ইসলাহি জোড়: প্রথাগত মাহফিলের বাইরে বিশুদ্ধতার আয়োজন

রাকিবুল হাসান নাঈম:

একটি গাড়ি এসে থামলো মাদরাসার সামনে। রাত তিনটা। গাড়িটি এসেছে রাজশাহি থেকে। ব্যাগ-বিছানা হাতে গাড়ি থেকে নেমে আসছেন মুসল্লিরা। মুসল্লিদের মধ্যে আলেম যেমন আছেন, তেমনি আছেন সাধারণ লোকজনও। তাদের মুখ পড়লে বুঝা যায়, এই শীতের রাতে তারা রাজশাহী থেকে ঢাকা এসেছেন নিতান্তই শখে নয়, এসেছেন শুদ্ধ হবার নিরেট আবেগ নিয়ে। তাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে তাদের নির্ধারিত খিত্তায় নিয়ে গেলো অভ্যর্থনাকারীরা। তখন গতকালই এসে উপস্থিত মুসল্লিরা কেউ কেউ তাহাজ্জুদের জন্য জেগে উঠছেন।

ঢাকার উপকণ্ঠের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম মাদানী নগরে শুরু হয়েছে দুদিনব্যাপী ইসলাহি জোড়। আজ শুক্রবার বাদ ফজর মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা ফয়জুল্লাহ সন্দ্বীপীর বয়ানের মাধ্যমে শুরু হয় ইসলাহি জোড়ের কার্যক্রম। শনিবার রাত ৯টায় আখেরি মুনাজাতের মাধ্যমে এ আয়োজনের সমাপ্তি ঘটবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথাগত মাহফিলের চেয়ে ভিন্ন অঙ্গিকে পরিচালিত হয় এই জোড়। এ জোড়ে সারাদেশ থেকে কয়েক হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করে। বিশেষ করে দারুল উলুম মাদানী নগরের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইদরিস সন্দ্বীপীর ভক্ত-মুরিদরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে উপস্থিত হন। জোড় শেষে নিজেকে শুদ্ধ করার প্রত্যয় নিয়ে ফিরে যান তারা।

দারুল উলুম মাদানী নগর মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইদরিস সন্দ্বীপী ছিলেন যুগের সংস্কারক। তার মিশন ছিল দাওয়াত, তালিম ও তাজকিয়া। তিনি সর্বস্তরের মানুষের কাছে দ্বীনের শিক্ষা বিস্তারের লক্ষে বাংলাদেশ, আমেরিকা ও আবুধাবীসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেড় শতাধিক কওমী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। এসব মাদরাসাকে নিয়ন্ত্রণের সুবিধার্তে গঠন করেছেন তালীমী বোর্ড মাদারিসে কাওমিয়া আরাবিয়া নামের স্বতন্ত্র শিক্ষাবোর্ড। দেশব্যাপী রয়েছে তার অসংখ্য ভক্ত মুরিদান। তাদেরকে আধ্যাত্মিক দিক-নির্দেশনা দেয়ার জন্য আয়োজন করতেন এ বার্ষিক ইসলাহি জোড়। তার ইন্তেকালের পর তার মিশন চালিয়ে নিচ্ছেন তারই সুযোগ্য সন্তান মাওলানা ফয়জুল্লাহ সন্দ্বীপী। এই জোড়টি ৩৮ বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

প্রথাগত মাহফিল নয়

প্রতি বছর ইসলাহি জোড়ে অংশ নেন ভারত ও বাংলাদেশের বরেণ্য ওলামায়ে কেরাম। কিন্তু প্রথাগত মাহফিলের মতো অতিথিদের নাম দিয়ে জোড়ের পোস্টার ছাপানো হয় না। কেবল হেন্ডবিল ছাপানো হয় জোড়ের তারিখ উল্লেখ করে।

এবারের জোড়ে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকছেন ভারতের বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দের মুহাদ্দিস আওলাদে রাসূল সায়্যিদ আরশাদ মাদানি। এছাড়াও উপস্থিত থাকবেন ভারতের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মাওলানা সোহরাব আলী কাসেমি। বাংলাদেশী শীর্ষ আলেমদের মধ্যে উপস্থিত থাকছেন ওলামা বাজার মাদরাসার প্রবীন উস্তাদ মাওলানা নুরুল ইসলাম, কাকরাইলের তাবলীগি মারকাজের মুরুব্বী মাওলানা জুবায়ের আহমাদ, আকবর কমপ্লেক্সের মুহতামিম মুফতি দেলাওয়ার হোসাইন, মারকাযুদ দাওয়া ঢাকার শিক্ষাসচিব মুফতি আব্দুল মালেক, রাজশাহীর শীর্ষ আলেম মাওলানা জামালুদ্দিন সন্দ্বীপী ও মুফতি উমর ফারুক সন্দ্বীপী প্রমুখ।

মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা মাহবুবুর রহমান ফাতেহকে বলেন, প্রতিদিন মাহফিলের কার্যক্রম ফজরের পর শুরু হয়। সকালে কয়েকজন বক্তার বয়ানের মধ্য দিয়ে প্রাথমিক পর্ব শেষ হয়। পরে বেলা ১০টার দিকে মানুষকে নামাজ-কালাম ও প্রাত্যহিক জীবনের প্রয়োজনীয় মাসায়েল শিক্ষা দেয়া হয়। জোহরের পরও শেখানোর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। পরে আসরের আগ থেকে আবার বয়ান শুরু হয়। এশার আগ পর্যন্ত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন উলামায়ে কেরাম বয়ান করেন। এশার পর আর কোনো আলোচনা হয় না। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করি, যেন এখানে যারা আসেন, তাদের সময়ের সদ্ব্যবহার হয়। এ সময়ে আমরা তাদের জন্য এমন আলোচনারই ব্যবস্থা করি, তা তাদের জীবন পরিবর্তনে সহায়ক হবে।

তিনি আরও জানান, আগত মুসল্লিদের সময় যেন যথাযথভাবে কাজে লাগে, সেজন্য মাদরাসার পক্ষ থেকে রয়েছে শিক্ষামূলক নানা উদ্যোগ। মাদরাসার প্রত্যেক কামরার জন্য একাধিক প্রশিক্ষকের ব্যবস্থা রয়েছে। তারা আগত মেহমানদের নামাজ-কালাম শিক্ষা দেন। প্রয়োজনীয় মাসয়ালা-মাসায়েল শেখান। এ সময় তাদেরকে বিশুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াতেরও মশক করানো হয়।

গোছালো আয়োজন ও মেহমানদারি

জোড়ে আগত মুসল্লিদের থাকার জায়গা ও মেহমানদারি সুষ্ঠুভাবে করার জন্য কর্তৃপক্ষ প্রতি বছরই বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। প্রথমেই পুরো মাদরাসাকে ভাগ করা হয় জেলাভিত্তিক। কোন জেলার মুসল্লিরা কোথায় কোন ভবনে থাকবেন, আঁকা হয় মানচিত্র। মুসল্লিরা এলে অভ্যর্থনাকারীরা তাদেরকে নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যান। সেখানে তারা বিশ্রাম নেন। মাদরাসার শিক্ষকরা সবসময় টহলে থাকেন। কেউ জায়গা না পেলে ব্যবস্থা করেন তারও।

আগত মুসল্লিদের দেয়া হয় দুইবেলা খাবার। খাবার পরিবেশন করা হয় মাঠেই। এছাড়াও এই মাদরাসার ফুজালা ও আবনাদের জন্য রয়েছে বিশেষ মেহমানদারি। তাদের জন্য বরাদ্দ করা আছে আলাদা রুম, বিছানা, খাবার। তাদের খাবার তাদের রুমে পৌঁছে দেয়া হয়।

প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় নরসিংদি থেকে আসা মুসল্লি হামিদুর রহমানের সঙ্গে। তিনি একজন স্কুল টিচার। স্থানীয় আলেমের কথায় তিনে এই জোড়ে এসেছেন। এসে কেমন লাগছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এত গোছালো আয়োজন কোথাও দেখিনি। একজন মানুষের যা যা দরকার, তার সবই সরবরাহ করা হচ্ছে মাদরসার পক্ষ থেকে। খাবারের চিন্তা করতে হচ্ছে না, ঘুমানোর জায়গা নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে না। সময়ে সময়ে কেবল মানুষ বয়ান শুনবে, আমলে অংশ নিবে। এবারই প্রথম এলাম। আমি নিয়ত করেছি, প্রতি বছর আসবো।

অন্যবারের তুলনায় মুসল্লি বেশি

এবার অন্যবারের তুলনায় বেশি মুসল্লি উপস্থিত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন মাওলানা ইদরিস সন্দ্বীপী রহ.-এর ছেলে এবং মাদরাসার শিক্ষক মুফতি কেফায়াতুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘এবার শীতও কম, পরিবেশ নাতিশীতোষ্ণ। ফলে মানুষ এসেছে বেশি। আমরা চাই, এ ধরণের শিক্ষণীয় মাহফিলে মানুষ উপস্থিত হোক। যত বেশি মানুষ উপস্থিত হবে, তত মানুষ উপকার বেশি পাবে। তাই এটা আশাব্যঞ্জক।’

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, এবার বিভিন্ন জেলার জন্যে যে জায়গা বরাদ্দ করা হয়েছে, তাতে সংকুলান হতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। মাদরাসার শিক্ষকরা তাদের জায়গা করে দিচ্ছেন। কেউ কোনো সমস্যায় পড়লে সমাধান করে দিচ্ছেন।

যেখানে ইসলাহি জোড়ের স্টেজ, তার পাশেই মাওলানা ইদরিস সন্দ্বীপী রহ.-এর কবর। তাতে ফুটে আছে হাসনাহেনা ফুল। সৌরভে মৌ মৌ করছে চারদিক। মুসল্লিরা আসছেন, কবর জিয়ারত করছেন, দোয়া করছেন। দৃশ্য দেখতে দেখতে আমিও দাঁড়াই, খানিক সৌরভ নেই। হাসনাহেনার সৌরভমাখা শীতের সকালের তুলনা হয় না।

 

আগের সংবাদমধ্যবর্তী মার্কিন নির্বাচন: রেকর্ডসংখ্যক মুসলিম প্রার্থীর বিজয়
পরবর্তি সংবাদতিনি ছিলেন দেশের জন্য রত্ন: পাক রাষ্ট্রপতি