ইরানে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান : রাষ্ট্র, ধর্ম ও ঐতিহ্যের বিতর্কে

 আবদুল্লাহিল বাকি

৯ জানুয়ারী ২০১৮ ইংরেজি তারিখে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি শিয়া মতবাদের অন্যতম কেন্দ্র কোমের ধর্মীয় স্বভাব, প্রকৃতি এবং এর বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠান আল হাওজার প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। ( ইমামি শিয়া ধারার ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে হাওজা বলা হয়। ) তার আলোচনার মৌলিক প্রতিপাদ্য ছিল, শত্রুদের সম্বন্ধে সতর্কীকরণ; সামগ্রিক আলোচনায় এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে কোম শহর, তার হাওজা কেন্দ্রিক ধর্মীয় সংগঠন ও বিপ্লবের সঙ্গে এর সম্পর্কের টানাপোড়েন—একটা যুগ-জিজ্ঞাসার মুখোমুখি। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘কোম শহর সমগ্র ইরানের বিপ্লবের প্রাণকেন্দ্র, এর ইলমি হাওজা, বিপ্লবের অভ্যন্তরীণ ও আধ্যাত্মিক পৃষ্ঠপোষক। কিন্তু কেউ কেউ এর বিপ্লবী পরিচয় মুছে ফেলতে চাচ্ছে। সুতরাং বহিঃশত্রুদের চক্রান্ত সম্পর্কে ঔদাসীন্য আমাদের জন্য কাল হয়ে আসতে পারে।’

বলা যেতে পারে, এই মন্তব্য ইরানের বিপ্লব-ব্যবস্থায় বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র হিসেবে আল হাওজার গুরুত্ব সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা প্রদান করে। কোম শহরকে এর কেন্দ্রস্থল হিসেবে ধরা হয়। তাছাড়া বিপ্লবের বেশিরভাগ তাত্ত্বিকই এই নগরীর বাসিন্দা ছিলেন। এটাই প্রথমবার নয়, যখন ইরানী নেতা রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতায় আল হাওজার অবস্থান বা ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের শাসনব্যবস্থায় আলেমের ভূমিকা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ২০১২ সালের অক্টোবরে আলেমদের উদ্দেশ্যে একটি বক্তৃতায় খামেনী জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, আল হাওজা ও তার আলেমরা হলেন শাসনব্যবস্থার প্রকৃত সেনাবাহিনী এবং  এর থেকে তাদের বিচ্ছিন্নতা কল্পনাও করা যায় না।

এমনকি খামেনী শাসনের সাথে আলেমদের সম্পর্কের রূপরেখা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘আলেমকে শাসন ব্যবস্থা থেকে পৃথককারী যে কোন চিন্তাই ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা।’ এর অর্থ দাঁড়ায়, তিনি ধর্মীয় সিলসিলা এবং শাসনব্যবস্থার মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার মধ্যে একটি নতুন সম্পর্ক স্থাপন করেন, তার মতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের চিন্তাভাবনার ধরণ ও প্রকৃতি ইরানের ইসলামী শাসনকাঠামো ও রাজনীতির বাইরে হওয়া উচিত নয়। এটাই শিয়াদের বহুল প্রচলিত বেলায়েতে ফকীহ ও বিপ্লব-ব্যবস্থার অর্থ।

এখানে,ধর্মনিরপেক্ষতার একটি নতুন সংজ্ঞা উদ্ভূত হয়েছে, যে, রাষ্ট্রের বাইরের অন্য যে কোন চিন্তাও ধর্মনিরপেক্ষতা, এবং শেষ পর্যন্ত ‘আল হাওজা’ ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় চিন্তার বাইরে যেতে পারে না। সেক্ষেত্রে আমাদের মূল প্রশ্নটি হল, ইরানের ইসলামিক প্রজাতন্ত্র এবং তার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে কি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি  হচ্ছে, সৃষ্টি হলে তার প্রকৃতি ও প্রবণতা ঠিক কেমন? এই প্রবন্ধে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

আল হাওজা : পরিভাষা ও সামাজিক ভূমিকা

ঐতিহাসিকভাবে জ্ঞান উৎপাদনে হাওজাকে একটি সুসংজ্ঞায়িত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হয়। শিয়া দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, হাওজাকে শিয়া মতবাদের অনুসারী বা শিয়া বিচার-বিভাগের অনুসরণকারীদের  ফিকহ ও বিচার পরিচালনার জন্য  ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক পদ, অধিকার ও আধিপত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। এটি অবিসংবাদিত ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা যা ইমামি শিয়া ধর্মে আলেমদের শিক্ষাপ্রদান ও গঠন কার্যক্রমের তদারকি করে। এবং এই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থেকেই শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় জ্ঞানের সিলসিলায় অগ্রগতি অর্জন করে দীর্ঘ সময় পরে আইনশাস্ত্রের ‘ইজতিহাদে’র পর্যায়ে পৌঁছায় এবং আরো পরে ‘মারজিইয়াত’ বা জীবন্ত রেফারেন্সের স্তরে উপনীত হয়।

হাওজা আজও তার জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির ঐতিহাসিক গুরুত্ব হারায়নি, তবে সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার জড়িত থাকার বিষয়টি সবসময়ই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। কারণ শিয়া মতবাদে রাজনৈতিক শক্তি ও একক কর্তৃত্ব শুধু বারো ইমামের জন্য পূর্বনির্ধারিত। এছাড়া অভিভাবক ও বৈধ শাসক হিসাবে, মাহদির অনুপস্থিতির তত্ত্বের অধীনে—যিনি শিয়াদের দ্বাদশ ইমাম — ফকিহের সামাজিক ভূমিকা কেমন হবে, বিদ্যমান কর্তৃত্বের বৈধতা কীভাবে নির্ধারিত হবে এবং ক্ষমতা গ্রহণের অধিকার কার রয়েছে এবং হাওজা  কীভাবে এই বিষয়টিকে মোকাবেলা করেছে, তা নিয়ে প্রশ্নগুলি ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে।

আল হাওজাতুল ইলমিয়ার ঐতিহাসিক বিকাশ এবং ক্ষমতার সাথে এর সম্পর্ক

শিয়া ঐতিহ্যে হাওজার ইতিহাস প্রায় হাজার বছরের ; শেখ তুসি’র যুগে এটি পুরোপুরিভাবে বিকশিত হয়েছিল, তিনি বাগদাদ থেকে পালিয়ে নাজাফ শহরে স্থিত হবার পর। আল হাওজা সেই সময়ে যে বৈজ্ঞানিক ও জ্ঞানীয় কাঠামোর জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার বাইরে ভিন্ন কোনো রকম উদ্যোগ—যার জন্য এটি প্রতিষ্ঠিত হয়নি, নিবন্ধভুক্ত করেনি। বরং ফকিহগণ রাজনীতির ক্ষেত্র থেকে দূরে অবস্থান গ্রহণ করে, ফিকহী ধারা ও ব্যবস্থার প্রতি সংবেদনশীল ছিলেন। রাজনৈতিক এমনকি আর্থিক দিক থেকেও নজফ শহরের হাওজা স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ছিল। অন্য কথায়, ফকীহগণের বেলায়েত বা সাধারণ কর্তৃত্ব ও ব্যাপক এখতিয়ারের ধারণা কার্যত অস্পষ্টই রয়ে গেছে। এই পরিভাষাটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শিয়া ফকীহদের এক ধরণের রাজনৈতিক উপস্থিতি ঘোষণা করে। এই শব্দটি খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে ইরানে সাফাভি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় প্রথম স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছিল।

সাফাভি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় শিয়া ধর্মীয় পন্ডিত  আল কারাকির ভূমিকা এবং সাফাভি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ইসমাইল সাফাভি এর সাথে তার সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী মতামত সত্ত্বেও, তিনি রাজা তাহমসিব আল-সাফাভি কর্তৃক ‘শাইখুল ইসলাম’ নির্ধারিত হয়েছিলেন। আমরা এখানে বলতে পারি যে এই পর্যায়টি সুলতানের সাথে ফকীহের সম্পর্কের সূচনা করে; অন্য কথায়, রাজনৈতিক ক্ষমতার সাথে শিয়া মতবাদের সম্পর্ক তৈরি করে। রাজনৈতিক নিপীড়নতত্ত্ব হতে শিয়া ফকিহেরা সরে আসেন—যে নিপীড়নতত্ত্ব দিয়ে তারা বারো ইমামের বাইরের সকল শাসক ও শাসনব্যবস্থাকে ব্যাখ্যা করতেন ও অবৈধ আখ্যা দিতেন। সাফাভি রাষ্ট্রে  উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতার সম্পর্ক ছিল। শাসক বিচারপতিগণকে (ফকিহ) আদালত এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রদান করেন এবং পণ্ডিতরা শাসককে শাসনের বৈধতা দেন। তাদের মধ্যে সহযোগিতা ও সম্পর্ক উভয়ের শক্তির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল। এর অর্থ এই নয় যে সমস্ত শিয়া আলেম একই পথ অনুসরণ করেছিলেন, বরং তাদের মধ্যে অনেকেই এই মত পোষণ করেছেন যে, যারা মাহদীর অনুপস্থিতিতে ক্ষমতা নিয়েছিলেন, তারা ক্ষমতার অবৈধ দখলদার।

শিয়া পরিসর ও ইতিহাসে, ফকীহ এবং রাজনীতির মধ্যে এই পরিবর্তিত সম্পর্কের আলোকে, অন্যান্য ঐতিহাসিক বাঁকবদল ছিল—যেখানে ফকিহ বিশিষ্ট রাজনৈতিক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ১৮৯২ সালে  নাসির আল-দীন শাহ আল-কাজারী এবং ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত তামাক চুক্তির বিরুদ্ধে, ইরানের শাসককে উত্তেজিত করার ক্ষেত্রে, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব মির্জা শিরাজীর ফতোয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯০৫ সালের সাংবিধানিক বিপ্লবেও আল্লামা নাইনীর মাধ্যমে তাত্ত্বিকভাবে ফকিহদের উপস্থিতি ছিল, যা তার লিখিত ‘তামবীহুল উম্মাহ ওয়া তানযীলুল মিল্লাহ’ পুস্তকে প্রতিভাত হয়েছে ও ধর্মীয় অভিভাবক, ইমাম ‘আখন্দ খোরাসানী’র মধ্য দিয়ে শাসককে উত্তেজিত করার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

রাজনীতি ও ক্ষমতার সাথে ফকীহের সম্পর্কের সর্বাধিক সুস্পষ্টতা ও বোধগম্যতার সূচনা করেছে ইরানের ইসলামী বিপ্লব। কোম শহরে আল হাওজাতুল ইলমিয়া, শিয়া পণ্ডিতদের রাজনীতি এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এই বৌদ্ধিক পরিবর্তনটির ভিত্তি তৈরি করেছিল। দ্বাদশ শিয়া অনুপস্থিত ইমামের পক্ষে ফকিহই শাসকের অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। তাদের এই ক্রমউন্নয়নের প্রসঙ্গে তিনটি দৃষ্টিভঙ্গিকে পৃথক করে চিহ্নিত করা যায়, যা শিয়া আইনশাস্ত্রকে রাজনীতি ও ক্ষমতার ক্ষেত্রে আরোপিত হতে বাধ্য করেছে।

—এক ধরনের ধর্মীয় পণ্ডিত, যারা সনাতন প্রবণতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে গ্রন্থ রচনা করতেন এবং মানুষেকে শ্রেণীবদ্ধ করতেন। তারা বিশ্বাস করেন যে, শিয়াদের ধারণা মতে অনুপস্থিতির কালে প্রতিষ্ঠিত যে কোন কর্তৃত্ব ও শাসন, হোক সেটা শিয়াদের রাজত্ব—তা দখলদারিত্ব এবং অবৈধ শাসন।

—আর একটি ঐতিহ্যবাহী দল, যা সাধারণ অধিক্ষেত্র এবং এর সাথে অংশীদারিতে বিদ্যমান কর্তৃপক্ষের সাথে সম্পর্কিত; যারা বর্তমান শাসনের বৈধতার স্বীকৃতি দেয় এবং বিচার বিভাগের সাধারণ বিষয়াদি, গণনা এবং যাকাতের সংগ্রহের দায়িত্বও গ্রহণ করে। এখানে এমন কিছু লোক আছেন, যারা ঐ শাসন ও অধিকারের গ্রহণযোগ্যতার পক্ষে থাকেন, যে শাসন জনগণের অধিকারের  নিশ্চয়তা দেয় এবং তাদের আগ্রহ ও স্বার্থ বিবেচনা করে। এভাবে তারা চিন্তা করেন এটা ধরে নিয়েই যে ,এ ধরনের রাষ্ট্র ও শাসন ধর্মীয় দখলদারিত্বের অংশ, এভাবেই তারা ইমাম মাহদির জন্য অপেক্ষা করবেন।

—তৃতীয় ধারাটি হল, ১৯৭৯ সালে ইরানের বিপ্লবের বিজয়ের পরে যা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, ধর্মীয় পন্ডিতগণ শাসন ও রাজত্বের অধিকারের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণভাবে শিয়াদের দ্বাদশ ইমামের প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা রাখেন। এই তত্ত্বটি কোমের আল হাওজা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল এবং ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খামেনী তাঁর ‘দ্য ইসলামিক গভর্নমেন্ট’ গ্রন্থে এর ভিত্তিমূল স্থাপন করেছিলেন।

খামেনীর এই তত্ত্বটি কোম শহরে আল হাওজার ধর্মীয় কাঠামো ও সত্ত্বাকে স্বল্প সময়ে উন্নত করে তোলে। এমনকি ইরানের জনগণ এই তত্ত্বকে শিয়া সম্প্রদায়ের জন্য, নজফের ঐতিহাসিক আলহাওজার বিপরীতে একটি নতুনতর বৌদ্ধিক মেরু হিসেবে গণ্য করে থাকে। আর তারা নজফের আল হাওজাকে, রাজনীতি এবং ক্ষমতা নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে সনাতন ধারাক্রম বৈ কিছুই মনে করে না।

কোমের ধর্মীয় আল হাওজা : প্রতিষ্ঠা ও ভূমিকা

ইরানের ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের সাফল্য না পেলে, দক্ষিণ ইরানের শহর কোমের আল হাওজাতুল ইলমিয়া  আজকের মতো এতটা জনপ্রিয় হত না। তারচেয়েও বড় কথা হল, এটি বিলায়াতে ফকিহ তত্ত্বের মূল উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ইতিহাস বিবেচনায়, এটি নাজাফ আল হাওজার তুলনায় সময় ও ইতিহাসের দিক দিয়ে আধুনিক হিসাবে বিবেচিত হয়; ১৩৩৩ হিজরিতে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখানে বেশকিছু সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক কারণ ছিল; যা কোম শহরে আল হাওজার প্রতিষ্ঠাকে শক্তিশালী ও বেগবান করে তুলেছিল। যেমন, এটি ইরাকের ধর্মীয় শিক্ষার্থীদের জন্য নাজাফের পরিবর্তে গন্তব্য হিসেবে বিবেচিত হলো।

তাছাড়া সাংস্কৃতিক স্তরে, এটি ইরানে কমিউনিস্ট সম্প্রসারণ মোকাবেলার একটি মাধ্যম ছিল। ইমাদুদ্দীন  ফায়াদির মতে, সাংবিধানিক বিপ্লবের সময় ভুল এড়াতে ইরানের এমন ধর্মীয় কেন্দ্রের প্রয়োজন ছিল। এর মধ্যে একটি, আলেম ফাদলাল্লাহ নুরীর ফাঁসি কার্যকর করার মত মারাত্মক অমার্জনীয় ভুল। নাজফে নয়, ধর্মতত্ত্ববিদদের তেহরানের সিদ্ধান্তকেন্দ্রের নিকটেই থাকতে হবে।’ কোম হাওজার প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আবদুল আল করিম আল-হায়রি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন না এবং তৎকালীন বিদ্যমান কর্তৃপক্ষের পক্ষাবলম্বন বা বিরোধিতা, কিছুই করেননি। চিন্তাশীলদের কেউ কেউ এটিকে ইরানের ধর্মপন্ডিতদের জন্য নতুন মঞ্চ হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন।

আল হাওজা এবং রাষ্ট্রের বিতর্ক

আল হাওজা এবং ক্ষমতা নিয়ে রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক বিতর্কে ১৫ জুন ২০১৮ তারিখটি একটি নতুন মোড় চিহ্নিত করেছে; কোম শহরে সাংস্কৃতিক বিপ্লব কাউন্সিলের সদস্য ‘রহিম বোরাজগাদি’র বক্তৃতার পরে, যেখানে তিনি আল হাওজা এবং এর ভূমিকার বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন। তিনি কোমের আলোচনার কয়েক সপ্তাহ পর জুমার নামাজের মিম্বরে এক বক্তৃতায় অভিন্ন বিষয়টির পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। এটি একটি নতুন বিতর্ক, যা ইঙ্গিত দেয় যে ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থার কেন্দ্রস্থল থেকে একটি নতুন দল হাওজার বর্তমান রূপে, তার ক্রিয়াকলাপ নিয়ে পুনর্বিবেচনা করছে এবং ইরানের শাসন ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার সাথে এটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে, এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।’

তবে বোরাজগাদীর অবস্থান ও প্রসঙ্গ শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়নি; হাওজা এবং ধর্মীয় মহল থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণি দ্বারা তিনি সমালোচিত হয়েছিলেন। শোনা যায় যে, এখানে একটি মতবিরোধ বিদ্যমান যা সাধারণত গুপ্ত থাকে এবং মাঝে মাঝে প্রকাশ্যে আসতে পারে। বিবাদের কেন্দ্রবিন্দু, হাওজার স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের নিয়ে। কেননা এটি একটি ট্রাডিশনাল আন্দোলন যা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে আল হাওজার ভূমিকাকে পাশাপাশি, শক্তিশালী করার আহ্বান জানায়। একটি তরুণ প্রজন্ম ভবিষ্যতের যে পরিবর্তন আনতে পারে তা বিবেচনায় নিয়েই এটাকে আহ্বান জানানো হয়েছে, যা ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কমবেশি প্রতিফলিত হয়েছে। এই বিতর্কের প্রসঙ্গে, বিপ্লব-পরবর্তী ইরানে হাওজা এবং আলেমদের কাজ দেখে তিনটি নিদর্শন লক্ষ করা যায়—

১. একটি ঐতিহ্যবাহী প্রবণতা ছিল, যা ধর্মপ্রচার, দিকনির্দেশনা, ওয়াজ, নসিহত এবং ফতোয়ার ক্ষেত্রে আলেম কর্তৃক পরিচালিত ঐতিহাসিক প্যাটার্ন থেকে সরে যায় না। এবং তারা ইরানের বিপ্লবের বিজয়ের পরেও এর সাথে একটি দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন। তারা শাসনের প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করেনি। সাইয়িদ হাদী তাবতাবায়ী ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ নয় এমন অনেক অনুসরণীয় ধর্মীয় পন্ডিতদের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যেমন উল্লেখ করেছেন আহমদ খোসারি, মুহাম্মদ কাজেম শরীয়তমাদারি এবং অন্যান্য ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে যারা রাজনীতিতে আগ্রহী ছিলেন না ঠিক, কিন্তু নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে যোগসূত্রও কাটেননি।

২. ধর্মীয় সংস্কারের আন্দোলন বা যা ‘ধর্মীয় প্রোটেস্ট্যান্টিজম’ হিসাবে পরিচিত। এটি, ধর্ম ও রাষ্ট্র এবং ধর্ম ও জনগণের সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের একটি বৌদ্ধিক প্রচেষ্টা এবং এই ধারার সমর্থকরা ধর্মীয় প্রবণতার বাইরে থেকে এসে ইরানের বুদ্ধিজীবী অভিজাতদের মধ্যে যাত্রা শুরু করেছিলেন। এই আন্দোলনটি গত দশকে একটি সুস্পষ্ট তৎপরতা প্রত্যক্ষ করেছে। এবং ২০০৪ সালে ইতিহাসের অধ্যাপক হাশিম আগাগারীকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছিল, খামেনির হস্তক্ষেপে পরবর্তীতে মৃত্যুদণ্ড বাতিল করা হয়েছিল।

ধর্মের সাথেই আলেমের সম্পর্কের পুনর্পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যদিও এটি হাওজার বাইরে থেকে এসেছিল, বিশেষত ইরানের বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রবের সাথে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আলেমের মধ্যস্থতার দরকার আছে কি নেই— এ নিয়ে বিতর্ক প্রকট রূপ ধারণ করে। আরও উত্তেজক বিষয় হলো তাকলিদ (tradition) ইস্যু সম্পর্কে কথা বলা, যা শিয়া সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ এবং আলেমদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।বিরুদ্ধবাদীদের আপত্তির জবাবে, এই প্রক্রিয়াটিকে অন্ধ অনুকরণ থেকে আলাদা বলে বর্ণনা করে থাকেন ট্র্যাডিশনাল আলেমগণ।

ঐতিহ্যবাহী ধারায় বিবেচনা করা হয় যে, আলেম এবং মানুষের মধ্যে সম্পর্ক একটি শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর সম্পর্ক; পীর এবং মুরিদের সম্পর্ক নয়, এবং নয় একজন ইমাম ও মুকাল্লিদের সম্পর্ক। শিয়া চিন্তায় এটি একটি বৌদ্ধিক বিতর্ক বলে মনে হচ্ছে, যা সনাতন আলেমদের গায়রত ও ইগোকে জাগ্রত করেছিল এবং নিঃসন্দেহে এটি ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জকে উত্থাপন করেছে। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব এবং ওলায়েত-এ ফকিহ-এর উপর ভিত্তিকৃত রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে অপ্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণহীন করে ফেলা— বেলায়েতে ফকিহকে আলেমদের অ-বৈধকরণের মূলত লক্ষ্য বলা যেতে পারে।

এই আন্দোলনটি ইরানী সমাজে কার্যত তার দ্যুতি এবং প্রভাব হারিয়ে ফেলেছে। এখন প্রচলিত ধর্মীয় ধারার পাশাপাশি ধর্মীয় প্রবণতা যুক্ত হয়েছে, যা ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের শাসনব্যবস্থার সাথে গভীরভাবে জড়িত।

৩. আরেকটি স্রোত যা মূলত ধর্মীয় অভিজাত দল এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্রের ইরানের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে থেকেই আকার নিতে শুরু করে, যা আপন বৈপ্লবিক চেহারার দরুণ আল হাওজাতুস সাওরিয়া হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে, যা আমরা এই প্রবন্ধে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করব।

আল হাওজা এবং বিপ্লবের সমস্যা

রহিম বোরাজগাদি যা বলেছিলেন, তার দিকে ফিরে তাকিয়ে, আমরা ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রবণতার দ্বারা উদ্ভূত সমস্যাগুলি, ভবিষ্যতে কীভাবে ইরানের ধর্মীয় দৃশ্যের চিত্র নির্ধারণের পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে, এবং কী কী রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং নতুন বিচারব্যবস্থার ভিত্তিতে তৈরি হতে পারে, এমনসব সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে— এসব সমাধান করার লক্ষ্যে একটি রাজনৈতিক ভবিষ্যত গঠনের পরিকল্পনা লক্ষ করি। নেতৃত্বের স্তর এবং পরিচালনা পর্যায়ে উভয় ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক ব্যবস্থা সমস্যাযুক্ত। বোরাজগাদী আল হাওজা থেকে যে সমস্যাগুলি নিয়েছিল তা দুটি ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে–

১. ধর্মীয় স্থাপনাই হয়ে যায় ধর্মনিরপেক্ষতার বহিঃপ্রকাশ, যখন সে তার ব্যবস্থা ও বৌদ্ধিক আন্দোলনকে আইনশাস্ত্র, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জরুরী ও নব উত্থাপিত সমস্যার উত্তর থেকে পৃথকতার ঘোষণা করে। অন্য কথায়, ঐতিহ্যগত দিক থেকে এই ধর্মীয় স্থাপনা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে এবং এর ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান ও শাস্ত্রগুলি বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাছাড়া এটি সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক দিক থেকে বিপ্লবের সমূহপ্রয়োজনগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করে না।

২. ধর্মীয় সংস্থাটি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ব্যবহারিক কোন ধরনের সুবিধা ও উপকারের উদ্দেশ্য ছাড়াই, অতি অধিক পরিমাণে ধর্মীয় আলেমদের ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করছে এবং এত বড় সংখ্যা গড়ে তোলার কোনই দরকার নেই। বলাবাহুল্য এটিই বোরাজগাদির কথায় সবচেয়ে দুঃসাহসিকতা হিসেবে গণ্য হতে পারে।

বোরাজগাদির এই বক্তব্য ইরানের একাধিক ধর্মীয় কর্তৃপক্ষকে উস্কে দিয়েছিলো এবং তারা তার সমালোচনা করেছিলেন। তবে এটি ধর্মত্যাগ ও তাকফিরের অভিযোগ এবং মৃত্যুদণ্ডের দণ্ড হিসাবে পরিগণিত হয়নি। বরঞ্চ আমরা দেখতে পাই যে ঐতিহ্যবাহী ধারার মধ্যে হতে এমন অনেকেই রয়েছেন, যারা রক্ষণশীল হলেও ইনসাফের সাথে তার পক্ষে লড়েছেন; তাদের দাবি ছিল, তার পন্থা উগ্রতা নয় বরং দৃঢ়তা। যা ইঙ্গিত দেয় যে রাষ্ট্র, শক্তি ও শৃঙ্খলার সাথে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কটিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার জন্য একটি প্রবণতা রূপ নিতে শুরু করেছে, যা আল হাওজাতুস সাওরিয়া বা বিপ্লবী এস্টেট হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। আর এটি ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রকাশ্যে একটি সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব।

ইরান এস্টেট এবং শাসনব্যবস্থা

সন্দেহ নেই যে ইরানে রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি আলেমের কেন্দ্রীয়তার উপর। আলেম ধর্মীয় ক্ষেত্রে যে জ্ঞানগত পদমর্যাদায় রয়েছেন, যা সাধারণ পর্যায় থেকে ইজতিহাদের পর্যায় অতিক্রম করে এবং আল মারজিইয়াতুদ দীনিয়া বা ধর্মীয় কর্তৃত্বের স্তরে চলে যায়। আর এটা আল হাওজাতুল ইলমিয়ায় ব্যবহৃত ও প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা অনুযায়ী। পাশাপাশি তিনি একজন রাষ্ট্রনায়কও, যেহেতু তিনি আইন ও শাসনের অভিভাবক বা ওলি। তিনটি কর্তৃত্ব—নির্বাহী, বিচার বিভাগীয় ও আইনসভায় তিনি বিচারক হিসাবে নজর রাখেন। ইরান সংবিধান ওয়ালি আল-ফকিহ-এর শর্তাদি নিম্নলিখিত সংজ্ঞায় উল্লেখ করেছে : সে হবে পুরুষ, ফকিহ, ন্যায়পরায়ণ, পরিচালক এবং চৌকস। সে হবে সময় ও স্থানের পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন এবং অভিজ্ঞ। রাজনৈতিক সচেতনতা যার রয়েছে। আলেম ও রাষ্ট্রের মধ্যে এই সম্পর্কের মূল সূত্রটি হল ধর্মীয় স্থাপনা–আল হাওজাতুল ইলমিয়া। প্রতিষ্ঠানটি স্নাতক বা একটি ধর্মীয় সনদ প্রদান করবে যাতে রাষ্ট্রে সে ওয়ালি ও ফকিহ-এর অবস্থান গ্রহণ করতে সক্ষম হয়।

আল হাওজা এবং বেলায়েত-এ ফকিহ-এর অবস্থানের ক্ষেত্রে ইরানী সংবিধানের শর্তগুলি কী হবে তা নিয়ে বিতর্ক ফিরে আসে। ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থার দরুণ ভবিষ্যতের বিষয়ে অনেক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। যদি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তার প্রয়োজনীয়তা পূরণ না করে, তবে কোন ধর্মগুরুর অনুপস্থিতির অর্থ কি, যে কি না সংবিধানের প্রয়োজনীয়তার প্রতি সাড়া দেয়? এর অর্থ কি এই নয় যে নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণের জন্য ইরান অন্যান্য আইনজ্ঞ ফকিহের দ্বারপ্রান্তে চলে যেতে পারে?

১৯৮৯ সালে ইমাম খোমেনির মৃত্যুর পরে, বর্তমান নেতা আলি খামেনীকে আয়াতুল্লাহ খামেনীর ধর্মীয় কর্তৃত্বের সর্বময়তার মর্যাদায় না পৌঁছিয়ে ফকীহ ও অভিভাবক হিসাবে নির্বাচিত করা হয়েছিল। এই অংশের একটি সংশোধনীতে, কাউন্সিল অফ এক্সপার্টস , আলী খোমেনির মুক্ত ইজতিহাদের পর্যায়েই সন্তুষ্ট ছিল যার অর্জন ইমাম খামেনীরও ছিল। পাশাপাশি তার রয়েছে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ফলে সে খামেনীর খলিফা হবার যোগ্যতা অর্জন করেছে। কিংবা এভাবে বলা যায় যে তার পর্যায়টি ছিল রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম পর্যায় যার মাধ্যমে একজন ওলি ও ফকিহ রাষ্ট্রের বিষয়-আশয়ে আধিপত্য বিস্তারে সক্ষমতা লাভ করে।

বর্তমানে ধর্মীয় স্থাপনার উপরে কেউ আপত্তি তুলছে এবং এখানে আগত এবং পলিটিক্যাল সাইন্সে শিক্ষাপ্রাপ্ত আলেমদের ধর্মীয় যোগ্যতা সন্দেহ-সংশয়ের জন্ম দিচ্ছে। এর অর্থ দাঁড়ায় যে, ইরান ক্রমাগতভাবে, পার্লামেন্টের দেয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী সকল শর্তের অধিকারী ফকিহের অনুপস্থিতিতে ও ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার পদশূন্যতায়—রাষ্ট্রনায়কদের ঘিরে একটি বিতর্কের আবহে প্রবেশ করছে।

মাজলিসুল কিয়াদাহ (নেতৃত্ব কাউন্সিল) : প্রাচীন পরিভাষা

এই শব্দটি বিপ্লব-পরবর্তী ইরানে রাজনৈতিক ফিকহের ক্ষেত্রে নতুন নাও হতে পারে। ১৯৮৯ সালের সংশোধনীর আগে এটি ইরানি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত ছিল, আয়াতুল্লাহ খামেনীর মৃত্যুর পরে, ইরানী সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনীকে ওয়ালি আল-ফকিহ-এর পদে নির্বাচিত করার সিদ্ধান্তের আগে—বিকল্প হিসাবে যা চিহ্নিত করা হয়েছিল। ইরানের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ রেখে হাশেমি রাফসানজানি তার মৃত্যুর আগে এই মত থেকে সরে এসেছিলেন। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি রয়ে গেছে, যে কখন এই বিকল্পটি অবলম্বন করা হবে?

রাফসানজানি বক্তব্য রেখেছিলেন যে, যদি বিলায়েতে ফকীহের অবস্থান গ্রহণের জন্য আলেমদের মধ্যে উপযুক্ত ব্যক্তি না থাকে তবে নেতৃত্ব পরিষদ হিসাবে তিন বা পাঁচ জনকে বেছে নেওয়া যেতে পারে। সর্বদাই আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য হলো, আলেমদের মধ্য হতে রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্যতা। উপরোক্ত বিষয়টির সাথে গভীর সম্বন্ধ রাখে এই প্রশ্নটি যে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আল হাওজা বিলায়েতে ফকিহের পদ গ্রহণের উপযুক্ত কার্যক্ষম আলেমদেরকে তৈরি করতে পারছে কিনা। ইরান সংবিধানের দেয়া ফকিহের শর্তাবলীর অনুপস্থিতির ক্ষেত্রে বিষয়টি কোন নতুন মতবাদ অথবা চিন্তাধারা প্রকাশে মোড় নিতে পারে,  ফলে রাষ্ট্রে ফকিহ ও আলেমের ভূমিকা গৌণ হয়ে পড়বে।

ফকিহ নয় এমন মুমিন ওলি

আয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ তাকী মেসবাহ ইয়াজদীকে একজন বিদ্বান ব্যক্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যিনি নেতৃত্ব পরিষদের প্রশ্নকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি মনে করেন যে, উপরোক্ত তত্ত্বটি কোন প্রতিষ্ঠিত সত্য নয়। এর পেছনে নেই কোন ঐতিহাসিক দলিল প্রমাণ। ইতিহাসে লেখা নেই যে, নবীগণ নিজেদের জন্য কোন ধরনের রিসালাত কাউন্সিল গঠন করেছিলেন এমনকি পূর্ববর্তী খলিফাদের জীবনীতেও মাজলিসুল কিয়াদাহ নামে কোন বিষয়ের অস্তিত্ব নেই। তার মতে এখানে একটি বিকল্প তত্ত্ব বিদ্যমান। বিকল্পটি হল ফকিহ ব্যতীত অন্য কারও পক্ষে নেতৃত্বের বিষয়টি গ্রহণ করা, যাকে নন-ফিকাহবিদ বলা হয়। তবে অবশ্যই তার মাঝে ধার্মিকতা এবং ন্যায়বিচারের শর্তাবলী থাকতে হবে, সাথে সাথে ধর্মীয় জ্ঞানের ক্ষেত্রে ফকীহদের স্তর না হলেও, তার প্রতি রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে জনগণের মধ্যে আস্থা থাকতে হবে।

বর্তমানে আল হাওজাকে ঘিরে বিদ্যমান বিতর্ক রাজনৈতিক প্রচেষ্টাগুলোর ক্ষেত্রে চিন্তার দ্বার উন্মুক্ত করতে পারে, এবং সাথে সাথে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের শাসন এক্ষেত্রে থেমে থাকবে না। এবং একটা সময় এর জন্য পুরোপুরিভাবেই কাঙ্ক্ষিত ইখতিয়ারের নিশ্চয়তা দিতে পারে তার জন্য, যিনি ওলি ও মুক্ত ফকিহ।প্রয়োজনীয়তার হিসাবে, এটি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের শূন্যস্থান পূরণ করার সম্ভাব্য বিকল্পগুলি নিয়ে আলোচনা করার দ্বার উন্মুক্ত করে। ইখতিয়ারের প্রকৃতিটি, তার সাহায্যার্থে থাকা দলের শক্তি এবং সামর্থ্যের সাথে সম্বন্ধযুক্ত এবং দেশের সর্বস্তরে সমর্থন জোগাতে পারে। ইরানে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রকৃতি ও কার্যাবলি নিয়ে বিতর্কের আলোকে আল হাওজাতুস সাওরিয়া বা বিপ্লবী এস্টেট হিসাবে যা পরিচিতি পেয়েছে, তার ধারণাটি রূপ নিচ্ছে। এর উদ্দেশ্য কী? অভিপ্রায় কি? এর মধ্যে ক্রিয়াশীল উপাদানগুলো কি?

আল হাওজাতুস সাওরিয়া বা বিপ্লবী এস্টেট : একটি পরিভাষা

আল হাওজাতুস সাওরিয়া ইরানে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি নতুন পরিভাষা।অনেকেই আছেন যারা বলেন যে এটি ধর্মনিরপেক্ষতার বিকল্প হিসাবে এসেছে, যেমন রহিম বোরাজগাদি বর্ণনা করেছেন। ইরানের রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে ধর্মনিরপেক্ষতা ও আল হাওজার পরিভাষাদুটিকে সামনে রেখে আমরা দেখতে পাই যে ধর্মনিরপেক্ষতা দ্বারা ইরানের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করার মত পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা গ্রহণ করা হয় না। কারণ আল হাওজায় ঐতিহ্যগত চিন্তাভাবনার উপাদান পাওয়া যায়, যা সময়ের প্রয়োজনের সাথে সাড়া দেয় না এবং বিপ্লব ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রাখে না। হাওজার ঐতিহ্যবাহী শৈলীর বিকল্প হল বিপ্লবী আল হাওজা, যে একই সাথে ‘পরিবর্তনকারী ও পরিবর্তনশীল’। এবং ‘একটি ইসলামী সভ্যতা প্রতিষ্ঠার দিগন্তে যা সমাজের প্রয়োজনগুলির সাড়া দেয়। এটি ইরানী সমাজের জন্য শুধুমাত্র নয় বরং সমগ্র বিশ্বের জন্য চিন্তাভাবনা এবং জ্ঞান তৈরি করে।’

কেউ কেউ যুক্তি দেখান যে বিপ্লবী হাওজার শিরোনামে ইরানে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের একটি নতুন প্রেক্ষাপট রূপ নিতে শুরু করেছে। এটি এমন একটি রাজনৈতিক প্রকল্প বহন করতে পারে যা অতীতের সাথে সম্পর্ক ভেঙে যেতে চায়। সরকারী পত্রিকা ‘ইরান’ প্রবীণ জ্ঞানীদের বহিষ্কারের কাজ শুরু করার জন্য, এবং শিয়া মতবাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জগদ্দলের বিরুদ্ধে তরুণ আলেমদেরকে বিদ্রোহী করে তোলার জন্য, রহিম বোরাজগাদির অবস্থানের কারণে হাওজার বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনাকে, গ্রীক কবি হোমারের ইলিয়ডে উল্লেখিত ট্রয় যুদ্ধের ঘোড়ার সাথে তুলনা করেছে।

বিপ্লবী আল হাওজা : ভিত্তি এবং লক্ষ্য

ইরানের রাষ্ট্র ও বিপ্লবের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ এমন একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের দাবি বহু আগে থেকে ছিল। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখে এবং এর স্থায়িত্ব বজায় রাখার জন্য পুনর্গঠন করাও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। ইসলামী বিপ্লবের নেতা তার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন যে আল হাওজাকে অবশ্যই বিপ্লব এবং বিপ্লবের উদ্দেশ্যের ভেতর থাকতে হবে। এবং এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য চিন্তাভাবনা, পরিচালনা ও কর্মসূচী করা দরকার । খামেনির অবস্থান কোনও ধারণার সাধারণ রূপরেখা হিসেবে বাস্তবায়িত হতে পারে। ঐতিহ্যবাহী প্যাটার্ন থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে আলাদা একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গঠনের কাজটি যতই বৌদ্ধিক, গতিশীল ও রাজনৈতিক সুরক্ষার স্তরে হোক না কেন, অক্ষমতাগুলো প্রকাশ পেতে শুরু করেছিল।

সাংগঠনিক পর্যায়ে, অনেকে হাওজার অধ্যাপকদের একটি নতুন সমাবেশকে এই আন্দোলনের একটি প্রাথমিক পয়েন্ট হিসাবে দেখেন। এই সংস্থার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটি ২০১২ সালে ছিল। এবং হাওজার ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়ে কথা বলা শুরুর পরপরই এটি উপস্থিত হয়েছিল।

এই পদক্ষেপটি আয়াতুল্লাহ মাকেরেম আল-শিরাজীসহ কোমের একাধিক ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের কাছে ভালভাবে গৃহীত হয়নি। এবং এটি বিবেচনা করা হয়েছিল যে, এই পদক্ষেপটি সরকারের স্বার্থে নয়। তাছাড়া হাওজার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এই প্রবণতাটি সর্বজনীনভাবে এটিকে নতুন ঘটনা হিসাবে অভিহিত করার জন্য একমত হয়েছে, অবশ্যই এর সাংস্কৃতিক এবং বৈজ্ঞানিক ঐশ্বর্য , ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে পারে না। তবে অবশ্যই একটি রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে হাওজাকে শাসনক্ষমতায় সংহত করা প্রয়োজন। এবং এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ঐতিহাসিক পুনর্বিবেচনা জরুরি।

ফিকহ ও আইনশাস্ত্র পর্যায়ে, কোমে ‘ইনস্টিটিউট অব ইনভেস্টিগেশন’, ‘ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স অ্যান্ড সিভিলাইজেশন’, ‘জাস্টিসপ্রুডেন্স ইনভেস্টিগেশন’, ‘দ্য বিল্ডিং অব ইসলামিক সিভিলাইজেশন’ নামে পরিচিত প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব বিদ্যমান।

ফাউন্ডেশন তার উদ্দেশ্যগুলি দুটি অংশে বিভক্ত করে :

১. চলার পথে মানচিত্র নির্ধারণ এবং ধর্মীয় সরকারের সামনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং শৈল্পিক পরিকল্পনা উপস্থাপন।

২. শক্তিশালী মানব-শক্তি ও চিন্তার গঠন।

সুরক্ষা ও সামরিক স্তরে, কোমের জাফর আল-সাদিকের ৮৩ তম ব্রিগেড, একটি অন্যতম মিলিটারি ব্রিগেড যা আইআরজিসির সাথে গভীরভাবে জড়িত। এর বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, এর সদস্যরা আলেম, ১৯৮৬-এর ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ব্রিগেডের নিরাপত্তা, সাংস্কৃতিক এবং সামরিক কার্যক্রম রয়েছে এবং তার ব্যাটালিয়ানরা সামরিক প্রস্তুতি বজায় রাখতে নিয়মিত সামরিক প্রশিক্ষণ কোর্স করে থাকে। এই ব্রিগেডকে বৈজ্ঞানিকভাবে একটি সামরিক অস্ত্র হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং বিপ্লব এবং তার উদ্দেশ্যগুলি রক্ষা। তা আল হাওজাতুল ইলমিয়ার বিপ্লব সংরক্ষণের জন্য তার লক্ষ্যগুলি নির্ধারণ করে থাকে।

উপসংহার

সুতরাং, ইরানের ধর্মীয় ময়দানে এমন একটি আন্দোলন চলছে যা ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ বিতর্কের প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান। যেটা প্রচলিত প্যাটার্নের মধ্যে পাওয়া যায় না। যেটি দেশের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে ঐতিহাসিকভাবে প্রাপ্ত ঐতিহাসিক রীতিনীতি সংরক্ষণ করতে চায়। ধর্মীয়ভাবে দেশের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের মধ্যে থাকে এবং রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি প্রণয়ন করে। ইরানের সংবিধানের মানদণ্ড এবং শর্তাবলী অনুসারে ফকীহকে স্নাতক প্রদান করে। শাসনের উদ্দেশ্য থেকে দূরে নয় এমন অন্যান্য তত্ত্বের জন্য চিন্তাভাবনা করার দ্বার উন্মুক্ত করে। রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণের মাধ্যমে এবং এর সাথে আলোচনার এবং রাজনৈতিক তাৎপর্যপূর্ণ ব্যবস্থার সাথে মতবিনিময় করার উদ্দেশ্য তার রয়েছে।

উচ্চাভিলাষ—ইরানের ধর্মীয় ক্ষেত্রের সীমা ছাড়িয়ে অন্যান্য ভূখণ্ড স্পর্শ করছে। ইরানের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির শিক্ষামূলক পরিকল্পনায় ঐতিহ্যবাহী ধারা থেকে নতুন বিপ্লবী বিন্যাসে যে কোনও পরিবর্তন আনতে পারলে চিরাচরিতভাবে শিয়া ধর্মের ঐতিহ্যবাহী জগতে নাজাফের সাথে নেতৃত্বের যোগসূত্রটি সহজ হতে পারে। ইরানের ধর্মাবলম্বী ইরাকের ধর্মীয় ময়দানে শীর্ষে আছে, যা সেখানকার রাজনৈতিক দৃশ্যে প্রতিফলিত। সরকারী এখতিয়ার থেকে নাজফের দখলকে এমন একটি ব্যবস্থার দিকনির্দেশনা ও নির্দেশনার মধ্যে আনতে হবে, যার মধ্যে ফকিহকে বিস্তৃত ক্ষমতা ও ধর্মীয় কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়েছে।

বর্তমানে ইরানের ধর্মীয় ক্ষেত্র এবং এর রাজনৈতিক প্রভাবগুলিতে এই নতুন আন্দোলনের সাফল্যের মাত্রা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। হাওজার ঐতিহ্যবাহী স্রোত এখনও সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী। কমপক্ষে নিকটবর্তী পর্যায়ে নতুন প্রবণতাটি একটি চ্যালেঞ্জ। বিচার ব্যবস্থা, রাজনৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করে, এমন একটি ব্যবস্থার মধ্যে বিপ্লব, এর লাভ, প্রতিরক্ষার স্লোগানটি রাজনৈতিক নিয়ম প্রণয়নের ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে।

আল জাজিরা গবেষণা সেন্টারের অবলম্বনে

লেখক : তরুণ আলেম ও অনুবাদক  

আগের সংবাদনিজামুল মুলক আত তুসী : ইসলামী সভ্যতার মহান সংস্কারক
পরবর্তি সংবাদইসলামী সভ্যতায় নৈতিক নজরদারী