রাকিবুল হাসান নাঈম:
একের পর এক জালিয়াতি এবং মালিকপক্ষের বিশাল অংকের ঋণ গ্রহণ—সব মিলিয়ে দেশের টালমাটাল অর্থনৈতিক অবস্থার মাঝেই আলোচনার কেন্দ্রে বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে হঠাৎ করেই বদলে যায় ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা। নিয়ন্ত্রণে নেয় দেশের শীর্ষ স্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ। এরপরেই আসতে থাকে একের পর এক পরিবর্তন। নতুন পর্ষদের পাশাপাশি দায়িত্ব নেয় নতুন ব্যবস্থাপনা কমিটি। এতদিন মালিকপক্ষের বিষয়ে গুরুতর তেমন অভিযোগ প্রকাশ্যে না আসলেও সম্প্রতি ব্যাপক অনিয়ম ঘটছে ইসলামী ব্যাংকে। নীতিমালার বাইরে গিয়ে এস আলম ও নাবিল গ্রুপকে ঋণ দেয়ার অভিযোগ ওঠে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। এরমধ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকা একাই ঋণ নিয়েছে ব্যাংকটির খোদ মালিকানা প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ।
বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন দেশের আলেম সমাজও। তারা বলছেন, ব্যাংকে ঋণ প্রদানের নামে লুটপাট হচ্ছে। নষ্ট করা হচ্ছে জনগণের আমানত। ঋণ বিতরণের কোনো নীয়মনীতি মানা হচ্ছে না। নামসর্বস্ব কাগুজে প্রতিষ্ঠানে বিপুল পরিমাণে টাকা ঢেলে যাচ্ছে তিনটি ব্যাংক। বাস্তবে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব নেই। এক্ষেত্রে সরকারের দায় আছে বলেও মনে করেন তারা। ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবজারভার কাজ করছিল ইসলামী ব্যাংকে। মালিকানা পরিবর্তনের পর নতুন কোনো অবজারভার নিয়োগ দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। তদারকি থাকলে এমন ঘটতো না।
তথ্য অনুযায়ী, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-আইবিবিএল থেকে ১১টি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে চারটি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে তিনটি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। প্রভাবশালী চক্রের যোগসাজশে গায়েবি প্রতিষ্ঠানে তিন ইসলামি ব্যাংক বিপুল পরিমাণ এ অর্থ বিনিয়োগ করেছে।
আলেমরা কী বলছেন?
নামসর্বস্ব কাগুজে প্রতিষ্ঠানে ঋণ প্রদানের নামে জনগণের টাকা লুট করা হচ্ছে বলে মনে করেন আলেম লেখক ও অধ্যাপক ড. আ ফ ম খলিদ হোসেন। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন । ব্যাংকের কাছে জনগণের টাকা আমানত। কোনো তদন্ত ছাড়া এমনিতেই কোনো প্রতিষ্ঠানকে এতবড় ঋণ দেয়া মানে জনগণের টাকা লুট করা। ব্যাংকে এমনিতেই তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। দুর্ভিক্ষের আভাস শুনাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। এমন সময় এত বড় ঋণ দেখে আমরা চিন্তিত না হয়ে পারি না। ইসলামি ব্যাংক যদি ফল করে, তাহলে সব ব্যাংকই ফল করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন আছে বলে আমি মনে করি। কারণ, সরকারের সমর্থন ছাড়া দেশের এই বিপন্ন অবস্থায় এতবড় ঋণ পাওয়া ও দেওয়া সম্ভব হতো না। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব ছিল তদারকি করা। কিন্তু তারা কোনো তদরকি করেনি। ফলে একমাসের মধ্যে এতগুলো ঋণ দিতে পেরেছে ব্যাংকটি। এই অবস্থা সমাধান করতে হলে সরকারকেই করতে হবে। আর কারও ক্ষমতা নেই।’
বিষিয়টি নিয়ে উদ্বেগের কথা জানান আলেম লেখক ও গবেষক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘প্রথমে আমি ইসলামি ব্যাংক হিসেবে কথা বলি। এই ব্যাংকের ইসলামি অনুশাসন পালন নিয়ে যদিও প্রশ্ন আছে, তবুও তারা ইসলাম নাম ধারণ করে কাজ করছে। একটি ব্যাংকের মূল ম্যানেজম্যান্ট কমিটি হুট করে বদলে দেয়া তো ঠিক না। অথচ ইসলামি ব্যাংকের কমিটি বদলে দিয়ে দায়িত্ব তুলে দেয়া হয়েছে এমন কোম্পানির হাতে, যারা নিজেরাই ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে নিচ্ছে। এতবড় ঋণের জামানত হিসেবে তারা যতটুকু সম্পত্তি দেখিয়েছে, ব্যাংক ঋণ দিয়েছে তার কয়েক হাজার গুণ। যেটা একেবারেই অনুচিত। এটা শুধু ইসলামি ব্যাংকের ক্ষেত্রে কথা না, ইসলাম নাম ধারণ করা সব ব্যাংকেরই কথা।’
তিনি বলেন, ‘ব্যাপকভাবে সব ব্যাংকের কথাই যদি বলি, ব্যাংকগুলোতে টাকা জমা রাখে কারা? যারা টাকা জমা রাখে, তাদের ৭০ ভাগই মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত। তারা বিভিন্ন মেয়াদে বিভিন্ন প্রয়োজনে টাকা জমা রাখে। ধনীরা কিন্তু টাকা জমা রাখে না। টাকা লোন নিয়ে বিনিয়োগ করে। সুতরাং অনৈতিকভাবে ঋণ দেয়া মানে এসব জনগণের টাকা অন্যায়ভাবে নষ্ট করা। বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই আমরা চিন্তিত। কারণ, দেশের এখন করুণ পরিস্থিতি। সরকারপ্রধানও বারবার বলছেন, ২০২৩ সাল হতে পারে দুর্ভিক্ষের বছর। সেখানে নামস্বর্বস্ব, ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে এতবড় ঋণ দিয়ে দেয়া চিন্তারই বটে।’
মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ বলেন, ‘দেখা যাচ্ছে, ইসলামী ব্যাংকের ভেতরে কী হচ্ছে তা খতিয়ে দেখতে নড়েচড়ে বসেছে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। ইসলামী ব্যাংকের বিষয়ে তদন্তে নেমেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তিন সদস্যের পরিদর্শন দল। এটা নতুন না। পিকে হালদার যখন টাকা নিয়ে পালিয়ে গেল, তখনও এমন কমিটি করা হয়েছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ডাক্তার আসিবার পূর্বেই যদি এভাবে রুগী মারা যেতে থাকে বারবার, তাহলে এ ডাক্তার এসে তো লাভ নেই।’