ইসলামি বইমেলা: পরিধি বাড়ানোর বিকল্প নেই

রাকিবুল হাসান নাঈম:

জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ চত্বরে জমে উঠেছে মাসব্যাপী ইসলামি বইমেলা। পবিত্র রবিউল আওয়াল মাস উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো এবারও মেলার আয়োজন করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। মেলায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বই বিক্রি কেন্দ্র, রাহনুমা প্রকাশনী, বই ঘর, সমকালীন প্রকাশন, কালান্তর প্রকাশনী, চেতনা প্রকাশন, মাকতাবাতুল ফোরকান, গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স, সালসাবীল পাবলিকেশন্স, ইত্তেহাদ পাবলিকেশন্স, রফরফ প্রকাশনীসহ ৬৪টি স্টল রয়েছে। এ বছরই প্রথম ‘লেখক কর্নার’ চালু করেছে কর্তৃপক্ষ।

মেলায় আসা প্রকাশক এবং পাঠকরা বলছেন, এবারের মেলা অন্যবারের তুলনায় বেশি জমে উঠেছে। প্রকাশিত হচ্ছে অনেক নতুন বই। তবে মেলার পরিধি খুব ছোট হবার কারণে বইকেন্দ্রীক অনেক আয়োজন সু্ষ্ঠুভাবে করা যাচ্ছে না। তারা জোর দাবি জানিয়েছেন, মেলার পরিধি বাড়ানোর।

পাঠকদের উপচে পড়া ভিড়

মেলা পুরো জমে উঠেছে। প্রায়শই মেলায় যাচ্ছেন প্রখ্যাত ইসলামি স্কলার, লেখক, শিল্পী ও ওয়ায়েজগণ। তারা পাঠকদের বই পড়তে আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা করছেন। বই সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন। তারা যেদিন মেলায় যাচ্ছেন, সেদিন বাঁধ ভেঙে পড়ছে পাঠকদের।

বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন জাগ্রত কবি মুহিব খান। মেলার এক ফাঁকে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, দেশের ৯৫ শতাংশ নাগরিক মুসলমান। সুতরাং এই বইমেলা দেশের ৯৫ শতাংশ জনগণের। এখানে সবাইকে আসতে হবে। এটাকে ইসলামিক বলে ক্ষুদ্র একটি গণ্ডিতে যদি কেউ আবদ্ধ করতে চায়, তা ঠিক হবে না। আমি বলি, এখানে কেবল মুসলমানরাই আসবে তা নয়, বরং এখানে অমুসলিমরাও আসুক। তারাও এসে দেখুক ইসলাম নিয়ে কী কাজ হচ্ছে, তারাও পড়ুক। আর মেলাটা তো আমাদের। আমাদের প্রখ্যাত ব্যক্তিদেরও উচিত, নিয়মিত মেলায় আসা। এতে জনগণের আগ্রহ বাড়বে। এই আগ্রহ তাদেরকে বই কেনায় উদ্বুব্ধ করবে।

এবারের মেলায় পাঠকের চাহিদার কথা মাথায় রেখে বাড়তি ছাড়ে বই বিক্রি করছে স্টলগুলো। অনেক স্টল সৌজন্য উপহারও প্রদান করছে পাঠকদের। অনেকেই আবার আয়োজন করেছেন সিরাত কুইজ প্রতিযোগিতার। নতুন বই এলে তার মোড়ক উন্মোচন করা হচ্ছে বাইতুল মোকারমের সেহানে। মোড়ক উন্মোচন উপলক্ষে পাঠকদের দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন ছাড় এবং উপহার।

মেলাপ্রাঙ্গনে রাহনুমার বই দেখতে দেখতে আইইউটির প্রফেসর ড. এম আব্দুল আজিজ বলেন, বইমেলার আসার আগে ভাবছিলাম, দেশের মুসলিম জনগণের কাছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন হলো একটা ইসলামিক ইনস্টিটিউট। তারা ইসলাম নিয়ে কাজ করে, গবেষণা করে, বইপত্র প্রকাশ করে। সে হিসেবে এই বইমেলায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর একটা ব্যাপক সমাগম থাকবে। সেটা দেখার জন্যই এলাম। আমি ইসলামি বইমেলায় এসে প্রকৃতপক্ষে আনন্দিত। কারণ, আগের বছরগুলোতে এতটা সাড়া দেখিনি। এবার এসে দেখি উপেচে পড়া ভীড়। এখানে একটা জিনিস প্রমাণিত হলো, দেশে ইসলামি বই এবং এর বাজারের একটা চাহিদা আছে। আমি মনে করি, এটা আমাদের অত্যন্ত ইতিবাচক। এই বইমেলা বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং মুসলিম আকাঙ্খার সাথে অত্যন্ত মানানসই।

আসছে নতুন বই

মেলা উপলক্ষে প্রকাশিত হচ্ছে নতুন নতুন বই। এই নতুন বইগুলো মেলার প্রতি পাঠকদের আগ্রহী করে তুলছেন বলে মনে করেন প্রকাশকরা। তারা আশা করছেন, এখন হয়তো কয়েকটি প্রকাশনী বই প্রকাশ করছে। সামনে ইসলামি বইমেলায় যদি প্রকাশনা বাড়ে , তাহলে পাঠকরা আরও বেশি আগ্রহী হবে।

এবার মেলায় রাহনুমা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে তিনটি বই, আরও একটি বই প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স দুইটি, মুহাম্মদ পাবলিকেশন প্রকাশ করেছে চারটি বই, আরও বই প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। চেতনা প্রকাশন প্রকাশ করেছে চারটি বই। এছাড়াও বই প্রকাশ করেছে মাকতাবাতুল আজহার, মাকতাবাতুল আসলাফ, ইত্তেহাদ, কালান্তর, সমকালীন এবং সিয়ানসহ আরও অনেক প্রকাশনী।

বইপ্রকাশ প্রসঙ্গে কথা হয় মাওলানা যাইনুল আবিদীনের সঙ্গে। তিনি বলেন, একটা অভিযোগ আছে মানুষ বই কিনছে, কিন্তু পড়ছে না। অভিযোগ শুনে হতাশ হলে চলবে না। আমি মনে করি, এই যে বই কিনছে মানুষ, সে যদি বইটা এখন না পড়ে, সে উপকৃত হবে না। কিন্তু তার পরবর্তী প্রজন্মের কেউ না কেউ বইটা পড়বে। কিংবা বইগুলো আখেরে কোথায় যায়। সারাজীবন তো অপঠিত থেকে যায় না। হয়তো কোনো লাইব্রেরীতে যায়। সেখানেও কিন্তু পঠিত হয়। সুতরাং, বই বেচাবিক্রি এবং কেনাকাটার একটা সুদূরপ্রসারী লাভ আছে। তবে আমাদের চেষ্টা করতে হবে মানুষকে বই পড়ানোর।’

চেষ্টাটা কেমন হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইসলামি বইমেলার প্রকাশকরা যদি সম্মিলিত পরিকল্পনা করেন, সেটা সম্ভব হতে পারে। যেমন সবাই মিলে ঘোষণা দিল, যারা আগামী বছর এই দুইশ বই পড়তে পারবে, তাদেরকে আগামী বইমেলায় প্রকাশিত সবকটি বই উপহার দেয়া হবে, তাহলে তরুণরাও কিন্তু চেষ্টা করবে। একজন প্রকাশক হয়তো সবগুলো বই দিতে পারবেন না। কিন্তু সবাই মিলে যদি করে, তাহলে বিষয়টি সহজ হবে। এছাড়াও বইয়ের রিভিউ, বই থেকে প্রশ্ন নিয়ে যদি বিভিন্ন ইভেন্ট করা যায়, যেখানে পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকে, তাহলেও মানুষ উদ্বুব্ধ হবে।

প্রখ্যাত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আলেম মাওলানা গজি সানাউল্লাহ রাহমানি বলেন, বইমেলায় অনেক বই প্রকাশ হচ্ছে। বিষয়টি আনন্দের। কিন্তু এই উৎসব আনন্দের মাঝেও আমাদের পর্যবেক্ষণ করতে হবে, কয়টা মানসম্মত বেই বের হচ্ছে। বই যদি মানসম্মত না হয়, তা টিকে থাকবে না। মানসম্মত হলে টিকে থাকবে।

মেলার পরিধি বাড়ানোর দাবি

ইসলামি বইমেলা যেভাবে জমে উঠেছে, তাতে মেলার জায়গায় সংকুলান হচ্ছে না পাঠকদের। এই প্রেক্ষিতে মেলার পরিধি বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন আলেমরা। তারা বলছেন, কোটি মানুষের বসবাসের এই শহরে এতটুকু জায়গায় মেলা অত্যন্ত বেমানান।

মেলা পরিদর্শন শেষে দেশের বিখ্যাত দাঈ আলেম শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বছরে দুইবার মেলা করে। এই মেলা যেভাবে জমজমাট হয়ে উঠছে, তাতে আমাদের দাবি হলো, মেলার পরিধি বাড়ানো। বাইতুল মোকাররমের পশ্চিম দিকের যে পথ, সেটা যদি মেলার জন্য ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে আরও অনেক স্টল আমরা বসাতে পারবো। এই দাবি বাস্তবায়নে প্রমাণ দেখাতে পাঠকদেরও। পাঠকদের উচিত, বেশি বেশি মেলায় এসে একথা প্রমাণ করে দেয়া, এতটুকু জায়গা আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় আলেম লেখক ও গবেষক ড. আ ফ ম খালিদ হোসাইনের সঙ্গে। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘মেলা মানেই নতুন কিছু। ইসলামি বইমেলায় এখন নতুন অনেক বই প্রকাশ হয়। সেখানে গিয়ে এখন নতুন নতুন বই দেখে কেনা যায়। এটা অত্যন্ত ইতিবাচক দিক। কিন্তু যে বিষয়টা আমাদেরকে পীড়া দেয়, তা হলো জায়গার সংকট। পাঠকরা আসে, বই দেখে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বইমেলায় যেসব কার্যক্রম চলে, ঠিকমতো সেসব করা যায় না। বিখ্যাত কোনো লেখক এলে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। জায়গার সংকটের কারণে দোকানদারদের বেগ পোহাতে হয়। জায়গা সংকটে বড় লেখকমঞ্চ করা যায় না, যেখানে আমাদের লেখকরা বসে কথা বলবেন। বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করবেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কাছে দাবি, তারা যেন মেলার পরিধি বাড়ায়। মসজিদের আশপাশে অনেক জায়গা আছে। সেগুলো মেলার জন্য ছেড়ে দিলে আরও অনেক স্টল বসানো যাবে।

মেলায় এবার ড. এনায়াতুল্লাহ আব্বাসী সাহেবের নতুন একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বইটির মোড়ক উন্মোচনে অংশ নিয়ে তিনি বলেন, বইমেলা হচ্ছে। কিন্তু এই বইমেলায় যেভাবে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা দরকার, তা নেই। মিডিয়ায় প্রচার নেই। এই আচরণকে তিনি বিমাতাসুলভ আচরণ বলেও অভিহিত করেন।

একটি সমর্থিত সূত্রে জানা গেছে, ইসলামি বইমেলার পরিধি বৃদ্ধি, বইমেলাকে আরও গোছানো, আরও সমৃদ্ধকরণ ইত্যাদি বিষয়ে মেলার পরপরই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি ড. মোঃ মুশফিকুর রহমানের সঙ্গে বাংলাবাজারের ইসলামি প্রকাশনীগুলোর বসবার কথা রয়েছে। ফাউন্ডেশনের ডিজি মহোদয়ও বসার সম্মতি দিয়েছেন।

আগের সংবাদমাহফিলের স্টেজ: গাইরে আলেমদের ঔদ্ধত্যে ক্ষুব্ধ আলেমসমাজ
পরবর্তি সংবাদবেআইনিভাবে ধর্মঘট ডাকলে বা সমর্থন দিলে জেল-জরিমানা