ড. মুহাম্মাদ আস সাগির
তরজমা: আবু ওমর আবদুল আযীয
প্রথম পর্ব (নারীশিক্ষা প্রসঙ্গ)
সম্প্রতি আফগানিস্তানে নারীশিক্ষা সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। এ কারণে খুব দ্রুতই মুসলিম আলেমদের একটি প্রতিনিধিদল আফগান সফর করে। এ প্রতিনিধি দলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বিভিন্ন আরব দেশের মুসলিম স্কলারদের বেশ কয়েকটি বড় বড় সংগঠন। এর মধ্যে রয়েছে ইন্টারন্যশনাল অর্গানাইজেশন টু সাপোর্ট দ্যা প্রফেট অফ ইসলাম, রাবেতাতু উলামাইল মুসলিমিন তথা এসোসিয়েশন অফ মুসলিম স্কলারস, দ্যা এসোসিয়েশন অফ প্যালেস্টাইন স্কলারস, দ্যা এসোসিয়েশন অফ মরোক্কান স্কলারস ও লিবিয়ার জাতীয় দারুল ইফতার সদস্যবৃন্দ। আমাদের প্রতিনিধিদলকে ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানানো হয়। বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় আমাদের। এটা প্রকাশ পায় ভাইস দুই সহকারী প্রধানমন্ত্রী মোল্লা আবদুল গনি বেরাদার ও মোল্লা আবদুস সালাম হানাফির সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে। তারা উভয়ে আমাদেরকে একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী প্রাসাদে স্বাগত জানান, যেখানে লেগে আছে রাজকীয় আভিজাত্য আর ইতিহাসের সুবাস। পাশাপাশি আমরা অন্তত দশজন মন্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হই। এদের সর্বাগ্রে রয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আমির খান মুত্তাকি ও স্বরাষ্টমন্ত্রী জনাব খলিফা সিরাজুদ্দিন হাক্কানি। এসব সাক্ষাতে আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল নারীশিক্ষা। আমরা প্রায় সব মন্ত্রীদের মধ্যেই ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করার এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করার আগ্রহ অনুভব করেছি। আশা করি সম্মানিত শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য মূল বিষয়টির খোলাসা করতে পারবে। অন্যদের বক্তব্যও এতে চলে আসবে।
নারীশিক্ষা বন্ধের প্রেক্ষাপট
আমরা শুরু করি প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ক মন্ত্রী জনাব মৌলবি হাবিবুল্লাহ আগা সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাতের মাধ্যমে। তিনি বলেন, ‘ইমারতে ইসলামিয়া তাদের সরকার পরিচালনায় জ্ঞানীদেরই সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করে থাকে। আর যে সরকার স্বয়ং আলেমদের (জ্ঞানীদের) তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়, তাদের পক্ষে শিক্ষা বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব কীভাবে? এ অধিকারের ক্ষেত্রে আমাদের মতে নারী-পুরুষে কোন বিভেদ নেই। বিশেষ কিছু সমস্যার কারণে সাময়িকভাবে স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
আমরা যখন উচ্চশিক্ষা বিষয়ক মন্ত্রী জনাব মৌলবি নেদা মুহাম্মাদ সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাত করলাম, তিনিই মূলত এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তিনি আমাদের সামনে পুরো বিষয়টি এবং সমস্যাগুলো সবিস্তারে তুলে ধরলেন। তিনি সবেমাত্র জাতিসংঘ ও ইউনেস্কো প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাতকার দিয়ে এসেছিলেন। তিনি আমাদের সঙ্গে আলাপ শুরু করলেন একথা বলে, ‘মেয়েদের শিক্ষা কোনটা ওয়াজিব কোনটা মুস্তাহাব, কোনটা ফরজে আইন আর কোনটা ফরজে কেফায়া এ বিষয়ে আমাদের মধ্যে পারস্পরিক মতভেদ হতে পারে। কিন্তু শিক্ষাকে একেবারে বন্ধ করে দেওয়ার বৈধতা আমাদের কেউই দেন না। আর সাময়িক স্থগিতকরণের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি কারণে।
এক. সহশিক্ষার মাধ্যমে নারী-পুরুষের মেলামেশা বন্ধ করা।
দুই. শিক্ষা সিলেবাসকে আগের দখলদারদের প্রভাবমুক্ত করা। বিশেষত তারা যেগুলো আফগান সংস্কৃতির উপর চাপিয়ে দিয়েছে সেগুলো থেকে মুক্ত করা।
তিন. পর্যাপ্ত নারী শিক্ষকের ব্যবস্থাপনা।
চার. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভৌগলিক বণ্টনের বিষয়টি লক্ষ রাখা। যেন কোন মেয়ে তার মাহরাম ছাড়া পরিবার থেকে দূরে না থাকে।
পাশাপাশি সম্মানিত মন্ত্রী আমাদেরকে নিশ্চিত করেন যে, ইমারতে ইসলামিয়ার নেতৃত্ব একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে, যারা তিন মাসের ভেতরে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করে ইসলামি শরিয়ার আলোকে উপযুক্ত সমাধান পেশ করবে। তিনি তার বক্তব্য শেষ করেন একথা বলে, ‘আপনারা যদি একে কল্যাণকর মনে করেন, তবে আমাদের সহযোগিতা করুন। আর যদি আপনাদের মতামত ভিন্ন কিছু হয় তবে আমাদের নসিহত করুন, যেন আমরা সঠিক সিদ্ধান্তের দিকে ফিরে আসতে পারি।’
একাধিক দায়িত্বশীল আমাদের নিশ্চিত করেছেন যে, বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে যদি নারীশিক্ষা বিষয়ে সরাসরি সাহায্য আসে, তবে তারা একে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। এবং এটা সমাধানের মেয়াদ কমিয়ে আনতে ভূমিকা রাখবে। এ বিবৃতির পর সবাই একমত হন যে, সম্মানিত শিক্ষামন্ত্রী মেয়েদের শিক্ষার বিষয়ে বাজপাখির মতই সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন। তাছাড়া তিনি ময়দানের বড় নেতৃবৃন্দের অন্যতম ব্যক্তি। এই হলো নেতৃবৃন্দের বক্তব্যের সারাংশ। তার নামে প্রচারিত বক্তব্য, ‘আমরা কখনোই মেয়েদের শিক্ষা বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসব না। এমনকি অমাদের উপর বোমা হামলা করা হলেও।’—যে সর্বৈব মিথ্যা কথা এটা আমরা নিশ্চিত হলাম। এগুলো মূলত পশ্চিমা মিডিয়ার মিথ্যা প্রোপাগান্ডা যা তারা ছড়িয়ে যাচ্ছে তালেবানদের সুনাম নষ্ট করতে।
আফগানিস্তানের মেয়েদের শিক্ষা বিষয়ে একটা কথা যোগ করতে চাই। তা হলো, নারীশিক্ষার প্রতি আফগানদের দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে তাদের গোত্রগত দূরত্ব ও যুগ যুগ ধরে চলে আসা এতিহ্যের প্রভাব অনেক। সাধারণত আধুনিকতার আগ্রাসনের আগ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি গ্রাম্য সমাজে আমরা যে চিত্রটি প্রত্যক্ষ করি। তাছাড়া চার দশকের যুদ্ধাবস্থা যে দারিদ্রের সৃষ্টি করেছে এর মধ্যে যারা দিনের খাবারই যোগাড় করতে পারে না তাদের জন্য শিক্ষা বিলাসিতাই বটে।
একটি অক্ষরও তারা পাল্টায়নি
আমরা পূর্ণ এক সপ্তাহ আফগানিস্তানে অবস্থান করেছি। শেষদিন আমরা সম্মিলিতভাবে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করি। যেখানে প্রায় সব রিপোর্টার ও মিডিয়াকর্মীরা অংশগ্রহণ করে। আমরা তাদের সামনে আমাদের সফরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরি। আমাদের প্রদত্ত রিপোর্ট সম্পর্কে তালেবান নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরামর্শ করি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, তারা এতে একটি শব্দও সংযোজন বা বিয়োজন করেনি। সে রিপোর্টটিই আমি আপনাদের সামনে সংক্ষেপে তুলে ধরছি।
সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য। সালাত ও সালাম অবতীর্ণ হোক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর। আম্মা বাদ! মুসলিম স্কলারদের একটি প্রতিনিধিদল ১২-৬-১৪৪৪ হি. থেকে ১৮-৬-১৪৪৪ হিজরি পর্যন্ত এক সপ্তাহ সময় ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান পরিদর্শন করেছেন। আমাদের রিপোর্টের সারাংশ সংক্ষেপে বলছি।
এক. স্কলারগণ নিশ্চিত করেছেন যে, আফগানবাসীর বিজয় এটা সমগ্র মুসলিম উম্মাহর বিজয়। আফগান মুজাহিদিন মুমিনদের হৃদয়ে নতুন করে আশার আলো প্রজ্জ্বলিত করেছেন। তারা ধৈর্য, কুরবানি, আত্মত্যাগ ও বীরত্বের অপূর্ব সব নিদর্শন স্থাপন করেছেন। এরপর তারা দ্বিতীয়বার বিজয়কে বাস্তবায়ন করেছেন নিজেদের কষ্টের উর্ধ্বে উঠে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার মাধ্যমে। যেন দেশ ও দেশের জনগণকে গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে পারেন। এর মাধ্যমে তারা মূলত একটি নববি সুন্নাহকে জীবন্ত করেছেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের সময় যেভাবে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বলেছিলেন, যাও আজকে তোমরা মুক্ত।
দুই. এ বিজয়কে সযত্নে সংরক্ষণ করতে হবে ঐক্য ও সত্যের উপর সুদৃঢ়ভাবে অবিচল থাকার মাধ্যমে। সতর্ক থাকতে হবে শত্রুর চক্রান্ত থেকে। পাশাপাশি অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে দলমত নির্বিশেষে আফগান জাতির সুখ-স্বাচ্ছন্দময় জীবনযাপন নিশ্চিত করতে।
তিন. ইমারতে ইসলামিয়ার নেতৃবৃন্দ ও উলামায়ে কেরাম উম্মাহর আলেমদের সঙ্গে যোগাযোগ ও তাদেরকে স্বাগত জানাতে আগ্রহী হওয়ার বিষয়টি জোরালো ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। তারা কল্যাণকামীদের অভিনন্দন জানাতে চান। তারা উম্মাহর আলেমদের কাছে আশা ব্যক্ত করেছেন যে, তারা যেন সত্যের ক্ষেত্রে তাদের সমর্থন জানান এবং অন্যায় কিছুতে তাদেরকে সতর্ক করেন।
চার. ইমারাহর নেতৃবৃন্দ আমাদেরকে নিশ্চিত করেছেন, তারা নারী-পুরুষ ও সকল দলমত নির্বিশেষে সবার শিক্ষার অধিকার বাস্তবায়নের ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কারণ এটা কল্পনাই করা যায় না, যে দেশটি পরিচালনা করছেন আলেম-ওলামা ও শিক্ষকবৃন্দ তারা নিজেরাই শিক্ষার বিরোধী হবেন। হ্যাঁ, কিছু লজিস্টিক সমস্যা আছে, যেগুলো শীঘ্রই সমাধান করা জরুরি, যেন শিক্ষা শরিয়াহসম্মত উপায়ে হয়। তারা সমস্যা সমাধানের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছেন ইতোমধ্যে।
পাঁচ. আমরা এখানে যে নিরাপত্তা ও স্থিরতা অনুভব করেছি এজন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করছি। আল্লাহর অনুগ্রহে দীর্ঘ তেতাল্লিশ বছর পর পুরো দেশ একটি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। পাশাপাশি ইমারতে ইসলামিয়া মাদক চাষ ও মাদক ব্যবসা বন্ধ করতে সমর্থ হয়েছে, এবং উগ্রপন্থী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো যেমন দায়েশদের মোকাবেলায় জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ছয়. এদেশের জনগণের প্রায় নয় মিলিয়ন ডলার আমেরিকা কর্তৃক জব্দ করার পর সমগ্র বিশ্বের শ্বাসরোধকারী অবরোধের মুখোমুখি ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান। যে সময়টায় দীর্ঘ চল্লিশ বছরের অসম যুদ্ধাবস্থার কারণে অর্ধ মিলিয়ন শিশু এতিম হয়ে গেছে। বিধবাদের সংখ্যা প্রায় আশি হাজার। প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা পঞ্চান্ন হাজারের বেশি। যারা অভিভাসী হয়ে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছেন তাদের সংখ্যা দশ মিলিয়ন। তিন মিলিয়ন লোক মাদকাসক্ত।
সাত. আমরা মুসলিম বিশ্বের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি, ইমারতে ইসলামিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে তাদের সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার, এবং মানবতা ও তাকওয়ার ভিত্তিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার।
আট. পাশাপাশি আমরা স্বচ্ছল মুসলিম ভাইদের আহ্বান জানাচ্ছি, ইমারতে ইসলামিয়ার ভাইদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে। তাদেরকে বিদেশী এনজিওগুলোর দয়ার পাত্র বানিয়ে দেওয়া উচিত হবে না, যাদের উদ্দেশ্য হলো মুসলমানদের আকিদা-বিশ্বাস নিয়ে খেলা করা। তদ্রুপ আমরা ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন পেশাজীবি মুসলিমদের কাছে আবেদন করছি তারা যেন এখানে এসে বিনিয়োগ করেন। বিভিন্ন সেক্টরে দক্ষ ভাইদের কাছেও আমাদের আবেদন হলো, আপনারা এ দেশে আসুন এবং তাদেরকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করুন। একটি আদর্শ ও সৎ রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিজ্ঞতায় সাফল্য লাভে তাদের সঙ্গী হোন।
দ্বিতীয় পর্ব
আফগানিস্তানে আমি যেন ভিন্ন একটি জাতিকে দেখেছি। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, যারা নিজেদের আকিদা-বিশ্বাস ও আত্মপরিচয় নিয়ে গর্বিত। স্বভাবের সৌন্দর্য ও চরিত্রের সৌকর্যের মাধ্যমে তারা নিজেদের যে ভাবমূর্তি তৈরি করেছে তা তাদের করে তুলেছে স্বকীয় ও অনন্য। উদাহরণ দিলে বক্তব্য পরিষ্কার হবে। আতিথিপরায়ণতার গুণে খ্যাতি লাভ করেছে পৃথিবীর বহু জাতি। কিন্তু আফগান জাতি এর উর্ধ্বে উঠে যোগ করেছে অতিথির প্রতি অভাবনীয় সলজ্জ শ্রদ্ধা। একজন অনুগত সন্তান যেভাবে তার বাবাকে শ্রদ্ধা করে, একজন ভদ্র-সুবোধ ছাত্র যেভাবে তার ভাবগম্ভীর শিক্ষককে শ্রদ্ধা করে, সারা পৃথিবী জানে অতিথিকে অপমান না করার কারণে কী পরিমাণ মূল্য তাদের পরিশোধ করতে হয়েছে। প্রিয় পাঠকদের সামনে আমার মনে গেঁথে যাওয়া, স্মৃতিতে লেগে থাকা কিছু চিত্র তুলে ধরতে চাই।
এক. আমি আশা করছিলাম কাবুল বিমানবন্দরে আমরা ভিন্নরকম অভ্যর্থনা পাব। কিন্তু আফগান জাতি যেভাবে সরকারিভাবে বড় বড় নেতৃবৃন্দের প্রতিনিধিদলের মতো আমাদেরকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছে, তা ছিল আমার একেবারে কল্পনাতীত। বিশেষ করে বিভিন্ন নিরাপত্তারক্ষী সদস্যরা বুলেটপ্রুফ গাড়ি নিয়ে আমাদের অভিবাদন জানিয়েছে। যে গাড়িগুলো তারা গনিমত লাভ করেছে মার্কিনিদের থেকে। জাপানি ল্যান্ডক্রুজ ও অন্যান্য গাড়িগুলো ছিল প্রচুর পরিমাণে। সেগুলো মূলত একটি উপসাগরীয় রাষ্ট্রের অনুদান, যা তারা তাদের মিত্র মার্কিন জোটকে শক্তিশালী করতে প্রদান করেছিল। তাদের এ ‘উদারতা’ আমার মোটেও ভালো লাগেনি।
দুই. সরকারি অফিসগুলো ও হোটেলগুলো দেখলে আপনার মনে হবে, আমেরিকা ভেবেছিল অনেক দীর্ঘসময় কাটিয়ে দেবে তারা এ দেশে। আমি সবচে’ বেশি অবাক হয়েছি হোটেলের দরোজাগুলো দেখে। যদিও সেগুলো আধুনিক দরোজা, তবুও সেগুলো ভেতর থেকে বিশাল লোহার খিল দিয়ে আটকানো হয়। প্রাচীন যুগে দুর্গের ফটকগুলোতে যেরকম খিল ব্যবহার করা হতো। খুলতে এমন বিকট শব্দ হয় যে, প্রতিবেশি কেউ ঘুমালে অবশ্যই জেগে উঠবে। পরে জানতে পারলাম, আমেরিকানরা এসব খিল এজন্য স্থাপন করেছিল যে, দুইবার মুজাহিদরা তাদের ভেতরের কক্ষগুলোতে ঢুকে পড়েছে।
তিন. আমাদের প্রতিনিধিদলটি ছিল চারটি আরব রাষ্ট্র থেকে। মিসর, সুদান, লিবিয়া ও ফিলিস্তিন। ড. মুহাম্মাদ আবদুল কারিম ছিলেন রাবেতাতু উলামাইল মুসলিমিনের পক্ষ থেকে। ড. আবদুল হাই ইউসুফ ছিলেন সুদানের আলেমদের প্রতিনিধি। শায়খ সামি সায়িদি মরোক্কান আলেমদের প্রতিনিধি, আর ছিলেন ফিলিস্তিন রাবেতাতুল উলামার প্রেসিডেন্ট ড. নাওয়াফ তিকরুরি। প্রতিনিধিদলের সবাই একমত হলেন, কয়েক দশক যাবৎ অস্থিরতামুক্ত বহু আরব দেশের রাজধানী থেকে রাজধানী কাবুল অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন। সাত মিলিয়নের বেশি মানুষের বসবাসের শহর কাবুলের পরিচ্ছন্নতা রীতিমতো আমাদের সবার দৃষ্টি কেড়েছে। শ্বাসরোধকারী বিদেশী অবরোধ সত্ত্বেও কাবুলের বাজারগুলো বেশ কোলাহলপূর্ণ। ট্রাফিক ব্যবস্থা খুবই সুশৃংখল। বিশেষত বড় বড় সড়ক ও মাঠগুলোতে ট্রাফিব পুলিশের সঙ্গে তালেবান সদস্যদের নিজস্ব ইউনিফর্মে পূর্ণ প্রস্তুত অবস্থায় টহল দিতে দেখা যায়।
চার. তাপমাত্রা ছিল শূন্য থেকে সাত ডিগ্রি নিচে। তারা আমাদের জানালো, প্রচণ্ড শীতে তাপমাত্রা শূন্য থেকে আঠারো ডিগ্রি পর্যন্ত নিচে নেমে যায়। আমাদের অবস্থানকালীন সময়েই একবার বরফ বৃষ্টি হয়েছে। মনে হলো পুরো শহর যেন শুভ্রতার চাদরে আচ্ছাদিত হয়ে গেছে। বৃক্ষগুলোর গজিয়েছে শুভ্র কেশ। সকাল সকাল আমরা বের হলাম। দেখলাম, নির্দিষ্ট শ্রমিকরা তাদের হাতে থাকা আটপৌরে কিছু যন্ত্রপাতি আর শক্তিশালী বাহু দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করে চলাচল উপযোগী করে তুলছেন।
পাঁচ. আফগানিস্তানের রাস্তাগুলোতে আরও একটি বিষয় লক্ষ করেছি। সেটি হলো অন্যান্য দরিদ্র দেশের রাজধানীগুলোর মতো এখানে ভিক্ষুকদের উপস্থিতি একেবারে নগণ্য। পরে জানতে পারলাম, ইমারতে ইসলামিয়া একটি অভিযান পরিচালনা করে সকল ভিক্ষুকদের রাস্তা থেকে এক জায়গায় সমবেত করে। এরপর তদন্ত করে যাকে তারা অভাবী পেয়েছেন তাদের জন্য প্রয়োজন মাফিক কিছু অর্থ জোগাড় করে দিয়েছেন। যারা পেশাদার ভিক্ষুক আছে, তারা যদি পুনরায় ভিক্ষা করতে নামে তবে তাদেরকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে বলে সতর্ক করেন।
ছয়. আফগানিস্তানে যারা ইমারতে ইসলামিয়ার শাসনকে স্বাগত জানান না তারা সরকারের আফিম চাষ বন্ধের ব্যাপারে সংশয় সৃষ্টি করার কোশেশ করেন। তাদের এ মতামত নিতান্তই ভুল দুটি কারণে। প্রথমত, তালেবান যখন প্রথমবার ক্ষমতায় আসে-যা পাঁচ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল-তখনও তারা আফিম চাষ বন্ধ করেছিল। জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক সংস্থথাগুলোর রিপোর্ট এর সপক্ষে উজ্জ্বল প্রমাণ। দ্বিতীয়ত, বিরোধীরা তালেবানকে চরম গোঁড়া একটি সংগঠন মনে করে। তবে এ হারাম একটি ইস্যুতে তারা কেন গোঁড়ামি করবে না? আফিম চাষ বন্ধে তাদের শক্তিশালী পদক্ষেপ আমরা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছি। পাশাপাশি তারা তিন মিলিয়ন মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার উদ্যোগ নিয়েছেন, যাদের মধ্যে এক মিলিয়ন হবে নারী ও শিশু। যেহেতু দখলদার মার্কিনীরা আফিম চাষের সরাসরি তত্ত¡াবধান করত এবং এজন্য উৎসাহিতও করত তারা।
সাত. বিশ বছরের রক্তাক্ত দখলদারির পর আমেরিকা আফগানিস্তান ত্যাগ করেছে। সঙ্গে আরও চল্লিশটি মিত্র দেশ। পরাজিত হয়ে মুক্তির পথ খুঁজছিল তারা। মুজাহিদিনরা মার্কিন জোটের দেড় লক্ষ সৈন্য ও আশরাফ গনির নেতৃত্বে তাবেদার সরকারের আড়াই লক্ষ সৈন্যকে পরাজিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এটি ছিল সবচে’ দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল একটি যুদ্ধ।
আট. আমেরিকা প্রস্থানের সময় আফগানদের নয় মিলিয়ন ডলার জব্দ করেছে। এতদ্বসত্ত্বেও আফগানিস্তানের কাঁধে নেই বিদেশী ঋণ। দেশের চাকা পরিচালিত হচ্ছে দেশে উৎপাদিত পণ্য দিয়ে। আমেরিকা বাজি ধরেছিল, অর্থনৈতিক সংকটে পিষ্ট হয়ে ছয়মাসের মধ্যেই তালিবানের শাসন মুখ থুবড়ে পড়বে। কিন্তু প্রশাসনে তালিবানদের যেসব সদস্য কাজ করেছেন, ছয় মাস পর্যন্ত তারা কোন বেতন গ্রহণ করেননি। নয় মাস অতিবাহিত হওয়ার পর মাসিক একশো ডলার বেতন তাদের জন্য ধার্য করা হয়েছে। অথচ পুরোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের বেতন কোন বিলম্ব ছাড়াই ঠিকই উশুল করে নিয়েছেন।
নয়. বিশ বছরের সর্বশেষ যুদ্ধ এতিম বানিয়েছে প্রায় অর্ধ মিলিয়ন শিশুকে। বিধবাদের সংখ্যা আশি হাজার। প্রতিবন্ধী পঞ্চাশ হাজারের অধিক। দশ মিলিয়ন হলো অভিভাসীদের সংখ্যা। ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান তাদের সর্বপ্রথম প্রায়োরিটি বানিয়েছে ইয়াতিম ও বিধবাদের পুনর্বাসন। এক্ষেত্রে তারা মুজাহিদদের এতিম সন্তান বা দখলদারদের এতিম সন্তানদের মধ্যে কোন পার্থক্য করেন না।
দশ. আফগানিস্তান খুবই উর্বর এবং প্রতিশ্রুতিশীল বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত ভূমি। এখানে এমন একটি সরকারের ছায়ায় কাজ করা যাবে, যারা নিরাপত্তাকে বানিয়েছে তাদের সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি। দীর্ঘ তেতাল্লিশ বছর পর প্রথমবারের মতো একটি কেন্দ্রিয় সরকারের অধীনে আফগানিস্তানের প্রতিটি প্রদেশে যারা নিজেদের ক্ষমতা পোক্ত করতে সমর্থ হয়েছে। এখানের অভাবনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ ও বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর পাশাপাশি ভৌগলিক অবস্থান সাম্রাজ্যবাদীদের বরাবর যুদ্ধে প্ররোচিত করে। অনেক মূল্যবান সম্পদ এখানে পাওয়া যায় খুবই সস্তায়। চায়ের সঙ্গে এখানে পুদিনা পাতার পরিবর্তে জাফরান ব্যবহার হয়। রাইস ক্র্যাকার্সগুলো এখানে বিক্রি হয় কুমড়ার বীজের মতো। এমন সব মূল্যবান পাথর এখানে পাওয়া যায়, দামে ও সৌন্দর্যে যার কোন তুলনা হয় না। সুতরাং শ্রমিক ও বিনিয়োগকারীদের উচিত এ সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগানো, এবং নিজেদের ভাইদের উপর থেকে অবরোধ ভাঙতে সাহায্য করা। প্রত্যেক অভিজ্ঞ ও দক্ষ ব্যক্তিদের উচিত কিতাবুল্লাহর ছায়ায় একটি আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থার সফল অভিজ্ঞতায় সাহায্য করতে এগিয়ে আসা।
সূত্র: আল জাজিরা