কারাগারে ঈদের স্মৃতি

আবদুল আজিজ

 

ত্রিপুরার কেন্দ্রীয় কারাগার৷ নামআগরতলা কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার ভারত দৃশ্যত যেহেতু ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, তাই মুসলমানদের বিভিন্ন ধর্মীয় সুযোগসুবিধা প্রদান করতে বাধ্য৷ তারপরও বিভিন্ন জায়গায় মুসলিমরা অন্যায়ের শিকার হয়ে থাকে৷ আগরতলা কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে রমজান মাসে মুসলিম কয়েদিদের রোজা পালনের ব্যবস্থা তারা করে৷ হাজতিকয়েদি মিলিয়ে আমরা প্রায় ৪৫ জন মুসলিম বন্দী৷ একসঙ্গে রমজান কাটিয়েছি আমরা৷ ইফতার, সাহরি, তারাবিসবই মোটামুটি ঠিকঠাকভাবে পালন করার সুযোগ পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ৷

ঈদের সময় ঘনিয়ে আসছে৷ দুতিন দিন পর ঈদ৷ বাড়ির কথা মনে পড়ছে প্রতি মুহূর্তেই৷ একটু একা হলেই অজান্তেই দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে৷ আমরা ভিনদেশি বন্দী৷ কোনোকিছুতেই আনন্দ নেই আমাদের৷ তবু মুসলিম ভাইদের আন্তরিক ব্যবহারে বুঝতেই পারিনি আমরা ভিনদেশি৷ তাঁরা কখনও আমাদেরকে বুঝতে দেননি আমরা ভিনদেশি৷ বরং আচরণেউচ্চারণে দীনি ভাই হওয়ার অনুভূতিই প্রকাশ করেছেন৷ দীনি ভ্রাতৃত্ববোধের মনকাড়া দৃশ্যে আমরা মুগ্ধ হয়েছি৷ প্রীত হয়েছি৷

ঈদের আমেজ স্পর্শ করতে পারেনি আমাদের৷ এক পোষাকে একমাস অতিবাহিত হয়েছে, সেখানে আর আনন্দ কীভাবে আসতে পারে! মুসলিম ভাইরা নিজেদের গামছা, কয়েদি প্যান্ট, গেঞ্জি ইত্যাদি দিয়ে সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছেন৷ যদি তাঁদের সহযোগিতা না থাকত, তাহলে আমাদের পক্ষে গোসল করাই কষ্টকর হয়ে পড়ত৷ আল্লাহ তাঁদের উত্তম বিনিময় দান করুন৷

রমজানে একবার শুনানির তারিখ পড়ল৷ আমরা ম্যজিস্ট্রেটকে আমাদের পোষাক ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আবেদন করলাম৷ আমাদের সব সরঞ্জাম থানায় আটক ছিল৷ জেল পর্যন্ত আসেনি৷ আমাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ম্যজিস্ট্রেট জেলসুপারকে আমাদের জন্য পোষাকের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেয়৷

আমাদের মধ্যে আনন্দের ছোঁয়া না থাকলেও কয়েদি ভাইদের মধ্যে যথেষ্ট আনন্দ দেখতে পেলাম৷ তাঁরা ঈদ উদযাপনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত; হিন্দুরা যেভাবে পূজা উদযাপন করে অনেক ঘটা করে৷ আসলে এটা অনেকটা দীনি গায়রত বা আত্মমর্যাদাবোধ থেকেই তাঁরা করে থাকেন৷ দুদিন আগে থেকেই সাজ সাজ রব পড়ে গেল৷ জেলের ভেতরের রাস্তাকে বিভিন্ন ডিজাইনের রঙবেরঙের কাগজ দিয়ে সুসজ্জিত করা হলো৷ পাশে ছোট্ট একটা মাঠে ঈদের জামাতের আয়োজন করা হবে৷ মাঠের চারপাশেই স্বচ্ছ সবুজ ঘাস৷ মাঠ প্রস্তুত করা হলো বেশ ঘটা করেই৷ নতুন বাঁশ কেটে মাঠের চারদিকে লাগিয়ে দিয়ে সাজসজ্জা করা হলো৷ আমরাও তাঁদের সহযোগিতা করলাম৷

ঈদের জামাতে ইমামতি কে করবেন এটা নিয়ে মৃদু তর্ক হয়ে গেল তাদের মধ্যে৷ একপক্ষের কথা হলো, আমাদের মধ্যে ২৪ জন আলেম আছেন, বাইরে থেকে ইমাম আনার আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই৷ আরেকপক্ষের কথা হলো, বাইরে থেকে ইমাম আনার ধারাবাহিকতা বহাল থাকুক৷ আমাদের আলেম বন্দীরা সবসময় থাকবেন না৷ ধারাবাহিকতা বন্ধ হয়ে গেলে পুনরায় চালু করা অনেক কষ্টকর হবে৷ আমরা সবাই দ্বিতীয় পক্ষকে সমর্থন করলাম৷ অবশেষে ইমাম আনার সিদ্ধান্তই স্থির হলো৷

ঈদের দিন সকালবেলা৷ মাইকের ব্যবস্থা করা হলো৷ আমাদের দেশে গ্রামের ঈদগাহগুলোতে যেমন ঈদের সকালে বাচ্চারা তেলাওত করে, হামদনাত পরিবেশন করে, এখানেও তাই শুরু হলো৷ আমি তেলাওত করলাম সুরায়ে হাক্কাহ৷ সম্ভবত নুমানও  তেলাওত করেছিল৷ আইনুল ভাই, তাজুল ওরফে ওমরসহ অনেকে হামদ নাত পরিবেশন করল৷ সাধারণ মুসলিমরাও পিছিয়ে নেই৷ তাঁরাও তেলাওত, নাত, কবিতা, পুঁথি সুর করে পাঠ করলেন৷

ঈদের জামাতের সময় হয়ে এল৷ আমাদের মধ্যে কাউকে বয়ান করতে বলা হলো মজমার পক্ষ থেকে৷ আমরা সবাই তানভীর ভাইকে এগিয়ে দিলাম৷ আধা ঘন্টার মতো

বয়ান করলেন তিনি৷ মুগ্ধকর বয়ান৷ সবাই তন্ময় হয়ে শুনছিল৷ ঈদের জামাতের পাশে কোনো কোনো অমুসলিমও বয়ান শুনছিল৷ সময়মতো এলেন আমন্ত্রিত অতিথিরা৷ অতিথি ইমাম সাহেবও থামালেন না তানভীরকে৷ তিনিও শুনলেন শেষ পর্যন্ত৷ তানভীর ভাই সংক্ষেপ করে শেষ করলেন৷

ইমাম সাহেবসহ মোট চারজন অতিথি এসেছেন৷ ইমাম সাহেব বক্তৃতা করলেন৷ ইসলামের সৌন্দর্য, উদারতা, মানবিকতা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা৷ হিন্দুমুসলিম সবাইকে মিলেমিশে থাকার আহ্বান জানালেন তিনি৷

এবার নামাজ পড়ানোর পালা৷ ইমাম সাহেব নামাজ পড়াতে গেলেন না৷ সাঈদ ভাই নামাজ পড়ালেন৷ তেলাওত ছিল বুঝে বুঝে৷ আবেগময় সুরে, বিগলিত চিত্তে৷ হৃদয়ের আকুলতা শ্রোতাদের স্পর্শ করছিল৷ নীরবে কাঁদছিল আমাদের কোনো কোনো সঙ্গী৷

নামাজের পর খুতবাও ইমাম সাহেব দিলেন না৷ শারফুদ্দীন ভাই খুতবা দিলেন৷ খুতবা শেষে দুআ হলো৷ ইমাম সাহেব দুয়ার জন্য হাত ওঠালেন৷ আমরাও আকাশের পানে হাত তুললাম৷ তিনি বন্দীদের মুক্তির জন্য যেই দুয়া করলেন, মজমা হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠল৷

কান্নায় আকাশবাতাস ভারি হয়ে উঠেছে৷ আবেগঘন পরিবেশ৷ কারও মুখে কোনো কথা নেই৷ চোখমুখ ভেজা প্রায় সবার৷ একজন অতিথি সবার জন্য আতর হাদিয়া এনেছেন৷ আতরগুলো বিতরণ করা হলো৷ বন্দীদের জন্য সামান্য হাদিয়া অসামান্য হয়ে উঠল হাদিয়াদাতার আন্তরিকতায়৷

নামাজশেষে পরস্পর কোলাকুলি করলাম সবাই৷ ইমাম সাহেব আমাদের সান্ত্বনার বাণী শোনালেন৷ সবরের উপদেশ দিলেন৷ বললেন, ‘আপনাদের মুক্তির জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি৷ চিন্তা করবেন না৷তারপর আমাদের কাছে রমজানের কারগুজারি শুনলেন৷

জেল কর্তৃপক্ষ ঈদ উপলক্ষে সবার জন্য মিষ্টির ব্যবস্থা করল৷ আমাদের সকলের জন্য একটা করে লুঙ্গিরও ব্যবস্থা হলো৷ আবার খাবারের মেনুটাও ভালো ছিল ওই দিন৷ মুসলমানদের হাতে জবাইকৃত মুরগীর গোশত তৈরী হলো৷ ভাই আনোয়ার আর রশিদ চাচারা মিলে সেমাইয়ের আয়োজন করলেন তাদের পকেট থেকেই৷ খাবার পর্বটা চলল হাসিমুখে৷

এবার বিদায়ের পালা৷ একসঙ্গে থাকার আর সুযোগ নেই৷ একমাস একসঙ্গে থাকায় একটা আন্তরিকতা গড়ে উঠেছিল সবার মধ্যে৷ যুগপৎ আনন্দবেদনার মিশ্র অনুভূতি৷ অল্পকয়দিনে অনেক আপন হয়ে উঠেছিলাম আমরা৷ ভাইভাইয়ের মতো আপন৷ এখন আমরা যার যার সেলে চলে যাবো৷ দুপুরের পরপরই আমাদের সকলকে ভাগ করে দেওয়া হলো৷ সেদিনের সন্ধ্যাটা সত্যি অনেক বিষণ্ন ছিল৷

লেখক : তরুণ আলেম 

আগের সংবাদজন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এবং সেক্যুলারিজমের ধোঁকাবাজি
পরবর্তি সংবাদধর্মীয় সমাজ : অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও প্রযুক্তি প্রশ্নে মাওলানা ইউসুফ সুলতানের সাথে আলাপ