কাতারের ধর্মীয় স্থপতি : কারজাবীর সাথে কাতারের সম্পর্ক

ডেভিড ওয়ারেন

কাতারের উপর প্রতিবেশী রাষ্ট্র সৌদি আরবের নেতৃত্বে সংযুক্ত আরব আমিরাত কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার ফলে যে সংকট তৈরী হয়েছে তা নিরসনের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। যারা উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতির সাথে পরিচিত, তারা কাতার বিরোধী অঞ্চলগুলোর ঘোষিত বর্তমান সঙ্কটের কারণগুলোর ব্যাপারেও হয়ত অবগত থাকবেন: ইরানের সাথে কাতারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক, তাদের জনপ্রিয় টেলিভিশন নেটওয়ার্ক আল জাজিরা এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি দেশটির সমর্থন। বস্তুত, সৌদি আরব ও এর মিত্ররা কাতারের প্রতি ১৩টি দাবির যে তালিকা প্রকাশ করেছে তার সময়সীমা সোমবার ৩ জুলাইয়ে শেষ হয়ে যাবে, যা ভবিষ্যতে সংকটটির আরো গুরতর আকার ধারণ করারই ইঙ্গিত দেয়। অন্যদিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর দাবিগুলো কাতার মেনে নিলে এটি কার্যকরভাবে একটি পুতুল রাষ্ট্রে পরিণত হবে।

৫ জুনে সৃষ্ট এই সঙ্কটের প্রাক্কালেই বিশ্লেষকরা কাতার ও এর প্রতিবেশী গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) পররাষ্ট্র নীতির পার্থক্যের উপর জোর দিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন। উদাহরণস্বরূপ, কাতার ইরানের সাথে তুলনামূলকভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায়ে রেখে এসেছে, এবং তারা যৌথভাবে বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক প্রাকৃতিক গ্যাস ক্ষেত্রগুলি নিয়ে কাজ করছে। কাতারের নিউজ নেটওয়ার্ক আল-জাজিরা ২০১১ সালের গণজাগরণকে উৎসাহিত করেছিল, যেখানে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সেই বিপ্লবের বিরোধী ধারার নেপথ্যে ছিল। এই নানানধর্মী নীতিগুলোর মধ্যে পার্থক্য আরো ব্যাপকভাবে পরিষ্কার হয় মিশরের ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে। সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ৩ জুলাই ২০১৩ তে সংঘটিত ক্যু এর শক্তিশালী সমর্থক ছিল, যে ক্যু তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে আর অন্যদিকে কাতার মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি তার সমর্থন অব্যহত রেখেছে।

মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি কাতারের সমর্থনের ব্যাখ্যা: ক্বারাদাওয়ী ফ্যাক্টর

শেষ এই বিষয়টিই আমি এখানে আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব। কাতারের স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি এবং মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড, গাজা (হামাসের মাধ্যমে) এবং লিবিয়া ও সিরিয়ায় ব্রাদারহুড সংশ্লিষ্ট মিলিশিয়াদের প্রতি রাষ্ট্রটির সমর্থনের উপর জোর আরোপ করা হলেও এত চড়া মূল্য দিয়ে কাতার কেন এই নীতি অনুসরণ করে যাচ্ছে সে ব্যাপারটি আলোচনার বাইরে থেকে যায়। অনেকেই এই সমর্থনগুলোকে অবশ্যম্ভাবী ধরে নেন কিংবা গতানুগতিক রাজনীতি বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের পেশীশক্তি প্রদর্শনের রাজনীতির অংশ হিসেবে ধরে নেন। প্রকৃতপক্ষে, সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি কাতারের সমর্থন এই ধারণার বিপরীত। কারণ গণতন্ত্রের প্রতি ব্রাদারহুডের সমর্থন কাতারের রাজতন্ত্র ব্যবস্থার বিপরীত, এমনকি তার জন্য সম্ভাব্য হুমকিস্বরূপ বললেও ভুল হবে না। উপরন্তু, ওয়াহাবিজম সংশ্লিষ্ট বহু রক্ষণশীল মূল্যবোধের বিষয়ে কাতারের সাথে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সামঞ্জস্যতা রয়েছে, যা আবারও মুসলিম ব্রাদারহুডের মত একটি সামাজিক আন্দোলনের প্রতি এই দেশের সমর্থনকে অনাকাঙ্খিত প্রমাণ করে।

আমার প্রস্তাবনা হল মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি কাতারের সমর্থনের পেছনে দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে এবং তা শুরু হয়েছে সেদেশে শাইখ ইউসুফ আল-ক্বারাদাওয়ী আগমনের সময়। ক্বারাদাওয়ী আরব বিশ্বজুড়ে একটি পরিচিত নাম এবং তিনি এ অঞ্চলের সবচেয়ে স্বীকৃত ‘আলেম।

তিনি ১৯২৬ সালে মিশরে জন্মগ্রহণ করেন এবং হাসান আল-বান্নার আদর্শ তাঁকে আকৃষ্ট করে। সেই উলামাদের মধ্যে তিনিও একজন ছিলেন যারা মিশরের বিখ্যাত ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আল-আজহারে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন পদগ্রহণের বদলে মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগদান করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। ক্বারাদাওয়ীকে দুইবার ব্রাদারহুডের মুর্শিদে ‘আমের পদ দেয়া হয়, দুইবারই তিনি তা নিতে অস্বীকার করেন। কিন্তু তিনি বহুদিন ধরেই আন্দোলনের জন্য একজন রুহানী দিকনির্দেশক বা শিক্ষক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন। কাতারের সমাজ ও স্থানীয় ধর্মীয় দৃশ্যেপটের উপর ক্বারাদাওয়ীর প্রভাব এটাই নির্দেশ করে যে ব্রাদারহুডের জন্য কাতারের বৃহত্তর সমর্থন কেবল ক্ষমতার রাজনীতি সংশ্লিষ্ট কোন বিষয় নয় বরং এটি ব্যক্তিগত এবং সামাজিক।

গামাল আবদুল নাসেরের শাসনকালে ব্রাদারহুড আন্দোলনকে দমনের যে চেষ্টা করা হয় সে সময়ে ১৯৬১ সালে ক্বারাদাওয়ী মিশর ছেড়ে নির্বাসনে যান। ব্রাদারহুডের সাথে সংশ্লিষ্ট তার অনেক সহযোদ্ধা উলামা যখন একই সময়ে দেশ ছেড়ে সৌদি আরবে আশ্রয় গ্রহণ করেন যেখানে বাদশা ফয়সাল (মৃত্যু ১৯৭৫) নাসের সমর্থিত ও প্রচারিত আরব সমাজতন্ত্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ‘ইসলামিক সলিডারিটি ক্যাম্পেইন’ বা ইসলামী ঐক্যের প্রচারের অংশ হিসেবে ব্রাদারহুডের উলামাদের স্বাগত জানাচ্ছিলেন)। অন্যদিকে ক্বারাদাওয়ীকে পাঠানো হয় কাতারে। ১

এটি ছিল তাঁর প্রথম বিমানভ্রমণ। সেই সময়ে, কাতার ছিল সবকিছু থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন এবং ব্রিটিশরা তখনও এর নিয়ন্ত্রনে ছিল। প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্ষেত্রগুলি আবিষ্কারের ফলে মাথাপিছু আয় বিবেচনায় কাতারের বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ হয়ে উঠাও তখনো বহুদুরের কথা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কাতারে প্রকৃত অর্থে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা স্থানীয় উলামাদের প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান বলতে কিছু ছিল না। হামিদ এ. হামিদ তার পিএইচডি গবেষণায় কাতারের ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর পর্যালোচনা করেছিলেন। তিনি তার থিসিসে কাতারি ইমামদের গুণমানের একটি ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছেন: “কাতারের দ্বা’য়ী বা প্রচারকরা তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত দায়িত্ব পালন করার যোগ্য নন। বেশিরভাগের যোগ্যতা কেবল ন্যুনতম পড়তে ও লিখতে পারা, ফলে তারা কাতার সমাজের সমস্যা মোকাবিলা বা সমাধানে সক্ষম নন। শুক্রবারের জুমার খুতবার জন্য তারা বছরের প্রতি সপ্তাহের জন্য একটি করে মোট ৫২টি খুতবা সম্বলিত একটি পুরাতন বইয়ের উপর নির্ভরশীল ছিল”। ২ ক্বারাদাউয়ি, যিনি ছিলেন ঐ সময়ের একজন সম্মানিত ফকীহ্‌, তাঁর স্মৃতিকথায় স্মরণ করেন যে, সেই পরিস্থিতিটি মোকাবেলা করার জন্য তাকে সেই দেশে যেন ধার হিসেবে পাঠানো হয়।

সৌদী আরব ও ঐ অঞ্চলের অন্যান্য দেশে ব্রাদারহুডের যে উলামাগণ নির্বাসনে গিয়েছিলেন তাদেরকে দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় উচ্চপর্যায়ের উলামাগণের সাথে অবস্থান ভাগাভাগি করে নিতে হচ্ছিল। অন্যদিকে কাতার যেন ছিল একটি অলিখিত স্লেট, যেখানে ক্বারাদাওয়ী যেভাবে উপযুক্ত বুঝেছেন সেভাবেই প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা কারিকুলাম তৈরী করতে পারছিলেন। তাঁর আগমনের পরপরই তিনি কাতার শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের প্রথম ইসলামী শিক্ষা ইনস্টিটিউটের (মা‌হাদ দ্বীনি) ডাইরেক্টর হিসেবে নিযুক্ত হন। প্রতিষ্ঠানটিকে মাত্র এক বছর আগে গড়ে তোলা হয়েছিল এবং তখন তা নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। ক্বারাদাওয়ী ও অন্যান্যরা মিশরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজানোর যে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন তা কাতারে বাস্তবায়ন করার জন্য সেখানকার ধর্মীয়-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব যুবক ক্বারাদাওয়ীর জন্য এক অনন্য সুযোগ হিসেবে আসে।

তাঁর আত্মজীবনীতে ক্বারাদাওয়ী স্মরণ করেছেন তিনি কিভাবে শিক্ষাসূচী নতুন আঙ্গিকে প্রণয়ন করেছিলেন, ইসলামী আইন এবং ইসলামী ভাষার অলংকারশাস্ত্র, ব্যাকরণ বা গঠনতন্ত্রের উপর একচ্ছত্র মনোযোগ সরিয়ে তিনি সেখানে বিদেশী ভাষা, বিজ্ঞান ও গণিতের উপর জোর আরোপ করেন। এই পরিবর্তনগুলো বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ক্বারাদাওয়ী তার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতিকূলতার মুখোমুখী হন, কিন্তু তিনি অবিচল থাকেন এবং এর স্বপক্ষে যুক্তি দেন যে আধুনিক সময়ের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য ভবিষ্যত উলামাদের যথাযথভাবে তৈরী করতে এই পরিবর্তনগুলো প্রয়োজনীয়। ক্বারাদাওয়ী মনে করেন যে এই বিষয়গুলো অধ্যয়ন করলে তা ছাত্রদেরকে “সামাজিক বাস্তবতার গভীর ও সত্যিকার উপলব্ধি” প্রদান করবে যা উলামা, ইমাম ও নেতা হিসেবে কাতারের গণজীবনের সমস্যার সাথে সম্পৃক্ত হতে সাহায্য করবে। ৩

ক্বারাদাওয়ী যে পরিবর্তনগুলো বাস্তবায়ন করছিলেন তা তৎকালীন আমীর আহমাদ বিন ‘আলী আল সানীর (মৃত্যু ১৯৭৭, বর্তমান আমীরের পিতামহের চাচাত ভাই) মনোযোগ আকর্ষণ করে। ক্বারাদাওয়ী আমীরের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তুলেন এবং রমজান মাসে তাঁর ব্যক্তিগত ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে আমীর ক্বারাদাওয়ীকে কাতারি নাগরিকত্ব প্রদান করেন। কাতারের রাজপরিবার ক্বারাদাওয়ীর একজন প্রধান সমর্থক হয়ে ওঠে এবং পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এমনকি জাপান, দক্ষিন কোরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ব্রাদারহুড সংশ্লিষ্ট তৃণমূল পর্যায়ের সংগঠনগুলো পরিদর্শনের জন্য ক্বারাদাওয়ীকে অনুদানও প্রদান করে।

ক্বারাদাওয়ী এবং কাতারে নতুন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ

১৯৭৭ সালে ক্বারাদাওয়ী আরেকটি ইসলামী প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন, সেটি হলো কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের শরিয়া অনুষদ, যেখানে তিনি ডীন নিযুক্ত হন। এই প্রতিষ্ঠানসহ দুটি কেন্দ্র থেকেই কাতারের ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিতদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এসেছে এবং এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকগণ ক্বারাদাওয়ীর প্রকল্পের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। এই স্নাতকদের কিছু অংশের প্রভাব এবং অবদান বেশ গুরত্বপূর্ণ ছিল।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মরিয়ম আল-হাজারি যিনি শরিয়া অনুষদে ক্বারাদাওয়ীর ছাত্রী ছিলেন। স্নাতক শেষে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি ফতোয়ার ওয়েবসাইট IslamOnline.net প্রতিষ্ঠা করেন। ৪ জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকার সময়ে, IslamOnline.net ওয়েবসাইটটি আরবী ভাষায় সবচেয়ে বেশী সার্চ করা ওয়েবসাইটে পরিণত হয়। ক্বারাদাওয়ীর অধীনে পড়াশোনার করার সময়ের কথা স্মরণে হাজারির বক্তব্য ইঙ্গিত করে যে, কাতারিদের মধ্যে ব্রাদারহুডের প্রতি সমর্থনের কারণ ছিল ইসলামের ব্যাপারে জন্য ব্রাদারহুডের লক্ষ্যভিত্তিক সক্রিয়তা, যেখানে ইসলামী আইনকে দৈনন্দিন জীবনের প্রাসঙ্গিক করার পাশাপাশি ইসলামী আইনের নৈতিক ভিত্তির উপর জোর দেয়া হয়েছে। হাজারী স্মরণ করেন ক্বারাদাওয়ীর সাথে যাকাত বিষয়ে অধ্যায়ন করার কথা, তিনি বলেন: “আপনি কিভাবে আপনার জ্ঞান বিলিয়ে দেবেন? এটি আমার জন্য একটি নতুন ধারণা ছিল। আগে আমি ভাবতাম যাকাত শুধুমাত্র অর্থের মাধ্যমেই প্রদান করা যায়। তাই, আমি ভাবলাম, আমার অনেক জ্ঞান অর্জন করেছি, আমি শীর্ষ একজন ছাত্রী ছিলাম, আমি এই জ্ঞান দিয়ে কি করতে পারি […] আমি এটি সম্পর্কে দীর্ঘদিন চিন্তা করলাম।” ৫ তাঁর এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, ব্রাদারহুডের ইসলামী পুনর্জাগরণের যে ভিশন তার অনেক দিক আছে।

গণতান্ত্রিক শাসন ও রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের উপর ব্রাদারহুডের জোরপ্রদানের বিষয়টি সাধারণ কাতারিদের আগ্রহী করেনি। ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ইসলামী আইনকে প্রাসঙ্গিক ও অর্থবহ করার প্রচেষ্টা তাদের প্রতি সাধারণ জনগণের সমর্থন জোগানোর পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।

আরব বসন্ত, ক্বারাদাওয়ী, আল-জাজিরা এবং আইইউএমএস

১৯৯৬ সালে আল-জাজিরা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ক্বারাদাওয়ীকে “আরব বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যক্তি” হিসেবে সম্বোধন করা হতে থাকে। বিখ্যাত সাংবাদিক এন্থনি শাদিদ (মৃত্যু ২০১২) এর এমন অবস্থানের পেছনে রয়েছে আল-জাজিরার জনপ্রিয় ইসলামী টক শো ‘আশ-শারিয়া ওয়াল হায়াত’-এ (শরিয়া এবং জীবন) অতিথি হিসেবে ক্বারাদাওয়ীর উপস্থিতি। দোহায় উমর ইবনে আল-খাত্তাব মসজিদে তাঁর শুক্রবারের খুতবা আল-জাজিরা নিয়মিত প্রচার করতে শুরু করে। ‘আশ-শারিয়া ওয়াল হায়াত’ অনুষ্ঠানে ক্বারাদাওয়ী প্রতি সপ্তাহে ৩৫ লাখ দর্শকের সামনে উপস্থিত হতে থাকেন। এই সম্মানের হাত ধরেই ২০০৪ সালে কাতারি আমীর International Union of Muslim Scholars – IUMS (আল-ইত্তিহাদ আল-‘আলামি লিল ‘উলামা আল-মুসলিমিন) প্রতিষ্ঠায় সমর্থন প্রদান করেন, যেখানে ক্বারাদাওয়ীকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়। সেই সময়ে উলামাদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক অনেকটা আল-জাজিরার মতই ছিল। এটির স্বাধীন একটি অস্তিত্ব সবার সামনে ছিল কিন্তু একইসাথে এর সাথে কাতারের সফট পাওয়ার এবং পররাষ্ট্র নীতিমালার লক্ষ্যগুলির সাথে সূক্ষ্ম সংযোগ ছিল।

২০১১ সালের আরব বসন্তের সময় ক্বারাদাওয়ী আল-জাজিরায় তাঁর অবস্থান এবং IUMS-এ তাঁর নেতৃত্বকে ব্যবহার করে প্রতিবেশী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া গণজাগরণের ব্যাপারে ইসলামী আইনী দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধতা প্রদান করেন (বাহরাইনে যদিও এর বাত্যয় ঘটে, যেখানে তিনি ক্ষমতাসীন সুন্নি সরকারকে সমর্থন করেছিলেন )। তবে তখনকার ঘটনার মোড় ঘুরে গিয়ে যখন জুলাই ৩, ২০১৩ তারিখে মিশরে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ব্রাদারহুড নেতৃত্বাধীন সরকারকে জোরপূর্বক ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, তার পরপর আল-জাজিরার মাধ্যমে ক্বারাদাওয়ীর ক্যু বিরোধিতার বিষয়টি কাতার এবং মিশরের নতুন শাসনের সমর্থক গোষ্ঠি, বিশেষত সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। এ সময় কাতারে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে ক্বারাদাওয়ীর কাছ থেকে কাতারি নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নিয়ে তাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে।

২০১৩ সালের আগস্ট মাসে, ‘আশ-শারিয়া ওয়াল হায়াত’ প্রোগ্রামটির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয় এবং তাঁর জুম্মার খুতবাও ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেয়া হয়। GCC-এর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি মোকাবেলায় ২৩শে নভেম্বর ২০১৩ তারিখে ১ম রিয়াদ চুক্তি সাক্ষরিত হয় যেটি পাল্টা বিপ্লবের মাধ্যমে হলেও পূর্বের ক্ষমতাসীনদের পুনরায় ক্ষমতায় এনে আরব বসন্তের প্রভাব থেকে এই অঞ্চলকে মুক্ত রাখার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল।

উত্তেজনা বেড়েই চলছিল এবং সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন, কাতার থেকে তাদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নেয় ২০১৪ সালের ৫ই মার্চ। ১৬ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে রাষ্ট্রদূতেরা দোহায় ফেরত গেলেও এটি একটি স্পষ্ট সংকেত ছিল যে সংকট নিরসন হয়নি। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখে ইন্টারপোলের মাধ্যমে মিশর ক্বারাদাওয়ীর বিরুদ্ধে হত্যার উসকানি দেয়ার অভিযোগে গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি করে (খুব সম্ভবত ২০১৩ সালের গণজাগরণের বিরোধীতা করার জন্য)। গ্রেফতারি পরওয়ানাকে কোন পাত্তা দেয়া হয়নি এবং ২০১৪ সালে মসজিদে ক্বারাদাওয়ীর জুমার খুতবা আবারো শুরু হয়।

উপসংহার

উপসংহারে বলা যায়, যে সমস্যাগুলোর কারণে ২০১৪ সালের শুরুতে কাতার ও তার প্রতিবেশীদের মধ্যে সম্পর্কের ভাঙ্গন শুরু হয় সেগুলো সমাধান করতে ব্যর্থতার কারণেই বর্তমান সংকটের জন্ম হয়েছে। কাতারের মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি সমর্থনই এর সাথে জিসিসির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্বের প্রধান কারণ, যার প্রমাণ ২০১৩ সালে মিশরের ক্যু এর ব্যাপারে এর প্রতিবেশীদের থেকে কাতারের ভিন্নধর্মী অবস্থান থেকেই পাওয়া যায়। তবে মুসলিম ব্রাদারহুডের জন্য কাতারের সমর্থন কেবল উপসাগরীয় অঞ্চলভিত্তিক ক্ষমতার রাজনীতির ফসল নয়। বরং এই সমর্থনের পেছনে দেশটির একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, যা কাতারে ক্বারাদাওয়ীর ব্যক্তিগত ইতিহাস থেকে অনুধাবন করা যায়। ক্বারাদাওয়ী ১৯৬১ সাল থেকে কাতারে বসবাস শুরু করেন এবং ১৯৬৯ সালে সেখানকার নাগরিকত্ব লাভ করেন। তিনি শূন্য থেকে কাতারের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে গড়ে তুলেছেন এবং মরিয়ম আল-হাজারির মত তাঁর শিক্ষার্থীরা গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছেন বিভিন্ন স্তরে।

রাজপরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পাশাপাশি, শারিয়া অনুষদের ডীন হিসেবে দায়িত্বপালন, আল জাজিরার ‘আশ-শারিয়া ওয়াল হায়াত’ অনুষ্ঠানে তাঁর অবস্থান এবং IUMS-এর নেতৃত্বদানের মাধ্যমে ক্বারাদাওয়ী কাতারের সমাজের উপর প্রভাব বিস্তার করেছেন। কাতারে ব্রাদারহুডের উপস্থিতির একটিমাত্র দিক চোখে পড়লেও, ক্বারাদাওয়ীর জীবনীটি পড়লে বোঝা যায় কাতারে ব্রাদারহুডের ইতিহাস কত দীর্ঘ এবং কত গভীরে এর শিকড় প্রোথিত। ৯ জুন, ২০১৭ সালে সৌদি আরব, মিশর, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত কাতারের প্রতি ক্বারাদাওয়ীসহ ব্রাদারহুডের নির্বাসিত নেতাদের নামের একটি তালিকা ইস্যু করে এবং তাদের বহিষ্কারের দাবি জানায়। যাহোক, এই দাবীর প্রতি কাতারের নতিস্বীকার অত সহজে আসবে আশা করা যায় না। ব্রাদারহুডের জন্য কাতারের সমর্থন কেবলমাত্র ক্ষমতা বা পেশীশক্তির রাজনীতির চেয়েও অনেক বেশিকিছু। আর ক্বারাদাওয়ী এবং তার ব্রাদারহুডের সহকর্মীদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্তটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনার মত সরল কিছু হবে না।

১. যদিও ক্বারাদাওয়ী তাঁর স্মৃতিচারণায় স্পষ্ট করেননি কেন অন্য কোন দেশের পরিবর্তে তিনি কাতার গিয়েছিলেন, সম্ভবত এই সিদ্ধান্ত ব্রাদারহুডের মুর্শিদে ‘আম হাস্‌সান আল-হুদাইবির (মৃত্যু ১৯৭৩) সমর্থনেই নেওয়া হয়েছে।

২. Hamed A. Hamed, “Islamic Religion in Qatar During the Twentieth Century: Personnel and Institutions” (Doctoral Dissertation, University of Manchester, 1993), 120. See also, Yūsuf al-ʿAbd Allāh, Taʾrīkh al-Taʿlīm fi al-Khalīj al-ʿArabī1913-1971 (Doha: n.p., 2003), 305–80.

৩. Yusuf al-Qaradawi, Ibn al-Qarya wa-l-Kuttāb: Sīra wa-Masīra, vol. 2 (Cairo: Dār al-Shurūq, 2004) 234–5, 440–2.

৪. মরিয়ম আল-হাজার আরেকজন কাতারি বংশোদ্ভূত সহকর্মী হামিদ আল-আনসারিকে নিয়ে ১৯৯৯ সালে IslamOnline.net প্রতিষ্ঠা করেন। আল-আনসারি ঐ সময় শরিয়া অনুষদের লেকচারার ছিলেন। Bettina Gräf, “IslamOnline.net: Independent, Interactive, Popular.” Arab Media & Society, 2008, 1–21.

 ৫. প্রাগুক্ত., ৩-৪।

সূত্রঃ সঞ্চারন

আগের সংবাদশরীফুজ্জামান নোমানি থেকে আবরার ফাহাদ: রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের প্রকারভেদ ও বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের স্বকীয়তা
পরবর্তি সংবাদযুগশ্রেষ্ঠ স্কলার ড. ইউসুফ আল কারযাভী র.-এর জীবন ও অবদান