কুরআনের বর্ণনায় নারী

যায়েদ মুহাম্মদ:

ইতিহাসের বিভিন্ন পাঠেই আমরা জানতে পারি, ইসলাম-পূর্ব যুগে নারীদের মর্যাদা ও গুরুত্ব সমাজিকভাবে স্বীকৃত ছিল না। নানাভাবেই নারীসমাজ বিভিন্ন হেনস্থা ও অধিকারহীনতার কবলে পড়েছেন। নারীকে সমাজের একটা খণ্ডিত অংশ হিসেবে দেখা হত। নারীর মৌলিক অধিকার, মানবিক মর্যাদা এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বলতে কিছুই ছিল না জাহেলি-সমাজে। অর্থনৈতিক কারণে নারীকে বাড়তি বোঝা বলে গণ্য করা হত; কখনো কখনো দারিদ্র‍্যের ভয়ে মেয়েদেরকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হত—ইতিহাসের পাতায় এমন মর্মান্তিক ঘটনাও বর্ণিত হয়েছে। কেউ কেউ নারীর মানবিক সম্মান স্বীকার করলেও নারীর জন্ম পুরুষের সেবার জন্য, এমন ধারণায় বিশ্বাসী ছিল। ফলে নারীর পূর্ণ সম্মান বলতে যা বোঝায়, তা কোনোভাবেই সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল না। সমাজের ধ্যানধ্যারণার মধ্যেই স্পষ্টত নারীর প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলা সামাজিক নৈতিকতার মানদণ্ডে অপরাধ ছিল না।

নারী-সমাজের এই পরিস্থিতিতে ইসলাম ধর্মের সূচনা হয়। ইসলাম যেহেতু নতুন দ্বীন; পূর্ববর্তী জাহেলিয়াত ও অনৈতিকতা থেকে বেরিয়ে মানুষকে নতুন ও গ্রহণযোগ্য জীবন-যাপনের আদেশ করে। ফলে নারী সম্পর্কে ইসলামের মৌলিক ধারণা কি তা জানা জরুরি। তবে এরও পূর্বে গুরুত্বপূর্ণ হলো—সে সময়ের নারী-সমাজের প্রেক্ষাপট জেনে নেয়া। কারণ ইসলামের সমাজ-বিপ্লবের সাথে পূর্ববর্তী সমাজের অনৈতিকতার মাত্রা ও সীমার যোগসূত্র রয়েছে। কোনোভাবেই পূর্বের সামাজিক অবস্থানকে এড়িয়ে ইসলামি বিধানের মর্ম যথার্থভাবে উপলব্ধি করা যাবে না। অবশ্য যে কোনো সামাজিক সংস্কারের অবস্থান বুঝতে হলে পূর্ববর্তী জাহেলিয়াত সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। অন্যথায় অনেক সময় ভুল উপলব্ধির জন্মও হতে পারে।

পবিত্র কুরআনে নারীদের সম্পর্কে স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে হয়েছে। বিভিন্ন প্রসঙ্গেই উঠে এসেছে নারীদের অধিকার ও মানবিক মর্যাদার বিষয়টি। এক্ষেত্রে কুরআনের বর্ণনায় কোনো অস্পষ্টতা নেই। স্পষ্টভাবেই অত্যন্ত জোরালো ভঙ্গিতে নারীদের যথার্থ মর্যাদা ও সামাজিক অবস্থান বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

নারীপুরুষ সৃষ্টিগত মর্যাদায় সমান

এটি সত্য, গঠনগতভাবে নারী-পুরুষের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। একইভাবে সার্বজনীন দৃষ্টিতে বললে, স্বভাবগত কিছু অমিলও রয়েছে। কিন্তু সৃষ্টিগত মর্যাদায় পুরুষের সাথে নারীর কিছুমাত্র পার্থক্য নেই। বরং পুরুষ সৃষ্টির বিবেচনায় যতটুকু মর্যাদার অধিকারী, একইভাবে নারীও ঠিক ততটুকু মর্যাদার অধিকারী। গঠনগত ও স্বভাবগত অমিলের কারণে নারীপুরুষের মধ্যে সৃষ্টিগত মর্যাদায় পরস্পরের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সুরা নিসার প্রথম আয়াতেই বিষয়টি উঠে এসেছে—

“হে লোক সকল! নিজ প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক ব্যক্তি হতে এবং তারই থেকে তার স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন। আর তাদের উভয় থেকে বহু নর-নারী (পৃথিবীতে) ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং আল্লাহকে ভয় কর, যার অছিলা দিয়ে তোমরা একে অন্যের কাছে নিজেদের হক চেয়ে থাক। এবং আত্মীয়দের অধিকার খর্ব করাকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখেন।” ( সুরা নিসা-আয়াতক্রম-১)

আয়াতের অর্থ সুস্পষ্ট— পুরুষ বা নারী যেই হোক, তারা উভয়েই একই সূত্রধারায় এসেছে। উভয়ের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। পুরুষের বংশধারা যেমন আদম-হাওয়ার সঙ্গে মিলেছে, একইভাবে নারীর বংশাধারাও আদম-হাওয়া থেকেই শুরু হয়েছে। কাজেই উভয়ের বাবা এবং মা একই ব্যক্তি। এ হিসেবে দুজন ভাইয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের মত নারী-পুরুষের সম্পর্ক। দুজনের মানবিক মর্যাদাগত অধিকার একই, কম বা বেশি নয়। এদিকে ইঙ্গিত করেই নবীজি বলেছেন— নারী ত পুরুষের ভাই।

নারীর ইবাদত

পুরুষের মতই নারীকে ইবাদতের আদেশ দেয়া হয়েছে। ইবাদতের ক্ষেত্রে কাউকে সুযোগ দেয়া, কাউকে বঞ্চিত করার বিধান ইসলামে নেই। নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই ইবাদতের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুরা আহযাবে এসেছে—

নিশ্চয়ই আনুগত্য প্রকাশকারী পুরুষ ও আনুগত্য প্রকাশকারী নারী, মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী, ইবাদতগােজার পুরুষ ও ইবাদতগােজার নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীল নারী, আন্তরিকভাবে বিনীত পুরুষ ও আন্তরিকভাবে বিনীত নারী, সদকাকারী পুরুষ ও সদকাকারী নারী, রােযাদার পুরুষ ও রােযাদার নারী, নিজ লজ্জাস্থানের হেফাজতকারী পুরুষ ও হেফাজতকারী নারী এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও স্মরণকারী নারী- আল্লাহ এদের সকলের জন্য মাগফেরাত ও মহা প্রতিদান প্রস্তুত করে রেখেছেন। ( সুরা আহযাব-৩৫ )

এই আয়াতের শানে নুজুল থেকে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়। সাহাবি উম্মে আম্মারাহ একবার নবীজিকে প্রশ্ন করেন, কুরআনে যা এসেছে সবই দেখি পুরুষের জন্য। নারীদের জন্য কিছুই ত আসেনি। এরই উত্তরে আয়াতটি নাজিল হয়।

বস্তুত পবিত্র কুরআনে মুসলিমদের যখনই কোনো হুকুম দেয়া হয়েছে কিংবা সুসংবাদ শোনানো হয়েছে সাধারণত তখন পুরুষবাচক শব্দ দিয়ে সম্বোধন করা হয়েছে; যদিও নারীরা এ সম্বোধনের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। কিন্তু সাহাবী উম্মে আম্মারাহর মনে আগ্রহ জাগে, আল্লাহ যদি নারীদের কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করতেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আয়াতটি নাজিল হয়। কাজেই নারীও পুরুষের মতই ইবাদতের জন্য আদেশপ্রাপ্ত, উভয়েই একজন রবের বান্দা। ইবাদতের ভিত্তিতে উভয়ে সম্মানীত হবেন পরকালে। কেবল পুরুষ হওয়ার কারণে কোনো পুরুষ ইবাদতের ক্ষেত্রে বিশেষ সম্মান পাবেন না৷

দ্বীনপ্রচারে অংশগ্রহণ

পুরুষের মত নারীরাও কি দ্বীনপ্রচারে অংশ নিতে পারবে? নাকি তাদের জগত-সংসার সীমিত? উত্তর হচ্ছে, সামাজিকভাবে দ্বীন-প্রচার, দ্বীনের চর্চা, দ্বীনী জ্ঞানের বিস্তার—এসবের ক্ষেত্রে নারীও সমান ভূমিকা রাখতে পারবে। তবে নারীকে নির্ধারিত বিধান মেনেই দ্বীন-প্রচার করতে হবে। সুরা তাওবায় এসেছে—মুমিন নর ও মুমিন নারী পরস্পরের একে অন্যের সহযোগী। তারা সৎকাজের আদেশ করে, অসৎ কাজে বাধা দেয়, নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। তারা এমন লোক, যাদের প্রতি আল্লাহ নিজ রহমত বর্ষণ করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। ( সুরা তাওবা,৭১)

পরকালীন প্রতিদান

নারী কি পুরুষের মতই প্রতিদান পাবে? সাধারণত শ্রেণীবিভাজনের ক্ষেত্রে একজনকে বেশি প্রতিদান দেয়া হয়, অন্যজন একই কাজ করার পরও তাকে একটু কম প্রতিদান দেয়া হয়। পবিত্র কুরআনের ভাষ্যমতে নারী-পুরুষের মধ্যে এমন কোনো বিভাজন নেই। পুরুষ কেবলমাত্র পুরুষ হওয়ার কারণে যেমন অতিরিক্ত প্রতিদান প্রাপ্য হবে না। একইভাবে নারীও কেবলমাত্র নারী হওয়ার শাস্তিতে প্রতিদান থেকে বঞ্চিত হবে না৷ এক্ষেত্রে নারী-পুরুষের আলাদা বিভাজন নেই। বরং নারী স্বাভাবিক নিয়মেই আমল অনুযায়ী প্রতিদান পাবে৷ একচুল পরিমাণও এদিক সেদিক করা হবে না। সুরা আলে ইমরানের আয়াত—

সুতরাং তাদের প্রতিপালক তাদের দু’আ কবুল করলেন এবং বললেন আমি তোমাদের মধ্যে কোন আমলকারীর কর্মফল নষ্ট করব না, তা সে পুরুষ হোক বা নারী। তোমরা পরস্পরে একই রকম। ( আলে ইমরান, ১৯৭)

সুরা নাহলের ৯৭ তম আয়াত— যে ব্যক্তিই মুমিন থাকা অবস্থায় সকর্ম করবে, সে পুরুষ হােক বা নারী, আমি অবশ্যই তাকে উত্তম। জীবন যাপন করাব এবং তাদেরকে তাদের উৎকৃষ্ট কর্ম অনুযায়ী তাদের প্রতিদান অবশ্যই প্রদান করব।

সুরা নিসার ১২৪ তম আয়াতেও বিষয়টি উঠে এসেছে—আর যে ব্যক্তি সৎকাজ করবে, পুরুষ হোক বা নারী, যদি সে মুমিন জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি সামান্য পরিমাণও জুলুম করা হবে না।

কাজেই কর্মের পরকালীন প্রতিদানের ক্ষেত্রে নারীপুরুষের আলাদা কোনো শ্রেণীবিভাজন নেই। উভয়েই এক্ষেত্রে পূর্ণ সমান অধিকার রাখেন।

অর্থনৈতিক অধিকার

বিভিন্ন ধর্ম ও ফেরকায় নারীদেরকে অর্থনৈতিক মালিকানা থেকে বঞ্চিত করা হয়ে থাকে। এটি নারী শোষণের অন্যতম হাতিয়ার। নারীকে অর্থনৈতিক মালিকানা থেকে পূর্ণ বঞ্চিত করা হলে তাকে শ্রেণীবিভাজনের মধ্যে আটকে ফেলা সহজ হয়। কিন্তু পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন প্রসঙ্গেই নারীদের অর্থনৈতিক সক্ষমতার বিষয়টি উঠে এসেছে। তারা পুরুষের মতই মালিকানার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক সক্ষমতা রাখেন। বেচাকেনা থেকে যাবতীয় বিষয়াদির সাথে নারীদের কোনো বিরোধ নেই। লেনদেন সংক্রান্ত যে কোনো ধরনের কাজেই তারা শরিক হতে পারবেন। উত্তঅরাধিকার সম্পত্তিতেও তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়নি। বরং নারীদেরকে উত্তরাধিকরার সম্পত্তি দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে বিষয়ে কুরআন স্পষট নির্দেশনাও দিয়েছে।

নারী যখন মা

মা হিসেবে ইসলামে নারীকে বিশেষ সম্মান দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনে নানাভাবে বিষয়টি উঠে এসেছে। মায়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করাটাকে উত্তম আমল হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কেবল একবার নয়, কয়েকবার আল্লাহ তায়ালা এ প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছেন, যাতে শ্রোতার অন্তরে এই বিষয়টি গেঁথে যায়। গভীর প্রভাবে ফেলে শ্রোতার হৃদয়ে। প্রসব-বেদনা থেকে নিয়ে সন্তানের জন্য মা যেসব ত্যাগ স্বীকার করেন সেগুলো উল্লেখ মায়ের গুরুত্ব ও বিশেষ মর্যাদার কথা এসেছে পবিত্র কুরআনে। সুরা লুকমানে এসেছে—
আমি মানুষকে তার পিতা-মাতা ও সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছি-(কেননা) তার মা কষ্টের পর কষ্ট সয়ে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে আর তার দুধ ছাড়ানাে হয় দু’ বছরে- তুমি শোকর আদায় কর আমার এবং তােমার পিতা-মাতার। আমারই কাছে (তােমাদেরকে) ফিরে আসতে হবে। (সুরা লুকমান, ৭)

কাছাকাছি অর্থেই পুনর্বার সুরা আহকাফে এসেছে—আমি মানুষকে তার পিতা – মাতার সদ্ব্যবহার করার হুকুম দিয়েছি। তার মা তাকে অতি কষ্টের সাথে ( গর্ভে ) ধারণ করেছে এবং অতি কষ্টে তাকে প্রসব করেছে। তাকে ( গর্ভে ) ধারণ ও দুধ ছাড়ানোর মেয়াদ হয় ত্রিশ মাস। (সুরা আহকাফ, ১৫)

মুমিন নারী-পুরুষের জন্য উত্তম দৃষ্টান্ত হিসেবে আল্লাহ তায়ালা ইতিহাসের ত্যাগ-স্বীকারকারী সৎ মায়েদের গল্পও বলেছেন। এই গল্পঘটনাগুলো শ্রোতার অন্তরে ঈমানের স্বাদ ও আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়।

নারী যখন মেয়ে

ইসলামপূর্ব আরব-জাহেলি যুগে কন্যাসন্তানকে অলুক্ষণে মনে করা হত। কন্যাসন্তান কোনো কাজের না, এমনই মনোভাব পোষণ করত সে সময়ের লোকেরা। মেয়েরা কেবল নাকি কান্না করত, যুদ্ধ বা লড়াইয়ে কোনো সহযোগিতা করতে পারত না। এমন বিস্তর অভিযোগ নিয়ে তারা কন্যাসন্তানকে ভালো চোখে দেখত না। কন্যাসন্তানের জন্ম হলে তাদের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যেত। সুরা নাহলে এসেছে—

যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তান ( জন্মগ্রহণ ) -এর সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন তার চেহারা মলিন হয়ে যায় এবং সে মনে মনে দুঃখ – ক্লিষ্ট হয়।
সে এ সুসংবাদকে খারাপ মনে করে। মানুষ থেকে লুকিয়ে বেড়ায় ( এবং চিন্তা করে ), হীনতা স্বীকার করে তাকে নিজের কাছে রেখে দেবে, নাকি তাকে মাটিতে পুঁতে ফেলবে। জেনে রেখ, তারা যে সিদ্ধান্ত স্থির করে তা অতি মন্দ! (নাহল—৫৮,৫৯)

কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়ারও ভয়ানক রেওয়াজ ছিল। বাবা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিবেন এটাও নৈতিকভাবে অপরাধ ছিল না। ভবিষ্যত দারিদ্র্যের ভয়ে কিংবা সামাজিক গ্লানির কারণে তারা এমনটি করতেন। পবিত্র কুরআনে এ ভয়ানক রীতির শক্ত নিন্দা করা হয়েছে। সুরা তাকবিরে এসেছে—
এবং যখন জীবন্ত প্রােথিত কন্যাকে, জিজ্ঞেস করা হবে। তাকে কী অপরাধে হত্যা করা হয়েছিল? ( ৮, ৯)

ইসলাম কন্যাসন্তানকে ছেলেসন্তানের মতই সমান গণ্য করে। কন্যা বা ছেলে এদুটোর মধ্যে পার্থক্য করে না। বরং মেয়েও ছেলের মতই সমান মর্যাদাবাহী এমনটি কুরআনে এসেছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে ছেলে হোক, মেয়ে হোক সন্তানপ্রাপ্তিটাই এক বিরাট। সুরা শুরার আয়াত—
আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যা চান সৃষ্টি, করেন। যাকে চান কন্যা দেন এবং যাকে চান পুত্র দেন।
অথবা পুত্র ও কন্যা উভয় মিলিয়ে দেন। আবার যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি সবজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। (৪৯-৫০)

পাশাপাশি পবিত্র কুরআন নারীদের কিছু গল্পঘটনাও উল্লেখ করেছে। যে ঘটনাগুলো থেকে বোঝা যায়, ক্ষেত্র বিশেষ নারীরা কিংবা কন্যাসন্তানরা অসংখ্য পুরুষের চেয়েও উত্তম ভূমিকা পালন করে। আল্লাহর প্রিয় হয়ে ওঠে। কাজেই কেবলমাত্র নারী হওয়ার কারণে তারা অলুক্ষণে হয় না।

আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসে কন্যাসন্তানের বিশেষ ফজিলত উঠে এসেছে। তাদের লালন-পালন, সঙ্গ দেয়া, প্রয়োজন পূরণ করা এসবের প্রতি বিশেষ উতসাহ দিয়েছেন নবীজি।

ফলে ইসলামে কোনোভাবেই কন্যাসন্তান উপেক্ষার বিষয় নয়। কোনোভাবেই কন্যাসন্তানের জন্মকে অশুভ মনে করা হয় না। বরং কন্যাসন্তান একজন মুসলিমের জন্য বিশেষ নেয়ামত। এমন নেয়ামত যে নেয়ামতের জন্য একজন মুসলিম বাবার মন উতসুক থাকে। অনেক ফজিলত ও মর্যাদার কথাও এসেছে।

নারী যখন স্ত্রী

নারীত্বের ভয়াবহ অবমাননা বোধহয় এটিই যে নারীকে বিবাহের যোগ্যই মনে না করা। অথচ আল্লাহ তায়ালা নারীকে পুরুষের প্রশান্তি ও আস্থার কারণ বলেছেন। নারী-পুরুষ পরস্পরের পরিপুরূক। এদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও সৌহার্দ্যের নেয়ামত দেয়া হয়েছে। কিছু কিছু ধর্মে নারীকে অস্পৃশ্য মনে করা হত। কিংবা নারীসংস্পর্শ থেকে পুরোপুরি দূরে থাকাকেও ইবাদত বলে গণ্য করত। কেউ কেউ আবার নারীকে কেবল ভোগ্যপণ্য বলেই বিবেচনা করত। কিংবা পুরুষের কাজকর্মের একান্ত দাসী। পবিত্র কুরআন এই ধ্যানধারণাগুলোর ভিত্তি ভেঙে দেয়। বৈরাগ্য ইত্যাদি ধারণাকেও প্রশ্রয় দেয়া হয় না। বরং বিবাহের প্রতি বিশেষ উতসাহ দেয়া হয়। নারী-পুরুষের পারস্পরিক বৈবাহিক সম্পর্ককে আল্লাহ অন্যতম নিদর্শন হিসেবেই উল্লেখ করা হয়। সুরা রূমের আয়াত—

তার এক নিদর্শন এই যে, তিনি তােমাদের জন্য তােমাদেরই মধ্য হতে স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তােমরা তাদের কাছে গিয়ে শান্তি লাভ কর এবং তিনি তােমাদের পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এর ভেতর নিদর্শন আছে সেই সব লােকের জন্য, যারা চিন্তা-ভাবনা করে। (২১)

তাছাড়া বিভিন্ন হুকুক ও অধিকার উঠে এসেছে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে। একজন স্বামী কিভাবে স্ত্রীকে মূল্যায়ন করবে, স্ত্রীর কি কি হক আদায় করবে —এমন নানাবিধ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে আলোচনা করা হয়েছে।

নারীর ব্যক্তিত্ব, নারীকেন্দ্রিক কোমলতা, নারীর মর্যাদা ও অধিকার, সমাজে নারীর ভূমিকা বিষয়ে পবিত্র কুরআনে অসংখ্য আয়াত নাজিল হয়েছে। নারী-নামে স্বতন্ত্র একটি সুরাই নাজিল হয়েছে। কাজেই কুরআনে নারী-প্রসঙ্গ একটি উল্লেখযোগ্য প্রসঙ্গ। কোনোভাবেই এই দিকটিকে উপেক্ষা করা যায় না। কেবলমাত্র কুরআনের দিকে তাকিয়েই নারী সম্পর্কে অসংখ্য সামাজিক ভুল ধারণা ও শোষণের দিকগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ইসলামে নারীর মর্যাদা ও অবস্থান জানা যায়। নারী মুসলিম সমাজের অন্যতম সদস্য। পুরুষের মতই সহযোগী সমাজ বিনির্মাণে। কর্মক্ষেত্রের নানা বিভাজন থাকলে উভয়েই সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখে। সমাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য নারী—এটিই কুরআনের মৌলিক ভাষ্য।

আগের সংবাদশবে বরাত উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আয়োজন
পরবর্তি সংবাদনারী ফেকাহবিশারদ ও তাঁদের পরিচালিত পাঠ্যসভা