কেন হজের খরচ বাড়ছে?

রাকিবুল হাসান নাঈম:

সব রেকর্ড ভেঙে বাংলাদেশি হজযাত্রীদের গত বছরের তুলনায় এবার দেড় লাখ টাকা বেশি গুণতে হচ্ছে। ইতোমধ্যেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজে যাওয়ার সর্বনিম্ন প্যাকেজ ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৮ টাকা নির্ধারণ করেছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। এছাড়া বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় প্যাকেজের মূল্য ৬ লাখ ৫৭ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

গত বছর সরকারিভাবে হজে যেতে প্যাকেজ-১ এ পাঁচ লাখ ৮৬ হাজার ৩৪০ এবং প্যাকেজ-২ এ পাঁচ লাখ ২১ হাজার ১৫০ টাকা খরচ হয়েছে। বেসরকারিভাবে এজেন্সিগুলোর ‘সাধারণ প্যাকেজ’র মাধ্যমে হজ পালনে খরচ হয়েছিল পাঁচ লাখ ২২ হাজার ৭৪৪ টাকা। গতকাল ঘোষিত প্যাকেজানুযায়ী গত বছরের প্যাকেজ-১ এর তুলনায় এবার খরচ বেড়েছে ৯৬ হাজার ৬৭৮ টাকা ও প্যাকেজ-২ এর তুলনায় খরচ বেড়েছে এক লাখ ৬১ হাজার ৮৬৮ টাকা।

চলতি বছর হজ পালনে গত ৯ জানুয়ারি সৌদি আরবের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক হজচুক্তি করেছে বাংলাদেশ। হজচুক্তি অনুযায়ী এ বছর আগের মতোই এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজযাত্রী বাংলাদেশ থেকে হজে যেতে পারবেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৫ হাজার, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এক লাখ ১২ হাজার ১৯৮ জন হজযাত্রী পবিত্র হজ পালন করতে পারবেন।

প্রভাব ফেলছে ডলার সঙ্কট

হজযাত্রার খরচ বৃদ্ধির পেছনে সবচে বেশি প্রভাব ফেলেছে ডলার সঙ্কট। সরকার থেকে শুরু করে হাব এজেন্সি সবার কথাতেই এ সঙ্কট উঠে এসেছে।

সংবাদ সম্মেলনে গত বছর থেকে এবার হজ প্যাকেজের খরচ যাওয়ার কারণ তুলে ধরে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক বলেন, ‘গত বছর রিয়ালের মূল্য ছিল ২১ টাকা, এখন সেই রিয়ালের মূল্য ৩০ টাকা। এক লাখ টাকার বেশি এখানেই চলে আসে। আনুষঙ্গিক ব্যয় খুব একটা বাড়েনি।’

এ প্রসঙ্গে কথা হয় হাবের দায়িত্বশীল সচিব মোঃ মাহবুব উল ইসলামের সঙ্গে। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘রিয়ালের দাম বেড়ে যাবার কারণে এবার খরচটাও বেড়েছে।’

সরকার নিবন্ধিত হজ এজেন্সি ইউনিভার্সাল ট্রাভেল বিডির পরিচালক তানভির আহমদ ফাতেহকে বলেন, ‘সবচে বড় সঙ্কট ডলার সঙ্কট। তাছাড়া সৌদি সরকারও সব ধরনের সেবার দাম বাড়িয়েছে। দুটো মিলে এখন হজযাত্রীদের খরচ চূড়ান্ত বেড়ে গেছে।’

ঝোঁপ বুঝে কোপ বিমানের

বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে একটানে ৬০ হাজার টাকা দাম বাড়িয়েছে এয়ারলাইনস। গত বছর হজযাত্রীদের বিমানভাড়া এক লাখ ৪০ হাজার টাকা থাকলেও এবার তা বেড়ে প্রায় দুই লক্ষ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। বিমানভাড়ার বিষয়ে ফরিদুল খান বলেন, ‘এক লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা। বিমানভাড়া কেন বেড়েছে তা আপনাদের বিবেচনা করা উচিত। বর্তমান বৈশ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিমানভাড়া বেড়েছে। বিমানভাড়া নিয়ে আমরা বিমান মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তিনদিন বসেছি। বর্তমান সময় আমাদের অনুকূলে না থাকার কারণে বিমানভাড়া বাড়াতে হয়েছে।’

বিমান ভাড়া যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে ভাড়া নির্ধারণে স্বতন্ত্র টেকনিক্যাল কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল হজ এজেন্সি মালিকরা। তাদের অভিযোগ হলো, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস সারাবছরের লোকসানের ধকল কাটিয়ে উঠে হজযাত্রীদের ওপর অতিরিক্ত ভাড়ার বোঝা দিয়ে। হজ ফ্লাইট থেকে বিমান ৮০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত মুনাফা করে। বিমানের আয়ের ১৫ শতাংশ হয় হজ ফ্লাইট থেকে। বিমান বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১০ থেকে ২০ কোটি টাকা মুনাফা রেখে ভাড়া প্রস্তাব করলে হজযাত্রীদের ওপর আর্থিক চাপ কমবে।

হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম বলেন, ‘এবার বিমার ভাড়া বৃদ্ধি ও বিমানের কনভারশন রেট কমাতে না পারায় হজের প্যাকেজ দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।’।

হাবের সচিব মাহবুব উল ইসলাম ফাতেহকে বলেন, ‘হাবের নেতৃবৃন্দ বিমান ভাড়া এতো টানা নির্ধারণ না করতে অনুরোধ করেছিলেন। এই বিমান ভাড়া নির্ধারণ করেছিল ২ লক্ষ ১০ হাজার ৩ শ টাকা। সেখান থেকে হাব সভাপতির জোর প্রচেষ্টা ও অনুরোধে সেখানে থেকে প্রায় ১৩ হাজারের বেশি টাকা কমে এসেছে। কিন্ত নেতৃবৃন্দ আরো কমাতে বলেছিলেন। কিন্তু৷ বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের পরিস্থিতি বিবেচনায় আর কমানো যায়নি।’

খরচ চাইলে কমানো যেত

তবে এবার সরকারি হজ প্যাকেজ থেকে ২৫ হাজার টাকা কমে হজপ্যাকেজ ঘোষণা করেছে হাব। এর নজির আগে কখনও পাওয়া যায়নি। দামটা কীভাবে কমানো হলো জানতে চাইলে হাব সচিব ফাতেহকে বলেন, ‘যে খরচগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ না, যেগুলো না হলেও চলে যায়, এসব খাতগুলো আমরা বাদ দিয়েছি। এরচেয়ে কমানো আমাদের পক্ষে সম্ভব না।’

হজের খরচ এরচেয়ে কমানো সম্ভব কিনা জানতে চাইলে ইউনিভার্সাল ট্রাভেল বিডির পরিচালক তানভির আহমদ ফাতেহকে বলেন, ‘বিমান ভাড়াটা কমালেই অনেক খরচ কমে যেতো।’

এ প্রসঙ্গে কথা হয় রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী মাদরাসা জামিয়া আরাবিয়া এমদাদুল উলুম ফরিদাবাদের মুহাদ্দিস মুফতি ইমাদুদ্দিনের সঙ্গে। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘খরচ বাড়লে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। খরচ অনুযায়ী হজ ফরজ হলে হজে যাওয়া লাগবে। নয়ত যাওয়া লাগবে না। কিন্ত হজ গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। সব মুসলমানদের আবেগ এটার সঙ্গে জড়িত। সরকার যদি ভর্তুকি দিয়ে হলেও হজের খরচটা কমাতো, তাহলে মানুষের জন্য সহজ হতো। সরকারও এটার সাওয়াব পেতো।’

মুফতি ইমামুদ্দিন বলেন, ‘আমাদের পাশের অমুসলিম দেশেও হজের খরচ কম। আমাদের চেয়ে গরিব দেশও ভর্তুকি দিয়ে হজের খরচ কমায়। যেই দেশ থেকে সরাসরি হজে যাওয়া যায় না, সেই দেশও ভর্তুকি দিয়ে হজের খরচ কম রাখে। তেমনি আমাদের সরকারও যদি খরচটা কমিয়ে দিতো, ভালো হতো। শুধু ভালো না, সরকারের জন্য কমানোটা উচিত।’

আগের সংবাদপাঠ্যক্রমে ইতিহাস বিকৃতি: প্রতিবাদ করছেন ইতিহাস বিশেষজ্ঞরাও
পরবর্তি সংবাদমানসম্মত চিকিৎসায় আর ছাড় নয়: স্বাস্থ্যমন্ত্রী