বাইজিদ আহমাদ:
উপক্রমণিকা
বিকেলের রোদ পড়ে এসেছিলো ।
আসরের নামাজের পর বাড়ির সামনে জলচৌকিতে বসেছিলেন লম্বাদেহী এক যুবক । তার হাতে একটি আরবি কিতাব । নিশ্চল তিনি সেই কিতাবের পাতায় চোখ বুলাচ্ছিলেন । যুবকের বয়স বাইশ কি তেইশ হবে । কালো জ্বলজ্বলে চেহারা । যোদ্ধাদের মতো শক্তপোক্ত শরীর । মুখভর্তি কুচকুচে কালো দাঁড়ি তার বয়স আরো বাড়িয়ে চেহারায় গাম্ভীর্যতা এনে দিয়েছে । সুন্দর করে আঁচড়ানো মাথার বাবরি চুল কাঁধ ছুঁয়েছে । যুবকের মাথায় বড় আকারে পাগড়ি বাঁধা । সাদা পাগড়ি । গায়ে ধূসর রঙের মোটা কাপড়ের জুব্বা । পরনে খাকি কাপড়ের পায়জামা ।
বাড়ির দহলিজে কারো আগমন টের পেয়ে মাথা তুললো যুবক। ভ্রু কুুঁচকে তাকিয়ে রইলো কতক্ষণ ৷ বারো তের বছর বয়সের একটি ছেলে দহলিজের বাইরে অবিরত হাঁপাচ্ছে ৷ চোখমুখ ফোলা ৷ ছেলেটাকে তিনি চিনতে পারলেন না । হাঁপানির কারণে ছেলেটা সালাম দিতে পারছেনা, আবার বাড়িতে প্রবেশের অনুমতিও নিতে পারছেনা । যুবক উঠে দাঁড়িয়ে ছেলেটার কাছে গেলেন । তারপর আলতে করে কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বললেন, কি হয়েছে তোমার? হাপাঁইতাছো কেন?
– হুজুর, আব্বা.. আব্বারে ওরা….
এতটুকু বলেই চিৎকার করে কেঁদে ফেললো কিশোর ছেলেটা । যুবকের চোখমুখ আরো গম্ভীর হয়ে উঠলো । কপালে ভাঁজ পড়লো । বাড়ির ভেতরে এসে ছেলেটাকে শান্ত করলেন আগে । তারপর পুরো ঘটনাে আদ্যোপান্ত শুনলেন ।
ছেলেটার পিতার নাম রহিম বখশ ৷ বশখ নামে পরিচিত ৷
গঞ্জের হাটে তার মসলাপাতির দোকান ৷ আজ সকালের দিকে ঘোষ জমিদারের খাজনা আদায়কারী বাজারে এসেছিল ষান্মাসিক খাজনা আদায় করতে । বেশ কিছুকাল যাবৎ সব ঠিক-ঠাক চলছিল ৷ সাধারন মানুষদের সাথে জমিদার আর ইংরেজ নীলকরদের একটা বোঝাপড়া সেরে ওঠেছিল স্থানীয় মুরব্বি নেতারা ৷ কিন্তু আজ খাজাঞ্চি ঘোষনা দিল, আসন্ন কালীপূজা উপলক্ষে ট্যাক্সের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে ৷ সবাই হতবাক ৷ এই পূজা-অর্চনা সহ অন্যান্য অবৈধ কর দেয়া বন্ধ অনেকবছর যাবৎ ৷ কিন্তু মুখে কেউ কিছু বললো না । পরে আবার হিন্দু পায়েক-পেয়াদাদের চোখ রাঙানি দেখতে হবে । বেশি রেগে গেলে কোনো ক্ষতিও করতে পারে । শারীরিক আঘাত তো সময়ের ব্যাপার । কিন্তু রহিম বখশ এটার তীব্র বিরোধিতা করলো । বাজারে সবচেয়ে বড় দোকান তার ৷ এমনিতেই করের পরিমাণ বেশি আসে । এর ওপর বাড়িয়ে দিলে তো লাভ বলতে কিছুই থাকে না । মাথায় লাল গামছার পাগড়িটা বেঁধে বাজারের ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়ালো রহিম বখশ ৷ তারপর চিৎকার করে প্রতিটা দোকানির নাম ধরে ডাকলো ৷ সবাই জমায়েত হওয়ার পর তীব্র রেশের সাথে বললো, সব কাপুরুষের দল । তোমাদের লজ্জা করে না মুসলমান হয়ে অন্যের সামনে মাথা নোয়াতে? কোন কলব নিয়া তোমরা আল্লাহ আর রাসূলকে বাদ দিয়া অন্যরে ভয় পাইতাছো । ক্যামনে তোমরা এই শিরকি কামে সাহায্য করলা । এ-ই আমি ঘোষণা দিয়া গেলাম, সামনের কালী পূজার লাইগ্যা একটা টাকাও দিমুনা ৷ কারো বুকে সাহস থাকলে আমার কাছ থেকে নিয়ে আসতে বইলো।’
তখন আর জল তেমন ঘোলা হলো না ৷ কর আদায়কারীরা রহিম বখশের দোকানের সামনেই আসেনি ৷ মাত্র কয়েকজন জমিদারের পেয়াদা গোটা বাজারে আতঙ্ক তৈরি করতে পারে, কিন্তু সাধারণ একজন দাঁড়িয়ে গেলে পরিস্থিতি পাল্টাতে মুহূর্তও লাগেনা ।
শেষ দুপুরের দিকে মিয়া বশখ বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। হঠাৎ তাঁর অনুমতি ছাড়াই বাড়ির ভেতরে জমিদারের হিন্দু নায়েব চারজন পেয়াদা নিয়ে প্রবেশ করলো ৷ সাদা চামড়ার ইংরেজ সেপাই৷ ফতোয়াটা গায়ে চড়াতে চড়াতে বাইরে আসতেই রহিম বখশের গায়ে আগুন ধরে গেল ৷ এই সাদা চামড়াটকে তিনি কুকুরের চেয়েও বেশি ঘৃণা করেন । অনুমতি ছাড়া এই অসময়ে বাড়িতে ঢুকলো কোন সাহসে !
শুরুতেই কথা কাটাকাটি আরম্ভ হলো ৷ নরম কথায় সহজ বুঝ দিলে হয়তো সেপাইরা চলে যেত । কিন্তু রহিম বখশের কথা হলো, যে ইংরেজরা মুসলমানদের দেশ-ভূমি দখল কইরা নিছে, মুসলমানদের উপর অত্যাচার করতাছে দিনের পর দিন, ওদের সাথে আর আপোস নাই ৷ কোনো তোষামোদ চলবে না । কথা হবে স্পষ্ট আর গরম । একপর্যায়ে মিয়া বখশকে হাতকড়া পরাতে আসতেই বিপত্তি বেঁধে গেল । তিনি বারবার বলছিলেন, আমি কোনো অপরাধ করি নাই যে, জমিদারের কাছে গিয়ে ওযর পেশ করতে হইবো ৷
একজন সেপাই তার গায়ে স্পর্শ করতেই তিনি রেগে গিয়ে দিলেন এক আ-মাপা ঘুষি । ঘুষির চোটে সেপাই ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো । তার নাক পুরোদমে থেতলে গেছে । গলগল করে বক্ত বেরুতে লাগলো । বাকিরা তখন হৈ হৈ করে ঝাঁপিয়ে পড়লো মিয়া বখশের উপর । একা আর বেশিক্ষণ পেরে উঠলেন না । বাড়িতে তখন মহিলা আর বাচ্চাকাচ্চা ছাড়া আর কেউ ছিলেন না । প্রায় অজ্ঞান করেই ঘোড়ার গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেল জমিদারের সেপাইরা ।
ছেলেটা কেঁদেই চলছে ।
– হুজুর, আপনি কিছু করেন দ্রুত । ওরা আমার আব্বারে মাইরা ফালাইবো ।
রহিম বখশকে তিনি চিনেন। তাঁর খুব প্রিয় লোক। নিয়মিত তার বাড়িতে এবং আস্তানায় আসা যাওয়া করে। ঠান্ডা মাথায় কি করা যায় এটা চিন্তা করছিলেন যুবক । এই বেদ্বীন বে-রহম জমিদারদের কাছে একজন সাধারণ মানুষের মর্যাদা একটা প্রাণীর সমানও নাই । আর সে যদি মুসলমান হয়, তাহলে তো কথা-ই নেই । শুধু ট্যাক্সের নাম দিয়েই অমানুষিক নির্যাতন চালাবে ৷ নির্যাতনের পদ্ধতিও ভয়ংকর রকমের । নির্দয়ভাবে চাবুক মারা, বস্ত্রহীন শরীরে লাল পিঁপড়া ছেড়ে দেয়া, ময়লার গর্তে বুক পরিমাণ দাবিয়ে রাখা । আর যে পদ্ধতিটা সবচেয়ে ভয়ংকর, যার কোনো বাহ্যিক প্রমাণ মিলে না, সেটা হচ্ছে, মুখ বেঁধে নাকে গুঁড়ো মরিচের ধোঁয়া দেয়া।
কারো নাম ধরে ডাক দিতেই বাড়ির ভেতর থেকে মাঝবয়েসী একজন লোক হাজির হলো । যুবক বললেন, আলীমুদ্দিনকে বিশজন লাঠিয়াল প্রস্তুত রাখতে বলুন । দ্রুত যেন করে । আমি এক্ষুণি আসছি । হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার মতো লোকটা বেড়িয়ে গেল। তারপর যুবক ছেলেটার হাত ধরে বললেন, তুমি বাড়ি যাও। বাড়ির সবাইকে শান্ত করো। আমরা এক্ষুণি জমিদারের কুঠিতে যাবো ৷ আশা করি তোমার পিতাকে সেখানেই পাবো । আর যদি সেখানে না পাই, তাহলে জমিদারের বাড়িতেই যাবো । ওরা অতি বাড় বেড়ে গেছে । কিছু একটা চূড়ান্ত করেই আজ ফিরবো ইনশাআল্লাহ। শেষ কথাটা চিবিয়ে বললেন যুবক। যুবকের নাম মুহসিনুদ্দিন আহমদ । সবাই চিনে দুদু মিয়া নামে ।
এই গল্পটা পূর্ব বাংলার মুসলমানদের এক অগ্নিগর্ভ সময়ের। যখন মুসলমানরা ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক সকল দিক দিয়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েও ফের যেন নতুন করে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো । অভিভাবক পথপ্রদর্শকহীন মুসলমানরা আলো খুঁজে পাচ্ছিলো ৷
পূর্ব বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সুবেদারি লাভের অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেছে ততদিনে । ইংরেজদের শাসনের নামে শোষণ ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিটা জনপদে ৷ বেনিয়া শ্রেণীর হিন্দুদের সহযোগিতায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে কোম্পানীর পূর্ণ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে । রাজস্ব আদায়ের অজুহাতে জমিদারি ও আয়মাদারি সম্পত্তি, লা-খেরাজ, ওয়াকফ সম্পত্তি মুসলমানদের হস্তচ্যুত হয়ে গেছে । তার স্থলে জমিদারি পেয়েছে ইংরেজদের পা চাটা গোলাম হিন্দুরা । গোড়াতেই সামরিক বিভাগ থেকে মুসলমানদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে । পলাশীর যুদ্ধের পর ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী যখন বাঙলার প্রতিরক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে, তখন কোম্পানীর হাতের পুতুল মীর জাফরের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী আশি হাজার মুসলমান সৈন্যকে বরখাস্ত করা হয় । কোম্পানীর আমলে গোড়ার দিকে এই অঞ্চলে যে হাজার হাজার মক্তব, মাদ্রাসা প্রভৃতি মুসলিম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল, সেগুলোও ধ্বংস করে দেয়া হয় ।
তারপর যেন শুধু অধপতনের পালা ।
বাঙালী মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিপর্যয় এসেছিল মুঘল আমল থেকেই । নানা প্রকার ইসলাম বিরোধী প্রথা, আচার-আচরণ মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছিল । ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যখন মুসলিম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহ ধ্বংস হয়ে যায়, তখন কাণ্ডারীহীন মুসলমান সমাজে অনৈসলামিক আচার-আচরণ আরও অধিক পরিমণে প্রবেশ করে ।
এই পটভূমিতে ও পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামের পুনর্জীবনের প্রয়োজনীয়তা সর্বত্র অনুভূত হয়েছিল । যার দরুন ইসলামের কেন্দ্রবিন্দু মক্কা থেকে ফিরে শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভি রহ. দিল্লী মহানগরীতে সেই ধর্মীয় সংস্কার আরম্ভ করেছিলেন । যা একসময় রূপ নিয়েছিলো রাজনৈতিক আন্দোলনে ।
আর এদিকে ১৮১৮ সালে পূর্ববাংলায় আগমন করলেন এক সূফী দরবেশ । যিনি এই পূর্ববাংলারই সন্তান । তাঁর নাম হাজী শরিয়তুল্লাহ । দীর্ঘ বিশ বছর মক্কায় ধর্মীয় জ্ঞান আর আত্মশুদ্ধি অর্জন করে দেশে ফিরে তৎকালীন মুসলমানদের ধর্মীয় অবস্থা দেখে তিনি ব্যথিত আর উদ্বিগ্ন হলেন । পীর পূজা, পীরের নামে মানত, ওরশসহ অসংখ্যা বেদাতি কর্মকাণ্ড আর হিন্দুয়ানী প্রথায় লোকেরা ব্যাপকহারে লিপ্ত ছিল ৷ তিনি মানুষের পিছনে মেহনত শুরু করলেন । দীর্ঘ মেয়াদি সে মেহনত । ধীরে ধীরে মানুষকে দ্বীনের পথে ফিরিয়ে আনতে লাগলেন নরম, সহজ কোমল ভাষায়। তিনি ঘোষণা দিলেন, সব শিরকি কর্মকাণ্ড ছেড়ে দিয়ে ইসলামের মূলভিত্তি ফরজ সমূহকে আকড়ে ধরো । তাহলেই তোমার দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা অর্জন করতে পারবে ৷ আজ মুসলমানদের অধপতনের মূল কারণ সঠিক ধর্মশিক্ষা বর্জন করে পৌত্তলিকতা গ্রহণ করা ৷
তাঁর এই সংস্কার আন্দোলন প্রসিদ্ধি পেলো ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ নামে ।
তাঁর লক্ষ্য ছিল সকল কুসংস্কার ও গোঁড়ামিকে দূর করে পবিত্র কোরআন ও হাদিস অনুযায়ী মুসলিম সমাজকে পরিচালিত করা। সমাজ সংস্কার করতে গিয়ে তার দৃষ্টিতে পড়লো কৃষক, জেলে, তাঁতি আর সাধারণ মানুষের ওপর জমিদার-মহাজন-ইংরেজ নীলকরদের চরম শোষণ, বঞ্চনা ও নির্যাতন । তিনি ফের ঘোষণা দিলেন, ‘যে জমিন আল্লাহর, সেখানে অবৈধ ট্যাক্স নেয়ার অধিকার কোনো মানুষের নাই ৷ জমিদারদের অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবার জন্য তিনি মুসলিম সমাজকে ঐকবদ্ধের আহ্বান জানালেন । তাঁর এই সাম্যের বাণী ধুমকেতুর মতো নিপিড়ীত-শোষিত নিম্নবিত্ত মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়লো। হাজী সাহেবের স্থানীয় জমিদার আর কুঠিয়ালদের সাথে সময়োপযোগী ও যুগপৎ বোঝাপড়া সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো ৷ দলে দলে মানুষ যোগ দিতে লাগলো ফরায়েজি আন্দোলনে । অতিদ্রুত তাঁর নেতৃত্বে ফরিদপুর, ঢাকা, বরিশাল, নোয়াখালী, মোমেনশাহী অঞ্চলে ফরায়েজি আন্দোলনের প্রসার ঘটলো ।
তার মৃত্যুর পর যেন এই আন্দোলনে নবশক্তি যোগ হলো । আন্দোলনের ধারাও পাল্টে গেল কিছুটা ৷ হাজী সাহেবের সময় আঘাত-প্রতিঘাতে ফরায়েজিরা অতটা সচল ছিল না ৷ বা হাজী সাহেব নিজেই সন্তর্পণে, ধর্মীয় কাজকর্মে যেন ব্যঘাত সৃষ্টি না হয় ; এসব থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতেন । কিন্তু এবার ফরায়েজিরা এক হাতে কোরআন-হাদিস অপর হাতে শক্ত লাঠিও তুলে নিলো ৷ তাঁর সুযোগ্য পুত্র মুহসিনুদ্দিন আহমদ ওরফে পীর দুদু মিয়া শক্তহাতে হাল ধরলেন । তখন তার বয়স মাত্র একুশ বছর ৷ পিতার মতো ধর্ম সম্পর্কে এত গভীর জ্ঞান না থাকলেও, তার ছিল প্রচুর সাংগঠনিক ক্ষমতা ৷ তিনি ফরায়েজি আন্দোলনকে একটি সুবিন্যস্ত সংগঠনে রূপ দিলেন । আন্দোলনভুক্ত অঞ্চলগুলোকে কয়েকটি সার্কেলে বিভক্ত করে সেখানে খলীফা নিযুক্ত করলেন । দু’ তিনটি গ্রাম মিলিয়ে গঠন করা হলো ক্ষুদ্র ইউনিট । সেখানেও নিযুক্ত করলেন একজন প্রধান বা সর্দার । এলাকায় এলাকায় গড়ে উঠলো মসজিদ-মাদ্রাসা, সরাইখানা, আর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র । গোপন তথ্য সরবরাহের জন্য সমগ্র অঞ্চল জুড়ে গড়ে তোলা হলো একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা বাহিনী । ফরায়েজিরা ব্রিটিশদের কোর্টকাছারি বর্জন করে গড়ে তুললো পৃথক বিচার ব্যবস্থা । অত্যাচারী জমিদার আর নীলকরদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য গড়ে তুললো সশস্ত্র ও সুশৃঙ্খল এক ‘লাঠিয়াল বাহিনী ‘। কার্যত সরকারি প্রশাসনের বাইরে দুদু মিয়া গড়ে তুললেন নিজস্ব সমাজ ব্যবস্থা ৷ এভাবে একসময় পাবনা থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে ফরায়েজি আন্দোলন ৷ গড়ে ওঠে প্রায় আশি হাজারের বিশাল ফরায়েজি মতাদর্শের সবল অনুসারী ।
মানুষ জমিদার আর নীলকরদের নির্যাতন উপেক্ষা করে স্বাধীন ভূখণ্ডে বসবাসের স্বাদ খুঁজতে থাকে । ঘুমন্তরা জেগে ওঠে, জেগে ওঠতে থাকে ।
উদয় সেই জেগে ওঠারই গল্প ।
আবির্ভাব
ঠিক সন্ধ্যার আগে আগে হাজী সাহেব ডিঙি থেকে শামাইল গ্রামে নামলেন । আমি তখন বাজার থেকে ফিরছিলাম । হাতে সওদাপাতি। মানুষের কানাঘুঁষায় দাঁড়িয়ে পড়তে হলো। দেখলাম কাকে যেন ঘিরে একটা জটলা তৈরি হয়ে আছে ৷ কৌতূহলী হয়ে কাছে গেলাম । এই দেখি আরবের লোক ! মুখভর্তি ঘন দাড়ি । গায়ে মোটা কাপড়ের ঢিলাঢালা জু্ব্বা । মাথায় আরবদের মতো রুমাল । জুতাও আমাদের দেশের না । হাতে সুন্দর সাইজের একটা ব্যাগ । আমি এসব দেখছিলাম, এর মধ্যেই আরবের লোকটা বাংলায় কথা বলে উঠলো । আরে, একদম এলাকার ভাষা বলছে । তখন ভীড় ঠেলে পুব পাড়ার কামাল আমার দিকে ইশারা করে বললো— আপনি ওর সাথে কথা বলুন । ওর বাড়ি তালুকদার বাড়ির পাশেই । লোকটা সালাম দিয়ে আমার দিকে হাত বাড়াল মোসাফার জন্য । বিব্রত হয়ে আমারও হাত বাড়াতে হলো । ভীড় পাতলা হয়ে গেছে । লোকজন খেয়াঘাট ছাড়ছে । সন্ধ্যায় এ জায়গাটা নিরাপদ না ।
লোকটার বয়স ঠিক অনুমান করা যাচ্ছে না । তবে মনে হলো চল্লিশের কম হবে না । ভেতরে সব জানার কৌতূহল হলেও আমি কিছু না বলে চুপচাপ হাঁটছিলাম । তিনি আমার সাথে সাথে হাঁটছেন । হঠাৎ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লেন । হাত দিয়ে আমাকে ইশারা করলেন উঁচু একটা ভিটের দিকে । যার চারপাশে রঙিন কাপড় দিয়ে ঘেরা । মাঝখানে বাঁশ-কাঠ দিয়ে বানানো একটা গম্বুজের আকৃতি । আমি বললাম, এইটা বিবি ফাতেমার মাজার । বছরে দুইটা ওরস হয় এখানে । লোকটা যেন ভিমড়ী খেল । চোখ বড়ো করে কাঁপা স্বরে বললো, আর মাটির ঘোড়া দেখা যাচ্ছে ওইটা?
আমি বিরক্ত হলাম । লোকটা কি আসলেই বাংলার নাকি? দেশীয় রীতিনীতি দেখছি কিছুই জানে না!
ওইটা কারবালার শহীদ হাসান-হুসাইনের ঘোড়া । এখান থেকে কারবালার দিন মিছিল বের হয় ।
আর কিছু না বলে মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগলেন তিনি ।
জানালেন পিতার নাম আব্দুল জলিল তালুকদার ৷ তার যখন আট বছর বয়স, তখন ইন্তেকাল করেছেন ।
জলিল তালুকদারের নাম শুনেছি । তার ছেলে সন্তান কেউ বেঁচে নেই ৷ বিছানায় পড়ে আছে তার ছোটো ভাই আজিমউদ্দিন ৷ কবে যেন তিনিও চলে যান । বাড়ির বাইরে জলচৌকিতে তাকে বসতে দিলাম । ততক্ষণে ছেলেবুড়োতে বাড়ি ভরে গেছে ৷ মহিলারাও পর্দা-আব্রু করে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে । ওদের আবেগ আমাকেও নাড়া দিলো । শুধু নবীর দেশের মানুষ জেনেই সবার এত আগ্রহ । কেউ কেউ কোলের শিশুকেও নিয়ে আসছে দোআ নেয়ার জন্য । পরে বাংলার লোক জেনেও মানুষের আগ্রহ কমছে না ।
এখানে সেখানে অন্ধকার ঝুলছে । মাগরিবের সময় হয়ে গেছে ৷ তিনি ওযুর পানি চেয়ে মসজিদ কোনদিনে জানতে চাইলেন। এতলোকের ভীড়ে আমি চুপ হয়ে গেলাম । তিনি বুঝলেন গ্রামে মসজিদ নেই । আসলে মসজিদ ছিল । কিন্তু না ব্যবহারের ফলে এখন ঝোঁপঝাড় হয়ে আছে এটার ভেতরে । তিনি দহলিজের বাইরে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে আযান দিলেন। লোকজন সরে পড়ছে । নামাজের জন্য অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও কাউকে তিনি পেলেন না । তার ব্যথিত চোখ আমি পড়তে পারছিলাম । কিন্তু নামাজে দাঁড়ানোর কোনো পরিবেশ ছিল না ৷ একাকী নামাজ পড়লেন । নামাজের পর মৃত্যুপথ-যাত্রী হাজী সাহেবের চাচা আজিমুদ্দিনের কাছে নিয়ে গেলাম। হাজী সাহেবকে দেখা মাত্রই চিনে ফেললেন আজিমুদ্দিন। কেঁদেকুটে বলতে লাগলেন, বাজান! আমার বাজান! এতদিন পরে তুমি কোত্থেকে আইছো!
এতটুকু বলে রহিম বখশ থামে ।
বাইরে পঞ্চমির চাঁদ । সাদা জোছনায় চরাচর ভেসে যাচ্ছে । চোখে ঘুম পাড়িয়ে দেয় এমন একটা শিরশিরে বাতাস বইছে । এতক্ষণ চুপচাপ গল্প শুনছিলো আলী । আলী চরলক্ষী গ্রামের গুড় ব্যবসায়ী কালু মিয়ার কর্মচারী ৷ গুড়ের বস্তা নিয়ে বাহাদুরপুরে আসা । রহিম বখশের সাথে আলীর কারবার । থাকা খাওয়া সব তার বাড়িতেই । অনেক বছর পর এসেছে বাহাদুরপুর । এসেই এলাকার চিত্র দেখে হতবাক হয়ে গেছে আলী ৷ মানুষেরা কেমন যেন আমূল পাল্টে গেছে ৷ নদীর পাড় থেকে রহিম বখশের বাড়ি পর্যন্ত দুইটা মসজিদ চোখে পড়েছে । আগে এগুলো ছিল না । আর নদীর পাশেই বড় যে মাজারটা ছিল, ওইটার কোনো চিহ্নও নেই । আগে এখানে কত বড় ওরস হতো । মাগরিবের নামাজ পড়তে গিয়ে মসজিদে মুসল্লি দেখে পুনরায় হতবাক হলো আলী । মনে হলো কোনো আরব দেশে চলে এসেছে । জোয়ান বৃদ্ধে মসজিদ ভরে গেছে । সবার পরনেই পাঞ্জাবি অথবা জুব্বা । সাথে লুঙ্গি বা সেলোয়ার । ধুতি পড়েনি কেউ । হিসেবে মিলছিল না । একজন আলেমের কথা শুনেছিল আলী । হাজী সাহেব নামে প্রসিদ্ধ । যিনি ঢাকা, ফরিদপুরের পূর্বাঞ্চলে ধর্ম প্রচার করছেন জোরেশোরে ৷ তাই বলে কি সমাজকে এভাবে পাল্টে দেয়া যায় নাকি !
‘আচ্ছা, হাজী সাহেব যদি শামাইলের সন্তান হয়ে থাকেন, তাহলে এখানে আসার পর কেউ তাকে চিনেনি কেন?’
রহিম বখশ বললো, ‘তোমাকে বলছি সব । পরে কি হইল শুনো । রাতেই হাজী সাহেবের চাচা মারা গেলেন ৷ তার হাতে দিয়ে গেলেন পরিবারের দায়িত্ব । সকালে লাশের দাফনকাজে দেখা দিল বিরোধ । হাজী সাহেব যে পদ্ধতি বলছেন, গ্রামের রীতির সাথে মিলে না । বিশেষত জানাযার আগে লাশকে ঘিরে সবাই মিলাদ পড়তো আর লাশসহ খাটিয়া কাঁধে তুলে পুরো গ্রামে একবার চক্কর দিতো । হাজী সাহেব বললেন, এসব হিন্দুয়ানী রীতি । একজন মুসলমানের লাশের সাথে এসব আমি হতে দিব না। কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে গ্রামের মানুষ ক্ষেপে গিয়ে বললো, কেউই তাকে সাহায্য করবে না । তাই হলো । তিনি একাকী দাফনকাজ সারলেন । মানুষের এই আচরণে তিনি মানসিকভাবে খুব কষ্ট পেলেন । এই ঘটনা হাজী সাহেবকে দৃঢ় মনোবল নিয়ে পূর্ববাংলার মুসলমানদের কুসংস্কার মুক্ত করতে উদ্বুদ্ধ করলো ।’
‘তাহলে তিনি মক্কা গিয়েছিলেন কবে?’
রহিম বখশ বলে চলে, মক্কা গিয়েছিলেন আরও পরে ৷ শৈশবে পিতা মারা যাওয়ার পর তার অভিভাবক হলেন এই চাচা আজিমুদ্দিন ৷ আদর স্নেহে লালিত-পালিত হতে লাগলেন ৷ চাচা-চাচীর কোনো সন্তান না থাকায় এই আদর আরো বাড়াবাড়ি রকমের ছিল । যার কারণে অনেকটা বুঝ হওয়ার পরও হাজী সাহেব কোনো শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেননি ।
তারপর একটা ঘটনা হাজী সাহেবের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো । তখন তার বয়স তেরো । ছোট পৃথিবীটা পেশির মতো আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে ৷ বার্ষিক ওরসের দিন তাঁর এক কাজে বিরক্ত হয়ে চাচা আজিমউদ্দিন কড়া কিছু কথা বললেন । মোটামুটি ভর্ৎসনা করলেন আরকি । এজন্য রাগ করে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলো আদুরে ছেলে শরিয়তুল্লাহ । সবাই ভেবেছে ছোট ছেলে রাগ করেছে, আবার ফিরে আসবে । কিন্তু ছেলে তখন কলকাতার জাহাযে রওনা করেছে ৷ কলকাতা এসে অনেক ঘুরঘুরি করে কুরআনের শিক্ষক মাওলানা বাশারত আলীর খোঁজ পেলো সে ৷ কিশোর একটা ছেলেকে অসহায় দেখে তিনি হেফজ খানায় মুফতে ভর্তি করিয়ে নিলেন ৷ নিজ প্রতিভায় অতিদ্রুত কোরআন কারিম শিক্ষা করে নিলো কিশোর শরিয়তুল্লাহ ৷ মাওলানা বাশারত আলী বুঝলেন এই ছেলেকে হাতছাড়া করা যাবে না ৷ তার ভেতরে বারুদ আছে । এখন কেবল জ্বালিয়ে দিলেই হয় । তারপর তিনি আরবি আর ফার্সি শিক্ষার জন্য শরিয়তুল্লাহকে হুগলী জেলার অন্তর্গত ফুরফুরায় পাঠালেন ৷ দেখা গেল মাত্র দুই বছরের মধ্যেই দুটি ভাষায় পড়তে লিখতে সমান পারদর্শী হয়ে উঠলো সে । অতঃপর সেখান থেকে মুর্শিদাবাদ যাত্রা করে তার ছোটো চাচা আশিক মিয়ার কাছে ৷ আশিক মিয়া তখন মুর্শিদাবাদের গণ্যমান্য ব্যক্তি ৷ প্রায় একবছর সেখানেও আরবি ভাষায় পাঠদান অব্যাহত রাখে শরিয়তুল্লাহ ৷ তারপর নাড়ির টান লাগে ৷ কিছুদিনের ভেতরেই চাচার সাথে গ্রামের বাড়ি শামাইল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় । সবকিছু গুছিয়ে চাচা আশিক মিয়া একটি ছোটো পাল তোলা নৌকা ভাড়া করেন । কিন্তু স্রষ্টা তো চাচ্ছিলেন ভিন্ন কিছু ৷ পথেই তুফানের কবলে পড়ে নৌকা উল্টে গেল । তীব্র ঝড়ে যখন সারারাত সাঁতরে শরিয়তুল্লাহ ভোরে ডাঙার খোঁজ পেল, তখন দেখলো আশপাশে নৌকার কোনো চিহ্ন-ই নেই । পানির গহ্বরে তার চাচা-চাচীও হারিয়ে গেছে ৷
এই ঘটনা শরিয়তুল্লাহর সব সাজানো-গোছানে স্বপ্নকে এলোমেলো করে দেয় । মানসিকভাবে অনেকটা বিকার হয়ে পড়ে সে । বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত পালটে ফের রওনা করে কলকাতার দিকে। ছিন্নভিন্ন হয়ে হাজির হয় মাওলানা বাশারত আলীর আস্তানায় ৷ কলকাতায় তখন আরেক কাহিনি ৷ স্থানীয় আলেমদের উপর ব্রিটিশরা বাড়াবাড়ি শুরু করেছে । ধর্মশিক্ষায় বিভিন্ন বাধা আরোপ করছে । এই কারণে ব্রিটিশ শাষণের প্রতি ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে হয়ে মাওলানা মক্কায় হিজরতের সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন । শরীতুল্লাহ তখনো দোদুল্যমনতায় । অবশেষে সে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই মক্কায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে । ১৭৯৯ সালে যুবক শরীতুল্লাহ ও তাঁর শিক্ষক মক্কার জাহাযে রওনা করে ৷ তখন তাঁর আঠারো বছর বয়স ।
এভাবেই বাংলায় পরিবর্তীকালের ইসলামী পুনরুজ্জীবনের প্রতিষ্ঠাতা ইসলামের মূল শিক্ষাকেন্দ্র মক্কায় যাওয়ার সুযোগ পান ।
আলী জানতে চায়, ‘তাহলে মক্কায় হাজী সাহেব কত বছর ছিলেন ‘
রহিম বখশ বলে, প্রায় বিশ বছর ৷ কলকাতার প্রাথমিক শিক্ষা তার শিক্ষার ভিত রচনা করে দেয় ৷ তিনি প্রথম কয়েকবছর মক্কার বাসিন্দা বাঙালি আলেম মাওলানা মুরাদের কাছে থাকেন ৷ এ সময়টাতে তিনি আরবি ভাষাসাহিত্য ও ইসলামি আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন । তারপরের ধাপ ছিল তার শিক্ষাজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ৷ মক্কার প্রাপ্ত শিক্ষা পরবর্তীকালে মহান নেতৃত্ব দেবার প্রেরণা দেয় ।
তিনি তৎকালীন ‘আবু হানিফা’ নামে সুপ্রসিদ্ধ হানাফি ফকিহ তাহির সাম্বুল রহ.-এর সোহবতে যান । তাঁর কাছে দীর্ঘ চৌদ্দ বছর ধর্মীয় জ্ঞানের প্রতিটা শাখায় পড়াশোনা করেন । একই সঙ্গে তিনি সূফিবাদের রহস্যতত্ব সম্পর্কেও অবগতি লাভ করেন । এবং এই সময়ে তিনি সুফীবাদের কাদেরিয়া তরীকার অনুসারী হন ৷
জ্ঞানের ক্ষুধা যেন তার বাড়তেই থাকল ৷ মক্কায় শিক্ষা শেষ করার পর তিনি মিশরের আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন তার মুর্শিদ ও উস্তাদ তাহির সাম্বুলের কাছে । ফিলোসোফি ( দর্শন) পড়বেন এটা জানা সত্বেও তাহের সাম্বুল তাকে নির্দ্বিধায় অনুমতি দিয়েছিলেন । যুক্তিবাদ-দর্শনশাস্ত্র তাকে পরিবর্তন করে ফেলবে, এর সন্দেহে বশীভূত না হয়ে তাহির সাম্বুল তাকে কাহেরা ( কায়রো) যাওয়া থেকে বাঁধা দেননি । সেখানে গিয়ে হাজী সাহেব প্রাচীন লাইব্রেরীগুলোতে পড়ে থাকেন দিনের পর দিন । ইমাম গাজ্জালী আর ইবনে রুশদের ইলমে মানতেকের বইগুলো তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে প্রায় দুই বছর ৷ এরপর মক্কায় ফিরে এসে মদীনা পর্যন্ত একটি সংক্ষিপ্ত সফর করেন । নবীর কবর জিয়ারত করেই তিনি নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন ১৮১৮ ৷ সে বছরই হাজী সাহেবের সাথে আমার প্রথম দেখা হয় ৷
আলী বললো, এ তো দেখছি রূপকথার কাহিনি । এতদিন হয়ে গেল তবু আমি হাজী সাহেবকে ভালো করে চিনতে পারলাম না ।
রহিম বখশ মুচকি হেসে বললো, তোমাদের এলাকার দিকে হাজী সাহেব নজর দেয়ার সময় পাননি এতদিন । তাছাড়া বাহাদুরপুর এসেছেন বেশি দিন হয়নি ৷ ঢাকা আর ফরিদপুরেই তার লোক-লশকর গড়ে উঠছে ৷ ধীরে ধীরে এ অঞ্চলেও হাজী সাহেবের আন্দোলনের বাণী ছড়িয়ে পড়বে ইনশাআল্লাহ ।
আলী অস্ফূট স্বরে ইনশাআল্লাহ বলে উঠে দাঁড়ায় । রাত বাড়ছে । প্রকৃতি সুনসান । রহিম বখশের বাড়িটা লম্বালম্বি ৷ বারান্দাসহ চারটা কোঠা (রুম) । সামনে বড়সড় উঠান । আগের তুলনায় বাড়ির চেহারায় পরিবর্তন এসেছে । চারদিকে চটের বেড়া উঠেছে । অন্দরমহলও আলাদা হয়েছে ৷ দাঁড়িয়ে থেকেই আলী জিজ্ঞেস করলো, হাজী সাহেবের ছেলেরা কি করে?
রহিম বখশ বললো, তাঁর এক ছেলে, নাম মুহসিনুদ্দিন । বাপের মতোই যোগ্য । গায়ে-গতরে দেখার মতো ৷ তবে এই ছেলের রক্তে টান একটু বেশি । অত্যাচারের জবাব দিতে অনেক সোচ্চার ।
‘এখন কি করে এই ছেলে?’
‘পড়াশোনার জন্য হাজী সাহেব আরবে পাঠিয়েছেন । শুনেছি কিছুদিনের মধ্যেই নাকি ফিরে আসবে । কালকে তোমাকে নিয়ে যাবো হুজুরের বাড়িতে । দেখলেই বুঝবে তিনি যে আল্লাহর ওলী !
কথা থেমে যায় । বারান্দায় কোঠায় আলীর ঘুমানোর ব্যবস্থা হয় । শোয়ার অনেকক্ষণ পরও ঘুম আসে না আলীর ৷ মাথায় শুধু ঘুরতে থাকে চরলক্ষীর মুসলমানদের সামাজিক চিত্রগুলো । কীভাবে মানুষ জাহান্নামের দিকে দৌড়াচ্ছে । হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া কেউ নামাজ পড়ে না । আর যত রকমের বেদাতি কর্মকাণ্ডে তো লিপ্ত আছেই । এতদিন ভেতরে একটু দায়িত্ববোধ অনুভূত হয়নি আলীর । নিজেকে অপরাধী অপরাধী লাগে ।
পরদিন সকালে হাজী সাহেবের আস্তানায় হাজির হয় আলী । মানুষের সমাগম লেগেই আছে । বড় ঘরের মাঝখানে মাদুরের উপর বসে আছেন যুগের মুজাদ্দিদ হাজী শরিয়তুল্লাহ । উচ্চতা মাঝারি । ফর্সা দেহের রঙ । শক্তিশালী ও ঋজু দেহ । মাথায় লম্বা পাগড়ি । একহাতে তসবিহ ৷ তার অবয়ব দেখতে একটু ভিন্নধর্মী ও আলাদা, যা অন্তরে নম্রতা ও ব্যক্তিত্বের প্রভাব তৈরি করে । আলী সালাম দিয়ে কাছে বসলো । তিনি একধ্যানে চেয়ে রইলেন । আলীর মনে হলো , এ চাহনি তার ভেতরের সব সংবাদ পড়ে ফেলছে । তারপর কথা শুরু করলেন তিনি। প্রতিটা কথা যেন আলীর কান দিয়ে ঢুকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো । আলী বশীভূত হয়ে সারাদিন পড়ে রইলো হাজী সাহেবের দরবারে । তারপর যখন চরলক্ষ্মীতে ফিরে আসলো, তখন সে অন্য জগতের মানুষ । এক মহান দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সে বাড়ি ফিরলো ।
হাজী সাহেব সাক্ষাতের শেষদিকে একটি কথা বারবার বলছিলেন, তোমার কাজ শুধু মানুষকে সঠিকটা জানানো । মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছে দেয়া । আর দাঈর ভাষা হতে হয় কোমল । ভাষার চেয়ে ভেতরটা হতে হয় আরো কোমল । ধৈর্য ধরো, ধৈর্য ধরো এবং ধৈর্যের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাও।
এক
ওপাড়ে চর ৷ চরের নাম মতিমারা।
চরের নাম মতিমারা কেন এটা অনেকেই জানে না ৷ বলতে গেলে বেশিরভাই জানেনা ৷ মুরব্বিগোছের কাউকে জিজ্ঞেস করলে একেকজন একেক উত্তর দেয় । কেউ বলে— অনেক দিন আগে মতি মিয়া নামের একলোক এই চরে বসবাস করতো । একলা থাকতো । গরুছাগল পালতো । সাত-পাঁচহীন জীবন । তারপর বলা নাই কওয়া নাই টুপ কইরা একদিন গায়েব হইয়া গেল । তার দেহ গেলেও আত্নাটা এখনো ঘুরে-বেড়ায় ৷ কে যেন গরুর পাল আনতে গিয়ে সন্ধ্যে বেলা মতি মিয়ার গলার ডাক শুনেছে।
কুপির গা ছমছম করা আলোয় খোকাখুকিরা এ গল্প শুনে ‘পরে কি হইছে’ এ আগ্রহ প্রকাশ করলেও একটু বুঝমানরা বলে, ধুর, এসব ফাও কথা । কত রাত যমিন পাহারা দিতে গিয়া মতিমারায় থাকছি ৷ এইতো গত আমাবস্যাতেই বদরুদ্দি চরের বালুতে সারারাত শুয়ে ছিল । জীন-ভূত কিচ্ছু নাই মতিমারায় । সব গালগল্প । মুরব্বিরা ধমক দেয়, নাস্তিক হইয়া গেছোস ৷ এমন কোনো জায়গা আছে যেখানে আল্লাহর সৃষ্টিকুল থাকবার পারেনা! আর যারা বলে, পলাশীর আমবাগানে পরাজিত নবাব সিরাজুদ্দৌলার একদল সৈন্য এই চরে এসে আশ্রয় নিয়েছিল ৷ সে দলের প্রধানের নাম ছিল মতি শেখ । এখান থেকেই তারা পুনরায় মুর্শিদাবাদ উদ্ধারের পরিকল্পনা করতে থাকে । তাদের গল্পটা এই পর্যন্ত এসে থেমে যায় ৷ মুর্শিদাবাদ উদ্ধার করা আর সম্ভব হয়নি এটা সবে জানলেও পালিয়ে আসা সৈন্যদের শেষ পরিণতি কি হয়েছিলো এটা কেউ-ই জানেনা ৷
মেঘনায় স্রোত নেই ৷ আকাশে গনগনে সূর্য । বাতাসও নেই । সবকিছু শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে । নৌকা থেকে চরে নেমে দ্রুত পা চালায় আলী ৷ গরম বালিতে হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে ৷ পায়ে জুতা নেই । আলীর পরনের লুঙ্গিটা হাটু অবধি গোটানো । কাদা না লাগার জন্য লুঙ্গিটা এভাবে পরেছে সে ৷ গায়ে পুরাতন একটা পাঞ্জাবি ৷ রোদ থেকে বাঁচার জন্য মাথার উপর চটের বস্তাটা ধরে রেখেছে ৷ আলীর জন্মবাড়ি পিতলগঞ্জে । মতিমারা থেকে পাঁচ মাইল পুবে । বাড়ি পিতলগঞ্জে হলেও আলী থাকে তালুকদার বাড়িতে ৷ আরো দুই বছর আগে নদী ভাঙনে ওদের ঘরবাড়ি সব মেঘনায় তলিয়ে গেছে ৷ বাপ মরা ওদের ছোটো সংসার ছিল ৷ বোন দুটির বিয়ে দিয়েছে অনেক আগেই । শুধু মাকে নিয়ে জীবন-যাপন ৷ নদী ভাঙনের বছর মাও মারা যায় । আলীর জীবনটা গোছানো ছিল বলে বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়েনি ৷ গ্রামের মুন্সির কাছে আরবিটা শিখেছিলো ছোটবেলা ৷ আর টুকটাক ফার্সি উর্দুও পড়তে পারতো ৷ ঘরবাড়ি হারিয়ে ছন্নছাড়া জীবন নিয়ে কিছুদিন এদিক সেদিক ঘোরাফেরা করেছে । টুকটাক কাজ বাজ করেছে । অবশেষে এই পাঁচচরের ঝানু তালুকদারের বাড়িতে ঠাঁই মিললো ৷ দুইবেলা পেট-ভাতের বিনিময়ে প্রথমে বাড়ির ছেলেমেয়েদের কোরআন পড়ার শিক্ষক হিসেবেই রেখেছিলো আলীকে । পরে আলী নিজ থেকেই বললো, আমাকে আপনার জমিতে কাজ করতে দেন । আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই । তারপর বাড়ির হুজুরের পাশাপাশি কাজের লোকও হয় গেল ৷ যদিও অন্যান্য কাজের লোক থেকে আলীর সম্মানটা একটু বেশি ৷
ঝানু তালুকদার চিকন বুদ্ধির লোক ৷ মতিমারার অর্ধেক চাষের জমিই তার । গোয়ালভর্তি দুধাল গাভী । অনেক রকমের ব্যবসা । মুসলমান হলেও হিন্দু জমিদার আর ইংরেজ সাহেবদের সাথে তার বেশ মাখামাখি ৷ এই লোকটার মতিগতি আলীর বুঝে আসে না ৷ অত্র এলাকায় ঝানু তালুকদারের ক্ষমতায় সব চলে । বছর দুয়েক আগে পাঁচচরে সাদা চামড়ার সাহেবরা কুঠি স্থাপন করলে মানুষ বাধা দিতে গেছিলো ৷ কারণ কুঠি স্থাপনের পর থেকেই ওদের নির্দেশমতো জমিতে নীল চাষ করতে হবে ৷ এই নীল চাষ একসময় লাভের ফসল থাকলেও, আজকাল কৃষকদের জন্য বোঝা ছাড়া আর কিছুই না ৷ পেটে ভাত না জুটলে শখের নীলচাষ কে করে !
কিন্তু তালুকদার নীলকরদের প্রশ্রয় দিলো । কৃষকদের ডেকে বললো, তোমরা সব বে-আক্কেলের দল ৷ এই সাহেবদের বিরোধিতা করে লাভ আছে? কার ক্ষমতা আছে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর! সারা দেশ চলছে যাদের হাতে, তাদের বিপক্ষে আমরা কিছু করতে পারুম! এরচেয়ে ভালো যদি আমরা তাদের কথা মত চলি । দেশের শান্তিও বজায় থাকলো, তোমরাও আরামে থাকলা ৷
দেশের বাহ্যিক শান্তি ঠিকই বজায় থাকে । গরুর গাড়িভর্তি নীলের আঁটি ফ্যাক্টরিতে চলে যায় । কিন্তু প্রথম বছর জমির সিকি ভাগে নীল চাষের ফলে কৃষকের ঘরে ঘরে দেখা দিল অভাব অনটন ৷ তারা ভেতর ভেতর বিদ্রোহী হয়ে উঠলো । কিন্তু এলাকার জমিদারের পোষা লাঠিয়াল বাহিনী আর সাহেবের চাবুকের সামনে মুখ খোলার সাহস ছিল না খেটে খাওয়া সাধারণ চাষাভূষা গরীব কৃষকদের । তাদের দ্রোহ মনের ভেতরেই কেবল গুমরে মরে, বাইরে প্রকাশের হিম্মত মিলে না । তারপর গতবছর আদেশ এলো, অর্ধেক জমিতে নীল চাষ করতে হবে । উপায় নেই । যা খেয়ে গোষ্ঠী বাঁচে, সেই প্রধান ফসল ধান, পাটসহ সকল জমির অর্ধেকটাতে নীল চাষে বাধ্য হল কৃষকরা ৷ শুধু তাই নয়, আলী সবসময় দেখছে লাঠি ও চাবুকের ভয়ে জালের বড় মাছটা, ভালো তরকারিরটা, কলার ছড়াটা দিয়ে আসতে হয় সাহেবদের কুঠিতে । এসব নিয়ে অভিযোগ করেও লাভ নেই । কোর্টকাছারি আর আইন-কানুন সব ইংরেজ আর তাদের এ দেশীয় দালাল হিন্দু জমিদারদের অধীনে ৷
মতিমারায় সপ্তাহে দুইবার আসতে হয় আলীর ৷ চরলক্ষ্মী থেকে কোষা নাও করে ঘন্টখানেক লাগে ৷ তালুকদারের জমির খবরাখবর নিতে হয় । সাথে নিজে তালুকদারের জমির যে অংশটা বন্ধক নিয়েছে, সেটাও দেখতে হয়। যদিও দুইজন বছর মেয়াদি কৃষক চরে থাকছে, তবু একটা পর্যবেক্ষণের ব্যাপার-স্যাপার আছে।
একটা গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে বসে আলী । পাতার ফাঁক গলে ডোরাকাটা ছায়া ওর গায়ে এসে পড়ছে । প্রকৃতি কেমন ঝিম ধরে আছে । একটুও বাতাস নেই ৷ চোখ মেলে চরটাকে নিজের সামনে আনে ৷ প্রতিটা জমিরই অর্ধেক জুড়ে নীল গাছ । রোদে পুড়ে কৃষকরা ক্ষেতে কাজ করছে । কৃষক সবাই আশপাশের গ্রামের। ভোরে এই মতিমারায় আসে, আবার সন্ধ্যা হলে বাড়ি ফিরে যায় । কেউ কেউ এখানে থাকেও । এই কষ্টের ফসল-ই কিনা সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে সাহেবদের গুদামে গিয়ে উঠবে । আলী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে । সূর্য পশ্চিমে হেলছে ধীরে ধীরে । কতক্ষণ বসে থাকার পর উঠে দাঁড়িয়ে ওযু করে নদীর গরম পানি দিয়ে ৷ তারপর পশ্চিমে দাঁড়িয়ে জোরে আযান হাঁকে ৷ আল্লাহু আকবার….
চাষীদের মুখে কিছুটা হলেও হাসি ফোটে ৷ এ সুর সবার চেনা । এই ছেলেটা আসলেই কৃষকরা শান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে । কত সুন্দর করে ছেলেটা কথা বলে ৷ কত ভালো ব্যবহার ৷ অসমাপ্ত কাজ দ্রুত শেষ করে সবাই বট তলায় জড়ো হয় ৷ নামাজ আদায় করে সবাই যার যার খাবার নিয়ে বসে । সামান্য কিছু । ঘরে চাল নাই । বছর শেষ হওয়ার আগেই অভাব শুরু হয়ে যাবে । হিসেব করে চলতে হয় ।
কারো মুখে কথা নেই । আলী প্রথমে শুরু করে, গত সপ্তাহে কি বলে গেছিলাম মনে আছে তো সবার? করুণ চোখে সবাই তাকায় ৷ এদের চোখ দেখলে আলীর সহ্য হয় না আর ৷ মন চায় এক্ষুণি গিয়ে এককোপে নীলকরের কল্লাটা ফেলে দিতে ৷
রইস মিয়া কথা বলে, কি হবে এসব জেনে ভাই ? জীবনই যদি না বাচে ধর্মের কথা শিখে কি হবে, বলো? কয়েকজন ঠিক ঠিক বলে তার কথায় সায় দেয় । এবার দাঁড়িয়ে চ্যাতাস্বরে যুবক কৃষক আব্দুল্লাহ এসবের প্রতিবাদ করে । ও বলে, কি সব বলতেছেন আপনারা? একটা লোক এতদূর থেকে এসে বিনাশ্রেম আমাদের এত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস শিক্ষা দিতাছে, আর আপনেরা বলছেন কি হবে এসব শিখে? লজ্জা থাকা উচিত আমাদের ৷ এরপর স্বর নেমে আসে আব্দুল্লাহর ৷ দেখেন, জন্ম হয়ে দেখছি আমগো বাপ-দাদার ভিটা বিদেশিদের দখলে । ছোটবেলা ধর্ম-কর্ম শিখতে পারি নাই ৷ ওরা আমাদের মসজিদ-মক্তব সব বন্ধ কইরা দিছে । এই পাঁচচর জুড়ে একটা মক্তব আছে বাচ্চাদের কোরআন শিখার? নাই ৷ গ্রামের কয়টা লোক নামাজ পড়তে জানে ৷ আর এই-যে রইস চাচা, আপনি কন তো, আপনার পনেরো বয়সের সেয়ানা ছেলেটা কি জানে? পাঁচ কালীমা পারে, নাকি হালাল-হারাম চিনে! পীরের নামে আমরা মান্নত করতাছি, পীরের দরবারে সেজদা দিতাছি । অথচ এই সেজদাটা আল্লাহর ঘর মসজিদে দেয়ার উচিত ছিল । এই যে আজ আমাদের এই অধঃপতন, নিজ দেশে হয়েও পরাধীন । এইটার একমাত্র কারণ ধর্মের সঠিক শিক্ষা থেকে বিমুখ হয়ে যাওয়া । ধর্ম ভুইলা আমরা যে দাস হইয়া আছি, এ কথাও ভুইলা যাইতাছি ।
হাঁপিয়ে ওঠে আব্দুল্লাহ । আলী তাকে থামিয়ে কথা শুরু করে । তার স্বর যেন দূর দেশের মেঘের গর্জন ৷ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেবদূত দেখার মতো সবাই আলীর দিকে তাকিয়ে থাকে ৷
আলীর প্রচেষ্টায় আল্লাহ বরকত দেয় । কাজ হয় । ধর্মের যে সঠিক শিক্ষা মানুষ ভুলে গিয়েছিলো, দিনদিন সে শিক্ষা সমাজে আলো ছড়াতে শুরু করে । প্রথমে অল্প কিছু লোক, তারপর আরো কিছু ৷ এভাবে দলটা ভারি হয়ে ওঠে । একসময় চরলক্ষ্মীতে একটি আস্তানা গড়ে তোলা হয় । গ্রামের শেষ দিকে পরিত্যক্ত যমিনে একচালা বড়সড় একটা ঘর । এখানে নামাজ হয়, বাচ্চাদের কোরআন শিক্ষা দেয়া হয় । এবং গোপনে, নীলকরদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য একটি লাঠিয়াল বাহিনীও গড়ে তোলা হয় । লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে একজন না দেখা হাজী সাহেবের কথা । তবে হাজী সাহেবের শাগরিদকে দেখেই লোকেরা তৃপ্ত হয় ৷ কিছুদিন পর হাজী সাহেব নিজেই তার মুরীদ-শাগরীদ নিয়ে একবার পরিদর্শনে আসেন চরলক্ষ্মীতে ৷ মানুষ ভেঙে পড়ে ৷ তিনি বারবার শুধু একটি কথাই বলেন, সবাই ধর্মের মূলভিত্তি ফরজকে আকড়ে ধরো । তারপর যারা এই ফরজকে আকড়ে ধরে নতুন জীবন শুরু করে, সমাজে তাদের নাম হয়ে যায় ফরায়েজি । মানুষের এই জেগে ওঠা দেখে উচ্চবিত্ত শোষকদের গায়ে লাগে । নাক উঁচা পন্ডিতরা মুখ বাকিয়ে বলে, দেখো লিলা! কই থেইকা না এক মোল্লা আইসা আমগোরে নতুন ধর্ম শিখাইতাছে ৷ এতদিন বাপদাদারা যা করছে, এর বিরোধিতা কইরা এরা বিশাল জান্নাত পাইয়া যাইবো ৷
সমাজ যে পরিমাণ বেদাত আর কুসংস্কারে ভরপুর, শুরুতেই প্রকাশ্যে এসবের বিরুদ্ধে কথা বললে বাধাগ্রস্ত হতে হতো । এজন্য আলী উস্তাদের কথা মতো প্রথমে কৃষকশ্রেণীটাকে নামাজ ধরিয়েছে । ইসলামের মূল বুনিয়াদগুলি শিক্ষা দিয়েছে । তারপর নিম্নবিত্তের ছেলেমেয়েদের ঘরে ঘরে গিয়ে সমাজে ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ড, কুসংস্কার সম্পর্কে সচেতন করে । দীর্ঘ সময় নিয়ে ওদের বুঝাতে থাকে । মাসলা-মাসায়েল শিক্ষা দেয় । একসময় সবাই আবে হায়াত পাওয়ার মতো বলে, কই ছিলেন এতদিন, কই ছিলো আপনার এই শিক্ষা । আলী হাসে ৷ হেসে বলে, ছিল আমাদের কাছেই । আমরা খুঁজে দেখিনি ৷ এভাবে ক্রমশ একটা নতুন জেনারেশন গড়ে ওঠতে থাকে , যারা ধর্মের সঠিকটা জানছে ।
আলী উস্তাদের মুখে শুনেছে, ইসলাম শক্তিশালী হয়েছে খেটে-খাওয়া মানুষদের দিয়ে । ফের শক্তি জোগাতে হলে তাদেরই লাগবে ৷ তাদের ভেতরটা থাকে কোমল, প্যাঁচমুক্ত । স্রোতের বিপরীতে তাদের দাঁড় করাতে পারলে স্রোত নিজেই একসময় ঘুরে যাবে।
দুই
পর্দার ওপাশ থেকে ফাতেমা বললো, কিছু শুনেন নাই?
আলী খাবারের বাসন (প্লেট) থেকে মাথা তুলে আবার চুপচাপ খেতে থাকে । মহিষের দইটা আলীর প্রিয় । এ বাড়িতে নিয়মিত মহিষের দই তৈরি হলেও অনাহুত বা নিম্নস্তরের লোক বলে তার দস্তরখানে আসে না । কিন্তু আজ এসেছে । পোড়া মাটির পাত্রে করে আধা সের দই এনেছে ফাতেমা ।
তালুকদার বাড়িটা একান্নবর্তী। ঝানু তালুকদারের চার ছেলে ৷ সবাই পরিবার নিয়ে একসাথে থাকে। একপাতিলের রান্না খায় । এই বাড়িতে এসে আলী জাত-পাতের ব্যাপারটা দেখেছে । এসব তো হিন্দুদের সমাজের । নিম্নজাতির ছায়া মাড়ালেও গঙ্গার জল আর গোবর দিয়ে ওদের শরীর ধুতে হয় । কিন্তু আজকাল মুসলমানদের মাঝেও এটা ব্যাপক । জেলে, কুলি, তাঁতি, কৃষক, কাহার,( পাল্কীবাহক) এদের সভ্য মানুষদের কাতারের মনে করা হয় না । এই বাড়িতেও কাজের লোকদের তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখা হয় । আলীসহ কাজের লোক চারজন । জমিজমা দেখে দুইজন, আর রাখাল আছে একজন । এদের থাকা-খাওয়া বাড়ি থেকে আলাদা ।
বাড়ির বাইরে দোচালা লম্বালম্বি একটা ঘর । মাঝে বাঁশের বেড়া দিয়ে দুইটা কোঠা করা হয়েছে । একরুমে আলী, আরেক রুমে বাকিরা থাকে ৷ আলীর রুমটা অবশ্য গোছালো বলা যায় । একটা পুরাতন ঘুনে খাওয়া বোম্বাই খাট ৷ সেখানে ভারি জাজিমের উপর একটা ময়লা চাদর বিছানো । একপাশে একটা টেবিল, একটা স্টিলের ছোটো সিন্দুক । প্রতিদিন সকালে বাচ্চারা পড়তে আসে বলে ঘরটা পরিস্কার আর লেপা-পোছা থাকে সবসময় ।
এ বাড়ির দুইজন মানুষ ছাড়া আর কারো চোখেই আলী ওর প্রতি সহানুভূতির চাহনি দেখেনি ৷ একজন তালুকদারকে বড় বউ রহিমা বানু । যিনি তাকে বাজান ছাড়া কথাই বলেন না ৷ আরেকজন তালুকদারের ছোটো মেয়ে ফাতেমা ৷ একমাত্র ফাতেমায় তার সাথে হাসিমুখে কথা বলে ।
আলী যখন এ বাড়িতে আসে ফাতেমার বয়স তখন দশ-এগারো হবে । কাঁধের দুইপাশে বেণী ঝুলিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়ায় ৷ চোখের দিকে তাকানো যায় না । পটপট করে কথা বলতেই থাকে । তারপর তড়তড়িয়ে বড় হয়ে গেল ৷ এখন আর তার সামনে আসে না । পর্দার বয়স হয়েছে । তাছাড়া সোমত্ত একটা মেয়ে পরপুরুষের সামনে গেলে লোকমুখে নানা কথা ছড়াবে । এজন্য হুটহাট করে ফাতেমা আলীর সামনে পড়ে গেলেও আলী এড়িয়ে যায় । একদিন সে ফাতেমাকে ডেকে বলে দিয়েছে , বেশি প্রয়োজন না হলে তার কাছে না আসতে । আর প্রয়োজন হলেও কারো মাধ্যমে সমাধা করতে । আড়ালে থাকলেও আলী বুঝে মেয়েটা তার প্রতি সবসময় দৃষ্টি রাখে ৷ আজ বাড়িতে বিশেষ কোনো আয়োজন ছিল হয়তো, তাই ভেতর বাড়িতে এসে দুপুরের ভোজ সারছে আলী ।
ফাতেমা আবার কথা বললো, আপনে কিন্তু আমার কথার জবাব দেন নাই?
পিতলের গ্লাসে ঢকঢক করে শেষ চুমুকটা দিয়ে আলী বললো, খাইতে বইসা কমপক্ষে তোমার বিশটা প্রশ্ন শুনছি । কোনটা রেখে কোনটার উত্তর আমি দেই । এবার তোমার প্রশ্ন শুরু করো । ধীরে-সুস্থে সব বলতাছি ।
এঁটো থালাবাসন নিতে ফাতেমা ভিতরে আসে । চোরা চোখে আলীর দিকে তাকিয়ে থাকে । ঘন সুরমা দেয়া আলীর বড়বড় চোখে যেন রাজ্যের মুগ্ধতা ৷ কাঁধ ছোয়া বাবরি চুল চেহারায় আলাদা আকর্ষণ তৈরি করেছে । ফাতেমার কাছে সময় দ্রুত বয়ে যায় । আলীর গলা খাঁকারিতে ঘোর কাটে ফাতেমার । আমতা আমতা করে বলে, আপনি আরো কালো হইয়া গেছেন?
হো হো করে হেসে দেয় আলী। সুন্দর-ই বা আছিলাম কবে ! আলী হাসি থামিয়ে বলে, তোমাদের মেয়েদের এই এক স্বভাব । মনে রাখো এক কথা, মুখে বলো আরেক কথা । কি বলতে চাইছিলা বলে ফেলো ।
‘আপনাদের লোকেরা নাকি ঝামেলা করতাছে?’
‘মানে?’
‘মানে আরকি । সকালে আব্বা কইলো কয়েকদিন আগে ফরিদুপরের দিকে ফরায়েজিদের সাথে জমিদারের সমস্যা হইছে । মারামারিও নাকি হইছে । এখন ফরায়েজিদের বিরুদ্ধে মামলা করছে জমিদার । ধরপাকড় চলতাছে নাকি ৷’
চুপচাপ আলী শুনে যায় । জমিদারদের সাথে ঝামেলা নতুন কিছু না । তবে হাজী সাহেবের জীবদ্দশায় অতটা ছিল না । গতবছর হাজী সাহেবের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে পীর দুদু মিয়া পিতার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে । এরপর থেকেই জমিদারদের সাথে তুমুল দ্বন্দ্ব শুরু ।
দুদু মিয়ার বয়স একদম অল্প । পড়াশোনা অত করার সময় হয়ে ওঠেনি, তবে সাংগঠনিক ক্ষমতা প্রচুর ৷ বলতে গেলে এ দিকটায় পিতার চেয়ে এগিয়ে । এরমধ্যেই দলকে একটা অবস্থানে নিয়ে এসেছেন তিনি । এই এলাকার সব খবরা-খবর নিয়মিত তাঁর কাছে পাঠাতে হয় । পাঠানো খবর সত্য না মিথ্যা, এটা যাচাইয়ের জন্যও গোপনে লোক নিয়োগ করেছেন ৷ নিজেও নাকি ছদ্মবেশে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান । এই চরলক্ষ্মীর দিকে তাঁর বিশেষ দৃষ্টি ৷ কারণ অত্র কয়েক থানা যেসব নীলের কুঠি আছে, তার মালিক হচ্ছে মি. ডানলপ । যিনি এই চরলক্ষ্মীর একটা কুঠিতে থাকেন । এখানে ফরায়েজিদের সাথে তেমন ঝামেলা না হলেও সবের মূল তো এই ডানলপ । তাই দুদু মিয়া তার দিকে ভালোভাবে দৃষ্টি রাখতে বলেছেন ।
শেষবার যখন তার আস্তানায় গিয়েছিলো আলী, তখন বারবার সতর্ক করছিলেন লাঠিয়াল বাহিনীকে শক্ত রাখতে । অন্যায়ের প্রতিবাদ প্রথমে মুখে করা হবে । এ দিয়ে সমাধান না আসলে লাঠি ব্যবহার করতে হবে । অন্যথায় জমিদার আর নীলকররা পথে আসবে না।
আলীর চুপ থাকা দেখে ফাতেমা উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো, আপনারা আবার ঝামেলা করতে যায়েন না ৷ আমাদের এলাকায় সব ঠিক আছে, ঠিক থাক…
ঠিক কই দেখলা? ফাতেমার মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে কথাটা বলে আলী । তুমি বড় ঘরের মেয়ে, আর থাকও সারাদিন বাড়ির ভেতর । বাইরের খবর কিছুই জানো না। তারা যা মন চায় তাই করছে । দুইদিন পরপরই নতুন নতুন কর ধার্য করছে । এই যে সামনের সপ্তাহ আমাদের কাচারিতে জমিদার আসবে, এটার জন্যও কর ধরা হয়েছে ৷ আর মানুষ যেখানে পেটের ভাত জোগাতে পারে না, সেখানে জমিতে করা লাগছে নীলের চাষ । এসব নিয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে নেমে
আসছে নির্মম অত্যাচার । এ অত্যাচারে প্রতিবাদ করা লাগবে না?
আলী থেমে যায় । এ অবলা মেয়ের উপর রাগ ঝেরে লাভ নাই । মূলত ভেতরে ক্ষোভটা তালুকদারের প্রতি । ব্যাটা নচ্ছার ৷ ফরায়েজিদের সংস্কার আন্দোলনে তালুকদারের কোনো সমর্থন নাই । গ্রামে এতবড় একটা দল গড়ে ওঠলো, পীর দুদু মিয়াও বার কয়েক গ্রামে ঘুরে গেল, তবু এই লোকের কোনো বিকার নাই । কথাবার্তায় বুঝা যায় উল্টো এর বিরোধী । পীরের শিরকি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কথা বলতেই গায়ে লেগেছে । শুধু জমিদার আর সাহেবদের গোলামি করতে জানে । শেষের কথা মিনমিনিয়ে বলে আলী ।
আলীর এমন চ্যাতামূর্তি ফাতেমা আগে দেখেনি । কিছু না বলে চুপচাপ নখ দিয়ে মাটি খুঁটতে থাকে । আলী উঠে দাঁড়ায় । আজ বাহাদুরপুর রওনা করার কথা । কিন্তু অবস্থা তেমন ভালো মনে হচ্ছে না । পুলিশি ঝামেলা চললে ওখানে যাওয়া কি ঠিক হবে!
‘আজ বাহাদুরপুর রওনা করার দরকার নাই । পরিস্থিতি ঠান্ডা হোক ।’
ফাতেমার কন্ঠের উদ্বিগ্নতা বাইরে প্রকাশ পায় না ।
আলী ঘুরে তাকায় । অবুঝ চোখের আশাহত চাহনি তার ভেতরটা কাঁপিয়ে তুলে । আলী বলে, আসলে কথাগুলি তোমারে বলি নাই । মনে কিছু নিও না ।
ফাতেমা দ্রুত মুখে হাত দিয়ে বলে, ছি ছি, কি বলছেন এসব । আমি আবার মনে কি নিবো? আপনার কথা তো সব সত্যি । কিন্তু এতবড় জমিদারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে কারা?
আলী বেরোতে বেরোতে বলে, আমরাই করবো ।
তিন
বৃষ্টি হচ্ছে । ঝুম বৃষ্টি ।
বৃষ্টির বড়বড় ফোঁটা মাটিতে পড়ে বুদবুদ তৈরি করছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে । অনেকদিন পর বৃষ্টি আসার কারণে পরিবেশ ঠান্ডা হতে সময় লাগছে ৷ শুষ্ক যমিন যেন আকাশের সব পানি শুষে নিচ্ছে । বারান্দায় চিন্তিত মুখে বসেছিলো আলী । বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হলো । যোহরের পর সবাইকে আব্দুল্লাহর বাড়িতে আসতে বলেছিলো । বৃষ্টি নামার কারণে কেউই আসতে পারছে না ।
এখন ফসল লাগানোর সময় ৷ বিশেষত বৃষ্টির এই টান থাকতেই নীলের চাষটা সেরে নিতে হয় ৷ গতকাল কুঠি থেকে ইংরেজ পেয়াদা এসেছিলো গ্রামে । কৃষকদের কুঠিতে গিয়ে দেখা করার আদেশ দিয়ে গেছে । তখন সবাই চুপ থেকেছে । পেয়াদা চলে যাওয়ার পরই সবাই আব্দুল্লাহকে ধরেছে । আলী তখন গ্রামে ছিল না । বয়স কম হলেও অনেকটা অঘোষিতভাবে কৃষকদের সর্দার হয়ে আছে আব্দল্লাহ । সবাই ওর কথাবার্তা মানে । আব্দুল্লাহ বললো, দুদু মিয়ার কাছে থেকে আদেশ এসেছে, এখন থেকে আমরা আর নীল চাষ করবো না । প্রয়োজনে ওদের সাথে স্পষ্ট বুঝাপড়া হবে । তবু এই অলাভজনক ফসল আমরা আর ধান পাটের জমিতে করছিনা’ । পুবপড়ার সোহরাব মুন্সি থেকে শুরু করে তামাক ব্যবসায়ী আবেদালী, গঞ্জের দোকানদার মিয়া জান সবাই জড়ো হয়েছে । ভীত চোখে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে । তারা জানে এভাবে সরাসরি নীলকরদের বিপক্ষে গেলে পরিণতি কি হতে পারে । তাদের কানে যেন দূর থেকে ভেসে আসতে লাগলো সাহেবের চাবুকের সপাং সপাং আওয়াজ । নির্যাতিতের অসহনীয় গোঙানি । আব্দুল্লাহ বিরক্তি নিয়ে কাপুরুষদের চেহারা পড়ার চেষ্টা করলো । মাইর খেতে খেতে প্রতিঘাত করার কথা তারা চিরতরে ভুলে গেছে । অথচ এই চরলক্ষ্মীতে যে পরিমাণ লাঠিয়াল ফরায়েজি গড়ে ওঠেছে, সবাই এক কাতারে দাঁড়ালে কুঠির সেপাইরা পালানোর পথ পাবে না ।
আলী বললো, পথ পাবেনা ঠিক । কিন্তু আগে পরিবেশ তৈরি করতে হবে । আমার তো মনে হইতাছে এবারও ঝানু তালুকদার ঝামেলা করবে ।
আব্দুল্লাহ এবার ক্ষেপে গেল ।
আলী ভাই, আপনার কথাবার্তা আমি বুঝতাছিনা কিছুই । তালুকদারের ঝামেলা করার কি আছে এখানে ! এতদিন আমাদের কোনো জনশক্তি ছিলনা । এখন সময় পাল্টে গেছে । আজ তালুকদারের সাথে কথা হবে লাঠি দিয়ে, মুখে নয় ৷
আলী কিছু না বলে বাইরে এসে দাঁড়ালো । তালুকদারের সমর্থন পেলে দলটা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠতো ৷ এই লোককে কিছু বলাও যাচ্ছে না, আবার সওয়াও যাচ্ছে না ৷
বৃষ্টি কমে এসেছে । ঝিরঝির করে ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে শুধু ৷ দমকা বাতাস শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দেয় । পিছনে পিছনে আব্দুল্লাহও আসলো । চুপচাপ অনেকক্ষণ হাঁটার পর গ্রামের শেষ দিকে এসে দাড়িয়ে পড়লো দুইজনে । অদূরে কুঠি দেখা যাচ্ছে । চারপাশে ইটের শক্ত গাঁথুনির দেয়াল উঠেছে ৷ লোহার গেইটের সামনে দুই নলা বন্দুক হাতে দুইজন পেয়াদা দাঁড়িয়ে আছে । আজকাল মনে হচ্ছে পাহারা বাড়িয়ে দিয়েছে ।
‘আব্দুল্লাহ তুমি বাড়ি যাও আপাতত । আমি কুঠিয়ালের সাথে কথা বলে আসছি ।’
‘পাগল হইলেন নাকি! একা গেলে আপনার সাথে কি ব্যবহার করবে, জানেন না আপনি?’
আলী আমতা আমতা করছিলো । আব্দুল্লাহ মাথা গরম ছেলে । একটু উনিশ বিশ হলে কুঠিতেই কিছু করে বসবে ।
‘তুমি ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করো । এখনো আমাদের লোকেরা এতটা প্রভাবশালী হয়ে ওঠেনি । ওদের সাথে আগে কথা বলি । সমোঝোতায় আসতে পারলে তো ভালো । ’
অবশেষে দুনোজনেই গেইটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো । আলীকে দেখেই দোরোয়ান চিনে ফেললো । সেলামি দিয়ে বললো, আসেন হুজুর । লাট সাব আপনার অপেক্ষাতেই আছে ।
ভেতরে ঢুকে সময় নিয়ে আশপাশটা লক্ষ্য করলো আলী । বেশ গুছিয়ে নিয়েছে মি. ডানলপ । দুইতলা বিল্ডিংয়ের নীচের অংশটা গুদামঘর । কাঁচা নীল ফ্যাক্টরি থেকে মাড়াই করে এনে মোড়কজাত করা হয় । এখান থেকেই লন্ডনে যায় । সামনে অনেকখানি জায়গা খালি । নীচে হাঁটার মতো বিছানো ঘাস । একপাশে ছোটোখাটো গোলাপের বাগান ৷ ঘোড়ার আস্তাবল । উপরতলায় কর্মচারীরা থাকে । দক্ষিণ দিকের রুমটা নীলকর মি. ডানলপের । স্টিলের দরজা ঠেলে রক্ষী আলী আর আব্দুল্লাহকে নিয়ে রুমে ঢুকলো । বিলেতি কায়দায় রুমের সাজগোছ । মেঝেতে মোটা নকশা করা লম্বা কার্পেট বিছানো । একপাশে পর্দায় ঘেরা উঁচু খাট ৷ এক কপাটের বড়সড় আলমারি । একটা বিউগল । দেয়ালে অনেকগুলি পেইন্টিং ৷ এর মধ্যে কয়েকটা ইংরেজ সেনাপতিদের । আলী এদের ছবি আরো অনেক জাযগায় দেখেছে, তবে নাম জানে না ৷
একদম জানালা ঘেষে মি. ডানলপের টেবিল । চেয়ারে হেলান দিয়ে কিছু দেখছিলেন । সামনে ধোয়া ওঠা কফির মগ । টেবিলের এপাশে আরো দুইটা চেয়ার রাখা । চোখাচোখি হতেই মি.ডানলপ হৈ চৈ করে উঠলো ৷
‘ইউ আলী? কামিং, সিট ডাউন ।’
আলী প্রতি উত্তরে হাসার চেষ্টা করলেও আব্দুল্লাহ চরম বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ।
‘টোমরা কেমুন আচো?’
ভাঙাচোরা বাংলায় নীলকর সাহেব কথা শুরু করলো ৷ বিদেশীদের বয়স ঠিক আন্দাজ করা যায় না । ক্লিন শেভড চেহারা মি.ডানলপের। মাথায় টাক পড়েছে । লালচে খযেরি আঁচড়ানো চুল ।
পরিবেশ কেমন গুমোট বেঁধে আছে ৷ আলী কথা গুছিয়ে নিলো । অতিকথা রেখে যা বলার তা বলে ফেলা উচিত । হুট করে আলীর অনুমতির তোয়াক্কা না করেই আব্দুল্লাহ বলে বসলো, এ বছর আমরা আর নীল চাষ করছি না ৷ বছর শেষে গরীব কৃষকদের ঘরে ঘরে ভাতের টান পড়েছে ৷ তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সব যমিনে শুধু ধান চাষ করবো । আগে নিজের পেট বাঁচাতে হবে, তারপর নীল চাষের কথা ভাবা যাবে ।
ডানলপ এসব শুনার জন্য প্রস্তুতই ছিলো । হো হো করে হেসে ফেললো । তারপর হাসির রেশ ধরেই বললো, সী!
মুহুর্তেই মি.ডানলপের স্বর পাল্টে গেল । ফোল্ডিং চেয়ারে ঘুরতে ঘুরতে বললো, তিনবছর যাবৎ চাষীরা নীল চাষ করছে । এতদিন কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। আজ হঠাৎ তোমরা ছোকরা বয়সের ছেলেরা এসে ঝামেলা পাকাচ্ছ কেন?
আলী বুঝলো মানুষের হুজুর হুজুর কথা শুনতে শুনতে ওদের অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেছে ৷ আলী অনুমতি না নিয়েই ওঠে দাঁড়ালো ৷ তারপর বললো, যাই আমরা ।
‘ওয়েট, কথা শেষ করো আগে ৷’
‘কথা তো শেষই । আর কি শুনতে চান আপনি?’ রাগে আব্দুল্লাহর দুই কান লাল হয়ে আছে ।
‘শুনতে চাই তো অনেক কিছু । আচ্ছা, তোমরা কি হাজী সাহেবের দলের লোক?’
তারা কিছু না বলে চুপ থাকে । ডানলপ বুঝতে পারে এরা ফরায়েজি এবং দুদু মিয়ার প্ররোচনায় এখানে এসেছে । তিনি মনে মনে কয়েকবার দুদু মিয়ার নামটা উচ্চারণ করলেন । দুদু মিয়ার সাথে তাঁর অনেকবার ঝামেলা হয়েছে, এখনও হচ্ছে । এজন্য কয়েক এলাকায় নীল চাষ বন্ধ আছে । আর যেভাবে জমিদারদের বিরুদ্ধে একের পর এক দুদু মিয়া সাফল্য অর্জন করছে, অচিরেই এই বৃহত্তর ফরিদুপর এলাকা তাঁর আয়ত্তাধীনে চলে যাবে ।
এই পেরেশানিকে বাইরে প্রকাশ করতে দিলেন না মি. ডানলপ । ঝাঁঝালো স্বরে বললেন, তোমরা হয়তো জানো না, থানায় আমার দুইটা ডায়েরি করা আছে । আমার ব্যবসায়িক কাজে কেউ ব্যঘাত সৃষ্টি করলে তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারী হয়ে যায় সাথে সাথে । আজ রাতে বা কাল সকালে পুলিশ এসে তোমাদের ধরে নিয়ে গেলে আমার কিচ্ছু করার থাকবে না ।
আলী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো । ফরায়েজিদের শক্তি সম্পর্কে অবগত হয়েছে বোধহয় । না হয় পুলিশের ভয় দেখাতো না । ওরাই শাস্তি প্রয়োগের চেষ্টা করতো ।
আর আপনিও হয়তো জানেন না, অত্যাচারি আর শোষকদের সোজা করার জন্য মানুষ আজকাল লাঠি ধরতে শিখছে ৷
হনহন করে বেড়িয়ে এলো আলী আর আব্দুল্লাহ ৷
চার
উত্তেজনায় বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন দুদু মিয়া ।
তাঁর সামনে বাঁশের চাটাইয়ে বসে আছে বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলের থানা ইউনিটের সর্দাররা । চোখেমুখে চিন্তার ছাপ ৷ তিনমাসে একবার নির্দিষ্ট একটা দিনে সবাই দুদু মিয়ার আস্তানায় হাযিরা দেয় । এখান থেকেই সামনের তিনমাসের সব কার্যক্রমের ঘোষণা দেয়া হয় । কিন্তু বিগত দুই বছর যাবৎ বেশ ঝামেলা চলছে জমিদারের সাথে ৷ তাই সবাই একসাথে জড়ো হতে পারেনি । এখন আশপাশের জমিদারদের সাথে একটা সমোঝতায় চলে এসেছে দুদু মিয়া । পিতার সময় থেকেই সাধারণ মানুষদের প্রতি জমিদারের বাড়াবাড়ি দুদু মিয়া দেখে আসছিলো । কিন্তু তখন বয়স কম হওয়ায় কিছু করতে পারেননি ৷ তারপর মক্কায় যাওয়ার সময় বারাসাতের দূর্গে স্বপ্নের পুরুষ তিতুমীরের সাথে দেখা হয়ে গেল । তীতুমীর তখন চব্বিশ পরগণার বড় একটা এলাকায় তার খেলাফত প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। হাজী সাহেবের ছেলে, এটা শুনতেই বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, তোমাকেই পিতার অপূর্ণ কাজকে পূর্ণতা দিতে হবে ।
১৮৪০ সালে হাজী সাহেবের মৃত্যুর পর জমিদারদের মতিগতি লক্ষ্য করছিলেন । ফরায়েজি আন্দোলন তখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে হলেও, প্রতিঘাতে ততটা শক্তি দেখাতে পারেনি । যার কারণে তুচ্ছ তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে জমিদার আর নীলকররা সাধারন ফরায়েজিদের উপর নির্মম অত্যাচার চালাত । এই নির্যাতন একপর্যায়ে দুদু মিয়ার ধৈর্যে আঘাত হানে । বাধ্য হয়ে তিনি ১৮৪১ সালে একশত লাঠিয়াল নিয়ে কানাইপুরের সিকদার জমিদারের বাড়ির দিকে অগ্রসর হোন । সাথে ছিল হাজী সাহেবের খাস শাগরিদ জানবাজ মোল্লা জালালুদ্দিন ।
দলটি প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে তাকবির দিলো । জমিদার প্রথমে বুঝতে পারছিলো না কি হচ্ছে । হয়তো কোনো প্রজারা ঝামেলা করতে আসছে । দুই ঘা লাগিয়ে দিলেই ঠিক হয়ে যাবে । বিরক্ত হয়ে বাড়ির ছাদে উঠে যখন বাইরে দৃষ্টি দিলেন, তিনি হতবাক হয়ে গেলেন । মাথায় বড় পাগড়ি বাঁধা ফরায়েজিরা তার প্রাসাদ ঘেরাও করে রেখেছে । নকীব দিয়ে জোর গলায় ঘোষণা দেয়ালেন, তোমরা কি চাও । জনতার ভীড় ঠেলে এক যুবক ভরাট গলায় আওয়াজ দিলো,
আমরা তোমার প্রাসাদের প্রতিটা ইট চাই । যে ইটের কণায় কণায় মিশে আছে শোষিত প্রজার ঘাম ।
জমিদার প্রমোদ গুনলো । এই স্বর তার চেনা ।
যুবক আবার ঘোষণা দিলো, ফরায়েজিদের সাথে সমোঝোতায় না আসলে এ প্রাসাদকে গুড়িয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হবে ৷
তখন বাধ্য হয়ে জমিদার ফরায়েজিদের সাথে সন্ধিতে আসলো, এবং সকল প্রকার নির্যাতন, অবৈধ ও পৌত্তলিক কর বন্ধের ঘোষণা দিলো ৷
এর পরের বছর তিনি ফরিদপুরের শক্তিশালী ঘোষ জমিদারের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযান পরিচালনা করেন । প্রথম অভিযানে সাফল্য তাঁকে উজ্জীবিত করে তুলেছে । কিন্তু ঘোষ জমিদার ছিল বেপরোয়া । রক্তপাত আর ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া ঘোষকে সমোঝোতায় আনতে পারলেন না দুদু মিয়া । তাই ৮০০ জনের এক সশস্ত্র দল গঠন করে মিয়া জানের নেতৃত্বে প্রেরণ করলেন জমিদারের বিরুদ্ধে । সেখানে ফরায়জিরা আক্রমণ করে গ্রেফতার কের নিয়ে গেল জমিদারের ভাই মদন ঘোষকে। যার বিরুদ্ধে ছিল ফরায়েজি মুসলমানদের উপর অত্যাচারের অসংখ্য অভিযোগ এবং সাথে মুসলিম মেয়েদের শ্লীলতাহানি করার মতও জঘন্য অপরাধ।
দুদু মিয়ার নির্দেশ মতো এই পাপীষ্টকে হত্যা করে পদ্মা নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয় ।
এর জের ধরে ঘোষ ফরায়েজিদের বিরুদ্ধে মামলা করে । জেলা মেজিস্ট্রেট ১১৭ জনকে গ্রেফতারের আদেশ দেয় । তাদের বিচার হয় । কিন্তু প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্তের অভাবে দুদু মিয়াকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
এই ঘটনা ফরায়েজি আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় । জমিদাররা দুদু মিয়ার প্রচার প্রসারে ক্রমশ ভীত-সন্ত্রস্ত হতে থাকে । কৃষক শ্রেণীর মধ্যে দুদু মিয়ার সম্মান বহুলাংশে বৃদ্ধি পায় । এতদিন যে সকল মুসলমান অত্যাচারের ভয়ে এ আন্দোলনে যোগ দিচ্ছিলো না, তারাও দলে দলে শরীক হতে থাকে । ফরিদপুর, পাবনা, বাকেরগঞ্জ, ঢাকা ও নোয়াখালীর ঘরে ঘরে উচ্চারিত হতে থাকে একটা শব্দ, পীর দুদু মিয়া জিন্দাবাদ!
আর আলী, চরলক্ষ্মীর কি খবর?
আলী দাঁড়িয়ে কথা ভুলে যায় । এত মানুষের ভীড়ে ও সবচেয়ে কম বয়েসী । তাছাড়া সব খবর দুদু মিয়া জানেন । একটু উনিশ বিশ হলেই ঝাড়ি খেতে হবে । আলী বলে, সরাসরি মি. ডানলপের কাছে গিয়েই আমরা জানিয়ে এসেছিলাম যে, এবছর থেকে আর নীল চাষ করবো না । ডানলপ তখন পুলিশি ভয় দেখালেও কিছু করতে পারেনি । আপনার কথা মতো আমরাও থানায় অগ্রীম মামলা দায়ের করে এসেছিলাম । পরে শুধু কয়েকটা পেয়াদা নিয়ে এসে ঝামেলা করতে চাইলেও এলাকার লাঠিয়ালদের ভয়ে কিছু করতে পারেনি।
এক শ্বাসে কথাগুলো বলে আলী ।
দুদু মিয়া দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে ঘরময় পায়চারি করতে থাকেন । তিনি আগেই ভেবেছিলেন, জমিদারদের শায়েস্তা করলেও মূল সমস্যা করবে নীলকররা । এখন দেখছেন তাই হচ্ছে । মি. ডানলপ চরলক্ষ্মীতে সুবিধা করতে পারেনি বলে চুপ থেকেছে । কিন্তু জায়গায় জায়গায় তার অপপ্রচার থেমে নেই । ফরায়েজিদেরকে ব্রিটিশ রাজ্যের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাচ্ছে । এদিকে আবার ডানলপের ব্রাহ্মণ্য গোমস্তা কালিপ্রসাদ কাঞ্জিলাল মুলফতগঞ্জের পাঁচচরে ফরায়েজিদের বিরুদ্ধাচারণ করছে । এই মাত্র পাঁচচরের ফরায়েজি নেতার মুখে ভয়াবহ কিছু কাণ্ড কারখানা শুনলেন । অন্যান্য করের সাথে সে নাকি এবার কুখ্যাত ‘শুশ্রুকর’ ( দাড়ি রাখলে যে কর দিতে হয়) চাপিয়ে দিয়েছে । গতপরশু দলবল নিয়ে ফরয়েজি আস্তানা আক্রমণ করেছে । টাকা পয়সা সব লুট করে নিয়ে গেছে । সাথে চারজন পাহারাদারকে হত্যা করেছে । বহুসংখ্যক আহতদের ধরে নিয়ে গেছে । ভেতর বাড়ির পর্দানশীন মহিলাদের বে-আব্রু করতেও ওদের হাত কাঁপেনি ।
দুদু মিয়ার উত্তেজনা ক্রমশ বাড়তেই লাগলো। তবু তিনি ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করছিলেন কি করা যায়। তিনি মজলিস শেষের দোআ পড়ে সবাইকে বিদায় জানালেন।
পাঁচ
শুকনো পাতায় খসখস আওয়াজ পেতেই লোকটা সতর্ক হয়ে ওঠলো । চোখ-কান খোলা রেখে আশপাশে ভালো করে তাকালো । নির্দিষ্ট একটা আওয়াজ করতেই ওপাশ থেকেও সারা এলো । তারপর লোকটা ঝোঁপের আড়াল থেকে বাইরে বেড়িয়ে এলো । ফিসফিস করে বললো, কতজন?
‘বারোজন আমরা।’
আর কথা হলোনা তাদের মাঝে । লোকটা আবার জঙ্গলে হারিয়ে গেল । কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো পাটের বস্তায় মোড়ানো লম্বা আকৃতির অনেকগুলো জিনিস নিয়ে । শব্দ ছাড়া আগন্তুকের হাতে দিতে দিতে ফিসফিস করে কিছু বললো ।
চাঁদ মিলিয়ে গেছে । আকাশ ভর্তি শুধু তারা । কৃষ্ণপক্ষের রাত না হলেও সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না । শুধু আবছা আবছা নজরে আসছে । মাঝরাতের দিকে বৃষ্টি হওয়ার কারণে রাস্তাঘাটে পানি লেগে আছে । কিছুক্ষণ পর আরেকটা দল আসলো । এ দলটা বড় । তাদের সদস্য সংখ্যা বিশজন । আলো আঁধারির মাঝেই লোকটা চিনে ফেল আগন্তুককে । পাগড়ির একাংশ দিয়ে চেহারা ঢাকা থাকলেও তার চোখ দুটি লোকটার চেনা । হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে বললো, আলী তুমি?
রহিম বখশ চাচা! আপনি… আপনি! জড়িয়ে ধরলো আলী ।
আপনার জন্য আমি পেরেশানিতে ছিলাম ৷ শুনছিলাম জমিদারের পেয়াদারা আপনাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো । তারপর ছাড়া পেলেন কীভাবে?
এসব এখন বলার সময় না । আমাকে ওরা প্রাসাদে নিয়ে যেতে পারেনি । একটা কুঠিতে বেঁধে রেখেছিলো । সন্ধ্যার আগেই স্বয়ং পীর দুদু মিয়া আমাকে ছাড়িয়ে এনেছেন । নীচু স্বরে আলী আলহামদুলিল্লাহ পড়ে । বর্তমান আলীর সবচেয়ে কল্যাণকামী এ রহিম বখশ । বাহাদুরপুর এলেই বাড়াবাড়ি রকমের যত্ন করে । নিঃস্বার্থ হলেও, আলী বুঝতে পারেনা ঠিক কি কারণে এই লোক আলীকে এত বেশি সম্মান করছে ।
ধীরে ধীরে পাঁচচর নীল ফ্যাক্টরির আশপাশে হাজার লোকের জমায়েত হয়ে গেল । সবাই সশস্ত্র । কারো হাতে বল্লম, কারো হাতে মোটা বাঁশের লাঠি, কারো হাতে কুঠার । এসব এতক্ষণ সরবরাহ করেছে রহিম বখশ আর তার লোকেরা । দায়িত্ব আগেই বন্টন করা ছিল । যার যার কাজ সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছে দুদু মিয়া । আশপাশের প্রতিটা এলাকা থেকে ফরায়জিরা চার-পাঁচজনের গ্রুপ হয়ে পায়ে হেটে পাঁচচরের আশপাশে অবস্থান নিবে । তারপর রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে সবাই ফ্যাক্টরির দিকে অগ্রসর হবে । ফ্যাক্টরির পাশের জঙ্গলে আরো আগ থেকেই রহিম বখশ সব ঠিক করে রেখেছিলো ।
শুরুর ওয়াক্তেই আওয়াজ না করে সবাই ফজর নামাজ পড়ে নিলো ।
অদূরে ফ্যাক্টরির দেয়াল দেখা যাচ্ছে ৷ আশপাশে অসংখ্য সশস্ত্র পাহারাদার । হেঁটে হেঁটে টহল দিচ্ছে । কিছুক্ষণ পরপর জোড় গলায় ঘোষণাকারী সতর্ক করছে, সাবধান! যবনদের আক্রমণ থেকে সাবধান ৷
সময় গড়াচ্ছে । উত্তেজনায় আলীর বাম হাতে ধরে রাখা বল্লমটা তিরতির করে কাঁপছে । আধাঁর পরিস্কার হচ্ছে ৷ সুবহে সাদিকের নির্মল বাতাস বইলেও সবার শরীর জুড়ে ঘাম । হঠাৎ গগনবিদারী তাকবিরের আওয়াজে পাঁচচরের মাটি কেঁপে উঠলো । প্রহরীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই দলে দলে ফরায়েজিরা ফ্যাক্টরিতে প্রবেশ করতে লাগলো । আশপাশের গাছ থেকে, পাচীল বেয়ে, ফটক দিয়ে যে যেভাবে পারে, ঢুকতে লাগলো কাঞ্জিলালের আস্তানায় । শুরু হয়ে গেল আক্রমণ । বর্শা আর কুঠারের আঘাতে যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গেল ৷
মানুষের চিৎকার চেচামেচি আর আহতদের গোঙানিতে পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠলো । কিন্তু এত এত ফরায়েজিদের সামনে কাচারির সেপাইরা বেশিক্ষণ টিকতে পারলো না । পালাতে লাগলো সব ফেলে । নির্দেশমতো নীলের গুদামে আগুন দেয়া হলো । আর যত অবৈধ মাল জমা করেছিলো সব হস্তগত করা হলো । মি. ডানলপের অত্যাচারী গোমস্তা কালিপ্রসাদ কাঞ্জিলাকে চোখ বেঁধে নিয়ে আসা হলো ।
এসব কিছু ঘটছিলে মুহুর্তেই । সূর্য ওঠার আগেই সবাই গায়েব হয়ে গেল ৷ অস্ত্রশস্ত্র ঝোঁপে ফেলে দিয়ে সবাই পায়ে হেঁটে যার যার গন্তব্যে ফিরে গেল ।
আরেকটা ছোটো দল কাঞ্জিলালকে নিয়ে গেল পদ্মার পাড়ে । সেখানে এই অমানুষকে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হলো ।
এই ঘটনা ঘটেছিলো ১৮৪৬ সালের ৫-ই ডিসেম্বর ৷
ছয়
১৮৪৭ খৃষ্টাব্দ, ২৩ ই সেপ্টেম্বর ৷
কলতাকার নিযাম আদালত থেকে বিশেষ ডাকে চিঠি এসেছে । সেই চিঠির খাম এখন খুলছে ফরিদুপুর সেশন কোর্টের মেজিস্ট্রেট হেনরি সোয়েটানহাম । পাশে অধীর আগ্রহে খাম খোলা দেখছে মি. ডানলপ । গোটা গোটা ইংরেজিতে লিখা একপাতার চিঠি । শেষের অংশটা হেনরি শব্দ করে পড়লো, ‘মামলায় ব্যবহৃত ঘটনার বিবরণ অংশত সম্পূর্ণ অবাস্তব ভ্রান্ত এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয় । এজন্য কলিকাতা নিযাম আদালত সেশন জজের রায়কে নাকচ করছে।’
রাগে ক্ষোভে নিজে চুল ছেড়ার উপক্রম মি. ডানলপের । হেনরি মুখে হাসি ঝুলিয়েই বললো, আরেকটু আছে তো, শুনবেন না সেটা? ১৮৪১ খৃষ্টাব্দের জুলাই মাসে ঢাকা সেশনের অতিরিক্ত জর্জ মি. ল্যাংম্যান যেভাবে মামলার রায় প্রদান করেছিলেন, এর সাথে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে । তাই আদেশ করা হচ্ছে দুদু মিয়া এবং তাঁর কর্মীদের বিচারের পর বে-কসুর খালাস করে দেয়া হোক’ ।
পাঁচচরের ঘটনার পর মি. ডানলপ বেশ প্রস্তুতি নিয়ে মামলা করে । মিথ্যা সাক্ষী ও তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে আদালতে অনেক জাল কাগজ পেশ করে । এতে মদদ জোগায় স্থানীয় পুলিশ আর ব্রিটিশ জর্জরা । কিন্তু দুদু মিয়ার চাতুর্যপূর্ণ কর্মকাণ্ডে এখানে এসেও এরা হতবিহ্বল হয়ে পড়লো । দুদু মিয়া এবং আত্নপক্ষ সমর্থনকারীরা মামলার বিবরণকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করলো এবং এর সত্যতা যাচাইয়ের চ্যালেঞ্জ করলো । যার ফলে মিথ্যার সিঁড়ি বেয়ে সরকারি উকিল আর পুলিশ ঘটনার গভীরে পৌছতে ব্যর্থ হয় । উপরন্তু দুদু মিয়ার জোড়ালো যুক্তি প্রদশর্নের ফলে ঘটনার বিষয়বস্তু কল্পনাপ্রসূত বলে ধরে নেয় কলিকাতা নিযাম আদালত ।
মি. ডানলপ ভেবেছিলেন ব্রিটিশ প্রশাসনের সাহায্যে এ ধাক্কায় ফরায়েজিদের থামিয়ে দিবেন ৷ কিন্তু নামে মাত্র বিচার আর জরিমানা ছাড়া আর কিছুই হলো না । পাঁচচরের ঘটনার পর ধরপাকড়ের যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিলো, অল্প ক’দিনেই থেমে গেল । মামলায় পরাজিত হওয়া মি. ডানলপ আর হিন্দু বাবুদের জন্য ছিল মরণঘাত স্বরূপ ৷ আর ফরায়জিদের কাছে ছিল নির্যাতিত কৃষকদের বিজয় ৷ তারা হাটে ঘাটে গান ধরে, দুদু মিয়া তাপ দিয়া রাজ্য বালা করে।
কালিপ্রসাদ কাঞ্জিলালের বিরুদ্ধে সফল অভিযানের ফলে দুুদু মিয়ার পথ থেকে শেষ বাঁধাটা দূর হয় ৷ গ্রাম নগরে, শহর বন্দরে ফরায়েজিরা মাথা উঁচু করে চলাফেরার সুযোগ পায় ৷
এডওয়ার্ড ডি লাটর, যিনি দুদু মিয়ার মামলা চলাকালীন ফরিদপুরের ডেপুটি কালেক্টর ও মেজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ পান, তিনি তার ব্যক্তিগত জবানিতে বলেছেন, ‘ডানলপের ফ্যাক্টরিতে দুদু মিয়ার আক্রমণ প্রতিঘাত স্বরূপ হলেও, এর জন্য দুদু মিয়াকে দায় করা যায় না কোনোভাবেই । ডানলপের নীতিহীনতা ও অবিচারই তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছিল । যার কারণে ফরায়েজিরা পাল্টাঘাত করতে বাধ্য হয়েছে ।
এরপর থেকেই ব্রিটিশ মেজিস্ট্রেটের মর্যাদাহীন কার্যকালাপের ফলে ব্রিটিশ বিচার ব্যবস্থা মূল্যহীন হয়ে পড়ে । অঘোষিতভাবেই সাধারণ জনগণ ব্রিটিশদের কোর্টকাছারি বর্জন করে । দুর্নীতি, ব্রিটিশ আদালতের কার্যকরহীন অবস্থা, সবমিলিয়ে প্রশাসনের বিশৃঙ্খলার কারণে ফরিদপুর ও পার্শ্ববর্তী জেলায় ফরায়েজি খেলাফত ব্যবস্থা প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করে ।
জমিদার ও নীলকরদের দ্বারা অত্যাচারিত হওয়ার সকল সম্ভাবনা দূর হয় এবং দীর্ঘ দশ বছর, ১৮৪৭ -১৮৫৭ পর্যন্ত, আযাদি আন্দোলনের দাবানল ছড়ানোর আগ পর্যন্ত পূর্ব বাংলার মুসলমানরা স্বাধীনতার স্বাদ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে ।
এখানে আমাদের তিতুমীর আর দুদু মিয়ার আন্দোলনের তফাৎটা বুঝতে হবে ।
মহান দুই নেতার মাঝে আদর্শিকভাবে কোনো অমিল ছিল না ৷ এবং প্রাথমিক অবস্থা দেখলে বুঝা যায় হাজী শরিয়তুল্লাহ আর তিমুমীরের লক্ষ ছিল এক, বাংলার মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনাকে জাগিয়ে তোলা । স্বাভাবিকতই মাথা ধরে টান দিলে দেহ আসবে । ধর্ম বিরোধী আন্দোলন ক্রমশ জমিদার আর শোষক বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয় । এই পর্যায়ে এসে জমিদারারা ব্রিটিশ প্রশাসন আর তিতুমীরের মধ্যে একটা ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয় । এই বলে ব্রিটিশদের কান ভারি করে দেয় যে, তিতুমীর দেশদ্রোহী । হিন্দুস্তান থেকে সে ব্রিটিশদের উৎখাত করতে চায় । ফলে একটা রাজশক্তির সাথে তিতুমীর লড়তে বাধ্য হয় এবং শেষতক শাহাদাৎ বরণ করে । যদিও তিতুমীর কখনো চাইতো না ব্রিটিশদের কাছে মাথা নোয়াতে । তবু জমিদারদের শায়েস্তা করার আগেই ব্রিটিশের সাথে তাঁর বিরোধ লেগে যায় ৷
অপরদিকে, এ জায়গায় এসে দুদু মিয়া দক্ষ কূটনৈতিক জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন ৷ শুরুর দিকে হাজি শরিয়তুল্লাহ সংস্কার আন্দোলনকে রাজনীতি থেকে দূরে রেখেছেন । এবং দুদু মিয়া এসে জেনেছেন কীভাবে আন্দোলনকে ষড়যন্ত্র আর উত্তেজনার ভেতর দিয়ে চালিয়ে নিতে হয় ৷ যার দরুন প্রশাসেনর সাথে ফরায়েজিদের সংঘাত সৃষ্টি করার শত চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হয়েছ নীলকর আর জমিদাররা । উপরন্ত ব্রিটিশ প্রশাসনের আড়ালে অবৈধ যেসব কর জমিদারার ক্রমশ মানুষের উপর চাপিয়ে দিচ্ছিলো, একে একে এসবের মুখোশ উন্মোচন করেছেন পীর দুদু মিয়া রহ. ।
ফ্ল্যাশব্যাক
ইতিহাস-মিশ্রিত গল্প হচ্ছে একটা টাইম মেশিনের মতো । আপনি এতে আরোহণ করে যতদূর যাওয়া যায়, যেতে পারবেন । আবার ইচ্ছে করলে মাঝপথে যাত্রাবিরতিও করতে পারবেন । ১৮৬১ সালে মাত্র ৪১ বছর বয়সে পীর দুদু মিয়ার মৃত্যুর পর এ আন্দোলন ক্রমশ স্তিমিত হতে থাকে । তবে তিতুমীরের আন্দোলনের মতো একবারে ঝিমিয়ে পড়ে না । জায়গায় জায়গায় জমিদার নীলকরদের সাথে ফের সংঘাত বাঁধতে থাকে । জন্ম নিতে থাকে নতুন নতুন গল্প । রাগী আব্দুল্লাহ আর মি. ডানলপরা ।
আলী আর ফাতেমা কিংবা ঝানু তালুকদার সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না ৷ তবে রহিম বখশের কথা ইতিহাস স্মরণ রেখেছে । রহিম বখশ সেই পাঁচচর অভিযানে মারাত্মক আহত হন ৷ তাঁকে ধরাধরি করে দুদু মিয়ার কাছে নিয়ে আসা হলে শেষ অবস্থায় একটা আবদার করেন । তাঁর মা আয়েশার জন্য আলীকে তিনি পছন্দ করেছিলেন । পরিবেশ ঠান্ডা না হওয়ার কারণে কথা তুলেননি। এখন যেন পীর সাহেব নিজ হাতেই এদের শুভকাজটা সেরে দেন ।
দুদু মিয়া হেসে বললেন, আমিও এমন কিছু ভাবছিলাম । বয়স তো হয়েছে । নবীর সুন্নতটা আদায় করে ফেলাই উত্তম । কী বলেন সবাই!
সবাই জোরে হা হা করে আমরা রাজি এ কথা বললেও আলীর নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া সম্ভবত দুদু মিয়ার চোখে পড়ে না । আলীর চোখের সামনে বারবার ভাসতে থাকে একটা মেয়ের নিশ্চল চাহনি; যে শুধু আলীর সাথে সেধে এসে কথা বলতে চায় ৷ খিলখিল করে হাসে । দূরদেশে নুপুর বাজার মতো যে হাসি।
সূত্র:
১. এ ক্রাই ফর ইন্ডিয়ান মহামেডানস – সৈয়দ আমীর আলী
২. নোটস ওন রিসেস- জেমস ওয়াইজ
৩. দ্য ড্রিস্টিক অব দ্য বাকেরগঞ্জ ইটস হিস্ট্রি – এইচ বেভারিজ
৪. বাংলায় ফরায়জি আন্দোলনের ইতিহাস- মইন উদ্দিন আহমদ খান ( পাকিস্তান)
৫. আমাদের জাতিসত্তার বিকাশ – মুহাম্মদ আবদুল মান্নান
৬. পৌরনীতি দ্বিতীয় পত্র- এইচএসসি পোগ্রাম
৭. দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক সংগ্রাম ( অনলাইন সংস্করণ)
৮. বিভিন্ন ওয়েবসাই ট
লেখক: ছাত্র, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া, সাত মসজিদ, মুহাম্মদপুর, ঢাকা ।