মুজাহিদুল ইসলাম
সত্যের সন্ধান প্রকৃতিপ্রদত্ত সম্পদ। যতক্ষণ প্রকৃতিকে তার নিজ অবস্থায় থাকতে দেওয়া হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তার সম্ভাবনা বাকী থাকে। আমেরিকান নাগরিক আফ্রো-আমেরিকান কিংবদন্তী শহীদ মালিক আল শাহবায বা ম্যালকম এক্স তেমনই একজন মানুষ। সত্যসন্ধান তাকে বার বার পথপরিবর্তন করিয়েছে।
নিগ্রোদের অধিকারে সোচ্চার বাবার ঔরসে বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে জন্মগ্রহণকারী এ নওমুসলিম আমেরিকান সমাজের মূল স্রোতে প্রবেশের তীব্র চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে লুটপাটে জড়িত নিগ্রো-গ্যাংয়ে যোগ দিয়ে পরিণামে ছয় বছরের অধিক জেলখানায় কাটান। তবে জেলখানা তাকে নিগ্রোদের অধিকারকর্মী হিসেবে গড়ে তোলে। বিদ্যমান আসমানী গ্রন্থের পাশাপাশি কনফুশীয় ও বৌদ্ধ ধর্মের ধর্মীয় গ্রন্থসহ প্রচুর বইপত্র পড়েন।
সেখানে ‘ন্যাশন অফ ইসলাম’ নামক দলের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন, যারা নিজেদের ইসলাম ধর্মের অনুসারী হিসেবে দাবি করতো। যদিও শেতাঙ্গদের প্রতি বিদ্বেষ ছাড়া তা আর কিছু বহন করতো না। পরবর্তীতে ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহ তাকে নিয়ে যায় পবিত্র ভূমি মক্কা-মদিনায়। অংশ নেন হজের মতো বড় ইবাদাতে। সন্ধান পান প্রকৃত ইসলামের। কিভাবে বিকৃত ইসলাম হতে আসল ইসলামে এলেন? কিভাবেই বা হজের পরিচয় পেলেন? হজের সফরে কী দেখলেন? হজের পর কী অনুভূতি ও কর্মপন্থা তিনি অবলম্বন করলেন?
ম্যালকম এক্স তার রোজনামচায় লিখেন, প্রকৃত ইসলামের সাথে তার প্রথম অভিজ্ঞতা বেশ নাটকীয়। তিনি তখন আমেরিকা জুড়ে লেকচার দিয়ে চলেছেন। হঠাৎ আরব স্টুডেন্টরা এসে তাকে বলল, শেতাঙ্গদের প্রতি বিদ্বেষ রাখা ইসলামের শিক্ষার সাথে যায় না। তিনি যদি ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা জানতেন, তবে বুঝতেন ও আশ্বস্ত হতেন। কিন্তু জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তেও যে ধর্মগুরু তার ভেতর বৈপ্লবিক চিন্তার বীজ বপন করে দিয়েছিলেন, তার শেকড় বেশ গভীরে প্রোথিত হয়ে গিয়েছিলো।
তাই বলে নিজ ধর্ম সম্পর্কে না জানার অনাগ্রহ কি তবে স্থায়ী থাকবে? আরব ছাত্রদের পিড়াপীড়ি তাকে চিন্তা করতে বাধ্য করে। তিনি বলেন, ‘আমি মনে মনে বলতে লাগলাম, মানুষ যদি তার ধর্ম সম্পর্কে সত্য-সঠিকই হয়, তবে কেন সে তার ধর্মজ্ঞানকে প্রশস্ত করবে না?’ এটাই তাকে পরবর্তীতে আমেরিকান মুসলিম স্কলার মুহাম্মাদ ইউসুফ শাওয়ারেবীর সাক্ষাৎ করিয়ে দেয়।
ম্যালকম ড. শাওয়ারেবীর নিকট যান। তিনি তাকে পবিত্র ভূমি হিজাজে যাওয়ার জন্য প্রত্যয়নপত্র দেন। কারণ তখন আমেরিকানদের হিজাজে যাওয়ার জন্য তার প্রত্যয়নপত্র প্রয়োজন হতো। শাওয়ারেবী তাকে হজবিষয়ক একটি বই উপহার দেন।
ধীরে ধীরে তার পূর্ব দল ন্যাশন অফ ইসলামের সাথে তার সংকট বাড়তে থাকে। এদিকে তিনি ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও আদর্শ এবং হজ সম্পর্কে অবগত হতে থাকেন। তিনি তার সফর শুরু করেন; দেখেন আর অভিভূত হতে থাকেন, নিউইয়র্ক হতে ফ্রান্কফুট, কায়রো হতে জেদ্দা। এ কালো লোকটি তার সফরে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সাথে মিশে ইসলাম সম্পর্কে তার জ্ঞানকে আরো সমৃদ্ধ করতে থাকেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন যখন দেখেন বাদশাহ ফাহাদের উপদেষ্টা তাকে উষ্ন সংবর্ধনা দেন। তিনি বুঝতে পারেন, ইলিজা মুহাম্মাদের ইসলাম তার দেখা বর্তমান ইসলামের সাথে ন্যূনতম সম্পর্ক রাখে না।
কায়রো হতে মক্কার পথে তিনি বিমানের ককপিটে পাইলট ও সহকারী পাইলটের সাথে পরিচিত হন। তারাও তার মতো নিগ্রো। জেদ্দা বিমানবন্দরে আমেরিকা হতে আসার কারণে তাকে কিছু সময় আটকও করা হয়। সেখানেই তিনি প্রথম নামাজ পড়া শেখেন। তিনি মনে মনে বলেন, ‘কল্পনা করো! আমি একজন মুসলিম। আমি ইলিজা মুহাম্মাদের ‘ন্যাশন অফ ইসলাম’-এর নেতা; অথচ আমি জানতাম না কিভাবে নামাজ পড়তে হয়।’
পরিশেষে স্বপ্নভূমি মক্কাতে পৌঁছান। খুঁজতে থাকেন লালিত পাপমুক্ত, বৈষম্যমুক্ত জগৎ। সেখানে তার পূর্বপরিচিত ইসলামের সাথে পূর্ণরূপে তার নিকট অপরিচিত ইসলামের খোঁজ পান, যা বৈষম্যমুক্ত একবিশ্বের স্বপ্ন দেখায়; ইসলাম শুধু কালোদের ধর্ম নয়, যেমন ইলিজা ও তার ইসলাম বিশ্বাস করে। বরং তা পুরো মানবজাতির ধর্ম, সাদাকালো সকলের। মক্কার বারো দিন তাকে দেখিয়ে দেয়, সাদাকালো সকলেই যেন এক হৃদয় ও শরীর।
কাবার দৃশ্য, তালবিয়ার ধ্বনি ও মুসলমানদের ভ্রাতৃত্বের আবহ দেখে ম্যালকম খুবই প্রভাবিত হন। ইসলামকে কাছ থেকে দেখেন। প্রকৃত ইসলামের সন্ধান পান। শিক্ষা গ্রহণ করেন নামাজের, যা সম্পর্কে তিনি একদম অনবগত ছিলেন। আরববিশ্বের আলেম-ওলামার সাথে কথা বলে বুঝতে পারেন, সকল শেতাঙ্গকে দায়ী করার অর্থ সকল কালোকে দায়ী করা।
তবে আরব ও ইসলামী বিশ্বে তিনি তার স্বপ্নের নিষ্পাপ ভূমি পাননি। কারণ, প্রত্যেক ভূমিরই কিছু অন্ধকার দিক রয়েছে।
মক্কার বারো দিনের স্মৃতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ইসলামী বিশ্বে কাটানো বারো দিনে আমি একই পাত্র হতে খাবার খেয়েছি, একই পানপাত্র হতে পান করেছি, একই বিছানায় ঘুমিয়েছি, এক মহান প্রভূর ইবাদত করেছি এমন মুসলিমদের সাথে যাদের চোখ সবুজ, চুল সাদা ও চামড়া সাদা। তাদের আন্তরিকতায় পেয়েছি ঠিক একই আবহ যা পেয়েছি নাইজেরিয়া, সুদান ও ঘানা হতে আগত মুসলিমদের মাঝে। মনে পড়ে মুযদালিফার ময়দানের খোলা আকাশের নিচে রাত্রি যাপনের কথা। মনে হলো, পৃথিবীর বিভিন্ন ভূখন্ডের বিভিন্ন চেহারার ও বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ যেন একই সারিতে ঘন-নিবীড়ভাবে সদলবলে উপস্থিত।’
মক্কা হতে তার পরিবার ও বন্ধুবান্ধদের নিকট পাঠানো এক চিঠিতে তিনি জানান, ‘আমি তোমাদের যা বলবো তা হয়তো তোমাদের অবাক করে দেবে, কিন্তু এ ভূখন্ডে আমি যা দেখেছি, তা আমার চিন্তা-চেতনাকে পুরো পরিবর্তন করে দিয়েছে। আমার পূর্ব-অভিজ্ঞতা হতে সহজেই মুক্ত হতে পারছি। এটা হলো নিষ্পাপতা ও মায়া-মমতার বিশ্ব, যেখানে ম্যালকম এক্স তার সকল পূর্ব-চিন্তা-চেতনা বিসর্জন দিয়ে উপনীত হয়েছে।
মক্কা হতে ফেরার পথে ম্যালকম তার নতুন ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বাগত জানান। প্রত্যাখ্যান করেন ইলিজার ইসলামের, যার মূল দৃষ্টিভঙ্গিই হলো শেতাঙ্গ মানেই শয়তান। তিনি এখন মনে করেন, অনারবীর ওপর আরবীর, সাদার ওপর কালোর কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শ্রেষ্ঠত্ব কেবল তাকওয়া ও সু-বিবেচনাসম্পন্ন মানবীয় বিবেক বুদ্ধির।
ফিরতি পথে ম্যালকম বৈরুতে বিভিন্ন লেকচার দেন। সেখানে আফ্রো আমেরিকানদের থেকে নজীরবিহীনভাবে স্বাগত হন। বৈরুত হতে কায়রো, তারপর নাইজেরিয়া। মিলিত হন অনেক মুসলিম ব্যক্তিত্বের সাথে।
নামসর্বস্ব ইসলামের সাথে দীর্ঘ বারো বছরের সম্পর্কের পর আমেরিকান বক্তার চিন্তা-চেতনায় আসে পরিশুদ্ধতা। দীর্ঘ ৩৯ বছরের জেঁকে বসা বিদ্বেষপূর্ণ ভার হতে নিজেকে মুক্ত অনুভব করেন।
হ্যাঁ, ম্যালকম ফিরে আসেন অপরাধজীবন হতে ঈমানের পথে, বিকৃত ঈমান হতে সরল-সঠিক ঈমানের দিকে। তবে এ নতুন জীবনের পর ইহজগতে বেশী সময় থাকতে পারেননি। মাত্র একবছর তিনি জীবত ছিলেন। এ সময়ের মধ্যে ছিলেন সাহসী, নিজ কর্মে নিবেদিতপ্রাণ ও ঈমানপ্রকাশে স্পষ্টবাদী। মাত্র একবছরের মাথায় তিন নিগ্রো যুবকের গুলিতে তিনি নিহত হন।
তিনি বলেন, ‘আমি দীর্ঘ অভিজ্ঞতার পর এই আত্মতুষ্টিতে পৌঁছেছি, কিন্তু হ্যাঁ আমি পৌঁছেছি।’
আলজাজিরা অবলম্বনে
লেখক : আলেম ও অনুবাদক