রাকিবুল হাসান নাঈম:
কওমি মাদরাসার কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগুলো ছাত্রদের যোগ্যতা সঠিকভাবে যাচাই করতে পারছে না। এক্ষেত্রে সিলেবাস এবং পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ধরণকে দায়ি করছেন শিক্ষকরা। তারা বলছেন, জেনারেল ধারার শিক্ষার মতো এখানেও ঢুকে গেছে পরীক্ষায় ভালো করার গতানুগতিক প্রতিযোগিতা। ফলে বাড়ছে নোট-গাইড নির্ভরশীলতা এবং আরবি বাদ দিয়ে বাংলায় লেখার প্রবণতা।
কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগুলোর মধ্যে বেফাকের অধীনে পরীক্ষা হয় তাইসির, নাহবেমির, শরহেবেকায়া এবং মেশকাতে। তাকমিলের পরীক্ষা হয় হাইয়াতুল উলয়ার অধীনে। নাহবেমিরের প্রশ্নপত্র হয় বাংলায়। ছাত্ররাও পরীক্ষা দেয় বাংলায়। শরহেবেকায়া, মেশকাত ও তাকমিলে প্রশ্নপত্র আরবিতে হলেও অধিকাংশ ছাত্রই উত্তরপত্র লিখে বাংলায়। হাইআতুল উলইয়ার পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং সহপরিচালকের সঙ্গে কথা বলে এই চিত্র পাওয়া গেছে।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘মূলত কওমি ধারায় পরীক্ষাটা মূল লক্ষ্য না। মূল লক্ষ্য থাকে ছাত্রদের যোগ্য করে তোলা। তাই শিক্ষকরাও পরীক্ষার উপর জোর দেন না। জোর দেন নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকাকে। তবে যারা সারাবছর ভালো করে পড়াশোনা করে, তার পরীক্ষাতে ভালো করেই।’
যোগ্যতার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘কওমি ধারায় চেষ্টা করা হয়, একজন ছাত্র যেন আরবিতে পূর্ণ যোগ্য হয়ে উঠে। যেহেতু ইসলামের মূল ভাষ্য আরবিতে, তাই। শিক্ষকরা এটাই চেষ্টা করেন। কিন্তু পরীক্ষায় যে বাংলায় লেখার স্রোত তৈরী হয়েছে, এটা হয়েছে অসুস্থ এক প্রতিযোগিতার কারণে। এখন জেনারেল শিক্ষার মতো কওমি শিক্ষাতেও ভালো রেজাল্ট নিয়ে তোড়জোড় দেখা যায়। ছাত্রের মৌলিক যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক। ফলে অনেকে নোট-গাইড পড়ে পরীক্ষায় ভালো করে ফেলছে।’
কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগুলো ছাত্রদের যোগ্যতা সঠিকভাবে যাচাই করতে পারছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যোগ্যতা সঠিকভাবে যাচাই করতে পারছে এটা বলা যাবে না। এই না পারার পেছনে দুটি কারণ আছে।
প্রথমত, প্রশ্নপত্রের ধরণ এবং পরীক্ষা সিস্টেম। নাহবেমিরে আরবি পড়া শুরু হয়। ব্যাকরণের প্রথম গ্রন্থ পড়ানো হয়। তাই প্রথম বই পড়েই তাদেরকে কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে। ফলে তারা আরবিতে লিখতে পারছে না। প্রশ্নপত্রও ঠিকভাবে করা যাচ্ছে না। সহজ করতে হচ্ছে। ফলে যোগ্যতা যাচাইয়ের মানদণ্ড ব্যহত হচ্ছে। এটা না করে যদি হেদায়াতুন্নাহু কিংবা কাফিয়াতে কেন্দ্রীয় পরীক্ষাটা নেয়া হতো, তাহলে যোগ্যতা যাচাইয়ের প্রশ্ন ছিল। কারণ, তখন সে নাহু-সরফের বেশ কয়েকটি কিতাব পড়ে ফেলে। তখন মন খুলে যেমন প্রশ্ন করা যায়, ছাত্ররাও উত্তর দিতে পারে। নাহবেমিরে সে সুযোগ নেই।
দ্বিতীয়ত, আমাদের সিলেবাস। প্রশ্নপত্রের মান উন্নত করতে বোর্ড যেমন তৎপরতা দেখায়, বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নেয়, সিলেবাস পরিমার্জন কিংবা উন্নত করতে এই উদ্যোগ দেখা যায় না। ফলে অস্থিরতা তৈরী হয়। মিজনা-নাহবেমির কিতাব দুটি ফারসি ভাষায় লেখা। অনেকেই ফারসি পড়ান না। বাংলায় কিংবা আরবিতে পড়ান। এছাড়াও বিভিন্ন ক্লাসে বিভিন্ন কিতাব পরিমার্জন করা যেতে পারে। যেগুলো ছাত্রদের যোগ্যতা বৃদ্ধি করবে।’
তবে বেফাক বোর্ড মহাপরিচালকের দাবি, চলতি বছর শুরু হওয়া বেফাক পরীক্ষার ধরণে বেশ পরিবর্তন এনেছেন তারা। এতে ছাত্রদের যোগ্যতা যাচাই হবে। মহাপরিচালক মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভি ফাতেহকে বলেন, ‘এবারের প্রশ্নগুলো লক্ষ্য করলে দেখবেন, যারা গাইড নির্ভর পড়াশোনা করেছে, তারা আটকে যাচ্ছে। তারা লিখতে পারছে না। আমরা এবার প্রশ্নপত্রের ধরণ বদলে দিয়েছি। ফলে মূল বই না পড়ে পরীক্ষায় বসলে সে লিখতে পারবে না। সামনে এটা আরও পরিবর্তন হবে।’
কয়েকজন শিক্ষক ফাতেহকে জানিয়েছেন, এবারের বেফাক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ধরণ বদলেছে। যারা গাইডনির্ভর পড়াশোনা করেছে, তারা ভালো করতে পারছে না। বরং যারা মুল কিতাব ভালো করে পড়েছে, তারাই ভালো করছে।