ইসলামী সভ্যতায় নৈতিক নজরদারী

আহসান জাইফ

বিশিষ্ট মার্কিন চিন্তাবিদ মাইকেল কোক ‘ইসলামী চিন্তায় সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ’ নামক গ্রন্থে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। এই ঘটনাটিই হয়তো বইটি লেখতে তাকে বিশেষভাবে প্রণোদিত করেছে। ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস। দিনদুপুরে শিকাগোতে বহু লোকের উপস্থিতিতে এক মহিলা ধর্ষিত হয়। পরবর্তীতে নিউইয়র্ক টাইমসের বরাতে জানা যায়, উপস্থিত কেউই ঐ মহিলার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি, ধর্ষণটা ঘটেছিল ভীড়ের মধ্যে, উপস্থিত লোকেরা সাহায্যের আবেদন ও চিৎকার শোনা সত্ত্বেও কেউ প্রতিবাদ কিংবা ওই মহিলাকে সাহায্য করেনি।

মাইকেল কোক ঘটনাটি সম্পূর্ণ বর্ণনা করার পর লেখেন, এটি সেসকল লোকদের জন্যে সর্বসম্মতভাবে অনৈতিক কাজ ছিল, যারা প্রকাশ্যে স্বচক্ষে এ ধরনের অপরাধ দেখেও এগিয়ে আসেনি। একই সাথে এসব ক্ষেত্রে আমাদের নিকট কোনো ব্যপক চিন্তাধারা এবং পদ্ধতিমূলক উপায় মওজুদ নেই, যার মাধ্যমে এসব সংকটকে সঠিকভাবে মোকাবেলা করা যেতে পারে। আমাদের নিকট মোটাদাগে নৈতিক মূল্যবোধের একটি ধারণা রয়েছে, সেটা ঠিক, কিন্তু এমন কোন নৈতিক বিশ্বাস নেই, যা আমাদের সভ্যতাকে সঠিক সক্রিয়তার দিকে পরিচালিত করবে।

মাইকেল কোকের সাহসী স্বীকারোক্তি, পশ্চিমা সভ্যতার নিকট নৈতিক নজরদারীর কোন মানদণ্ড নেই। এমন মানদণ্ড যাকে আপামর জনতা নৈতিকতা বলে স্বীকার করে। বরং আপাতত স্বীকৃত নৈতিকতাগুলোও ছিল বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিকদের তর্কের বিষয়-বস্তু। ইসলামে মূল্যবোধ নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোন সংকট কখনই ছিল না, কিছু বিষয় টেক্সটে সুস্পষ্ট বলা আছে, কিছু বিষয় সামগ্রিক নৈতিকতার ভিত্তিতে  বোঝাপড়ায় শামিল হয়েছে। মাইকেল কোক স্বীকার করেন, সভ্যতার ইতিহাসে ইসলামই প্রথম সুবিন্যস্তভাবে নৈতিক নজরদারী ও মূল্যবোধ প্রয়োগের এক সুবিশাল ক্ষেত্র তৈরি করেছে, যাকে এক বাক্যে বলা হয়–আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার।

এই নৈতিক নজরদারীর অধিকার প্রত্যেকে সমানভাবে সংরক্ষণ করে। সমাজের ভেতরে ঘটমান ধর্মীয় ও জাগতিক নৈতিকতায় ব্যাঘাতকারী সকল বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে যে কেউ । রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করার জন্যে যে দল কিংবা সংস্থা রয়েছে, তার দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নৈতিক নজরদারী। কিন্তু ব্যক্তি পর্যায়ের নৈতিক নজরদারীও আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকারের একটি অন্যতম লক্ষ্য। তবে ব্যক্তি পর্যায়ের এই নৈতিক নজরদারীর ক্ষেত্রে খেয়াল রাখা দরকার, যাতে এই নজরদারী ও সক্রিয়তা খোদ অনৈতিক না হয়ে যায়। ব্যক্তি পর্যায়ের নজরদারীর প্রায়োগিক সীমাবদ্ধতার প্রতি খেয়াল রেখেই এই কাজটি সম্পন্ন করতে হবে।

বিগত কিছুদিনে আমাদের দেশে ছেলেধরা সন্দেহে কিংবা অন্য যেকোন অপরাধে গণপিটুনিতে যে হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন হলো, তাকে কিছুতেই নাহি আনিল মুনকারের আওতাভুক্ত বলা যাবে না। বরং যারা এই গনপিটুনির প্রতিবাদ করেননি, তারা বরং এইক্ষেত্রে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ না করার দায়ে দায়ী হবেন। কেননা এখানে আপত্তির জায়গা দুটি। প্রথমত, কেবল সন্দেহের ভিত্তিতে হত্যা করা, তথা যথাযথ তদন্তবিহীনভাবে এমন শাস্তি দেয়া হয়েছে, যা কেবল রাষ্ট্র প্রয়োগ করতে পারে। দ্বিতীয়ত যদি আদতেই অপরাধী হয়, তবুও বিচারিক প্রক্রিয়া ও আত্মপক্ষ সমর্থনসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়বস্তু,যা একজন আসামীর অধিকার, সেগুলোর প্রতি পরোয়া না করে হত্যা করা হয়েছে, ফলে বলা যায় এই হত্যাকাণ্ডগুলো সুনিশ্চিতভাবে অনৈতিক কাজ।

রাষ্ট্রীয় নজরদারী সংস্থা ও ইসলামী ঐতিহ্যবাদী চিন্তা

ইসলামী চিন্তা ও সভ্যতায় সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের গোড়াপত্তন করে এই আয়াতটি–‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, মানুষের কল্যাণের জন্য যাদের সৃষ্টি করা হয়েছে, সৎ কাজের আদেশ করবে, অসৎ কাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর প্রতি ইমান আনবে ‘

ইসলামী রাজনীতিতত্ত্বের কতিপয় বিশেষজ্ঞ একে শাসক ও রাষ্ট্রের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব হিসেবে দেখেছেন, যেমনটা ইমাম আবু ইয়ালা আহকামুস সুলতানিয়াতে লিখেছেন। কিন্তু তারই সমসাময়িক ইমাম আল জুয়াইনী আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকারকে শাসকের নিকট অর্পিত দায়িত্বের চেয়ে বেশি ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখেছেন। এই ব্যাপারে তিনি তার বই গিয়াসুল উমাম-এ আলোচনা করেন। তিনি বলেন, দ্বীনের শুরু থেকে শেষ সবই সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের সাথে সম্পৃক্ত এবং গোটা উম্মতের ওপর এই দায়িত্ব অর্পিত।

ইমাম জুয়াইনী এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেছেন। তা হচ্ছে, ‘অসৎ কাজের নিষেধ ব্যক্তিপর্যায়ে কেবল উপদেশ ও নম্র ব্যবহারের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে। কঠোরতা কিংবা উচ্চপর্যায়ের লোকদের তোষামোদি হিসেবে করা যাবে না। ঠিক তেমনিভাবে অসৎ কাজে বাধা প্রদানে অস্ত্রের ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। (যেমন রমজান মাসে কাউকে প্রকাশ্যে খাওয়ার কারণে মারধর করা)। কাউকে শাস্তি প্রদানের বিষয়সমূহ রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত হবে। অত্যাচারী ফাসেক শাসকের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহকে ইমাম জুয়াইনী নাহি আনিল মুনকার হিসেবে বিবেচনা করতেন না। এছাড়া হাদীসেও শাসকের কুফরী প্রকাশ না পাওয়া পর্যন্ত সশস্ত্র বিদ্রোহ করতে নিষেধ করা হয়। তবে এগুলো আরও ব্যাখ্যাসাপেক্ষ বিষয়।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নৈতিক নজরদারি ইসলামের অস্ত্বিত্বের সাথে যুক্ত ছিল শুরু থেকেই। সমাজের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় নৈতিক নজরদারী এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ, এমনকি বাজারে/ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এর চর্চা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সময় থেকে খুলাফায়ে রাশেদিনসহ পরবর্তী ইসলামী শাসনব্যবস্থাতেও জারি ছিল। হযরত উমর রা.-এর শাসনকালে রোমের সম্রাট রাষ্ট্রীয় সৌজন্য হিসেবে উপহারসহ দূত প্রেরণ করলেন। উক্ত সংবাদদাতা মদীনায় এসে জিজ্ঞেস করলো, খলীফার রাজপ্রাসাদ কোথায়? লোকেরা বলল, রাজপ্রাসাদ তো তার নেই, তার একটি ছোট ঘর রয়েছে কেবল। ঐ দূত হযরত উমরের বাড়িতে এসে দেখলেন, ঘরটি খুবই জরাজীর্ণ একটি কুটির। সেখানে উমর ছিলেন না। লোকেরা বলল, তিনি বাজারের শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য পরিদর্শনে  বাজারে গিয়েছেন। তারপর দূত তার খোঁজে পুনরায় বের হলে দেখতে পেল অর্ধেক পৃথিবীর সম্রাট কাজ শেষে একটি গাছে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছেন।

আমরা দেখলাম, কিভাবে একজন খলীফা সমাজে নৈতিক নজরদারীর কর্তব্যকে নিজ দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আব্বাসী ও উমাইয়া খেলাফতের সময় এই সামাজিক দায়িত্বের জন্য গোয়েন্দা নিয়োগ করা হত, যারা দুনিয়াবী বিষয়সমূহ তথা রাস্তাঘাটে ও বাজারে বিভিন্ন অপরাধকে নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় কাজ করতেন।

দামেস্কের জনৈক শাসক একবার এক আলিমকে বললেন, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ আপনাদের দায়িত্ব, সুতরাং তা যথাযথভাবে আপনাদেরকে পালন করতে হবে। অতঃপর ঐ আলিম বললেন, তাই যদি হয় তাহলে আপনি আপনার সিংহাসন হতে উঠে দাঁড়ান, মাথার পাগড়ি খুলে ফেলুন, কেননা তাতে রেশম রয়েছে, সোনার আংটি ফেলে দিন, কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমার উম্মতের পুরুষদের জন্য রেশমী পোশাক ও স্বর্ণ ব্যবহার করা হারাম।

এ ছাড়াও ফুকাহায়ে কেরাম লিখেছেন, যদি মহিলাদের চলাচলের রাস্তায় কোন পুরুষ তাদের উত্যক্ত করে তবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়োজিত সংস্থা তাকে শাস্তি প্রদান করবে এবং আদাব শেখাবে।

ঠিক তেমনিভাবে কোন নারীকে উত্যক্ত হতে দেখলে তাতে বাধা দেয়া ব্যক্তি পর্যায়েও আবশ্যক। এ ব্যাপারে আমাদের দীনদার সমাজেও অনেক অনীহা দেখা যায়। ফলে আল্লাহ তায়ালা ধর্ষণের মত যিল্লতি আমাদের উপর চাপিয়ে দেন।

আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকারের ব্যাপারে ফুকাহায়ে কেরাম বেশ সচেতনভাবে তাদের বইপত্রে লিখেছেন, এমনকি প্রায়োগিক উদাহরণের সাথেও এই নীতিকে ব্যাখ্যা করেছেন।তন্মধ্যে ইমাম মাওয়ারদির লিখিত আহকামুস সুলতানিয়া, ইমাম গাযালির ইহইয়া উলুমিদ দীন, ইবনে তাইমিয়ার আল হিসবাহ ফিল ইসলাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইবনে জুমআহর লিখিত তাহরীরুল আহকামেও এ বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে।

সামাজিক পর্যায়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ইসলামের একটি অন্যতম শিক্ষা, এমনকি গোটা ইসলামই সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ — এই নীতির সাথে যুক্ত, যেমনটা ইমাম জুয়াইনী বলেছেন। এই নীতি কেবল ধর্মীয় ইবাদাতের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নয়, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি পরিবেশকে ক্ষতি করে এমন সব কাজ ও নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাও এই মূলনীতির অন্তর্গত।

ইসলামী সভ্যতায় কখনো নৈতিক মূল্যবোধ কাকে বলে, এই প্রশ্ন ও সংকট ছিল না। কিন্তু পশ্চিমা সভ্যতার সূচনা ও বর্তমান অবস্থান, এই সংকটের উপর দাঁড়িয়ে আছে। ইসলামী আইন যেকোন অপরাধকে ওহী দ্বারা চিহ্নিত করার মাধ্যমে তার সাথে বোঝাপড়া করে। অপরাধ দূরীকরণ ও রোধ করার ক্ষেত্রে টেক্সট ও তাহকীক আল মানাতের সামঞ্জস্যকরণের মাধ্যমে বৌদ্ধিক প্রক্রিয়ায় সমাধানে পৌঁছায়। আমাদের এই প্রচন্ডরকমের অস্থির সময় ও দেশে আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকারের পুনরজ্জীবিকরণ ভীষণভাবে প্রয়োজন।

লেখক : তরুণ একটিভিস্ট 

আগের সংবাদইরানে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান : রাষ্ট্র, ধর্ম ও ঐতিহ্যের বিতর্কে
পরবর্তি সংবাদহজের সফরে শহীদ মালিক আল শাহবায ম্যালকম এক্স যেভাবে বিপ্লবী হয়ে উঠেছেন