ঐতিহ্যবাদ : ধর্মীয় চিন্তায় নতুন সিলসিলা

হুজাইফা মাহমুদ:

এই দ্রুত প্রাগ্রসরমাণ মানবসভ্যতায় অতীত ও ঐতিহ্যের প্রাসঙ্গিকতা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। একটা সময় পর্যন্ত মানুষের ইতিহাস-ঐতিহ্যই তার বর্তমান ও ভবিষ্যতের গতিপথ ঠিক করে দিতো। কিন্তু এই আধুনিক সময়ে এসে অতীতের সাথে যেকোনো ধরনের কার্যকরী সম্পর্ক স্থাপন করে রাখাটাকে মানুষ এখন পশ্চাৎগামিতা হিসেবেই বিবেচনা করছে। ফলে যেকোনো সমাজ, রাষ্ট্র , মতবাদ ও মানবরচিত ধর্মের কাছে ঐতিহ্য কেবলই প্রাত্যহিক কিছু আচার-আচরণ ও রীতি-রেওয়াজের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে, কখনও বা এটা কেবলই গৌরবময় অতীতের স্মৃতিচারণা বৈ আর কোনো গুরুত্ব বহন করে না। এর বাইরে আলাদা আর কোন সক্রিয় ভূমিকা থাকে না। এরকমই একটা কথা প্রচলিত আছে- tradition is the peer pressure from dead peoples . মানে, ট্র্যাডিশন হলো মৃত মানুষের তৈরী করা সামাজিক চাপ। কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছাড়াই আধুনিক মননে ট্র্যাডিশনের প্রতি দায়বদ্ধতা কতটুকু সেটা বুঝা যাচ্ছে । ট্র্যাডিশনের প্রতি এই দায়হীন মনোভাবের ব্যতিক্রম কেবল এক জায়গাতে চোখে পড়ে, সেটা ইসলামে।

ইসলামে ট্র্যাডিশন সব যুগেই যাবতীয় চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো। এখানে ট্র্যাডিশন বলতে আমরা ধর্মীয় চিন্তা ও জ্ঞানের সিলসিলার কথা বুঝাচ্ছি। সামনের আলোচনায় সেটা আরও সুস্পষ্ট হবে বলে আশা করছি।

কল্পনা করুন, এই একবিংশ শতকে এসেও একজন মুসলিম স্কলার বা আলেম যখন কুরআন ও হাদিসের কোন ব্যাখ্যা বা বিধান অনুসন্ধান করতে যান, তখন তিনি অনুসন্ধান শুরু করেন ইসলামের একেবারে শুরুর সময় থেকে। তার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে বিষয়টির সমাধান যতটা সম্ভব পুরাতন ও পূর্ববর্তী কোন উৎস থেকে বের করা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তিনি যদি কোনো আয়াতের তাফসীর জানতে চান, তাহলে প্রথমেই তিনি হাদিসের সুবিস্তৃত ভান্ডারে এর অনুসন্ধান করবেন, রাসুল সা.-এর পবিত্র জবান থেকে এই আয়াতের কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কি না। সেখানে না পেলে তার দ্বিতীয় উৎস থাকে রাসূল সা.-এর সাহচর্যপ্রাপ্ত বিশ্বস্ত অনুসারী তথা সাহাবায়ে কেরামের বক্তব্য ও ব্যাখ্যা অনুসন্ধান করা। তারপর তাবেইন ও তাবে তাবেইনদের বক্তব্যকে প্রাধান্য দেয়া হবে। এভাবে ইসলামি চিন্তা ও জ্ঞানের একটি সুদীর্ঘ ও মজবুত সিলসিলা তৈরী হয়েছে। যে সিলসিলা ধরে দ্বীনের যাবতীয় ইলম ও আমল আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন উপায়ে। যেহেতু আলেমগণ মূলত নবীদেরই উত্তরাধিকারী, রাসূল সা.-এর রেখে যাওয়া দাওয়াত ও বাণী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পৌঁছে দেয়াই তাদের দায়িত্ব। আর এই দায়িত্বের সবচে বড় দিক হলো আমানতদারিতা রক্ষা করা। অর্থাৎ রাসূল সা.-এর রেখে যাওয়া দ্বীনকে সবধরণের বিচ্যুতি ও বিকৃতি থেকে রক্ষা করে হুবহু সেভাবেই টিকিয়ে রাখা।

ঐতিহ্যবাদ কী এবং ঐতিহ্যবাদি কারা?

এখানে আবারও আগের প্রশ্নে ফেরা যাক, ইসলামিক ট্র্যাডিশন বলতে আমরা কী বুঝাচ্ছি?

আপনি যদি ইসলামের যে বৃহৎ বিস্তৃত ও বহুমুখী জ্ঞানপ্রকল্প রয়েছে তার দিকে তাকান, তাহলে দেখতে পাবেন সবকিছুর মূলে রয়েছে কুরআন, সুন্নাহ, এবং সে সময়কার নির্বাচিত মানুষদের, তথা সাহাবা, তাবেইন, তাবে তাবেইন এবং তাদের পরবর্তী ইমাম ও মুজতাহিদগণের বোঝাপড়া। আকিদা, ফিকহ, তাফসির ও হাদিস সহ জ্ঞানের যত শাখা-প্রশাখা বিদ্যমান, তার সবটাই আবর্তিত হয় মূলত এই সামষ্টিক জ্ঞানের উৎসকে কেন্দ্র করেই। এই সমষ্টিগত প্রকল্পটিকেই আমরা ইসলামিক ট্র্যাডিশন বা ঐতিহ্য বলছি। ইসলামের জ্ঞানতত্ত্ব (Epistemology) বা জ্ঞানের উৎস বলা যায় একে। ইসলামি জ্ঞানের যে স্ট্রাকচারটি রয়েছে তার মূল উপাদান এবং শেকড় হলো এই ট্র্যাডিশন। সুতরাং এই ট্র্যাডিশন ব্যতীত ইসলামি জ্ঞান কল্পনা করা সম্ভব না। একই সাথে এই ট্র্যাডিশনের প্রতিটি উপকরণই অপরিহার্য এবং পরস্পরের সম্পূরক । এর মধ্য থেকে কোনো একটিকে বাদ দেয়ার সুযোগ নেই। কুরআনকে যথাযথভাবে বুঝতে হলে সুন্নাহ ও সাহাবা তাবেইন ও ইমাম মুজতাহিদদের দ্বারস্থ আপনাকে হতেই হবে। কেননা, কুরআন ও সুন্নাহ এবং শরীয়তের সকল আহকাম ও বিধিবিধান বুঝার ক্ষেত্রে তারাই সবার চাইতে অগ্রগামী । এটাই যৌক্তিক এবং ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। এই ট্র্যাডিশনাল জ্ঞানচর্চার ভেতর দিয়েই ফিকহ ও আকিদার মাযহাবগুলো গঠিত হয়েছে, এবং প্রত্যেকে নিজস্ব চিন্তা ও মতামত বাদ দিয়ে ট্র্যাডিশনের যে সিলসিলা নির্মিত হয়েছে তাতে শামিল হয়ে পড়েছে। যারা এর বাইরে গিয়ে নিজস্ব চিন্তা ও মতামতের অনুসরণ করতে চেয়েছে, তারা সিলসিলা থেকে ছিটকে পড়েছে এবং কখনোই আর মূলধারার সাথে মিলিত হতে পারেনি।

সুতরাং, ঐতিহ্যবাদি বলতে তাদেরকেই বুঝাচ্ছি, যারা দ্বীন ও শরিয়ার যাবতীয় বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহ এবং পূর্ববর্তী ইমাম মুজতাহিদগণের হুবহু অনুসরণ করেন। স্থান ও কালের পরিবর্তনে কিংবা পারিপার্শ্বিক চাপে কখনও এই নীতি থেকে সরে আসেন না, এবং দ্বীন প্রচারের ক্ষেত্রে কোনরূপ নমনীয়তা ও কৈফিয়তবাদি অবস্থান গ্রহণ করেন না। যিনি মনে করেন, এই দ্বীন যেভাবে প্রণীত হয়েছে, আল্লাহ ও তার রাসূলের পক্ষ থেকে ঠিক সেভাবেই এটা কিয়ামত পর্যন্ত সকল যুগে সকল স্থানে সকল মানুষের জন্য সমানভাবে উপযুক্ত, স্থান ও কালের পরিবর্তনে দ্বীনের কোন বিধানে কোন পরিবর্তন ঘটবে না, তিনিই হলেন ইসলামের ঐতিহ্যবাদের প্রকৃত ধারক বাহক।

একে যদিও আরও নানানভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়, কিন্তু মূল কথা আসলে এতটুকুই।

ট্র্যাডিশন এবং ইসনাদ

ইসলামের ঐতিহ্যবাদকে পুরোপুরি বুঝতে চাইলে আরও একটা বিষয়ের সাথে পরিচিত হওয়া আবশ্যক। তা হলো ইসনাদ। ঐতিহ্যবাদ, এমনকি খোদ ইসলামেরই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক একটি উপাদান হলো ইসনাদ। আল্লাহ এই উম্মতের উপর অধিকতর অনুগ্রহ করে তাদেরকে এমন এক অমূল্য সম্পদ দান করেছেন। ইসনাদ মানে সিলসিলা বা পরম্পরা। যে সিলসিলা আপনাকে আত্মিক ও আক্ষরিক উভয়ভাবে ট্র্যাডিশনের সাথে যুক্ত রাখবে। যদিও অধিক প্রসিদ্ধি ও প্রয়োজনীয়তার বিবেচনায় অনেকেই হয়তো মনে করেন, এটা শুধু হাদিস সংরক্ষণেরই মাধ্যম। বস্তুত ইসনাদ পুরো দ্বীনেরই অংশ। আমাদের ধর্মীয় চিন্তা, বোধ, আকিদা, বিশ্বাস, আমল ও কর্মপরিধি সবকিছুরই একটা সিলসিলা আছে। ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের চিন্তা, আকিদা, বিশ্বাস ও আমলের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে আছে এই ইসনাদ। কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ ইসনাদের মাধ্যমেই দ্বীন, শরিয়া, কুরআন ও সুন্নাহর সঠিক বোঝাপড়াকে অবিকৃত ও অপরিবর্তীত রাখবেন।

আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক বলেছেন, ‘এই ইসনাদ দ্বীনের অংশ। যদি এটা না থাকতো তাহলে যার যা খুশি দ্বীনের নামে তাই বলে বেড়াতো!’ সুফিয়ান সাওরি বলেন, ‘ইসনাদ হইলো মুমিনের অস্ত্র, এইটা না থাকলে সে লড়াই করবে কী দিয়ে?’ ইসনাদ শুধুমাত্র কিতাবে লিপিবদ্ধ কতগুলো নামের পরম্পরাই নয়। এটা তারচাইতেও ব্যাপক ও বিস্তৃত একটি কনসেপ্ট।

ট্র্যাডিশন খৃষ্টধর্ম এবং ইহুদি ধর্মেরও ছিলো। কিন্তু সেটাকে সংরক্ষণ করার জন্য ইসনাদের মতো কোন টুলস তাদের ছিলো না । ফলে সেগুলো কালের বিবর্তনে এতোটাই বিকৃত ও পরিবর্তিত হয়েছে যে, সেগুলোতে এখন কেবল কতগুলো আচার অনুষ্ঠানই বাকি রয়ে গেছে, বাকি ধর্মের মূল সার-সত্তা সব বিলীন হয়ে গেছে। যে যেভাবে পেরেছে তাতে সংযোজন বিয়োজন করেছে।

এই দৃষ্টিকোণ থেকেই বলা হয়, ইসলামে নতুন চিন্তা বা বিতর্কের উত্থাপন কখনোই আকর্ষণীয় এবং পছন্দনীয় কিছু ছিলো না। এটাকে সবসময়ই বিপদজনক ও বিভ্রান্তির আশঙ্কাপূর্ণ পথ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়েছে। ইসলামের যে সুবিস্তৃত জ্ঞানের ঐতিহ্য রয়েছে, সেখানে আমরা দেখি, প্রত্যেক ইমাম, মুফাসসির, মুহাদ্দিস, পন্ডিত, আলেম-উলামা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন তাদের ব্যাখ্যা ও বক্তব্য যেন পূর্ববর্তীদের পরম্পরা থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়। ইমাম আবু ইউসুফ রহ. স্পষ্ট করেই বলেন, যে শরিয়তের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন মতামত খুঁজে বেড়ায় সে ভ্রষ্টতার শিকার হবে।

ইসলামের সমগ্র বুদ্ধিবৃত্তি ও জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি যে পালন করেছে, তা হলো ঐতিহ্যবাদ বা ট্র্যাডিশনালিজম। এই মানহাজ ও পদ্ধতি অনুসরণ করতেন যারা, তারাই ছিলেন ট্র্যাডিশনালিস্ট উলামা শ্রেণী, যারা সবসময়ই ধর্মীয় পরিমণ্ডলে মূলধারার বাহক হিসেবে গণ্য হতেন। বস্তত, উনবিংশ শতকের মধ্যভাগের আগ পর্যন্ত ট্র্যাডিশনালিজমই ছিলো ইসলামের চিন্তা ও জ্ঞানচর্চার একমাত্র পদ্ধতি। ঐতিহ্যবাদি আলেমরাই ধর্মের যাবতীয় বিষয়ে নেতৃত্ব দিতেন। তারা ফিকহ, আকিদা, হাদিস, তাফসির সহ সকল বিষয়ে পূর্ববর্তী ইমাম, মুজতাহিদ, মুফাসসির ও মুহাদ্দিসগণের মতামত বিশ্বস্ততার সাথে পৌঁছে দিতেন। নিতান্ত প্রয়োজন দেখা না দিলে নিজস্ব মতামত ও ইজতিহাদের দ্বারস্থ হতেন না।

কিন্তু উনিশ শতকে মুসলিম বিশ্বে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে পশ্চিমা উপনিবেশ ও আলোকায়নের (enlightenment) প্রত্যক্ষ প্রভাবে। উপনিবেশায়ন, আধুনিকায়ন, বিশ্বায়ন এবং আলোকায়ন, সবকিছুর সুতীব্র ঝলক এসে লাগে কিছু মানুষের মনে। ওই সময়েই হিন্দুস্তান, মিশর ও সিরিয়াসহ মুসলিম বিশ্বের নানান অঞ্চলে ট্র্যাডিশন বিরোধী আওয়াজ উঠানো হয়। এর প্রবক্তরা দাবী করেন, আমরা যদি এখনও হাজার বছরের পুরাতন ট্র্যাডিশন নিয়েই পড়ে থাকি, তাহলে আমাদেরকে বর্তমান দুনিয়া থেকে আরও হাজার বছর পিছিয়ে থাকতে হবে। কিন্তু আমরা যদি ইউরোপের মতো পুরাতন ট্র্যাডিশনকে ফেলে দিয়ে আমাদের সময়ের উপযোগী নতুন ট্র্যাডিশন নির্মাণ করি, তাহলে আমরাও ইউরোপের মতোই জাগতিক উন্নতি ও শক্তির শিখরে পৌঁছাতে পারবো। তাদের এই চিন্তা নেহায়েতই আত্মঘাতী চিন্তা ছিলো। যার দু:খজনক খেসারত মুসলিম বিশ্বকে এখন পর্যন্ত দিতে হচ্ছে।

উপনিবেশপূর্ব সময় পর্যন্ত ঐতিহ্যবাদি ধারার আলেম উলামারাই রাষ্ট্র ,সমাজ ও ধর্মীয় পরিসরে কর্তৃত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করতেন। কিন্তু তাদের এই সংস্কারবাদী আন্দোলনের ফলে রাষ্ট্রের সকল পরিসরে ঐতিহ্যবাদি ধারার যে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিলো সেটা ভেঙে পড়ে। জনমানুষ থেকে নিয়ে রাষ্টনায়ক পর্যন্ত, অনেকের ধর্মীয় চিন্তায় দেখা দেয় তুমুল বিশৃঙ্খলা । ট্র্যাডিশনাল উলামাদের ধর্মীয় কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে তারা নিজেরাই সেই কর্তৃত্ব দাবী করে বসলো। যারা অতি দীর্ঘ ও পরিশ্রমসাধ্য একটি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আলেম হিসেবে স্বীকৃত হতেন এবং ধর্মের যাবতীয় বিষয় আশয়ে অত্যন্ত দক্ষতা ও প্রজ্ঞার সাথে পরিচালনা করতেন, তাদের জায়গায় আবির্ভূত হতে লাগলেন এমন সব লোক, যারা ইসলামের ট্র্যাডিশন কিংবা জ্ঞানচর্চার যে স্বীকৃত-অনুসৃত পদ্ধতি আছে, সে ব্যাপারে মোটেও সচেতন না। তারা ভাবতে লাগলেন, আমাদের সামনে যেহেতু কুরআন ও হাদিস উভয়টিই টেক্সট আকারে বিদ্যমান, এবং আমরা এমন এক সময়ে বসবাস করছি যে সময়টা পূর্ববর্তীদের চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন, সেহেতু এইসব টেক্সটের অর্থ ও মর্ম আমরা আমাদের মতো করে এবং সময়ের উপযোগী করে বুঝবো। এ যুগে এসেও ট্র্যাডিশন অনুসরণ করার কোন অর্থ নেই।

এই এলোপাথাড়ি জ্ঞানের চর্চা আরও ব্যাপকতা লাভ করে যখন মুসলিম বিশ্বে ছাপা খানার আবির্ভাব ঘটে। কিতাবপত্র তখন নিতান্তই সহজলভ্য হয়ে পড়ে সকলের কাছে। পূর্বে যেগুলোর প্রচলন ছিলো কেবলই বিজ্ঞ আলেম-উলামাদের মাঝে। তারা একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত প্রক্রিয়ায় কিতাবের অনুলিপি তৈরী করতেন এবং এর যথাযথ ব্যবহার করতেন। তারা এই জ্ঞান পৌঁছে দিতেন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সরাসরি পাঠদানের মাধ্যমে। অর্থাৎ পুরো ব্যাপারটাই সুরক্ষিত ও নিরাপদ ছিলো। কিন্তু ছাপাখানার সুবাদে সেসব কিতাব মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে গেলেও সেগুলো বুঝা ও আয়ত্ত করার জন্য যে প্রয়োজনীয় প্রজ্ঞা ও দক্ষতার প্রয়োজন সেটা ছাপাখানায় পাওয়া যেতো না। এই ধারাকে আরও বেগবান করে পরবর্তীতে সৃষ্ট সালাফি ধারার আন্দোলনগুলো। তারা সাধারণ শিক্ষিত মুসলিমদেরকে মাযহাবের তাকলীদ থেকে বের হয়ে নিজস্ব গবেষণা ও ইজতেহাদ অনুযায়ী চলার প্রতি জোর দেন। এমনকি ফিকহ ও আকিদার ট্র্যাডিশনাল যে পদ্ধতি রয়েছে, সেটাকে বিদাত ও ইসলাম বহির্ভূত রীতি হিসেবে আখ্যায়িত করতেও ছাড়েননি।

তবে এটাও সত্য, সাধারণ শিক্ষিত সংস্কারবাদী মুসলিমদের বড় একটা অংশ ট্র্যাডিশনালিজমকে বিভিন্ন দিক থেকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করলেও দিনশেষে ট্র্যাডিশনালিস্ট উলামা শ্রেণীটাই ধর্মের মূলধারা হিসেবে টিকে রইলেন। কেননা ‘স্বশিক্ষিত এক্সপার্টদের’ ওই ক্ষমতা কখনোই ছিলোনা যে, তারা বিপুল একটা জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বিষয়ে নেতৃত্ব দেবে এবং তাদের ধর্মীয় জিজ্ঞাসার চাহিদা মেটাবে।

সমকালীন প্রেক্ষাপটে ঐতিহ্যবাদ

মুসলিম বিশ্বে ইতিপূর্বেও আরও বহুবার পশ্চিমা শক্তির আগ্রাসন ঘটেছে। তারা প্রবল প্রতাপ নিয়ে এসেছিলো মুসলিম বিশ্বকে জয় করার উদ্দেশ্যে। দীর্ঘ কয়েকশত বছর যাবৎ ধরে চলা ক্রসেড যুদ্ধের কথাই ধরা যাক। কিন্তু কখনও তাদের আগ্রাসন মুসলিমদের চিন্তা ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধকে প্রভাবিত করতে পারেনি। উপরন্তু তারা নিজেরাই মুসলিম সভ্যতার দ্বারা বিপুলভাবে প্রভাবিত হয়। কিন্তু অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক অভিযানগুলো যখন মুসলিম বিশ্বে ঠাঁই গেড়ে বসে, তখন থেকেই মুসলিমদের মাঝে চিন্তাগত বিশৃঙ্খলা তৈরী হয়। পারিপার্শ্বিক বহু প্রভাবে পাল্টে যেতে থাকে চিন্তার স্রোত। মরক্কোর প্রসিদ্ধ চিন্তক ও আলেম শায়খ বাশির ইসাম মারাকেশি এর কারণ হিসেবে বলছেন, তখনকার মুসলিমরা সামরিক শক্তিতে কখনও পশ্চিমাদের হাতে পরাজিত হলেও তাদের ভিত্তিমূল এবং চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু ( مرجعية) ছিলো মজবুত । তখন কুরআন, সুন্নাহ ও সালাফদের চিন্তার সিলসিলা ব্যতীত অন্যকিছুকে দ্বীনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে মানা হতো না। কিন্তু পরবর্তীতে এই কেন্দ্রবিন্দুটা পাল্টে যায় সময়ের চাপ ও পারিপার্শ্বিকতার কারণে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত মুসলিমদের এই বুদ্ধিবৃত্তিক বিশৃঙ্খলা বহু ডালপালা ছড়িয়েছে। ট্র্যাডিশনের প্রতি যে অনাস্থা ও বিরুদ্ধ মনোভাব তৈরী হয়েছে, তা আরও বহুমাত্রিক রূপে দেখা দিয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে যেমন আমরা দেখছি, মুসলিমদের মধ্য থেকেই বেশ কিছু দল বের হয়েছে, যারা ট্র্যাডিশনের সাথে সেই পুরাতন বোঝাপড়ায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। বিবিধ স্রোতে ভাগ হয়ে গেছে ট্র্যাডিশন-কেন্দ্রিক চিন্তা। এদের মাঝে কেউ আছে ট্র্যাডিশনের একাংশ বাদ দিয়ে আরেকাংশের উপর নির্ভর করে ধর্মীয় চিন্তার পূনঃনির্মাণ চায়। আবার বৃহত্তর একটা অংশ মনে করে, বর্তমান সময়ে ইসলামকে বাকি পৃথিবীর সাথে সামঞ্জস্য রেখে টিকে থাকতে হলে এর আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রয়োজন ধর্মীয় ব্যাখ্যার যুগোপযোগী সংস্করণ, যা আধুনিক মানুষের মননশীলতা ও মনস্তত্ত্বকে ধারণ করবে। ইসলামকে এই পরিবর্তনশীল সভ্যতার সাথে মানিয়ে নেয়ার জন্য ছাড় দিতে হবে বহু বিষয়ে। ইসলামের হুদুদ, কিসাস সহ আরও যে সকল বিষয় আধুনিক বিজ্ঞান কিংবা ‘বিশ্ব মানবাধিকার সংবিধান’ স্ট্যান্ডার্ডের সাথে সাংঘর্ষিক, সেগুলোকে বাদ দিয়ে এর বিকল্প ব্যাখ্যা হাজির করার প্রস্তাবনা তারা সামনে আনছে। ট্র্যাডিশনের ব্যাপারে তাদের মনোভাব হলো- যে সময়টাতে এইসব ব্যাখ্যা ও চিন্তার উদ্ভব হয়েছে, এগুলো সে সময়ের জন্যই প্রযোজ্য ,আমরা আমাদের সময় ও পরিবেশ অনুযায়ী সেগুলোকে নতুন করে নির্মান করবো। এই মডারেট ও উদারপন্থী চিন্তাধারার চিন্তকরা আজকাল মোটেও বিচ্ছিন্ন ও সংখ্যালঘু কেউ নন। এটাও বেশ জনপ্রিয় একটি প্রস্তাবনা আজকাল মুসলিম সমাজে।

নিউ ট্র্যাডিশনালিস্ট বা ‘নব্য ঐতিহ্যবাদি’ ধারার চিন্তকরা ভাবছেন, যে ট্র্যাডিশন এতদিন যাবৎ টিকে আছে মুসলিমদের মাঝে, তা আমাদের সময়কে ব্যাখ্যা করার জন্য যথেষ্ট না। সুতরাং আমরা ক্ষেত্র বিশেষে ট্র্যাডিশনের অনুসরণ করবো, একই সাথে নিজেদের চিন্তা ও ইজতেহাদের স্কোপও তৈরী করবো। এতে তারা ট্র্যাডিশন এবং মডারেশন উভয়টার মেলবন্ধন ঘটানোর চেষ্টা করেছেন।

এর পাশাপাশি আছে ট্র্যাডিশনের নারীবাদী পাঠ ও পুনর্পাঠ। যারা ভাবেন, আমাদের পুরাতন ট্র্যাডিশন মূলত পুরুষতান্ত্রিক । ফলে কুরআন ও হাদিসের যে ব্যাখ্যা এসেছে এবং এর উপর নির্ভর করে যে ফিকহ প্রকল্প গড়ে উঠেছে, তা প্রবলভাবে পুরুষতান্ত্রিকতায় আক্রান্ত। সুতরাং ট্র্যাডিশনকে হুবহু গ্রহণ করার সুযোগ নাই। বরং একে সংস্কারের মাধ্যমে তার ভিতরে বিদ্যমান পুরুষতন্ত্রকে দূর করতে হবে এবং ধর্মের সমতাপূর্ণ ব্যাখ্যা তৈরী করতে হবে।

আরও আছে, যারা নিজেদেরকে পুরোদস্তুর ঐতিহ্যবাদি হিসেবে দাবী করেন, কিন্তু চর্চার ক্ষেত্রে ‘সহজতর ফিকহ’ (فقه التيسير) কে গ্রহণ করে নিয়েছেন। অর্থাৎ, শরিয়াকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে ট্র্যাডিশনের মাঝে থাকা পূর্ববর্তী আলেমদের বিচ্ছিন্ন ও অনির্ভরযোগ্য মতামতগুলো প্রাধান্য দিয়ে, কিংবা তাদের উসূলের ভুল প্রয়োগ করে সহজতর একটা পথ তৈরী করে নেন। যেহেতু তার আহরিত উপাদান ট্র্যাডিশনের মধ্য থেকেই নেয়া, সে হিসেবে তাদের এ পদ্ধতিকেও তারা ঐতিহ্যবাদি হিসেবে চিহ্নিত করতে চান।

এখানে নির্দিষ্ট কোন দল বা ব্যাক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলা আমার লক্ষ্য নয়। বরং খুবই সংক্ষেপে সমাজে বিদ্যমান ট্র্যাডিশন কেন্দ্রিক চিন্তাগুলোর শিরোনাম উল্লেখ করতে চেয়েছি। প্রতিটি চিন্তার আলাদা আলাদা বিস্তারিত পর্যালোচনার প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও আপাতত সে সুযোগ এখানে নেই।

ঐতিহ্যবাদের নব জাগরণ

৯/১১ এর পর শুরু হওয়া পশ্চিমাদের ‘ওয়ার অন টেররের’ মূল টার্গেটে পরিণত হয় ট্র্যাডিশনাল ইসলাম। পুরো পৃথিবীজুড়েই ঐতিহ্যবাদিরা এক বড়সর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। পশ্চিমের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে মুসলিম দেশগুলোতেও তারা ক্রমশ প্রান্তিক মানুষে পরিণত হন। সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক মহল থেকে বিভিন্ন উপায়ে তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করা হতে থাকে। এবং দেশে থেকে ইসলাম বিদ্বেষী শক্তিগুলোও রাষ্ট্রীয় প্রচ্ছায়ায় তাদের বিরুদ্ধে একজোট হতে লাগলো। ফলে রাষ্ট্রীয় ও জনপরিসরের সকল স্তরে তাদেরকে ‘বিপদজনক অপর’ হিসেবে দেখার প্রচলনও শুরু হয়। ঐতিহ্যবাদি ইসলাম চর্চার কেন্দ্র, তথা মাদ্রাসা ও মসজিদগুলোকে আনা হয় কঠোর নজরদারিতে। একই সাথে ট্রাডিশনাল ইসলামের বিপরীতে ‘কালচারাল ইসলাম’ ও ‘মডারেট ইসলাম’ নামক ধারনাগুলিকেও আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় উপায়ে প্যাট্রোনাইজ করা হয়। এগুলোর প্রচার প্রসারে রাষ্ট্রীয় কিংবা বিদেশী এনজিওদের প্রণোদনায় গড়ে তোলা হয় বড়বড় প্রতিষ্ঠান, পত্রিকা, ওয়েবসাইট এবং সংগঠন ইত্যাদি । ট্র্যাডিশনাল ইসলামকে জনপরিসরে পরিচিত করে দেয়া হতে লাগলো গোঁড়া ও পশ্চাৎপদ হিসেবে।

ঐতিহ্যবাদি ইসলামের এই দুর্যোগপূর্ণ সময়েই আমরা দেখি সম্পূর্ণ বিপরীত দিক থেকে একটি দল এসে ঐতিহ্যবাদের ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছে। প্রত্যাবর্তনের এই চিত্র দেখা যায় পুরো পৃথিবীজুড়েই। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো, যারা আসছেন তাদের প্রায় সকলেরই একসময়ের ব্যাকগ্রাউন্ড ছিলো লিবারেল সেক্যুলার ধারার। বিশেষত রাষ্ট্রায়ত্ত স্যাকুলার বিদ্যালয়গুলোতে ট্র্যাডিশনাল ইসলামের ব্যাপারে রীতিমতো ঘৃণার উৎপাদন চলে। এমন একটা বিরুদ্ধ পরিবেশে লালিত-পালিত হয়েও তারা যখন ট্র্যাডিশনালিজমের দিকে প্রত্যাবর্তন করেন, তখন একেই মনেপ্রাণে গ্রহণ করে নেন, এবং এর মূল্যবোধ ও চেতনা রক্ষার জন্য নিজেদের সাধ্যানুযায়ী সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। শরিয়ার প্রতিটি বিধানাবলীকে আপোষহীন অনমনীয় অবস্থান থেকে বুঝতে চান এবং তা প্রচার করেন।

উদাহরণস্বরূপ একজনের নাম নেয়াই যায়। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন আলোচনা সমালোচনায় একজনের নাম প্রায়ই সামনে আসছে, ড্যানিয়েল হাকীকাতজু। তিনি জন্মসূত্রে ইরানীয় ইসনা আশারিয়া শিয়া ধর্মের অনুসারী। তার বেড়ে উঠা ও শিক্ষাদীক্ষা সম্পূর্ণ আমেরিকান স্যাকুলার সমাজে। হার্ভার্ডের মতো নামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলোসফিতে মাস্টার্স করেছেন। এমন একটা মনস্তাত্ত্বিক পর্যায় থেকে তিনি যখন ট্র্যাডিশনাল ধারায় ইসলামকে বুঝতে যান, তখন তিনি বিস্ময়করভাবেই ট্র্যাডিশনকে আত্মিকরণ করে নেন এবং ট্র্যাডিশনের ব্যাপারে অ-কৈফিয়তবাদী অবস্থান গ্রহণ করেন অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে। একক প্রচেষ্টায় muslim skeptic নামে অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি ওয়েবসাইট গড়ে তুলেন। যেটা খুব শিঘ্রই আমেরিকার ঐতিহ্যবাদি মুসলিমদের আস্থার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। আমেরিকার মতো দেশে, যেখানে মডার্নিস্ট ইসলামকে রাষ্ট্রীয় প্রটোকলে লালন-পালন করা হয়, ড্যানিয়েল একা সেইসব মডার্নিস্ট স্কলার ও শায়েখদের ব্যাপারে মুসলিমদেরকে সচেতন করা শুরু করেন। মডার্নিস্টদের সাথে ট্র্যাডিশনাল ইসলামের দ্বন্দ্ব এবং মডার্নিস্টদের দ্বীন বিকৃতির তথ্য-প্রমাণ প্রকাশ করতে থাকেন। ইয়াকীন ইন্সটিটিউট এর মতো শক্তিশালী ও রাষ্ট্র সমর্থিত প্রতিষ্ঠানের মডার্নিস্ট এজেন্ডার তত্ত্ব তালাশ করেছেন, এবং সেখানকার নামকরা জাদরেল স্কলার ও শায়েখদের এজেন্ডাগুলোকেও সকলের সামনে এনেছেন। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই এরকম ড্যানিয়েল আছেন, লেখা দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কায় তাদের আলোচনা আপাতত করা গেলো না।

বাংলাদেশেও আমরা এমন একটি বড়সড় দলকে পেয়েছি। যারা দেশের সেক্যুলার প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা লাভ করে পরবর্তীতে ট্র্যাডিশনাল ধারায় ফিরে এসেছেন। আমাদের দেশে একটা সময় পর্যন্ত ট্র্যাডিশনালিস্ট বলতে কওমি মাদ্রাসা ঘরানার লোকদেরকেই বুঝানো হতো। সেই চিত্রে এখন ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। এখন বিভিন্ন স্রোতের মোহনা এসে তৈরী হয়েছে ঐতিহ্যবাদের ছায়াতলে। শরিয়ার অ-বিকৃত ও অনমনীয় ব্যাখ্যার প্রচারক এখন একজন ডাক্তার কিংবা জীববিজ্ঞানীও। জিহাদ, খিলাফাহ, ইতিহাস, রাজনীতি, আকিদার মতো যাবতীয় বিষয়ে সমানভাবে কথা বলছেন, কলম তুলছেন। যেহেতু তাদের শিক্ষাদীক্ষা মূলত বিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস কিংবা চিকিৎসা কেন্দ্রিক, সে হিসেবে তারা তাদের অর্জিত শিক্ষাকে দ্বীন প্রচারের কাজেও সমানভাবে কাজে লাগাতে পারছেন। এর মাধ্যমে উলামা শ্রেণী এবং ভিন্ন ধারা থেকে আগত ট্র্যাডিশনালিস্টদের মাঝে যে মেলবন্ধন তৈরী হয়েছে, তা খুবই ফলপ্রসূ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের সক্রিয় বিচরণ অলক্ষ্যে বা অগোচরে থেকে যায়নি। ইতোমধ্যেই তারা সাধারণ জনমানুষের মাঝেও সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। সময়ের দাবী পূরণে এগিয়ে আসছেন অনেকে।

তবে এসবের পাশাপাশি আরও কিছু বিষয় লক্ষ্য রাখার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। প্রথমত, তারা যেহেতু দ্বীনি ইলম শিখার যে স্বীকৃত ও অনুসৃত ধারা রয়েছে এর ভেতর দিয়ে আসেননি, সেহেতু দ্বীনের একান্ত গভীর ও জটিল বিষয়ে নিজস্ব পড়াশোনার উপর নির্ভরশীল না থেকে বিজ্ঞ আলেমদের দ্বারস্ত হওয়াটাই নিরাপদ। এবং অতীব প্রয়োজন দেখা না দিলে লেখা ও বক্তব্যে সেসব বিষয়ের অবতারণা না করা। দ্বিতীয়ত, শরিয়ত যেসব ক্ষেত্রে বৈধ ইখতেলাফের সুযোগ রেখেছে, এবং পূর্ববর্তী আলেম উলামাগণ ইখতেলাফ করেছেন, সেসব ক্ষেত্রে অতিশয় কঠোরতা প্রদর্শন না করা, এবং যারা ভিন্নমত পোষণ করবে তাদের ব্যাপারে মন্দ ধারণা না রাখা।

তাদের অনেকে আবার দ্বীনের বিষয়ে সীমাতিরিক্ত চরমপন্থা লালন করেন। ‘চরমপন্থা’ শব্দটি যদিও এখন প্রবলভাবে রাজনৈতিক দোষে দুষ্ট, এর অন্যায় ব্যবহার আমরা দেখছি প্রতিনিয়তই। কিন্তু একটা পর্যায় পর্যন্ত এর বাস্তবতা অস্বীকার করারও সুযোগ নেই। কুফর ও তাকফীর বিষয়ে অনেকে এর শিকার হচ্ছেন। কোনো প্রকারের উসূল ও কাওয়ায়েদ ব্যতীত যত্রতত্র এগুলোর প্রয়োগ বড় ধরনের ফেতনা তৈরী করার আশঙ্কা রাখে। বরং এ ক্ষেত্রেও আমাদের সমৃদ্ধ তুরাস ও ট্র্যাডিশনে যা আছে তার অনুগামী হওয়াই সবচে নিরাপদ।

ঐতিহ্যবাদের এই নব জাগরণ নিঃসন্দেহে দ্বীনেরই পুনর্জাগরণ। শত প্রতিকূলতা ও বাধা বিপত্তির মাঝেও আল্লাহ তার দ্বীনের বিশুদ্ধতা ও অখণ্ডতা সমুন্নত রেখেছেন এর মাধ্যমে। এবং কেয়ামত পর্যন্ত এভাবেই এর ধারাবাহিকতা বজায়ে থাকবে, ইনশাআল্লাহ । যেমনটা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন এক বিখ্যাত হাদীসে—
«لا تزال طائفة من أمتي ظاهرين على الحق لا يضرهم من خذلهم حتى يأتي أمر الله وهم كذلك»

অর্থাৎ , আমার উম্মতের একটি দল সর্বদাই হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। যারা তাদের শত্রুতা করবে তারা তাদের কোন ক্ষতিই করতে পারবে না। কেয়ামত পর্যন্ত তারা এভাবেই (হকের উপর প্রতিষ্ঠিত) থাকবে।

বুখারী মুসলিম সহ প্রসিদ্ধ সকল হাদিসের সংকলনেই হাদিসটি এসেছে। এর ব্যাখ্যায় শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, এই হাদিসে রাসুল সা. স্পষ্টতই বলে দিচ্ছেন, একটা সময়ে দ্বীনের ভেতর বিভিন্ন মত পথ ও বিভেদ তৈরী হবে। উসূলে দ্বীনের ব্যাপারেও মানুষ মতপার্থক্য করবে। এজন্য আল্লাহ একটি মাত্র দলকে সেই কাঙ্খিত হকের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখবেন, যারা রাসূল সা. এবং তার সাহাবিদের দেখানো পথের অনুসরণ করবে, এবং কোনো প্রকারের বিভ্রান্তিতে পতিত হবেনা। এদেরকেই মুক্তিপ্রাপ্ত দল (الفرقة الناجية) হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। (ইবনে তাইমিয়া-শরহু হাদিসিল ইফতেরাক্ব)

আগের সংবাদকুয়েতের বিশ্ব কোরআন প্রতিযোগিতায় তৃতীয় বাংলাদেশের আবু রাহাত
পরবর্তি সংবাদরোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে রাজি মিয়ানমারের জান্তা সরকার : পররাষ্ট্রমন্ত্রী