উসুলে হাশতেগানা: পরিচিতি ও পর্যালোচনা

আব্দুল্লাহ আল মাহী :

দেওবন্দি আদলে পরিচালিত প্রতিটি মাদরাসার জন্য কাসেম নানুতবী রহ. প্রবর্তিত উসূলে হাশতেগানা বা মূলনীতি অষ্টকের সময়নিষ্ঠ পর্যালোচনা আবারও জরুরি হয়ে পড়েছে। যুগ চাহিদাকে যারা রুপান্তর হিশেবে না দেখে পরিবর্তন কিংবা মূলোৎপাটন হিশেবে দেখেন, তাদের একটি জিনিস জেনে রাখা জরুরি, এসব মূলনীতি যথাস্থানে সঠিক। আমরা শুধু এতটুকু বলতে পারি, এসব মূলনীতির ভেতর থেকে মূলনীতির ইশারা, তাকাদা ও ইল্লত (কারণ) কী আছে, তা ভালোভাবে উসূলের ধারায় অনুধাবন করে সেখান থেকে মূলনীতির সুষ্ঠু ব্যখ্যা বিচার করা এখন সময়ের দাবি এবং দারুল উলূম ও এর আকাবিরদের প্রতি সুবিচার। যেকোন কিছু ভেঙে ফেলা সহজ। কারণ, ভেঙে ফেলা স্বতন্ত্রভাবে ভালো কাজ না। কিন্তু সেই জিনিস তৈরী করা কঠিন। কারণ, সৃজনশীলতা স্বতন্ত্রভাবে মৌলিক ভালো কাজ। এখন দেখে নেয়া যাক উসূলে হাশতেগানা বা মূলনীতি অষ্টক।

১. যথাসম্ভব মাদরাসার কর্মচারী ও কর্মকর্তাদেরকে অধিকহারে চাঁদা আদায়ের বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। নিজেও এর জন্য চেষ্টা করতে হবে, অন্যের মাধ্যমেও চেষ্টা করাতে হবে। মাদরাসার হিতাকাঙ্খীদেরও এ বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।

২. যেভাবেই হোক মাদরাসার ছাত্রদের খানা চালু রাখতে হবে বরং ক্রমান্বয়ে তা বৃদ্ধি করার ব্যাপারে হিতাকাঙ্খী ও কল্যাণকামীদের সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে।

৩. মাদরাসার উপদেষ্টাগণকে মাদরাসার উন্নতি, অগ্রগতি এবং সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার দিকে সর্বদা লক্ষ্য রাখতে হবে। নিজের মত প্রতিষ্ঠার একগুঁয়েমী যাতে কারো মাঝে না হয় এ দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। আল্লাহ না করুন যদি এমন অবস্থা দেখা দেয় যে, উপদেষ্টাগণ নিজ নিজ মতের বিরোধিতা কিংবা অন্যের মতামতের সমর্থন করার বিষয়টি সহনশীলভাবে গ্রহণ করতে না পারেন তাহলে এ প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিমূল নড়বড়ে হয়ে পড়বে। আর যথাসম্ভব মুক্ত মনে পরামর্শ দিতে হবে এবং মাদরাসার শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টি লক্ষণীয় হতে হবে।  নিজের মত প্রতিষ্ঠার মনোবৃত্তি না থাকতে হবে। এ জন্য পরামর্শদাতাকে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে তার মতামত গ্রহণীয় হওয়ার ব্যাপারে অবশ্যই আশাবাদী না হতে হবে। পক্ষান্তরে শ্রোতাদেরকে মুক্তমন ও সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তা  শুনতে হবে। অর্থাৎ এরূপ মনোবৃত্তি রাখতে হবে যে, যদি অন্যের মত যুক্তিযুক্ত ও বোধগম্য হয়, তাহলে নিজের মতের বিপরীত হলেও তা গ্রহণ করে নেওয়া হবে। আর মুহতামিম বা পরিচালকের জন্য পরামর্শসাপেক্ষে সম্পাদনীয় বিষয়ে উপদেষ্টাগণের সাথে পরামর্শ করে নেওয়া অবশ্যই জরুরী। তবে মুহতামিম নিয়মিত উপদেষ্টাদের থেকেও পরামর্শ করতে পারবেন কিংবা তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত এমন কোন বিদগ্ধ জ্ঞানী আলেম থেকেও পরামর্শ গ্রহণ করতে পারবেন, যিনি সকল দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের জন্য হিতাকাঙ্খী ও কল্যাণকামী। তবে যদি ঘটনাক্রমে উপদেষ্টা পরিষদের সকল সদস্যের সাথে পরামর্শ করার সুযোগ না হয় এবং প্রয়োজনমাফিক উপদেষ্টা পরিষদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্যের সাথে পরামর্শক্রমে কাজ করে ফেলা হয়, তাহলে কেবল এ জন্য অসন্তুষ্ট হওয়া উচিত হবে না যে, ‘আমার সাথে পরামর্শ করা হল না কেন?’ কিন্তু যদি মুহতামিম কারো সঙ্গেই পরামর্শ না করেন, তাহলে অবশ্যই উপদেষ্টা পরিষদ আপত্তি করতে পারবে।

৪. মাদরাসার সকল শিক্ষককে অবশ্যই সমমনা ও একই চিন্তা চেতনার অনুসারী হতে হবে। সমকালীন (দুনিয়াদার) আলেমদের ন্যায় নিজ স্বার্থ প্রতিষ্ঠা ও অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করার দুরভিসন্ধিতে লিপ্ত না হতে হবে। আল্লাহ না করুন যদি কখনো এরূপ অবস্থা দেখা দেয়, তাহলে মাদরাসার জন্য এটি মোটেও কল্যাণকর হবে না।

৫. পূর্ব থেকে যে পাঠ্যসূচী নির্ধারিত রয়েছে কিংবা পরবর্তীতে পরামর্শের ভিত্তিতে যে পাঠ্যসূচী নির্ধারণ করা হবে, তা যাতে সমাপ্ত হয়; এই ভিত্তিতেই পাঠদান করতে হবে। অন্যথায় এ প্রতিষ্ঠান সুপ্রতিষ্ঠিতই হবে না, আর যদি হয়ও তবু তা ফায়দাজনক হবে না।

 

৬. এ প্রতিষ্ঠানের জন্য যতদিন পর্যন্ত কোন স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হবে; ততদিন পর্যন্ত আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতার শর্তে তা এমনিভাবেই চলতে থাকবে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু যদি স্থায়ী আয়ের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, যেমন কোন জায়গীর লাভ, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, মিল ফ্যাক্টরী গড়ে তোলা কিংবা বিশ্বস্ত কোন আমীর উমারার অনুদানের অঙ্গীকার ইত্যাদি, তাহলে এরূপ মনে হচ্ছে যে, আল্লাহর প্রতি ভয় ও আশার দোদুল্যমান অবস্থা; যা মূলতঃ আল্লাহমুখী হওয়ার মূল পুঁজি, তা হাত ছাড়া হয়ে যাবে এবং গায়েবী সাহায্যের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যাবে। তদুপরি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও কর্মচারীগণের মাঝে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও কলহ বিবাদ দেখা দিবে। বস্তুতঃ আয় আমদানি ও গৃহাদি নির্মাণের বিষয়ে অনেকটাই অনাড়ম্বরতা ও উপায় উপকরণহীন অবস্থা বহাল রাখার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।

৭. সরকার ও আমীর উমারাদের সংশ্লিষ্টতাও এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে বলে মনে হচ্ছে।

৮. যথাসম্ভব এমন ব্যক্তিদের চাঁদাই প্রতিষ্ঠানের জন্য অধিক বরকতময় হবে বলে মনে হচ্ছে; যাদের চাঁদাদানের মাধ্যমে সুখ্যাতি লাভের প্রত্যাশা থাকবে না। বস্তুতঃ চাঁদাদাতাগণের নেক নিয়ত প্রতিষ্ঠানের জন্য অধিক স্থায়ীত্বের কারণ হবে বলে মনে হয়।

ওপরের উসূল নিয়ে কয়েকটি নোক্তা

নোক্তা একঅর্থনীতি; গণ চাঁদা 

প্রথম মূলনীতি হচ্ছে, দারুল উলূমের প্রাণ এবং বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর মূল চালিকা শক্তি। গণচাঁদা হচ্ছে, সাধারণ জনগণ দিবে, সেটা নয়। গণচাঁদা হচ্ছে, সর্বস্তরের জনগণ থেকে আদায় করা চাঁদা। আলেমসমাজও এর অন্তর্ভুক্ত। বলা যায়, তাদের জন্য একাজে অংশগ্রহণ আবশ্যকীয় দায়িত্ব। কারণ, সাধারণ মানুষের ধারণা- আলেমরা দরিদ্র হয়। বিষয়টির জাগতিক বাস্তবতা গড়পড়তায় পুরোটাই সত্য। কিন্তু, টাকাপয়সার আধিক্যতা আর টাকাপয়সা হাতে পেয়েও মুখ ফিরিয়ে রাখা, দুটো ভিন্ন জিনিস। ইসলামিক এথিক্সের চর্চা যারা করেন তাদের ক্ষেত্রে এই অমুখাপেক্ষীতার চর্চাও লক্ষ্য করা যায়। সেন্ডেলের ফিতা ছেড়ার মতো মামুলি ব্যাপারেও সাহাবায়ে কেরাম মানুষ থেকে অমুখাপেক্ষী হয়ে আল্লাহ মুখী হয়েছেন। কাজেই, সাধারণ মানুষের ধারণা পাল্টাতে হলে এথিক্সের বায়বীয় চর্চার পাশাপাশি এর বাস্তবিক প্রয়োগও করতে হবে। বাস্তবিক প্রয়োগের ব্যাপারে কুরআন বলছে, ‘আর যার রিজিক কমিয়ে দেয়া হয়েছে, সে যেন অতটুকু থেকেই দান করে যতটুকু তাকে দেয়া হয়েছে’।’  (সুরা তালাক- আয়াত ০৭)

এই আয়াতের সম্বোধনে সবাই শামিল। সবাই নিজ থেকেই সামর্থ্য অনুযায়ী চাঁদা আদায় করার প্রতি লক্ষ্য রাখবে। সমাজের নিঃস্ব শ্রেণী ছাড়া অন্য কোন বিশেষ শ্রেণিই এ থেকে পৃথক হবে না। মূলনীতি অষ্টকের প্রথমটি ওপরে উল্লিখিত আয়াতের সমর্থনে সৃষ্ট। এ বিষয়টির বাস্তব প্রয়োগ দারুল উলূমের প্রতিষ্ঠালগ্নেই লক্ষ্য করা গেছে। এই প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রথম চাঁদা আদায় করেছিলেন স্বয়ং এর প্রতিষ্ঠাতাগণ।

আরেকটি ব্যপার হচ্ছে, গণ চাঁদার বিষয়টি তখন গণসংযোগ তৈরি করার লক্ষ্যে ছিল। বৃটিশ সরকারের হস্তক্ষেপকে প্রত্যাখ্যান করেই এই পদ্ধতির সূচনা। চাঁদা প্রদানে অংশ গ্রহণকে কৃতিত্ব ও মর্যাদা হিশেবে বিবেচনা করা হতো তখন। কিন্তু বর্তমানে ধর্মীয় বিষয়ে মানুষের মাঝে সংশয় ও সন্দেহ বৃদ্ধি পওয়ার পাশাপাশি বহুমত ও পথের তৈরী হয়েছে, এক মতাদর্শী ভিন্ন পক্ষকে দৃষ্টিবান ও কটুক্তিতে আক্রমণ করে চলে। তাছাড়া, বর্তমানে চাঁদা গ্রহণের অরাজক পদ্ধতির কারণে মানুষের এ ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধতা লক্ষ্য করা যায়। তাই প্রথম মূলনীতির ইঙ্গিতবহ অর্থ হচ্ছে, আলেমমসমাজকে স্বাবলম্বী হতে হবে। পাশাপাশি মূল্যবোধের চর্চা বৃদ্ধি করত হিতাকাঙ্ক্ষীদের থেকেও চাঁদা গ্রহণ করা যাবে।

সরকারি হস্তক্ষেপ এড়াতে গণচাঁদার প্রবর্তন করা হয়। সেজন্য বর্তমানে, সরকারি অনুদান গ্রহণ ও বর্জন বিষয়ে প্রায়শই আলাপ ওঠে। এরপর থেমে যায়। আবার ছাই থেকে সেই আলাপের মজলিস উত্তপ্ত করে জ্বলে ওঠে ওই একই ইস্যু। একদম সোজা কথায়- এসব আলাপচারিতা বন্ধের স্থায়ী কোন সমাধান নেই। তবে সাময়িক সমাধান আছে। সে কথাই এখন বলি, যেকোন জিনিস গ্রহণের জন্য স্থান-কাল-পাত্রের সংশ্লেষ জরুরি। দেখতে হবে, শাসকগোষ্ঠী কর্তৃত্ববাদী কি না! কারণ, ইলাহি কার্যাবলিতে স্পষ্টত কারও প্রভাব প্রতিপত্তি আমলে নেয়া হবে না। সুতরাং এক্ষেত্রে বর্তমানে কিছুতেই এই যুক্তি গিলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা যাবে না- সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের অনুদানে চললেই কী তাতে সরকারের হস্তক্ষেপ আছে নাকি! কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সরকারের সম্পর্ক ভ্রাতৃত্বমূলক। যখন তখন প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। কিন্তু বর্তমানে যেই থিমে রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সেই রাষ্ট্রের সাথে যেহেতু ধর্মীয় শিক্ষার বৈরিতা, তাই ধর্মীয় ব্যাপারে সরকারের হস্তক্ষেপ অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবেই  থাকছে। কারণ, ধর্মীয় চিন্তার চর্চা কখনোই পরাধীনতা মেনে নেয় না। আল্লাহর আনুগত্য আর মানুষের আনুগত্যে তফাত শেখানো হয় এখানে। তাছাড়া, ধর্ম তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ ও হস্তক্ষেপকারী কোন সরকারকেই কখনো মেনে নিবে না৷ কিন্তু ধর্মের প্রতি আনুগত্যপ্রবণ সরকার ধর্মের সাহায্যেই জনসমর্থন পাবে।

নোক্তা দুইখাদ্য সরবরাহ 

জ্ঞানার্জনে খাদ্য ও চিকিৎসা অপরিহার্য বিষয়। আসলে, টিকে থাকার জন্য খাদ্য বরাবরই আনুষঙ্গিক ব্যাপার। কাজেই, যেকোনভাবেই হোক মাদরাসায় খাবার জারী রাখা জরুরি। এই নিয়ম প্রথম নিয়মের অধীনেই। পড়াশোনার পরিবেশ তৈরি করার জন্য ছাত্রদের মাসিকভাতা নির্ধারণ করাও এখন সময়সাপেক্ষ বিষয়। এজন্য অর্থনীতিতে মাদরাসার নিজস্ব খাত তৈরি করাও এই উসূলের তাকাদা। যদিও বলা হয়েছে, স্থায়ী কোন আয়ের উৎস থাকলে, সেক্ষেত্রে তাওয়াক্কুলহীনতার ভয় করা হচ্ছে। তবুও এর সমাধান চাঁদা গ্রহণেই সীমাবদ্ধ থাকা জরুরি না। বরং এর সমাধান ইসলামী মূল্যবোধের উন্নতিকল্পেই নিহিত। বস্তুবাদের আগ্রাসন ঠেকানোর যেই পন্থা এই উসূলে বলা হয়েছে সেটা সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু খুব ভেঙ্গে ভেঙে এবং একটু ভিন্ন করে দেখলে আমাদের সামনে স্পষ্ট হচ্ছে, অর্থনীতি ছাড়া কোন কিছুতেই অগ্রসর হওয়া সম্ভবপর নয়। ওলিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী রহ. তার হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা গ্রন্থে অর্থনৈতিক অধঃপতনকে যাবতীয় বিশৃঙ্খলার উৎস হিশেবে চিহ্নিত করেছেন। তাছাড়া অর্থনীতি এমন এক জিনিশ যেখানে তাওয়াক্কুলের ব্যপারটা মানসিকতা সংশ্লিষ্ট। হাজার থেকেও তাওয়াককুল থাকতে পারে। আবার কিছু নেই, তবুও ভরসা নেই আল্লাহর রাজ্জাক নামে পরিচালিত খাজানার প্রতি এমনও হতে দেখা যাচ্ছে। সুতরাং ইসলামী মূল্যবোধের চর্চা ও অর্থনীতির সুষ্ঠু ব্যখ্যা বর্তমানে জরুরি হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি এর বাস্তবিক প্রয়োগে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেই এগিয়ে আসতে হবে। আর এর প্রাথমিক ধাপগুলো পূর্ণ করতে পারলে মাদরাসার ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অন্নবস্ত্র ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা নিয়ে হাজির হতে পারব এই উসূলের ভেতর দিয়েই। এজন্য আরও একটি বিষয় জরুরি, আমাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রয়োজন পূরণ করতে পারার রুচিবোধ। এ বিষয়টি তখনই পূরণ হবে যখন আমরা প্রতিটি কাজের মৌলিক উদ্দেশ্য ও উসূল নিয়ে আলাপ জারি রাখব।

 নোক্তা তিনপরিচালনা, পরামর্শ ও অগ্রাধিকার

প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থে নিজ স্বার্থ বলতে কিছু থাকতে পারে না৷ এটা সামগ্রিক স্বার্থের উসূলের অধীন। সামগ্রিক স্বার্থ ব্যাহত  না করে ব্যক্তিস্বার্থের জলাঞ্জলি দেয়ার মানসিকতা লালন করতে পারাই হচ্ছে সাহাবী ও নববী মাসলাকের অনুসরণ।

কিন্তু প্রত্যহ হাদিসের চর্চা বৃদ্ধি পেলেও সুন্নাতের চর্চা কমে যাওয়ায় আমাদের মাঝে ব্যক্তিচর্চার মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধর্মীয় বিষয় কখনোই ব্যক্তির সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে না। যদি করা হয় তাহলে সেটা ধর্ম থাকে না, সেটা হয়ে যায় পোপতন্ত্র। কিন্তু আমাদের মনে থাকে না এসব৷ এর পেছনেও সেই একই কারণ। বস্তুবাদের আগ্রাসন। এই ঢেউ সবাইকে গ্রাস করেছে। ইসলামের মূলনীতি যাদের সামনে আছে তারা মাঝেমধ্যে বুঝতে পারেন। বেঁচে থাকার লড়াই জারি রাখেন। এছাড়া সবাই এই রোগে আক্রান্ত। ফলে, অর্থনীতি থেকে শুরু করে পরামর্শনীতি পর্যন্ত সব স্তরেই খোদাহীনতার চিহ্ন। এজন্য জরুরি হচ্ছে, যারা মনের কার্পণ্য থেকে নিজেদের মুক্ত করেছে তারাই সফলকাম” সাহাবায়ে কেরাম এর এই অগ্রাধিকারের গুণকে অর্জনে সচেষ্ট হওয়া।

নোক্তা চারচিন্তা ও চেতনা চর্চা

যেকোন গোষ্ঠীর উন্নতি ও অগ্রগতির পেছনে সর্বাগ্রে, সর্বাধিক জরুরি বিষয় হচ্ছে– এক মন, এক দিল ও এক মানসিকতার অধিকারী হওয়া। তৃতীয় নোক্তা এবং এই নোক্তাটা খুব ওতপ্রোতভাবে জড়িত- ইবনে খালদুন বলছেন- ‘রাজ্যশক্তি এমন একটি উন্নত ও আকর্ষণীয় পদমর্যাদা, যাতে পার্থিব কল্যাণ, দৈহিক ভোগেচ্ছা ও আত্মিক সম্ভোগ বাসনা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এজন্য এতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতা দেখা যায় এবং পরাজিত না হওয়া পর্যন্ত এ ব্যাপারে কেউ কারও প্রাধান্য মেনে নিতে চায় না। এসব ব্যাপারের কোনটিই গোত্রেপ্রীতি ব্যাতিত সম্ভব নয়।’

ইবনে খালদুন এর এই বক্তব্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিটা আদলেই বাস্তবিক৷ পদমর্যাদা ও পদন্নোতির লোভ অনেক কওমি মাদরাসাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। কিন্তু উলামায়ে কেরামের এই পারষ্পরিক আত্মকলহ কোরআন কারিম তেলাওয়াতের জন্য কুরআন কারীম নিয়ে টানাটানি করতে গিয়ে তা ছিঁড়ে ফেলার মতো। সেজন্য তৃতীয় এবং চতুর্থ পয়েন্ট নিয়ে একসাথে আলোচনা করলে ফলাফল এই দাঁড়ায়, উক্ত অঞ্চলের ধর্মীয় মানসিকতাকে সামনে রেখে, বৃহত্তর স্বার্থে ব্যক্তিস্বার্থকে পিছনে ফেলে, জাগতিক ও পারলৌকিক কল্যাণে নিজের মতামত পেশ করা।

নোক্তা পাঁচশিক্ষা-কার্যক্রম 

পাঠ্য সিলেবাস নিয়ে আলাপের অনেক ক্ষেত্র রয়ে গেছে দেওবন্দী ধারার বাংলাদেশী কওমি মাদরাসাগুলোতে। এক্ষেত্রে নেসাবে তালিমের যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম প্রবর্তন না করা এবং শিক্ষার্থীকে শিক্ষার ধারাবাহিকতায় আধ্যাত্মিকতায় রাহনুমায়ী করতে না পারার ব্যার্থতা সবচে বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গতানুগতিক দাওরা পাশের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও উপযুক্ত ও গুণগত পদ্ধতিতে অধ্যাপনা না পাওয়ার কারণে নেসাবে তালিমের উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে না। এজন্য যেমনিভাবে যোগ্য শিক্ষকের সংকট নিরসন জরুরি ঠিক তেমনিভাবে যোগ্য হলেও অধ্যাপনায় দুর্বলতা হেতু ছাত্র-ছাত্রীদের ফায়দা কম হচ্ছে।

এজন্য জরুরি বিষয় হিশেবে যা যা মনে করছি-

০১. সহনশীলতার চর্চার সাথে সহযোগিতামূলক পড়াশোনার পরিবেশ তৈরি করা।

০২. শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে উসূলে শরিয়ার চর্চা পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি করত পাঠ পদ্ধতিতে যেসব কুসংস্কারের অনুপ্রবেশ ঘটেছে সেগুলো ঝেঁটিয়ে বিদায় করা। যেমন, এক মাযহাবকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে অন্য মাযহাবের ইমামকে ছোট করে পেশ করা।

০৩. এমন একটি স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করা যা উত্তীর্ণ হওয়া ছাড়া শিক্ষকতার যোগ্য হিশেবে বিবেচ্য হবে না। তাহলে শিক্ষায় ভারসাম্য ফিরে আসবে।

০৪. আখলাকী সংকট দূর করতে হবে। বাহ্যিক পড়াশোনার সাথে আখলাকী রুহের মিশ্রণ তৈরি করতে পারলে পড়াশোনার পরিবেশ তৈরি হবে।

০৫. প্রাধান্যের ভিত্তিতে পড়াশোনার সিলেবাসে যুগপৎ পদ্ধতি নিয়ে আসা। এছাড়াও আরও যা কিছু উপকারী সেগুলো নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা ও এর প্রয়োগ জারি রাখা জরুরি।

উসূলে হাশতেগানার আবেদন স্থায়ী হওয়ার পেছনের বড় কারণ হচ্ছে– এসব মূলনীতির বাহ্যিক অর্থ, ইঙ্গিতার্থ, বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্য ও মূলনীতির তাকাদাসমূহ প্রতিটাই মূলনীতি নির্ভর। এবং প্রতিটা মূলনীতি নুসুসে শারইয়্যাহ এর আলোকে গঠিত। উসূলের পরিভাষায়- সমস্ত নুসুসকে একটি নসে পরিণত করা। মানে, সমস্ত দলিলকে একত্রিত করে একটি সামগ্রিক দলিলে রুপান্তর করা। কাজেই, যারা এসব মূলনীতির পরিবর্তনের কথা বলছে তাদের উচিত উসূলের আলোকে এসব মূলনীতির ইশারা, ইকতিদা, ইবারাত ও নস খুঁজে খুঁজে বের করে সেগুলোকে বাস্তবিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা। আমরা পরিবর্তন চাই না। আমরা চাই, রুপান্তর।

তথ্যসূত্র

আল-কুরআন

মুকাদ্দিমা ইবনে খালদুন

 

আগের সংবাদপ্রস্তাবিত বাজেট মন্ত্রিসভায় অনুমোদন
পরবর্তি সংবাদপদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে ২৫ জুনের এসএসসি পরীক্ষা ২৪ জুন