রাকিবুল হাসান নাঈম:
কওমি মাদরাসা থেকে গ্রাজুয়েট করা শিক্ষার্থীরা কর্মের খোঁজে বেরিয়ে জটিলতার মুখে পড়ছে। প্রতি বছর কওমি মাদরাসা থেকে গ্রাজুয়েট করছে গড়ে পনেরো হাজার শিক্ষার্থী। তাদের অধিকাংশই মসজিদ-মাদরাসায় নিয়োগ পাচ্ছে না কিংবা বিভিন্ন কারণে মাদারাসা-শিক্ষকতায় আগ্রহী হচ্ছে না। তারা বাইরে কর্মক্ষেত্রে গিয়ে খাপ খাওয়াতে পারছে না নিজেদের। মাস্টার্স সমমান সনদ থাকলেও অংশ নিতে পারছে না কোনো সরকারি পরীক্ষায়। ইচ্ছে হলেই যেতে পারছে না উচ্চশিক্ষার নিমিত্তে বাইরের কোনো দেশে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমকালীন পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে এসব ঘটছে। এতে গ্রাজুয়েটদের যেমন দায় আছে, দায় আছে মাদারাসার শিক্ষকদেরও। এই দুদলকেই নিয়েই কাজ করতে পারে কওমি শিক্ষাবোর্ড।
জটিলতা কোথায়
কথা হয় রাজধানীর এক মাদরাসা-শিক্ষকের সঙ্গে। তার অভিজ্ঞতায় জটিলতার স্বরূপ জানতে চাইলে তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘প্রতি বছর যত শিক্ষার্থী গ্রাজুয়েট হচ্ছে, তাদের সমসংখ্যক পদ তো তৈরী হচ্ছে না। তারা সবাই নিয়োগ পাচ্ছে না মসজিদ-মাদরাসায়। ফলে তাদের বাইরের কর্মস্থানে পা বাড়াতে হচ্ছে। কিন্তু মাদারাসার বর্তমান এই সিলেবাসে পড়াশোনা করে তারা বাইরে গিয়েও তেমন সুযোগ পাচ্ছে না। পেলেও এমন কাজে সুযোগ পাচ্ছে, এত কম বেতন, যা তার সঙ্গে বেমানান।’
এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘বর্তমানে ইসলামি প্রকাশনার জগতে লেখালেখির একটা স্রোত তৈরী হয়েছে। সেখানেও কিন্তু পদ স্বল্পতা। হাতেগোনা কয়েকজন সেখানে যুক্ত হতে পারছে। বাকিরা কোথাও সুযোগ না পেয়ে ব্যবসায় নামছে। এটাকেও আমি জটিলতা হিসেবে দেখছি। একজন ছাত্র গ্রাজুয়েট হচ্ছে, কিন্তু তার পড়ালেখা দিয়ে কিছু করত পারছে না।’
বেফাক-সংশ্লিষ্টদের ভাবনা
কর্মসংস্থানের এই জটিলতা স্বীকার করেছেন বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের সহকারী পরিচালক মাওলানা যুবায়ের আহমাদ। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘বর্তমান বাজারের মূল্যস্ফীতির কারণে মাদরাসার বেতনে অনেকের হয় না। পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। ফলে অনেকে মাদরাসায় না এসে বাইরে কোনো কর্মস্থানে যোগ দিতে চায়। অনেক শিক্ষার্থী বিভিন্ন জায়গায় নিয়োগের পরীক্ষার জন্য সার্টিফিকেট তুলে নিয়ে যান। এক শিক্ষার্থী ইসলামি ব্যাংকে আবেদন করেছির। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পরও তাকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। কারণ, তাকে দিয়ে সব কাজ করাতে পারবে না। এই জটিলতার মুখোমুখি শিক্ষার্থীরা হচ্ছে।’
জটিলতা নিরসনে তিনি বলেন, ‘মাদরাসা কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকদের প্রচেষ্টা এই জটিলতা কিছুটা হলেও কমাবে। শিক্ষকদের ভেবে দেখতে হবে, পড়া শেষ করে এই শিক্ষার্থী কর্মক্ষেত্রে যাবে। এজন্য অভিজ্ঞ হতে দরকারি যা কিছু লাগে, তার ব্যবস্থা তাকে করে দিতে হবে। দরকার হলে ছাত্রদেরকে বিভিন্ন শাখায় ভাগ করে পড়াবে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে এটা জরুরী। কারণ, এখন মাদরাসার তুলনায় গ্রাজুয়েটদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। তাদেরকে বাইরে কাজ করতেই হবে।’
হাইয়া-সংশ্লিষ্টদের ভাবনা
কর্মসংস্থানের জটিলতা কথা স্বীকার করলেও তা শিক্ষার্থীদের কারেণেই বলে মনে করেন কওমি শিক্ষাবোর্ডগুলোর সমন্বিত বোর্ড হাইয়াতুল উলয়ার সদস্য মুফতি মোহাম্মদ আলী। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘জটিলতা তৈরী হচ্ছে গ্রাজুয়েটদের কারণে। সবাই শহরে-রাজধানীতে থাকতে চায়। শহরে তো এত মানুষের কর্মসংস্থান নেই। এমন অনেক জেলা আছে, সেখানের মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা দরকার। যেগুলো প্রতিষ্ঠিত আছে, সেগুলোতে দরকার শিক্ষক। কিন্তু শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছে না। যারা গ্রাজুয়েট হচ্ছে, শিক্ষকতার মানসিকতা নিয়ে তারা গ্রাজুয়েট হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘কওমি মাদরাসার লক্ষ্য হলো, দ্বীনের কল্যানে কাজ করা। কর্মজীবনেও দ্বীন প্রতিষ্ঠারই চেষ্টা করা। সেই লক্ষ্যেই মাদরাসায় পড়ানো হয়। ফলে এখানে পড়ে কার্পোরেট সবখানে কাজ করতে পারে না কেন, তা প্রশ্ন করাই ঠিক না। যদিও অনেকেই কাজ করছে। তাই, শিক্ষকদের দায়িত্ব হলো, শিক্ষার্থীদেরকে কওমি মাদরাসার লক্ষ্য বোঝানো। সেই লক্ষ্যেই তাদেরকে তৈরী করা।’
এই জটিলতা কমাতে বোর্ডের তৎপরতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি হাইয়াতুল উলয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, সনদ কার্যকর করার। আমরা জোর তৎপরতা শুরু করেছি, যেন কওমি সনদ দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মশিক্ষক, মডেল মসজিদে নিয়োগ, বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা যায়। সফল হলে জটিলতা অনেকটা কমবে। পাশাপাশি যারা উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরে যেতে চায়, তাদের জটিলতা নিরসনেও কাজ শুরু হয়েছে।’