ইসলামি সভ্যতায় নারী মুফতি

মুজাহিদুল ইসলাম :

নারীদের ফতোয়া প্রদানের বিষয়ে উপমহাদেশে বিশেষ কোন আলোচনা লক্ষ্য করা যায় না। পক্ষান্তরে আরব ও ইসলামি বিশ্বে মাঝে মাঝে ফতোয়া প্রদানের ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থান নিয়ে বিতর্ক দেখা যায়। এটা মূলত ফতোয়া ও কাযার (বিচারিক ক্ষমতা) ফারাক বোঝার সীমাবদ্ধতার কারণে। তাছাড়া এতকাল সুলতানরা সাধারণত পুরুষদেরকেই ফতোয়া প্রদানের দায়িত্ব দিয়ে এসেছেন। আর ইসলামি আইনজ্ঞদের নিকট কখনও নারীদের ফতোয়া প্রদানের বিষয়ে কোন মতানৈক্য ছিল না। যা মতভিন্নতা ছিল, তা মূলত বিচারিক ক্ষেত্রে তাদের নিয়োগকে কেন্দ্র করে। যুগে যুগে নারী হাদীসবিশারদ ও ফকীহদের অবদান নিয়েই বিদ্যমান এই প্রবন্ধ।

ইসলামের সূচনালগ্নে নারীদের ফতোয়া

ইবনুল কায়্যিম রহ. তার “ই’লামুল মুয়াক্কিয়ীন আন রাব্বিল আলামীন” নামক বিখ্যাত গ্রন্থে ফতোয়া দেয়ার শর্তাবলীর আলোচনায় যোগ্যতাকেই মূল মানদণ্ড নির্ধারণ করেছেন। নারী-পুরুষ ও স্বাধীন-গোলাম কারো সাথেই নির্দিষ্টি করে দেননি।

ফতোয়ার জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয় না, যা বিচারিক ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়। ফতোয়া হলো শরিয়তের কোন হুকুম বর্ণনা করা। যা পালনের কোন বাধ্যবাধকতা থাকে না। শুধু তাকে শায়খের শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে হবে। মুফতি কিংবা আলেম অথবা ফকীহের উপাধি গ্রহণের যোগ্যতার বিষয়ে সমকালীন আলেমগণের স্বীকৃতি পেতে হবে। সে যুগে উপাধিগ্রহণ অত সহজ কিছু ছিল না। জীবনচরিতে ফকীহ-বিশেষণে বিশেষায়িত ব্যক্তিরাই মূলত ফতোয়া দানের উপযুক্ত হিসেবে বিবেচিত হতেন।

ইবনুল কায়্যিমের মতে রাসূলের প্রায় একশ পচিশ জন সাহাবী থেকে বিভিন্ন ফতোয়া সংকলিত হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছেন আয়েশা রা.-সহ নারী ফতোয়া প্রদানকারী প্রায় ২২ জন।

আয়েশা রা. ও ফতোয়া

প্রথম শতাব্দীতে নারীদের ফতোয়ার চর্চা বেশ লক্ষ্যণীয় ছিল। আয়েশা রা.-কে সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী সাতজনের একজন গণ্য করা হয়। ইমাম যাহাবীর মতে তিনি সকল যুগের সেরা নারী ফকীহ। আবু বকর, উমর ও উসমানের খেলাফতের সময় তিনি ফতোয়া দিতেন। উমর ও উসমান রা. বিভিন্ন বিষয় তার নিকট চিঠি দিয়ে পরামর্শ নিতেন।

আয়েশা রা. শুধু ফতোয়া ও হাদীস বর্ণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি। বরং বিভিন্ন সাহাবীর সাথে ইলমি আলোচনা করেছেন। তাদের দেয়া বিভিন্ন ফতোয়ার ওপর সংশোধনী দিয়েছেন। তিনি এমন অনেক ফতোয়া দিয়েছেন, যা শুধু তার মাধ্যমেই প্রমাণিত। তার হাত ধরেই পরবর্তীতে ফতোয়া প্রদানের যোগ্য নারী ইসলামে অবদান রেখেছেন। যেমন- আমরাহ বিনতে আব্দুর রহমান, যিনি তার পরে ফতোয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন। সাফিয়্যাহ বিনতে শায়বাহ ও উম্মে দারদা।

প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের নারী শিক্ষক

তাবেয়ীদের যুগে মদিনার প্রসিদ্ধ সাত আলেমের প্রত্যেকেই নারীদের থেকে ইলম শিক্ষা করেছেন। সাইদ ইবনুল মুসায়্যিব আয়েশা থেকে, উরওয়া তার মা আসমা ও খালা আয়েশা থেকে, কাসিম তার ফুফু আয়েশা থেকে এবং উবায়দুল্লাহ আয়েশা থেকে ইলম গ্রহণ করেছেন।

ইমাম মালেক রহ. আয়েশা বিনতে সাআদ রা. থেকে ইলম গ্রহণ করেছেন। তাছাড়া ইমাম রহ. এর এক মেয়ে ফাতেমা তার ইলম সংরক্ষণ করতেন। তিনি দরজার পেছনে দাঁড়ানো থাকতেন। ইমাম মালেক রহ. এর কোন ছাত্র ভুল করলে তিনি দরজা নক করতেন এবং ইমাম মালেক রহ. তা সংশোধন করে দিতেন। ইমাম আবু হানিফা রহ. মূলত একজন নারীর প্রশ্নের কারণেই ফিকাহ শাস্ত্রে অগ্রসর হন।

পরবর্তী পাচঁশত শতাব্দীর খতীবে বাগদাদীর মতো মানুষ নারী মুহাদ্দিস ও ফকীহ তাহেরা বিনতে আহমাদ থেকে ইলম অর্জন করেছেন। ইমাম ইবনু আসাকির (৫৭১), হাফেজ সিলাফী (৫৭৬) ও ইমাম যাহাবী প্রত্যেকেই তাদের নারী শায়েখদের উল্লেখ কথা উল্লেখ করেছেন।

যুগেযুগে নারী মুফতি

ইতিহাসের সব যুগে পৃথিবীর সব অঞ্চলেই নারী মুফতি ছিল। হিজরি তৃতীয় শতাব্দীতে তিউনিসিয়ার কারওয়াইনের বিখ্যাত দুই জন নারী আলেম ছিলেন। আসমা বিনতে আসাদ (২৫০); তিনি ইলমি বিভিন্ন বিতর্কে অংশ নিতেন। তার প্রশ্নোত্তর মজলিস অনুষ্ঠিত হত। তার পিতা মালিকি মাযহাবের বড় ইমাম হওয়া সত্বেও তিনি ফিকহে হানাফি অনুসরণ করতেন। দ্বিতীয়জন মালিকি মাযহাবের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা ইমাম সুহনুনের মেয়ে খাদিজা (২৭০)।

ঠিক একই সময়ে মিসরে ছিলেন শাফেয়ি মাযহাবের পুরোধা ইমাম মুযানীর বোন (২৬৪); যিনি শুধু মুযানীর বোন নামেই পরিচিত ছিলেন। তিনি ইমাম শাফেয়ি থেকে ইলম অর্জন করেন। খোদ মুযানীর সাথেও বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক করতেন।

আন্দালুসে ফাতেমা বিনতে ইয়াহইয়াহ (৩১৯) আলেম, ফকীহ ও মুত্তাকী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার জানাযায় যত মানুষ অংশ নিয়েছিল, কোন নারীর জানাযায় এমন দেখা যায়নি।

ইরাকে উম্মে ঈসা (৩২৮) ফতোয়া প্রদান করতেন। কাযী হুসাইনের মেয়ে (৩৭৭) শাফেয়ি মাযহাবের পাণ্ডিতব অর্জন করে পিতার সাথে ফতোয়ার কাজ করতেন। খোরাসানে আয়েশা বিনতে আহমাদ (৫২৯) ফিকহের চর্চা করতেন। ফতোয়া দিতেন। একই শতাব্দীতে ইরাকে শাহদাহ বিনতে আহমাদ (৫৭৪) উলুমে ইসলামিয়াতে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। বিশেষত ফিকহে। তিনি পর্দার ওপাশ থেকে নারীদের পাঠদান করতেন। তার নিকট অনেকে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।

হিজরি সপ্তম শতাব্দীতে ছিলেন যায়নাব বিনতে আবুল কাসিম। তিনি তাফসীরে কাশশাফের রচয়িতা যামাখশারীসহ অনেক আলেম থেকে ইলম অর্জন করেন। আর তার নিকট ঐতিহাসিক খাল্লিকানসহ তৎকালীন অনেক বড় আলেমগণ ইজাযাত গ্রহণ করেন।

ইমাম নাজমুদ্দিন ইবনে ফাহাদ (৮৮৫) ১৩০ জন নারী থেকে ইলম অর্জন করেছেন। ইবনু হাজার (৮৫২) তার কিতাবে হিজরি অষ্টম শতাব্দীর ১৭০ জন নারী শায়েখের উল্লেখ করেছেন, যার মধ্যে ৫৪ জন থেকে তিনি বর্ণনা করেন। ইবনু হাজারের ছাত্র সাখাবী (৯০২) ৮৫ জন নারী থেকে ইলম অর্জন করেছেন। তার সমসাময়িক সুয়ূতি (৯১১) ৪৪ জন নারী শায়েখ থেকে ইলম অর্জন করেছেন।

মোটকথা সপ্তম ও হিজরি অষ্টম শতাব্দীর ইবনু হাজার ও যাহাবীসহ অন্যান্য যাদেরকে দিয়ে যুগের উদাহরণ দেয়া হয়, তাদের প্রত্যেকেই কোন না কোন নারী হতে হাদীস ও ইলম গ্রহণ করেছেন।

হিজরি দশম শতাব্দীতে কায়রোর বুকে উম্মে আব্দুল ওয়াহাব জ্ঞানের আলো বিতরন করেন। তিনি তৎকালীন বড় বড় আলিমদের থেকে ফতোয়া ও শিক্ষাদানের অনুমতি লাভ করেন।

হিজরি একাদশ শতাব্দীতে মক্কাতে আমরা পাই কুরাইশ বিনতে আব্দুল কাদিরকে (১১০৭)। তিনি বড় আলেম পরিবারের সদস্য হওয়ার পাশাপাশি তিনি বড় মাপের ফকীহ ছিলেন। বাড়িতে তার নিকট হাদীসের কিতাব মানুষ পড়তো। এমনকি একাদশ শতাব্দীতে মক্কায় যে সাত হিজাযি সনদ খ্যাতি লাভ করে, তার এক সনদের মূল তাকে গণ্য করা হয়।

গ্রন্থনায় নিরাসক্তি ও নির্মম ফলাফল

ফিকহের ক্ষেত্রে নারীদের এমন লক্ষ্যণীয় উপস্থিতি সত্বেও ফিকহের কিতাবে উম্মাহাতুল মুমিনীন ছাড়া অন্যদের মতামত পাওয়াই যায় না। তবে এর কিছু কারণ রয়েছে। সাধারণত ফুকাহায়ে কেরাম তাদের কিতাবে প্রসিদ্ধ মতই আনেন। আবার নারী ফকীহের ক্ষেত্রে দেখা যায়, হয়তো তার পিতা কিংবা স্বামী বড় আলেম হয়। ফলে তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট আলাদা করে আর সামনে আসে না। যাই বলি না কেন, তবে এর সবচে বড় কারণ হিসেবে তাদের লেখনীর অনুপস্থিতিই দায়ী। লেখনীই মানুষকে জীবিত রাখে। অবশ্য আরব সমাজের নারীকে অন্দর মহলের বস্তু বিবেচনা করায় তাদের অবদানকেও সামনে আনা হয়নি, একেও কারণ হিসেবে দেখানো যায়।

আগের সংবাদহিজাব: নারীর জন্য পর্দা কেন জরুরী?
পরবর্তি সংবাদনারী : প্রেক্ষিত ইসলাম ও বস্তুবাদ