কাতার কেন বিশ্বকাপ আয়োজন করছে?

মুনশী নাঈম:

ফুটবলের সব পথ মিশে গেছে মরুর দেশ কাতারে। বেজে উঠেছে বিশ্বকাপের বাঁশি। এই প্রথম প্রথা ভেঙে শীতকালীন বিশ্বকাপ শুরু হলো। কাতারই মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম দেশ, যারা ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজন করছে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যই নয়, আরববিশ্বেও কাতারই প্রথম। এশিয়ায় অবশ্য এটি দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। প্রথমবার হয়েছিল ২০০২ সালে, যৌথভাবে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে। এই বিশ্বকাপ আয়োজন করতে গিয়ে রেকর্ড অর্থ ব্যয় করেছে কাতার। দেশটি বলেছে, এবারের ফিফা বিশ্বকাপে তারা ২২০ বিলিয়ন ডলার খরচ করছে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।

বিশ্বকাপ আয়োজন করতে গিয়ে মিলিয়ন থেকে বিলিয়নে পা দেওয়ার প্রথম যাত্রা শুরু করেছিল আমেরিকা। ১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য ০.৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল। ১৯৯৮ সালে ফ্রান্স খরচ করেছিল ২.৩ বিলিয়ন ডলার। ২০০২ সালের বিশ্বকাপ আয়োজন করার জন্য কোরিয়া ও জাপান যৌথভাবে খরচ করেছিল ৬.৫ বিলিয়ন ডলার। ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে জার্মানি খরচ করেছিল ৪.৩ বিলিয়ন ডলার। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের খরচ ছিল ৩.৩ বিলিয়ন ডলার। চার বছর পর ২০১৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপ আয়োজন করতে গিয়ে খরচ করেছিল ১৩.৮ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপ আয়োজন করতে গিয়ে ব্যয় করেছিল ১০.৭ বিলিয়ন ডলার। কাতার এবার সেসব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। রাশিয়ার থেকে প্রায় ১১ গুণ বেশি অর্থ খরচ করেছে তারা।

কিন্তু কেন এমন বিপুল অর্থ ব্যয় করল কাতার? অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ফুটবলের এই মহা আয়োজন থেকে লাভের হিসাব কষেই মাঠে নেমেছে তারা।

কোথায় খরচ হলো এত টাকা

বিশ্বকাপের কমিউনিকেশন্স এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ফাতমা আল নুয়াইমি বলেন, ‘২০৩০ সালের দিকে তাকিয়ে কাতার পরিকাঠামোগত পরিবর্তন এনেছে। বিশ্বকাপ তারই একটা অংশ। শহরের উন্নয়নের, জাতীয় পরিকাঠামো, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নয়নের দিকেও নজর রাখা হয়েছে। আসলে ২০০ বিলিয়ন ডলার কাতার ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের জন্যই খরচ হয়েছে।’

বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য কাতারের সবচেয়ে বেশি খরচ হয়েছে অবকাঠামো নির্মাণে। নতুন করে ছয়টি স্টেডিয়াম নির্মাণ করেছে আয়োজকরা। সংস্কার করেছে দুটি স্টেডিয়াম। খেলোয়াড়দের প্রস্তুতির জন্য বানাতে হয়েছে অনুশীলনের জায়গা। সেসব আধুনিকিকরণেও ব্যয় হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা। স্টেডিয়ামগুলো হলো: ১. লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়াম, ধারণক্ষমতা ৮০ হাজার। ২. আল-বায়াত স্টেডিয়াম, আল-খোর (ধারণক্ষমতা ৬০ হাজার)। ৩. অ্যাডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম, আল-রাইয়ান (ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার)। ৪. আহমাদ বিন আলি স্টেডিয়াম, আল-রাইয়ান (ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার)। ৫. খালিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়াম, দোহা (ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার)। ৬. আল-থুমামা স্টেডিয়াম, দোহা (ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার)। ৭. স্টেডিয়াম ৯৭৪, দোহা (ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার)। ৮. আল-জানুব স্টেডিয়াম, আল-ওয়ারকাহ (ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার)।

সরকারী পরিসংখ্যান অনুসারে, মোট অবকাঠামোগত ব্যয়ের মধ্যে কেবল স্টেডিয়াম নির্মাণের ব্যয় প্রায় ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা পুরো বিশ্বকাপেও এত ডলার খরচ করেনি। ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর মতে, এখন পর্যন্ত সেরা বিশ্বকাপ এটি।

ফিফার কাছে যে পরিকল্পনা কাতার দিয়েছিল তাতে বলা হয়েছে, শুধু ফুটবলের অবকাঠামো নির্মাণে ৪ বিলিয়ন ডলার খরচ করবে তারা। কিন্তু আদতে খরচ করেছে ৬.৫ বিলিয়ন থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার। ইউএস স্পোর্টস ফাইন্যান্স কনসালটেন্সি ফ্রন্ট অফিস স্পোর্টসের মতে, বাকি প্রায় ২১০ বিলিয়ন ডলার বিমানবন্দর, নতুন রাস্তা, হোটেলসহ উদ্ভাবনী হাব এবং অত্যাধুনিক পাতাল পরিবহনের উন্নয়নে ব্যয় করেছে কাতার। শুধুমাত্র দোহাতেই, ‘দ্য পার্ল’ নামে আবাসন কমপ্লেক্সে ১৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়েছে এবং দোহা মেট্রোতে খরচ হয়েছে ৩৬ বিলিয়ন ডলার। রাশিয়ার নিউজ এজেন্সি টাসের মতে, কাতারের অর্থমন্ত্রী স্বীকার করছেন প্রতি সপ্তাহে অন্তত ৫০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে অবকাঠামো নির্মাণে।

স্টেডিয়াম ছাড়াও কাতার ১০০ টিরও বেশি নতুন উচ্চ-স্তরের এবং বিলাসবহুল হোটেল তৈরি করেছে, যার মোট কক্ষের সংখ্যা ৩০ হাজার। এছাড়াও তৈরী করা হয়েছে এপার্টমেন্ট, ভিলা এবং আবাসিক ইউনিট। প্রস্তুত করা হয়েছে অসংখ্য ভাসমান হোটেল। সিএনবিসির পর্যবেক্ষণ অনুসারে, বিশ্বকাপ চলাকালীন একটি হোটেল-কক্ষের দাম রাতপ্রতি ৫ হাজার ডলার করে পড়ছে। যেটা তিন তারকা এবং দুই তারকা হোটেলে ৫০০ থেকে ২ হাজার ডলারের মধ্যে ছিল।

পরিবহন এবং যোগাযোগের জন্য অনেক হাইওয়ে নির্মাণ ছাড়াও সাইকেল এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য পথ প্রস্তুত করা হয়েছে। ২০১৯ সালে কাতার খুলেছিল দোহা মেট্রো টানেল। যাতে খরচ হয়েছিল ৩৬ বিলিয়ন ডলার। এটি ৭৬ কিমি দীর্ঘ। ৩৮টি সেটশনে থামে। যে জায়গাগুলোতে বিশ্বকাপের আয়োজন, সেগুলো অতিক্রম করেই যায়।

কাতার বিশ্বকাপ উপলক্ষে তৈরী করেছে স্মার্ট শহর এবং কৃত্রিম দ্বীপ। রাজধানী দোহার কেন্দ্র থেকে ১৬ কিমি দূরে, কাতার ‘লুসাইল’ আধুনিক শহরটিকে ভবিষ্যতের স্মার্ট সিটির মডেল হিসাবে তৈরি করেছে। খরচ হয়েছে ৪৫ বিলিয়ন ডলার। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম স্মার্ট শহর হয়ে উঠেছে এটি। এই শহরের স্টেডিয়ামেই অনুষ্ঠিত হবে বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ। এই শহরটি ২২টি অতি-বিলাসী আন্তর্জাতিক হোটেল, দুটি বড় গল্ফ কোর্স, ১৯টি শহরতলির সমন্বয়ে গঠিত। এতে রয়েছে পার্ক, বিনোদন কেন্দ্র, বাণিজ্যিক সুবিধা এবং ক্রীড়া সুবিধা। প্রধানত প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং সবুজ পরিবেশের উপর নির্ভর করে শহরটি ডিজাইন করা হয়েছে। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে কাতারি ঐতিহ্য। এছাড়াও ১৫ বিলিয়নেরও বেশি খরচে তৈরী করা হয়েছে কৃত্রিম পার্ল দ্বীপ। এতে রয়েছে আবাসিক টাওয়ার, ভিলা এবং কয়েকটি বিলাসবহুল হোটেল।

খেলার চেয়েও বেশি কিছু

কাতার কি কেবল বিনোদনের লক্ষে এত এত ডলার খরচ করেছে? এই প্রশ্নের উত্তরে রয়টার্সকে কাতারের একজন সরকারি কর্মকর্তা বলেছেন, কাতার তার মাটিতে অনুষ্ঠিত হওয়া বিশ্বকাপকে কেবল একটি ক্রীড়া ইভেন্টের চেয়ে অনেক বেশি কিছু মনে করে। দেশটি মনে করে, এটি তার জন্য একটি প্রধান ‘বিপণন লঞ্চ প্যাড’ হিসাবে কাজ করবে।’

ওয়াশিংটনের মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের একজন ফেলো কারেন ইয়াং বলেন, এটি একটি একটি দুর্দান্ত বিপণন। যা পর্যটন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলে।

কাতার আশা করছে, এই বিশ্বকাপ মৌসুমে দেড় মিলিয়ন পর্যটক পাবে তারা। দোহা এবং অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থাগুলির আশ্বাস অনুযায়ী, শুধুমাত্র পর্যটন খাত থেকে উৎপন্ন রাজস্ব প্রায় সাড়ে ৭ বিলিয়নে পৌঁছবে। বিশ্বকাপের সাথে যুক্ত পর্যটন ব্যয় এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম দেশের জিডিপিতে ১.৫% যোগ করবে। এই প্রেক্ষাপটে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আশা করেছিল যে, কাতারি অর্থনীতি এই বছর ৩.৪% হারে বৃদ্ধি পাবে এবং আগামী বছরগুলিতে ৪.৪% হারে বৃদ্ধি পাবে। কারণ বিশ্বকাপ আয়োজনের পর দেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিকাশ ঘটবে। কাতারের লক্ষ হলো, ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে ৬ মিলিয়ন পর্যটক নিয়ে আসা।

বিশ্বকাপের পর কাতারে পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বকাপের ফলে একটি দুর্দান্ত পর্যটন-সুবিধা পেয়েছিল দেশটি। ২০১৯ সালে বছরে দেশটির পর্যটক হয়েছিল ১০ মিলিয়ন। যা মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ১০ শতাংশ।

আমেরিকান ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট ম্যাগাজিনের অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, কাতার বিশ্বকাপ উপলক্ষে এতকিছু উন্নত করেছে বিশ্বকাপ শেষে স্থানীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে। ব্যবসা, পরিবহন ও বাণিজ্য উদ্যোগের পরিধি সম্প্রসারণ করতে।

কাতারের জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক অ্যালেক্সিস আন্তোনিয়াদেস বলেছেন, এখন কাতারের সময় এসেছে বিশ্বের সামনে নিজেকে উন্মুক্ত করার, প্রতিভা এবং কোম্পানিকে আকর্ষণ করার, সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ এবং পর্যটকদের আকর্ষণ করার।

টিকেট থেকে কামাই

ফিফা জানিয়েছে, আট স্টেডিয়ামে মোট তিন মিলিয়ন টিকেট তারা বিক্রি করেছে। শুধু টিকেট বিক্রি থেকেই ফিফা রেকর্ড রেভেনিউ পেতে পারে। রাশিয়া বিশ্বকাপে টিকেট বিক্রি থেকে ফিফার আয় ছিল ৫.৪ বিলিয়ন ডলার। এবার সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলেই রিপোর্টে এসেছে। এর পেছনে কারণ, ম্যাচ টিকেটের দাম বৃদ্ধি।

জার্মানির ক্রীড়া ক্রোড়পত্র আউটফিটার এক গবেষণায় বলেছে, ২০১৮ সালের টিকিটের থেকে ৪০ শতাংশ বেশি দামে কাতার বিশ্বকাপের টিকিট কিনেছে দর্শকরা। ফাইনালের টিকিটের সর্বনিম্ন দাম পড়েছে ৬৮৪ পাউন্ড। সর্বোচ্চ ৫ হাজার পাউন্ড ছাড়িয়ে। এছাড়া ম্যাচপ্রতি গড় টিকিটের মূল‌্য ২৮৬ পাউন্ড, রাশিয়া বিশ্বকাপে যা ছিল ২১৪ পাউন্ড।

কিলার স্পোর্টসের ভাষ্যমতে, ‘শেষ ২০ বছরে সবচেয়ে বেশি টিকিটমূল‌্য দিয়ে মাঠে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন সমর্থকরা। ফাইনালে যারা টিকিট পেয়েছেন তারা শেষ চার বছরের তুলনায় ৫৯ শতাংশ বেশি অর্থ খরচ করছে।’

ধারণা করা হচ্ছে, শুধু টিকিট থেকেই ২০ বিলিয়ন ডলার আয় করবে আয়োজকরা। এছাড়া ২ লাখ ৪০ হাজার হসপিটালিটি প্যাকেজ বিক্রি করেছে আয়োজকরা। এছাড়া ব্রডকাস্টটিং স্বত্ব, স্পন্সর স্বত্ব থেকেও বিশাল আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে কাতারের।

আগের সংবাদসমাবেশের নামে ‘পিকনিক’ করছে বিএনপি: তথ্যমন্ত্রী
পরবর্তি সংবাদচার মাসে রাজস্ব ঘাটতি ৬৪০০ কোটি টাকা