উম্মু জামিইল কুরআন: আন-নাওয়ার বিনতে মালিক রাদি.

তাসনীম জান্নাত:

তালাআল বাদরু আলাইনা……
খুশীর আতিশয্যে গেয়ে চলেছে মদীনার শিশু-কিশোররা। মদীনাবাসীর মনে আজ আনন্দের ঢেউ উথলে উঠেছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর আজ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের মেহমান। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আছেন প্রিয় সহচর আবু বকর রাদি.। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঘিরে মদীনাবাসী আনসারগণ এগিয়ে চলছেন। সবার মনের আকুল আবেদন, আমার বাড়িতেই যেন মেহমান হন রাসুলুল্লাহ। কিন্তু নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, উটনীর পথ ছেড়ে দাও। সে আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট। চলতে চলতে উটনী গিয়ে বসলো আবু আইয়ুব আনসারী রাদি.-এর বাড়ির দোরগোড়ায়। তিনি তো মহাখুশী। কৃতজ্ঞতায় নুয়ে আসছে তনুমন। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মেজবান আর রাসুলুল্লাহ তাঁর মেহমান।কত সৌভাগ্য তাঁর। সানন্দে ঘরে নিয়ে এলেন নবীজিকে। নবীজি আবু আইয়ুব আনসারীর রাদি.-এর গৃহে গিয়ে উঠলেন। সেই বাড়িটি ছিল রাসূলের মামার বংশ বনী নাজ্জারের এলাকায়।

বনী নাজ্জারের এক ছোট্ট বালক যায়েদ। এগারো বছর বয়সেই যে রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে। রাসূলের জন্য হাদিয়া নিয়ে এসেছে। মদীনায় আগমনের পর সর্বপ্রথম উপহার। দুধ-ঘি মিশ্রিত গমের রুটির ছারিদ। নবীজির সামনে পেশ করে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার মা পাঠিয়েছেন ‘ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত খুশি হয়ে হাদিয়া গ্রহণ করলেন এবং মা-বেটার জন্য বারাকাহর দোয়া করলেন।

যায়েদ বিন ছাবিত রাদি.-এর নিজের ভাষায়- আমার মা আমাকে একটি পাত্র দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পাঠালেন। তাতে ছিল দুধ-ঘি মিশ্রিত গমের রুটির ছারিদ। আমি সেটি তাঁর সামনে রাখলাম। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বারাকাল্লাহু ফীহা।

আরেকটি রেওয়ায়াতে আছে, বারাকাল্লাহু ফীক। এরপর তিনি সাহাবাদের ডেকে সকলে আহার করলেন।

আজ আমরা জানবো সেই মহিয়সী মা সম্পর্কে, রাসূলের প্রতি ছিল যার অকৃত্রিম ভালোবাসা। যিনি রাসূলের জন্য সর্বপ্রথম হাদিয়া পাঠিয়েছিলেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জন্য বারাকাহর দোয়া করেছিলেন। জানবো সেই মা সম্পর্কে যিনি একটি আদর্শ পরিবার গড়ে তুলেছিলেন।

তিনি হলেন বনী নাজ্জারের এক মহিয়সী নারী আন-নাওয়ার বিনতে মালিক আল-আনসারী রাদিআল্লাহু আনহা। বিখ্যাত সাহাবী কাতিবে ওহী জামিউল কুরআন হযরত যায়েদ বিন ছাবিত রাদি.-এর মা। ছেলের কাতিবে ওহী এবং পরবর্তীতে জামিউল কুরআন হয়ে ওঠার পেছনে মায়ের অবদান ছিল অনেক বেশী। এই মহিয়সী নারী রাসূলের মদীনায় আগমনের পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং রাসূলের কাছে বাইআত হয়েছিলেন। ইসলামপূর্ব জীবনে ছাবিত বিন যাহহাকের সাথে তাঁর বিবাহ হয়। সেখানেই জন্ম হয় যায়েদ বিন ছাবিত ও তাঁর ভাই ইয়াযিদের। বুআছের যুদ্ধে ছাবিত বিন যাহহাক নিহত হয়। প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর বিবাহ হয় আম্মারা বিন হাযাম রাদি.-এর সাথে। তিনি ছিলেন লাইলাতুল আকবায় বাইআতগ্রহণকারী সাহাবী। রাসূলের সাথে বদর, উহুদ ও খন্দকসহ বহু যুদ্ধে তিনি শরীক ছিলেন। এখানে তাঁর মালিক নামে এক সন্তানের জন্ম হয়।

কুরআনের প্রতি তাঁর ছিল অকৃত্রিম ভালবাসা। তিনি সাহাবী মুসআব বিন উমাইর রাদি.-এর কাছে কুরআন শিক্ষা লাভ করেছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে তিনি একাধিক হাদীস রেওয়ায়াত করেছেন। তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন উম্মে সাদ বিন যুরারাহ রাদি.। তিনি তাঁর পরিবারকে একটি আদর্শ পরিবার হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। বাচ্চাদের অন্তরে ছোটবেলায়ই কুরআনের মুহাব্বাত গেঁথে দিয়েছিলেন। আল্লাহর রাসূলের প্রতি তাদের ছিল অনুপম ভালোবাসা।

পুত্র যায়েদ বিন ছাবিত রাদি. ছিলেন তুখোর মেধাবী। মা চেয়েছিলেন, রাসূলের সান্নিধ্যে থেকে তাঁর পুত্রের জীবন যেন পবিত্রময় হয়। পুত্রও তাই সর্বদা রাসুলের সাথে থাকতেন। তিনি কোরআন মুখস্থ করতেন । একপর্যায়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ওহী লেখার দায়িত্ব দেন। এভাবেই তিনি কাতিবে ওহী হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে আবু বকর রাদি.-এর জামানায় তিনি কুরআন সংকলনের দায়িত্ব পান এবং যথাযথভাবে সেই দায়িত্ব পালন করেন।

এভাবেই তিনি একাধারে ছিলেন কাতিবে ওহী, হাফিযে কুরআন ও জামিউল কুরআন। কুরআনের সান্নিধ্যে তিনি কাটিয়ে গেছেন সারাটি জীবন।

নবীজি মদীনায় আগমনের পরপরই মসজিদ নির্মাণ শুরু করেন। মসজিদে নববী নির্মাণাধীন থাকাকালীন রাসুলের মুয়াজ্জিন বিলাল রাদি. এই মহিয়সী নারীর ঘরের ছাদে উঠে আজান দিতেন। তাঁর ঘর ছিল ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম মিনার।

তাঁর নিজের ভাষায়- মাসজিদের আশেপাশের বাড়িঘরের মধ্যে আমার ঘরই ছিল সবচেয়ে উঁচু। তাই মাসজিদে নববীর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত বিলাল রাদি. আমার ঘরের ছাদে উঠে আজান দিতেন।

এভাবেই তিনি এবং তাঁর পরিবার এমনকি তাঁর ঘরটিও ইসলামের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায়।

পুত্র যায়েদ বিন ছাবিত রাদি.-এর জীবদ্দশাতেই এই মহীয়সী মা পরপারে পাড়ি জমান এবং উম্মাহর মায়েদের জন্য রেখে যান একটি আদর্শ পরিবারের নমুনা।রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহা।

তথ্যসূত্র-
الطبقات الكبرى ط العلمية (৮/ ৩০৯)
الإصابة في تمييز الصحابة (৮/ ৩৩৭)
أسد الغابة ط العلمية (৭/ ২৭২)
الاستيعاب في معرفة الأصحاب (৪/ ১৯১৯)
السيرة الحلبية (২/ ১১১)

আগের সংবাদআব্বাস ইবনু আবদিল মুত্তালিব
পরবর্তি সংবাদমাওলানা আকরম খাঁ: যেভাবে হয়ে ওঠেন মুসলিম সাংবাদিকতার জনক