই-উৎরাই পেরোতে হয়নি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপনিবেশ শক্তি এসে আঘাত করেছে এবং মুসলিমরা তাদের সঙ্গে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এমনকি আজও তারা সংগ্রামের মধ্য দিয়েই যাচ্ছে।

ইন্দোনেশিয়ায় পর্তুগিজ উপনিবেশ

ইন্দোনেশিয়া দ্বীপাঞ্চলটি সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা প্রাকৃতিক নেয়ামতে ভরপুর ভূখণ্ড। এখানে আছে প্রচুর খনিজ সম্পদ। এর ফলে পর্তুগিজ, ডাচ, ব্রিটিশ, স্প্যানিশ এবং মার্কিনী; প্রায় সকল উপনিবেশ শক্তিই এ অঞ্চলের দিকে লোলুপ নজর দিয়েছে। যখন এ অঞ্চলে মুসলিমরা নিজেদের ভীতকে শক্ত করতে শুরু করেছে, সে সময় ইউরোপীয়রা ব্যস্ত তাদের বিষাক্ত থাবা বসানোর পরিকল্পনা প্রণয়নে। এ অঞ্চলের মসলার বেশ দাম ছিল ইউরোপের বাজারে। তাই তারা এখানে নিজেদের ব্যবসায়িক ঘাঁটি বানানোর চক্রান্ত শুরু করে। [১৫]

ইন্দোনেশিয়া অঞ্চলের প্রথম উপনিবেশ ছিল পর্তুগিজ ফিরিঙ্গিদের। পর্তুগিজদের আধিপত্য রুখে দিতে ইন্দোনেশীয় মুসলিমগণ তাদের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধে নেমেছিল। একদিক থেকে সেটিকেও ক্রুসেড যুদ্ধ বলা যায়। কারণ, এর কিছু সময় আগেই পর্তুগিজ ফিরিঙ্গিরা আন্দালুসের মুসলিমদের উপর নিধনযজ্ঞ চালিয়ে এসেছিল। মুসলমানদের অর্থনৈতিক শক্তিকে পঙ্গু করে দেয়া এবং মুসলিমদের ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের মিশন নিয়ে এসেছিল এই ফিরিঙ্গিরা। মুসলিমদের উপর বিদ্বেষের ফলে তারা সব ধরনের সহিংস এবং নৃশংস পদ্ধতি মুসলিমদের উপর প্রয়োগ করেছে। একের পর এক হামলা পরিচালনা করে তারা সফলতার মুখ দেখতে শুরু করে এবং তাদের উপনিবেশ নীতির বেশ কিছু স্থানীয় সমর্থকও বাগিয়ে নেয়। সে সময় থেকেই ইন্দোনেশিয়ায় ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের আনাগোনা বেড়ে যায়।

ইন্দোনেশিয়ার মুসলিমগণ পর্তুগিজ ফিরিঙ্গিদের এই উপনিবেশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এবং বেশ কিছু প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ৯৭৮ হিজরি মোতাবেক ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে ইন্দোনেশিয়ার তারনাত রাজ্যের রাজা হারুনকে বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিয়ে হত্যা করার পর এই প্রতিরোধ আরও বেগবান হয়। এই রাজার রাজত্ব ফিলিপাইন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। [১৬]

ডাচ এবং ব্রিটিশ উপনিবেশ

৯৮৮ হিজরি মোতাবেক ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পর্তুগিজরা ইউরোপে এ অঞ্চলের মসলা রপ্তানির ব্যবসা জারি রাখে। অতঃপর স্প্যানিশরা পর্তুগালের দখল নিয়ে নেয়। ৯৯৭ হিজরি মোতাবেক ১৫৮৮ খ্রিস্টাব্দে সমুদ্রপথে ইংল্যান্ডের সাথে আরমাডার যুদ্ধে স্প্যানিশদের নৌবহর ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে পর্তুগিজদের মতো করে তারা ইন্দোনেশীয় অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপনে এগোতে পারেনি। [১৭]

হল্যান্ড (বর্তমান নেদারল্যান্ড) যখন স্বাধীনতা লাভ করে তখন আর তাদের স্প্যানিশ নৌবহরের ভয় ছিল না। ভারত মহাসাগরের সমুদ্রপথে তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিচরণ করতে থাকে। ১৫৯০ হিজরিতে ডাচদের প্রথম নৌবহর ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। তারা ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছে পুনরায় হল্যান্ডে ফিরে আসে। ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া ওলন্দাজ বা ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠনে এটি অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করেছে। [১৮] এই কোম্পানি শুরুতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, তাদের উদ্দেশ্য কেবলই ব্যবসা করা। কিন্তু পরবর্তীতে সকল ফসল এবং ব্যবসায়িক পণ্যে দখল বসাতে শুরু করে। স্থানীয় শাসকদের সঙ্গে আঁতাতের বিনিময়ে তারা একের পর এক ভূখণ্ডে থাবা বসাতে শুরু করে। [১৯]

অতঃপর ডাচদের দৌরাত্ম্য ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং সকল প্রান্তে তাদের নিয়ন্ত্রণ ছড়াতে থাকে। নিয়ন্ত্রণ একটু শক্ত হতেই তারা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। তখন মুসলিম অধিবাসীগণ তাদের এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং ডাচরা মুখোমুখি এক শক্তিশালী প্রতিরোধ আন্দোলনের। [২০]

শুধু পর্তুগিজ এবং ডাচরাই ইন্দোনেশিয়ায় উপনিবেশ স্থাপন করতে চায়নি। ব্রিটিশরাও যোগ দিয়েছিল। ১৭১৪ সালে তারা সুমাত্রার পশ্চিম উপকুলে বান কোলান দুর্গ স্থাপন করে এবং ১৮২৫ সাল পর্যন্ত অবস্থান করে। এর ফলে ইন্দোনেশিয়া ১৮১১-১৮১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীন হয়ে পড়ে। যখন ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন যুদ্ধ করে ডাচদের উপনিবেশ হটিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই আগস্ট ব্রিটেন এবং হল্যান্ড লন্ডনে চুক্তিবদ্ধ হয়। এর ফলে ডাচরা ব্রিটিশদের কাছ থেকে ইন্দোনেশীয় দ্বীপগুলোর নিয়ন্ত্রণ পুনরায় ফিরিয়ে নেয়।

জাপানি উপনিবেশ

খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর শুরু থেকে দীর্ঘ সময় ধরে ডাচরা এ অঞ্চলের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করে এবং এ অঞ্চলের সকল উত্তম পণ্য এবং ব্যবসায়িক সুবিধা ভোগ করতে থাকে। এক্ষেত্রে তাদের কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল না বললেই চলে। অবশেষে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে জাপানিরা ইন্দোনেশিয়ার দখল নিয়ে নেয়। ডাচরা তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। [২১]

জাপানিদের উপনিবেশ স্থাপনের এক মাস যেতে না যেতেই এ অঞ্চলের সকল রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য সংগঠনগুলো সক্রিয় হয়ে উঠে এবং জাপানিদের কার্যক্রমে বাঁধা দেয়। নিজ দেশের অভ্যন্তরে তারা তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তুলে। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে জাপানে পারমাণবিক হামলার পর জাপানিরা মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে। এর দুদিন পরই ১৯৪৫ সালের ১৭ ই আগস্ট ইন্দোনেশিয়ার জাতির জনক হিসেবে স্বীকৃত আহমাদ সুকর্ণ এবং তার ডেপুটি মোহাম্মদ হাত্তার নেতৃত্বে ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয় এবং ইন্দোনেশীয় প্রজাতন্ত্র গঠন করা হয়।[২২]

দারিদ্র্য এবং খ্রিস্টান মিশনারীর প্রকোপে আক্রান্ত বর্তমান ইন্দোনেশিয়া

ইন্দোনেশিয়ার সর্ববৃহৎ এই মুসলিম জনপদের বর্তমান অবস্থা খুবই জটিলতাময়। বিশাল আয়তন, বিশাল সংখ্যক জনপদ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ভরপুর হলেও অঞ্চলটির উৎপাদন ক্ষমতা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। এদিকে সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার আশংকায় অতি সম্প্রতি দেশটির রাজধানী জাকার্তা থেকে বোর্নিওতে স্থানান্তর করা হয়েছে। দেশের নিরক্ষরতা এবং বেকারত্বের হারও ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এমনিকি বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের ঊর্ধ্বগতি এবং জীবনযাত্রার মান কমে যাওয়ার তাদের মুদ্রার মান সবচেয়ে কম।

এমন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে খ্রিস্টান মিশনারীরা এ অঞ্চলে হানা দিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই ইন্দোনেশিয়াকে খ্রিস্টান রাষ্ট্র করার লক্ষ্যে তাদের এই কুচক্রী মিশন শুরু হয়েছে। অনেক রাষ্ট্র, মিডিয়া এবং পত্র-পত্রিকা তাদের এ কাজে সমর্থন জোগাচ্ছে। তাদের এই কার্যক্রমের ফল ইতোমধ্যে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। ইন্দোনেশিয়ার মুসলিম জনসংখ্যা শতকরা ৯৭% থেকে ৮৫% তে নেমে গেছে। বহু অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে খ্রিস্টানদের নিয়ন্ত্রণ। পূর্বাঞ্চলীয় ইস্ট নুসা তেনগারায় মুসলিম জনসংখ্যা নেমে মাত্রা ৯.১২% এ। এ অঞ্চলটি ১১১টি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত। যার মধ্যে সর্ববৃহৎ দ্বীপটি হচ্ছে তিমুর। এখানকার অধিকাংশ লোকই খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেছে। বর্তমানে পূর্ব তিমুর একটি স্বাধীন রাস্ট্র হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি প্রাপ্ত এবং এ অঞ্চলের মুসলিম সংখ্যা ১% এরও কম।

তথ্যসূত্র:
[1] আল-ইসলামু ওয়াল মুসলিমুনা ফি জুনুবি শারকি আসিয়া, পৃষ্ঠা: ৪৩।
[2] আতলাসু তারিখিল ইসলাম, হুসাইন মুনিস, পৃষ্ঠা: ৩৮০।
[3] আত-তারিখুল ইসলামি, মাহমুদ শাকির, ৩৬৮/২০।
[4] দ্য প্রিচিং অব ইসলাম (আরবি সংস্করণ), পৃষ্ঠা: ৪০১, ৪০২।
[5] আল-হিজরাতুল ইয়ামনিয়্যাহ ওয়াল হাজরামিয়্যাহ ফি ইন্দোনিসিয়া, পৃষ্ঠা: ৮৯।
[6] তারিখুল আলামিল ইসলামিল হাদিস ওয়াল মুয়াসির, ১/২৮৭।
[7] আতলাসু তারিখিল ইসলাম, হুসাইন মুনিস, পৃষ্ঠা: ৩৮১।
[8] সুওয়ারুম মিনাশ শারকি ফি ইন্দোনিসিয়া, ১০৮।
[9] দ্য প্রিচিং অব ইসলাম (আরবি সংস্করণ), ৪০৩।
[10] ইনতিশারুল ইসলাম ফি ইন্দোনিসিয়া, ৭২।
[11] প্রাগুক্ত।
[12] রিহলাতু ইবনি বতুতা, ৪/১১৪।
[13] দ্য প্রিচিং অব ইসলাম (আরবি সংস্করণ), পৃষ্ঠা: ৪০৮।
[14] ইনতিশারুল ইসলাম ফি ইন্দোনিসিয়া, ৭২।
[15] তারিখুল ইসলামিল হাদিসি ওয়াল মুয়াসির, ১/২৮৭।
[16] তারিখুল ইসলামিল হাদিসি ওয়াল মুয়াসির, ১/২৮৯।
[17] প্রাগুক্ত।
[18] আল-ইসলামু ওয়াল মুসলিমুনা ফি জুনুবি শারকি আসিয়া, মুস্তফা রমাদান, ৭।
[19] তারিখু দুওয়ালি জুনুবি শারকি আসিয়া, মাহমুদ আস-সাইয়িদ, ৯৪।
[20] আল-ইসলামু ওয়াল মুসলিমুনা ফি জুনুবি শারকি আসিয়া, মুস্তফা রমাদান, ৮।
[21] প্রাগুক্ত।
[22] আত-তারিখুল ইসলামি, মাহমুদ শাকির, ২/৩৮৬, ৩৮৭।

আগের সংবাদইয়াজিদি ধারা: ইতিহাসের বিস্মৃত অধ্যায়
পরবর্তি সংবাদকরোনার টিকা গ্রহণে শরঈ দৃষ্টিকোণ