’ইসলাহুল আওয়াম’: থানবির ওয়াজ-নসিহত

আশরাফুল হক:

কাউকে নিয়ে লিখতে হলে তাকে ধরতে হয়। হযরত আশরাফ আলী থানবি রহ.-কে ধরার মতো বা অনুভব করার মতো অন্তর যে সহজে অর্জনীয় নয়, তা বুঝতে পেরেছি সেই ছোট্ট ছাত্রজীবনে। দেখুন—‘দ্বীনের অঙ্গ পাঁচটি। আকায়েদ, ইবাদাত, মোয়ামালাত, বাতেনী আখলাক সংশোধন, সামাজিক নীতিমালা। প্রথম চারটির প্রতি আলেম এবং জনসাধারন কোন না কোনভাবে দৃষ্টি দিয়েছেন। এ চারটিকে দ্বীন মনে করেছেন। কিন্তু সামাজিক নীতিমালাকে সেগুলোর মতো সাধারণত দ্বীনের অঙ্গ মনে করা হয় না। আমার মতে বর্তমান যুগে আমাদের মাঝে পরিলক্ষিত বিভেদ ও অনৈক্যের প্রধান কারণ সামাজিক অসদাচরণ। কারণ, সামাজিক অসদাচরণের সূত্র ধরে মানুষের মাঝে ঘৃণা ও বিদ্বেষের উৎপত্তি ও বিস্তার হয়।’ থানবি রাহ. যখন এ কথাগুলো বলেন, তখন সহজেই বুঝা যায় তার চিন্তার বৃন্ত কেমন উচ্চাঙ্গ অধরায় অবস্থান করছে। থানবি রহ. আরো বলেন, ‘গুরুত্বের দিক বিবেচনায় সামাজিক সদাচরণের স্থান হওয়া উচিৎ আকায়েদ ও ইবাদাতের পর। কিন্তু আকায়েদ ও ইবাদাতে ত্রুটি থাকলে মানুষ নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সামাজিক সদাচারে ত্রুটি থাকলে অন্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাই সামাজি সদাচারের গুরুত্ব আকায়েদ ও ইবাদাতের চেয়ে অগ্রে।’

থানবির বিশ্লেষণে সদাচারের গুরুত্ব সততাকে ছাপিয়ে ওঠে। তিনি দেখেন- মানুষের জীবন ও ইজ্জত-আব্রুর মূল্য সম্পদের চেয়ে বেশি। মানুষ সৎ হলে তার থেকে অন্যের সম্পদের নিরাপত্তা আসে, আর মানুষ সদাচারী হলে তার থেকে অন্যের জীবন ও ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা আসে। তবে জীবন, ইজ্জত-আব্রু এবং সম্পদ তিনটিকেই তিনি গুরুত্ব দেন। এ ক্ষেত্রে তিনি বিদায় হজের ভাষণে প্রদত্ত রাসূলের এই বাণীটি উল্লেখ করেন– তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ এবং তোমাদের ইজ্জত একে অপরের জন্য কেয়ামত পর্যন্ত হারাম করা হলো।

থানবিকে আমাদের সমাজ একজন যিকির-আযকারের পীর হিসেবে গ্রহণ করে থাকলে তা হবে বিরাট ভুল। থানবি রহ. বলেন, ‘অজিফা ত্যাগ করলে কেয়ামতের দিন কিছু হবে না, বান্দার হক আদায় না করলে বিপদে পড়তে হবে। বান্দার হক আদায় করা অজিফা ও যিকিরের চেয়েও বেশি জরুরি, কারণ অজিফা পাঠ করা মুস্তাহাব আমল। মানুষ জরুরি কাজ বাদ দিয়ে কম জরুরি বিষয়ে মেতে থাকে।।’

থানবির এ বক্তব্যে হযরত উসমান রাদি.-এর উক্তিটিই যেন ব্যাখ্যায়িত হয়েছে- ‘মানুষের হক সম্পর্কে অসচেতন ব্যক্তি আল্লাহর হক সম্পর্কে সচেতন হতে পারে না।’

হযরত থানবি রহ. মানবকল্যাণের মাপকাঠি দেখেন আল্লাহর ফরমানকে। তিনি বলেন, ‘কোন জিনিসের ভালমন্দ মাপকাঠি আল্লাহ যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই মেনে নিতে হবে।’ মানবকল্যাণ সাধনে সাধারণ মানুষের জন্য এই একটি বক্তব্যের গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষের চিন্তার স্বাধীনতার আড়ালে ভালমন্দের মাপকাঠি মানুষের বিবেকের উপর স্থাপন করা হলে সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া নিশ্চিত। থানবি রহ. মানবতার পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘মানবতার সারমর্ম হলো তোমার দ্বারা যেন অপরের হক নষ্ট না হয়।’ মানবতার এই পরিচয় দিয়ে তিনি জনসাধারণকে সচেতন করেন– ‘বুযুর্গী অন্বেষণের আগে মানবতার অন্বেষণ প্রয়োজন।’

হযরত থানবি রহ. জনসাধারণের ইসলাহের ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে আমলে উদ্বুদ্ধ করার চেয়ে মানুষের সামনে আমলের পরিচয় ও গুরুত্ব অনুপাতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি ওয়াজিব ও মুস্তাহাবের ফারাক ধরে মানুষকে সচেতন করতেন। তিনি ওয়াজিবের চেয়ে ওয়াজিব নয়—এমন আমলকে গুরুত্ব দিলে তা জুলুম বিবেচনা করতেন। থানবি রহ. মনে করতেন- সাধারণ মানুষের ইসলাহের ক্ষেত্রে শুধু যিকির-আযকার নয়, মানুষ প্রকৃত মুসলমান হওয়ার জন্য সকল ক্ষেত্রে পরিমিতিবোধ, সুরুচি, দূরদর্শিতা বা পরিণামদর্শিতা, উদার অন্তর ইত্যাদি আবশ্যক। থানবীর দৃষ্টি হলো– যে কোন বিষয়েই কাউকে ছাত্র বানাতে হলে তাকে নীতি, পদ্ধতি ইত্যাদির খেয়াল রেখে শিখাতে হবে। তা জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প বা রুটি বানানোই হোক না কেন। আগে নিজেকে সংশোধন হতে হবে, না হয় অপরকে সংশোধন করতে পারবে না। মানুষকে সুরুচির প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। কারণ কুরুচিতে অন্তর নোংরা হয়ে পড়ে।

থানবি রহ. তার ওয়াজ-আলোচনায় দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে কথা বলতেন। নিজের দায়িত্বের পরিধি বুঝতে বলতেন। পরিধির বাইরে দায়িত্ব ফলানোকে বিশৃঙ্খলার কারণ হিসেবে দেখতেন। এমনকি অন্যের অধীনস্থকেও কিছু বলার আগে অধিপতির অনুমতি নিতে বলতেন। সে ক্ষেত্রে অধিপতি নিজের অধীনস্থ হলেও তার অনুমতি নিতে বলতেন। থানবীর দৃষ্টিতে বিশৃঙ্খলা বে-বরকতীর কারণ। তিনি শিষ্যদের নসীহত করতেন–বেহিসাবী এবং অপরিণামদর্শী হওয়া যাবে না। মুসলমানদের পতনের কারণ এ দুটি। তার বয়ানে ফুটে উঠতো নীতি ও নিয়মের প্রয়োজনীয়তা। বাস্তব জীবনে নীতি ও নিয়মের ভিতর থেকে কেউ ভুলত্রুটি করলেও থানবী তাকে মার্জনার দৃষ্টিতে দেখতেন।

হযরত থানবি রহ. ওয়াজ-নসীহতে ছিলেন উদারনৈতিক। জায়েযকে জায়েযের পাল্লায় রেখে কথা বলতেন। তাকওয়া অবলম্বনের নামে কোন বিষয়কে নাজায়েয বলতেন না এবং কাউকে লাঞ্ছিত করতেন না। একবার তার কাছে ফতোয়া চাওয়া হয় জনৈক নারীর ব্যাপারে। নারী বেপর্দায় চলেন। মুচি ও মেথরদের সাথেও তমিজ রাখেন না। নারীর স্বামীও এ বিষয়ে উদাসীন। এই নারীর রান্না খাওয়া জায়েয হবে কি? তাকওয়ার দৃষ্টিতেই বা এর হুকুম কি? থানবি রহ. উত্তরে বলেন, ‘কাফেরের হাতের রান্না খাওয়াও জায়েয, আর এই নারী তো মুসলমান! আর তাকওয়ার বিষয়ে কোন মুত্তাকী মানুষকে জিজ্ঞেস করুন।’

ফতোয়া প্রসঙ্গে থানবি রহ. অবাক হয়ে বলেন, ‘মনে হয়– এই ফতোয়াপ্রার্থী কোন পাপ কাজ করে না! হাল জমানার জোনায়েদ বাগদাদী আর কী! ফতোয়া নিয়ে অপরকে লাঞ্ছিত করাই এদের উদ্দেশ্য।’ আলোচনার শেষে তাকওয়া অবলম্বনের নামে যারা জায়েযকে না-জায়েযের পাল্লায় নিয়ে যায় এবং কাউকে লাঞ্ছিত করে, তাদেরকে অহঙ্কারী বলে সম্বোধন করেন।

থানবি রহ. আদবকেতার প্রতি ছিলেন সতর্ক মানুষ। তিনি আদবের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে– আদব হলো শান্তির নাম। যে কাজে অন্যের কষ্ট হয়, তা আদব নয়। হযরত ইয়াকুব রহ. বলতেন, আমার সম্মানে তোমরা উঠে দাঁড়িয়ো না। সুতরাং এ ক্ষেত্রে না উঠাই আদব। এ প্রসঙ্গে থানবি রহ. এর ওয়াজ-নসীহতে জনসেবার গুরুত্ব ও প্রেরণা ফুটে উঠতো। জনসেবার অর্থ হলো– কোন পুরস্কার ও পারিশ্রমিক ছাড়াই আল্লাহর সৃষ্টির সেবা করা। জনসেবার এই অর্থ সামনে রেখে থানবি রহ. শিষ্যদের উপদেশ দিতেন– অন্যান্য দ্বীনী কাজের মতো জনসেবাও জরুরি। অন্যের চিন্তা যে করে না, সে পশু সমতুল্য। পশু যেমন একজনকে মরতে দেখলেও নিশ্চিন্তে ক্ষেতের ফসল খেতে থাকে। থানবি রহ. জনসেবাকে উচ্চস্তরের আখলাক হিসেবে অভিহিত করেন। তবে জনসেবা করতে গিয়ে যেন নিজের দ্বীন ও ঈমানের ক্ষতি না হয়, সেদিকেও শিষ্যদের সতর্ক থাকতে বলতেন।

থানবি রহ. মানুষকে আমলের পাশাপাশি স্বাস্থ্য-সচেতন থাকতে বলতেন। শরীয়ত অনুমোদিত আরাম-আয়েশ করতে বলতেন। তিনি বলতেন, মুস্তাহাব আমলের চেয়ে স্বাস্থ্যরক্ষার গুরুত্ব বেশি। যেমন ভোরের বায়ু গায়ে মাখার জন্য খোলা মাঠে যাওয়া মসজিদে ইশরাকের নামায আদায়ের জন্য বসে থাকার চেয়ে উত্তম। জনৈক রোগীকে ডাক্তার বেশি বেশি ঘুমাতে পরামর্শ দেয়। রোগীর এতে আমলের সময় কমে যায়। রোগী থানবি রহ. এর কাছে পরামর্শ চায়– ডাক্তারের কথা মতো ঘুমোলে আমলে ঘাটতি হয়। কী করবো? থানবী রাহি. তাকে ডাক্তার যতক্ষণ ঘুমোতে বলেছেন, তার চেয়েও বেশি ঘুমোতে বলেন! থানবি তাকে বলেন, পূর্ণ স্বাস্থ্য লাভ না হওয়া পর্যন্ত আমল কমিয়ে দাও, পূর্ণমাত্রায় সওয়াব পাবে।

কাফেরদের অনুকরণকে মুসলিম সমাজের বিশৃক্সখলার কারণ মনে করতেন থানবি রাহ.। তবে যেসব বস্তু শুধু কাফেরদের কাছেই আছে, মুসলমানদের কাছে এর বিকল্প নেই, এবং বস্তুটি কাফেরদের জাতীয় বা ধর্মীয় আদর্শও নয়, সেসব বস্তু গ্রহণের অবকাশ দিতেন। বিজাতীয়দের অনুকরণের অন্যতম বড় ক্ষেত্র-পোষাকের ক্ষেত্রে থানবি বলতেন, অনেকে পোশাকের ব্যাপারে বিজাতীয়দের অনুকরণ করে। অথচ ইসলাম পোশাকের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদার। ইসলামে বৈধ পোশাকের তালিকা বেশ দীর্ঘ এবং নিষিদ্ধ পোষাকের তালিকা সংক্ষিপ্ত। আর বিজাতীয়দের সংস্কৃতিতে নিষিদ্ধ পোষাকের তালিকা দীর্ঘ, বৈধ পোশাকের তালিকা সংক্ষিপ্ত।

থানবি রহ. সমাজগঠনের স্বার্থে বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং দৈনন্দিন ক্রিয়াকর্মে মানুষকে প্রথাপালনে নিষেধ করতেন। তিনি অপ্রয়োজনীয় কাজকে প্রয়োজন মনে করাকে প্রথা হিসেবে দেখতেন।
সমাজের প্রগতিতে অংশ রাখতে বলতেন। তবে হীনমানসিকতার বশে বিজাতীয় অনুকরণের প্রগতিকে নিষেধ করতেন, নিজেদের আদর্শকে আঁকড়ে রেখে প্রগতি বিনির্মাণের কথা বলতেন। হালাল পথে থেকে জীবনমান উন্নয়নকে তিনি প্রগতি মনে করতেন। যে প্রগতির ফলে মানুষ অমানুষে পরিণত হয়, মানবসমাজে বিশৃঙ্খলা ও বল্গাহীনতা তৈরি হয়, এমন প্রগতিকে নিষেধ করতেন। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, কৃষি ও বাণিজ্যের প্রতি উৎসাহিত করে বলতেন, ‘কৃষি ও বাণিজ্য ফরজে কেফায়া। কারণ এগুলোর উপর মানুষের বেঁচে থাকা নির্ভর করে।

থানবি রহ. এর ওয়াজ-উপদেশে ফুটে উঠতো রাজনীতির সচেতনতা এবং জাতীয় স্বাতন্ত্র্যের কথা। তিনি রাষ্ট্রকে মূল্যবোধের প্রতি উৎসাহিত করতেন। রাষ্ট্রকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলতেন। ঐক্যের আলোচনায় তিনি বলতেন, ‘ঐক্যের মূল হলো বিনয়। বিনয় ছাড়া ঐক্য হতে পারে না। অনেকে মনে করে- মানুষ অপরকে নিজের সমমনা ও মতানুসারী বানানোর নাম ঐক্য। যদি অপরেও ঐরূপই চায়, তবে ঐক্য হবে কীভাবে? তাই দেখা যাচ্ছে- আত্মগরিমা থাকলে ঐক্য হতে পারে না। হলেও তা হয়ে থাকে শুধু মৌখিক।’

থানবি রহ. মনে করতেন- কাজ উদ্দেশ্য না হয়ে নাম উদ্দেশ্য হলে সেখানে বিরোধিতা এবং অনৈক্য অনিবার্য। এ ক্ষেত্রে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ঐক্যকেও নিরুৎসাহিত করতেন। থানবি বলতেন, প্রত্যেকে নিজে অপরকে নিজের মত মেনে নিতে বললে কখনো ঐক্য প্রতিষ্ঠা পাবে না। বরং ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য মানসিকতা থাকতে হবে- কেউ আমাকে না মানলেও আমি তাকে মানবো। তবে ঐক্যের নামে কারো শরীয়তবিরুদ্ধ কাজে নিরবতাকে নিষেধ করে বলতেন, কিছু অনৈক্যেরও প্রয়োজন আছে!
প্রসঙ্গত থানবি রহ. ইসলামী আয়োজনে দুনিয়াদারদের প্রাধান্যকে অনুচিৎ মনে করতেন। এক আলোচনায় তিনি বলেন, ‘দলে দুনিয়াদারদের প্রাধান্য হলে এবং ধার্মিকগণ কোণঠাসা হলে এমন দলের সাথে কাজ করা ওয়াজিব নয়।’

হযরত আশরাফ আলী থানবি রহ. ইসলাহের জন্য শুধু আমল আর যিকির-আযকার নয়, ব্যক্তিগত জীবন, সামাজিক জীবন, রাজনৈতিক জীবন, অর্থনৈতিক জীবন, সবকিছুর প্রতিই সতর্ক করতেন। ওয়াজ-নসীহতে থানবীর কণ্ঠ ছিলো সর্বব্যাপী।

সূত্র:

আল-ইফাজাত
আদাবুল মুয়াশারাত
দাওয়াতে আবদিয়্যাত
আশরাফুস সাওয়ানেহ
আরজাউল গুয়ূব
খাইরুল মালি লিররিজাল
তরিকুল কালান্দার

লেখক: পাঠক, শিক্ষক

আগের সংবাদসংক্ষিপ্ত সিলেবাসে হবে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা: শিক্ষামন্ত্রী
পরবর্তি সংবাদকরোনায় দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ২১ জনের মৃত্যু