কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশনে ধর্ম ও ধর্মীয় শিক্ষা

এহসানুল্লাহ জাহাঙ্গীর:

বলা হয় যে— শিক্ষা জাতির দর্পণ। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। সে হিসেবে জাতীয় শিক্ষানীতির গুরুত্ব একটি দেশের জন্য নিঃসন্দেহে অপরিসীম। মূলত শিক্ষা হলো অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের মতোই মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। উপযুক্ত শিক্ষা ছাড়া যেমন কোনো জাতির যথাযথ বিকাশ সম্ভব নয়। তেমনি জাতি হিসেবে পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্যেও শিক্ষা অপরিহার্য। ভালোভাবে লক্ষ করলে দেখা যায়, কোনো জাতির পশ্চাৎপদতার সবচেয়ে বড় কারণ প্রয়োজনীয় শিক্ষার অভাব। তবে সেই শিক্ষা কোনো গৎবাধা শিক্ষা নয়। হতে হবে নৈতিকতা, আদর্শ, চেতনা ও বিশ্বাসে সমুন্নত। আধ্যাত্মিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধে উন্নীত। এখন কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের শিক্ষানীতি আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্যে পূরণে কেমন ভূমিকা রাখছে? বিশাল একটি জাতিগোষ্ঠী মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষাদীক্ষায় কতটুকু পৃষ্ঠপোষকতা করছে? এসব জানতেই আমরা এখন খতিয়ে দেখব বাংলাদেশের সর্বশেষ শিক্ষা কমিশন— জাতীয় অধ্যাপক ‘কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশন’ এর শিক্ষানীতি।

১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর শিক্ষা কমিশন গঠনের পূর্ব পর্যন্ত আরো ৬টি শিক্ষা কমিশন কমিটির মাধ্যমে শিক্ষানীতি প্রণীত বা সংস্কার হলেও কোনো শিক্ষানীতি পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। দু-একটি আংশিক বাস্তবায়ন হলেও অধিকাংশই আলোর মুখ দেখেনি। কারণ প্রতিটি সরকারই মেয়াদের শেষ দিকে এসে শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলে সেটি সম্ভব হয়নি। এবং পরবর্তী সরকারও পূর্ববর্তী সরকারের প্রণীত শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের উদ্যোগ না নিয়ে নিজেদের কৃতিত্ব দেখাতে নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এভাবেই সর্বশেষ বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার ১৯৭২ সালের ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট এবং ২০০০ সালের ড. শামসুল হক শিক্ষা কমিশন রিপোর্টকে সামনে রেখে ২০০৯ সালের ৬ এপ্রিল অধ্যাপক কবির চৌধুরীকে চেয়ারম্যান এবং ড. খালেকুজ্জামানকে কো-চেয়ারম্যান করে ১৮ সদস্যের শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি শিক্ষানীতির চূড়ান্ত খসড়া ২রা সেপ্টেম্বর ২০১০ সালে সরকারের কাছে পেশ করে এবং ১৭ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদে এই শিক্ষানীতি পাস হয়। সরকার শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে ২৪ টি সাবকমিটির মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে।

অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত প্রাক- কথন এবং শিক্ষামন্ত্রী প্রদত্ত মুখবন্ধ সহ এতে মোট ২৮টি অধ্যায় এবং ২টি সংযোজনীসহ সাধারণের সামনে আসার পর দুধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। একদল এর ঘোর বিরোধিতা করে। কেননা এই শিক্ষানীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে আছে সেক্যুলারতন্ত্র এবং ইসলামের আদর্শ ও মূল্যবোধবিরোধী চেতনা। তাদের কথা হচ্ছে, ১৯৭৪ সালে প্রণীত ড. কুদরতে খুদা, ১৯৯৭ সালে ড. শামসুল হক শিক্ষা কমিশনই হচ্ছে বর্তমান শিক্ষানীতির মূল ভিত্তি। আর এই দু’টি নীতিই দেশের আপামর জনসাধারণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কারণ উক্ত নীতির লক্ষ্য হিসেবেই বলা হয়েছিল, সমাজতান্ত্রিক ধ্যান ধারনায় বিশ্বাসী এবং সমাজতান্ত্রিক দর্শনের নীতিমালা সম্পন্ন চরিত্রবান নাগরিক গড়ে তোলা। শামসুল হক শিক্ষা নীতিও প্রায় এক ও অভিন্ন নীতির উপরই প্রতিষ্ঠিত। অবশ্য আরেকটি দল এর স্বপক্ষে আঁটঘাট বেঁধে নেমে যায়। তাদের মতে এতে আছে, প্রগতি, সেক্যুলারতন্ত্র, নারীবাদ ও স্বাধীনতামুখী শিক্ষা। এই শিক্ষা পেলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে, প্রান্তিক, সাম্প্রদায়িক ও ধর্মভিত্তিক চিন্তা থাকবে না। জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য ডক্টর মো. আখতারুজ্জামান—তিনি তার একটি প্রবন্ধে বলেন, “শিক্ষানীতির সমালোচনা করে কিছু পেশাজীবী সংগঠন স্ববিরোধী বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তারা বলেন, ‘‘ইতোপূর্বেকার কুদরাত-ই-খুদা ও শামসুল হক শিক্ষা কমিশনে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা গুরুত্ব না পাওয়ার বরাবরই এ-জাতি সে বিষয়ে আপত্তি তুলেছে। বর্তমানে প্রণীত শিক্ষানীতি ২০১০-কেও খুদা এবং হক কমিশনেরই প্রতিরূপ (replica) বলে মনে হয়েছে। এজন্যই এ শিক্ষানীতিতে অনেক ভাল প্রস্তাব থাকার পরও জাতি তা মেনে নিতে প্রস্তুত বলে মনে হয় না।’’ তারা আরো বলেন, ‘এ শিক্ষানীতি বাস্তাবায়িত হলে একজন সাধারণ ধারার শিক্ষার্থী শিক্ষা জীবনের সূচনা হতে প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করা ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে। তাই দেশ ও জাতির স্বার্থে এ-শিক্ষানীতি কোন অবস্থাতেই বাস্তবায়িত হতে পারে না।’’ (জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০, পর্যালোচনা মন্তব্য ও পরামর্শ, বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক পরিষদ, ঢাকা, ৬ ডিসেম্বর ২০১০, পৃ.৪, ১৬) প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ একমাত্র শিক্ষানীতি যেখানে শিক্ষাধারা নির্বিশেষে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়টি বাধ্যতামূলক। সুতরাং উল্লিখিত মন্তব্য যে ভিত্তিহীন, মনগড়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও উস্কানিমূলক তাতে কোন সন্দেহ নেই।”

এ থেকে সহজেই অনুমেয় যে, অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর শিক্ষা কমিশনের শিক্ষানীতি ধর্মীয় শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করেইনি, বরং কৌশলে এই শিক্ষানীতির মাধ্যমে ইসলামফোবিয়া ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। যদিও দাবি করা হয়েছে, ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়টি বাধ্যতামূলক।’ কিন্তু স্কুলগুলোতে একটু খোঁজখবর নিলেই জানা যায়, বাস্তবে ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ কতটা উপেক্ষিত। প্রথমত ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বিজ্ঞ ও সর্বজন স্বীকৃত কোনো ধর্মীয় ব্যক্তি এর সিলেবাসের কাজে যুক্ত নেই। দায়সারাভাবে করা হয়েছে এর কাজ। দ্বিতীয়ত পাঠদানের ক্ষেত্রে রয়েছে অভাবনীয় শিথিলতা। এমনও সংবাদ শোনা গেছে, ‘ইসলাম ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বই পড়ান কোনো হিন্দু শিক্ষক কিংবা শিক্ষিকা। হিন্দু ধর্ম শিক্ষা কী কোনো মুসলিম পড়ান কিনা সেটা অবশ্য আমার জানা নেই! ধর্মীয় বইগুলো হয়তো সপ্তাহে একদুইবার ক্লাস করানো হয়। কোথাও তো মাসের পর মাস যায় ধর্মীয় বই কোথায় থাকে শিক্ষার্থীরা জানেই না। এক তো এই সমস্ত বইয়ে ধর্ম সম্পর্কে যথাযথ পাঠও নেই। যা আছে কেবল দায়সারাগোছের। তারপর পড়ানও ধর্মের মর্ম সম্পর্কে অনবগত কোনো ব্যক্তি। যার নিজেরই ধর্ম ও নৈতিকতা নিয়ে জানাশোনা নেই—তিনি কীভাবে ধর্মের সঠিক প্রতিনিধিত্ব করবেন? সুতরাং এমন ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ পড়ানোর ফলাফল কী আসবে এবং কী আসছে—সেটা অবশ্য সবারই জানা। সুতরাং শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত একটি স্বাধীন দেশের যে জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষার প্রতিটি স্তরে উপযুক্ত ধর্মীয় শিক্ষা আবশ্যিক হিসাবে থাকবে না, সেটা জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয় কিভাবে?

জাতীয় শিক্ষানীতির চূড়ান্ত খসড়ার প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার কৌশল ৪-এ বলা হয়েছে, ‘মসজিদ, মন্দির, গীর্জা ও প্যাগোডায় ধর্ম মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত সকল ধর্মের শিশুদেরকে ধর্মীয় জ্ঞান, অক্ষরজ্ঞানসহ আধুনিক শিক্ষা ও নৈতিকতা শিক্ষা প্রদানের কর্মসূচি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার অংশ হিসেবে গণ্য করা হবে’।(পৃষ্ঠা: ১০) এই নীতির মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষা উপেক্ষার চূড়ান্ত রূপ ফুটে উঠেছে। মূলত এর মাধ্যমে ধর্মশিক্ষাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ, রাষ্ট্র থেকে আলাদা করার বিশেষ এক কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। কেননা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে যেসব মক্তব চালু আছে সেসবের হাল-হাকিকত সকলেরই জানা থাকার কথা। নিয়মতান্ত্রিক চালু এমন মক্তব খুবই কম। তাছাড়া সংখ্যায় এত কম যে এগুলো মূল চাহিদার দুই পার্সেন্টও পূরণ করতে পারছে না। এরপর এইসব মক্তবের পড়াশোনা এতটাই মানহীন যে—দায়িত্বশীল কোনো অভিভাবক এগুলোতে নিজ সন্তান পাঠায় না। অনেক জায়গায় এমনও দেখা যায়, মক্তবের পরিচিতি দিয়ে বোর্ড টানিয়ে রেখেছে ঠিকই আদতে এখানে পড়াশোনার কোনো বালাই নেই। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মক্তবের বোর্ড টানিয়ে নতুন একটি খাত তৈরি করে দলীয় নেতাকর্মীদের টাকা কামানোর একটি উপযুক্ত পন্থা ছাড়া এগুলো আর কিছুই নয়।

জাতীয় শিক্ষানীতির ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ শীর্ষক অধ্যায়ে একটি ধারায় বলা হয়েছে, “প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার ধারা নির্বিশেষে সকল শিক্ষার্থীকে নির্ধারিত বিষয়ে অর্থাৎ বাংলা, ইংরেজি, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, বাংলাদেশ স্টাডিজ, গণিত, প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিচিতি এবং তথ্য প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বাধ্যতামূলকভাবে পড়তে হবে;” অথচ কার্যক্ষেত্রে ১ম ও ২য় শ্রেণীতে ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এদিকে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ধর্মীয় শিক্ষার কোন ব্যবস্থা না থাকায় একজন শিশু তৃতীয় শ্রেণীতে উঠার পূর্ব পর্যন্ত তিন বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একবারের জন্যও আল্লাহ, নবি-রাসূল, জান্নাত-জাহান্নাম, খেলাফাহ-জিহাদ ইত্যাদির মতো ইসলামী শব্দগুলো শুনতে পাবে না। অথচ তার কচি হৃদয়ে গেঁথে দেওয়া হচ্ছে— বিভিন্ন মিথ্যা বানোয়াট কল্পকাহিনী। শিল্প-সাহিত্য চর্চার নামে তাদেরকে শেখানো হচ্ছে— ইসলামে নিষিদ্ধ বিভিন্ন প্রাণীর ছবি আঁকাআঁকি। সহশিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে ছেলেমেয়েদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে, অবৈধ প্রেম-ভালোবাসা। ধর্মীয় চেতনা ও অক্ষরজ্ঞানহীন এই শিক্ষার্থী বড় হয়ে যখন জানতে পারবে প্রাণীর ছবি আঁকা ইসলামে নিষিদ্ধ, ধর্মীয় ব্যক্তিরা জিহাদের কথা বলে, প্রেম-ভালোবাসা হারামের কথা বলে— তখন সে ইসলামের বিধানের ওপর আঙুল তোলবে। বলবে, হুজুররা সেকেলে। এখনো অন্ধকারেই পড়ে আছে। জিহাদকে সন্ত্রাস কিংবা নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করবে। আর এভাবেই কী বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে জাতীয় শিক্ষানীতির অন্যতম উদ্দেশ্য; যা বলা হয়েছে— ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’- “এই শিক্ষানীতি সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে সেক্যুলার, গণমুখী, সুলভ, সুষম, সর্বজনীন, সুপরিকল্পিত এবং মানসম্পন্ন শিক্ষাদানে সক্ষম শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি ও রণকৌশল হিসেবে কাজ করবে।”(পৃষ্ঠা:৭)

দেশের ৯০% মুসলিমরা তো এদেশে সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা চায় না। দেশের মানুষের আশা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আক্বীদা-বিশ্বাস, কৃষ্টি-সভ্যতা ইত্যাদির সমন্বয়ে ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা। তাহলে শিক্ষানীতির ‘মুখবন্ধ’ -এ সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদের বক্তব্য ‘‘এটা কোন দলীয় শিক্ষানীতি নয় – জনগণ তথা জাতির আকাঙ্খা ও প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটিয়ে তৈরি করা হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতি।” কোনদিনে ইঙ্গিত করছে? গুটিকয়েক সেক্যুলারের আকাঙ্ক্ষাই কি তাহলে ৯০% মুসলিমের আকাঙ্ক্ষার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ? এটা কি তাহলে “চোরের মন পুলিশ পুলিশ” আচরণ নয়?

অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর শিক্ষানীতির পূর্বের শিক্ষানীতি যদিও মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা সঠিকভাবে কিছুটা করেছে বলেও দাবি করা যায় না; তবুও এই শিক্ষানীতির মতো এতটা সেক্যুলারঘেষা ছিল না। এই শিক্ষানীতি ধর্মহীনতার ক্ষেত্রে এতটা এগিয়ে গেছে—গভীরভাবে ভাবতে গেলে বিস্ময়ে থ বনে যেতে হয়। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও চেতনাকে এমনভাবে চেপে গেছে—ভাবতেও অবাক লাগে। পূর্বের শিক্ষানীতিতে প্রণীত পাঠ্যপুস্তকে ছিল এমন ১৭টি রচনা বাদ দেওয়া হয়েছিল এবং নতুন যুক্ত করা হয়েছিল সেক্যুলার ও হিন্দুত্ববাদী চেতনাসম্পূর্ণ ১২টি কবিতা, গল্প ও বিভিন্ন রচনা। অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর শিক্ষা কমিশনের শিক্ষানীতির সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়ন লক্ষ্যে ২০১২ সালে পাঠ্যবইয়ে এমন ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এরপর যখন ২০১৩ সালে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছায় এই নতুন বই—তখন বিভিন্ন মহল থেকে জোর প্রতিবাদ আসে। বিশেষত হেফাজতে ইসলাম এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আন্দোলনের দাবি ছিল এমন,“স্কুল-কলেজ পাঠ্যপুস্তক থেকে নাস্তিক্যবাদ ও হিন্দুত্ববাদের বিষয়গুলো বাদ দিয়ে তদস্থলে বৃহৎ মুসলিম জনগোষ্ঠির ধর্মীয় চিন্তা ও আদর্শের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ইসলামী ভাবধারা এবং মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি উদ্বুদ্ধকরণ মূলক রচনা, গল্প ও কবিতা যুক্ত করতে হবে।” বিবৃতিতে হেফাজত নেতৃবৃন্দ হুঁশিয়ারী দিয়ে বলেন, “সরকার নাস্তিক্যবাদ ও হিন্দুত্ববাদের শিক্ষায় ভরপুর বিদ্যমান পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও ইসলাম বিরোধী শিক্ষানীতি পরিহার না করলে, উলামা-মাশায়েখের নেতৃত্বে স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার ছাত্রসমাজ এবং সাধারণ তৌহিদী জনতার অংশগ্রহণে সম্মিলিতভাবে দূর্বার কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলে দাবী পুরণে বাধ্য করা হবে।”

শেষ পর্যন্ত গণমানুষের তুমুল আন্দোলনের মুখে সর্বশেষ ২০১৭ সালে পুনরায় আগের পাঠ্যবইয়ের আদলে নতুন পাঠ্যবই তৈরি করা হয়। কিন্তু পূর্ব থেকে চলে আসা অসঙ্গতিগুলো বাদ পড়েছে? যারা সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চায় তারাই কি আর থেমে গেছে? প্রগতিশীল শিক্ষক নিয়োগের নাম দিয়ে কি সেক্যুলার শিক্ষকের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ব্রেইন ওয়াশের কাজ যথারীতি চলছে না?

এখন আমি এই শিক্ষানীতির কয়েকটি মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মোটা দাগে দেখাব— যেগুলো ইসলামের সাথে মৌলিকভালো সাংঘর্ষিক।
১. সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা।
২. জনগণের মধ্যে ধর্ম নিরপেক্ষতাবোধ জাগ্রতকরণ।
৩. অসাম্প্রদায়িক শিক্ষার্থী গঠন।
৪. সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে সম-মৌলিক চিন্তা চেতনা সৃষ্টিকরণ।

এখানে প্রথম পয়েন্টটি সবশেষে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা মানেই যেখানে ধর্মের কোনো বাঁধন থাকবে না। ধর্মের সঙ্গে এর আলো অন্ধকারের সম্পর্ক। একটি থাকলে অপরটি থাকা সম্ভব নয়। পরবর্তী পয়েন্টগুলো এর সংযোগী। কারণ ধর্মনিরপেক্ষ এর সাধারণ অর্থ হলো ধর্মের ব্যাপারে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করা। অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের ভ্রাতৃত্ববোধে সে বিশ্বাসী হতে পারবে না। ধর্মের ভিত্তিতে এক হওয়া যাবে না। মুসলিম জাতিগতভাবে বিজয়ী হওয়ার কোনো প্রচেষ্টাও করতে পারবে না। বলা যাবে না, ইসলামই একমাত্র সঠিক ধর্ম। বলা যাবে না, আমাদের রাসূল পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। অথচ আল্লাহতে বিশ্বাসী একজন মুসলিমের পক্ষে ধর্মের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকার কোনই সুযোগ নেই। তৃতীয় পয়েন্ট—তথা অসম্প্রদায়িক বলতে তারা কী বোঝায়? ধর্মের ভিত্তিতে কোনো চিন্তা করা যাবে না? ধর্মীয় চেতনায় বিশ্বাসী হওয়া যাবে না। ধর্মের ভিত্তিতে সম্প্রদায় গড়া যাবে না? সমস্ত ধর্মের লোকদেরই তো সম্প্রদায়ভুক্ত থাকতে দেখা যায়। কুরআনের-হাদিসের ভাষ্য থেকেও তো বোঝা যায়, ইসলাম সাম্প্রদায়িক চিন্তায় বিশ্বাসী। ইসলাম তো বলে ইসলামই একমাত্র সঠিক ধর্ম। আমরা কি তাহলে কুরআন-হাদীস ছেড়ে সেক্যুলার চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে যাব?ইসলামের শিক্ষাই হচ্ছে, নিজ ধর্ম বা আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা, বিশ্বাস, ভালবাসা, মমত্ববোধ এবং অপর ধর্মের প্রতি পরম সহিষ্ণুতা। সুতরাং সাম্প্রদায়িক-অসাম্প্রদায়িক এসব প্রশ্ন তোলা এখানে অবান্তর। চতুর্থত সম-মৌলিক চিন্তাবিশ্বাসী হতে বলা হয়েছে। সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে সম মৌলিক চিন্তা-চেতনা গড়ে তোলার নীতি যৌক্তিক ও বাস্তবানুগ নয়। কারণ মানুষের চিন্তা ও চেতনা তার ধর্মীয় বিশ্বাস, কর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এক্ষেত্রে বরং শিক্ষার্থীদের স্ব স্ব ধারার শিক্ষার ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্য রক্ষা করে মৌলিক বিষয়ের সমমানের জ্ঞান অর্জনের ব্যবস্থা করাই যুক্তিযুক্ত। মূলত সম-মৌলিক চিন্তাবিশ্বাসী বলতে কি বুঝানো হচ্ছে? প্রগতিশীল সেক্যুলার, পুঁজিবাদী, সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী চিন্তা? অথবা অসম্প্রদায়িক চিন্তা? কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা? নাকি হিন্দুত্ববাদী চিন্তা? আমরা তো এসব চিন্তায় বিশ্বাসী নই। আমরা নিরেট কুরআন-সুন্নাহর চিন্তায় বিশ্বাসী। কে কীভাবে যুক্তি দিল সেটা আমরা যাচাই করি কুরআন-সুন্নাহর কষ্টিপাথরে। সুতরাং এসব অনৈতিক কথা আমাদের মৌলিক আদর্শ ও লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না। আচ্ছা, এরপরও কীভাবে বলা যায়, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশন প্রণীত শিক্ষানীতি ধর্ম ও ধর্মীয় শিক্ষার আনুকূল্যে ছিল?

আগের সংবাদ১১৬ আলেমের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান হচ্ছে না: দুদক সচিব
পরবর্তি সংবাদপদ্মা সেতুর দুয়ার খুললো