কেমন আছে বাংলাদেশের নারী ইফতা বিভাগগুলো?

রাকিবুল হাসান:

ইফতা পড়ার জন্য বাংলাদেশে পুরুষদের জন্য ইফতা বিভাগ অনেক থাকলেও নারীদের জন্য নেই বললেই চলে। গেলো কয়েকবছরে নারীদের জন্য ইফতা বিভাগের আয়োজন শুরু হয়েছে মাত্র। নারীদেরকে ইফতা পড়ানোর ব্যবস্থাপনা করতে গিয়ে যেমন সামনে আসছে বিভিন্ন সঙ্কট, তেমনি সংশ্লিষ্টগণ দেখতে পাচ্ছেন বিপুল সম্ভাবনা। তবে নারীদের ইফতা পড়ানোর যে যাত্রা শুরু হয়েছে, তা প্রতিষ্ঠিত হতে সময় লাগবে বলেও জানিয়েছেন তারা।

মিরপুর ১২-ত ব্লকের একটি মহিলা মাদরাসায় পড়ানো হয় ইফতা। ওই মাদরাসায় ইফতা পড়েছেন কুমিল্লা সদরের মেয়ে সালমা বিনতে ওয়াদুদ। তাকে বলা চলে নারী মুফতি। ইফতা পড়ার অভিজ্ঞতা কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মিরপুর-১২ ত ব্লক মাদরাসায় আমরা যখন ইফতা পড়তাম, আমাদের সাথী ছিলো মোট ছয়জন। নারী মুফতি দেশে না থাকায় আমরা সবসময় অন্যরকম মূল্যায়ন পেতাম সবার কাছে। যারা জানতে পারতো সম্মান করতো আমাদের। এটা একটা ভালো লাগার বিষয় ছিলো।

আমাদের দেশে নারীদের জন্য ইফতা বিভাগ না থাকায় সেই বিভাগে শিক্ষকতা করার সুযোগ নেই। শিক্ষকতা করতে পারলে আরো বেশি উপকৃত হতাম। আমাদের পরবর্তীরাও আমাদের থেকে উপকৃত হতো। তখন অভিজ্ঞতার ঝুলি সবার ভারী হতো।’

নারীদের ইফতা পড়া কতটুকু ফলপ্রসূ—প্রশ্নের জবাবে সালমা বিনতে ওয়াদুদ জানালেন, ‘আমরা যারা ইফতা পড়েছি, ব্যক্তিগতভাবে আমরা উপকৃত হয়েছি একথা স্বীকার করতেই হবে। একজন নারী হিসেবে আমি যেহেতু পর্দার বিধানের কারণে পুরুষ মুফতিদের কাছে মাসআলার জন্য যেতে পারিনা, তাই ইফতা পড়ার কারণে আমার নিজের জন্য এবং পরিবার পরিজনসহ সবার জন্য উপকার হয়েছে। পরিচিত নারীরাও এখন আমার কাছে এসে মাসআলা জানতে পারে।

বাংলাদেশে নারীদের জন্য ইফতা বিভাগ জরুরী কিনা—এমন প্রশ্ন রেখেছিলাম এই নারী মুফতির কাছে। তিনি অকপটে বললেন, ‘শরিয়ত যেহেতু নারী-পুরুষ সবাইকেই মানতে হয়, সেহেতু মানার জন্য তো জানা জরুরী। রাসূল সা. এর স্ত্রী হযরত আয়শা রা. একজন প্রসিদ্ধ রাবী ছিলেন। উত্তরসূরী হিসেবে তাদেরকে আমাদের অুনুসরণ করাও দরকার। এছাড়া আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি রহ. এর উক্তি অনুযায়ী কোরআন বুঝার জন্য হাদিস বুঝা শর্ত, হাদিস বুঝার জন্য ফিকাহ বুঝা শর্ত। কাজেই নারী-পুরুষ সবার জন্য ফিকাহ শাস্ত্র অধ্যায়নের প্রয়োজনীয়তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

তিনি আরও বললেন, ‘ছেলেরা ফিকাহ শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করলে জাতির শাখা-প্রশাখা, পাতা-পল্লব পযর্ন্ত পত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে উপকৃত হয়। আর মেয়েরা এ শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করলে জাতির ভিত্তি তথা মূল দ্বীনের ওপর মজবুত হয়। তাই আমি মনে করি নারীদের জন্য দাওরায়ে হাদীসের পাশাপাশি বাংলাদেশে ইফতা বিভাগও সর্বত্র চালু হোক। যেনো যাদের সুযোগ আছে তারা পড়তে পারে।’

নারীদের ইফতা, ব্যবস্থাপনা সঙ্কট

নারীদের জন্য ইফতা বিভাগ খোলার ঘোষণা দিয়েছিলেন মুফতি কামালুদ্দিন রাশেদী। তিনি দীর্ঘ ১৮ বছর দারুল উলুম করাচির ইফতা বিভাগের তত্বাবধায়ক ছিলেন। পরবর্তীতে শিক্ষকতা করেছেন জামিয়া মাদানিয়া দারুল উলুম যাত্রাবাড়ীতে।

সঙ্কটের কথা তুলে ধরে ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরকে তিনি বললেন, ‘নারীদের জন্য ইফতা বিভাগ খোলার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। দু’বছর চেষ্টা করেও পারিনি। কারণ দুটো। এক—সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার সঙ্কট। নারী শিক্ষক, তত্ত্বাবধায়ক, আবাসন—সবকিছুর সঙ্কট। হেনতেনভাবে করতে চাচ্ছি না। চাচ্ছি ভালেভাবেই নারীদের জন্য ইফতা বিভাগ খুলবো। দুই—আলেম এবং মুফতিদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া। তারা বলেন, নারীদের মুফতি বানানো কী দরকার। আসলে এখানে তো আমরা নারীদের মুফতি বানাচ্ছি না। মূলত তাদেরকে শিক্ষিত বানাচ্ছি। শিক্ষার অধিকার নারী-পুরুষ সবার ক্ষেত্রেই সমান।’

ব্যাতিক্রম বিরূপ প্রতিক্রিয়া সবকালে সবসময় ছিলো। তা উজিয়ে এগিয়ে যেতে চান মুফতি কামালুদ্দিন রাশেদি। বললেন, ‘নারীদের জন্য ইফতা বিভাগ খুলতে, নারীদের ইফতা পড়াতে শরীয়তে কোনো বাধা নেই। ব্যবস্থাপনা সঙ্কট কাটিয়ে গুছিয়ে নারীদের জন্য ইফতা বিভাগ খুলবো। সবার দোয়া চাই।’

২০১৮ সালে কামরাঙ্গীরচরের কুমিল্লাপাড়ায় আদ-দ্বীন ইনস্টিটিউট মহিলা মাদরাসায় শুরু হয়েছিলো নারীদের জন্য ইফতা বিভাগ। কিন্তু ব্যবস্থাপনা সঙ্কটের কারণে এক বছর পরই বন্ধ হয়ে যায় বিভাগটি। ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাওলানা মুফতি কাজি সিকান্দার প্রতিবদেককে বলেন, ‘আমাদের মাদরাসায় কয়েকজন ছাত্রী দাওরা পড়েছে। তাদের অভিভাবকরাই চাইছিলেন তাদেরকে ইফতা পড়ানো হোক। বাংলাদেশে ইফতা বিভাগ হাতেগোনা দুএকটি। আমরা তখন ইফতা বিভাগ শুরু করি। কিন্তু ব্যবস্থাপনা সঙ্কটের কারণে দ্বিতীয় বছর বিভাগটি চালু রাখতে পারিনি। ইনশাআল্লাহ, আবার শুরু করবো সব ঠিক করে।’

জানতে চাইলাম এক বছরের অভিজ্ঞতা। তিনি বললেন, ‘যদি নিবিড় তত্ত্বাবধানে নারীদেরকে ইফতা পড়ানো যায়, তাহলে অবশ্যই ফলপ্রসূ হবে। নারীদের মজলিসে নারীদের মাসআলা এবং জিজ্ঞাসাগুলোর তারা জবাব দিতে পারবে। নারীদের পরিমণ্ডলে তারা সঠিক সমাধান এবং বিশ্লেষণ তুলে ধরতে পারবে। মেধাবী এবং আগ্রহী নারী আছে; তারা ইফতা পড়তে চায়। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করে তাদের পড়াতে পারলে সমাজের জন্যও উপকার হবে।’

মুফতিগণ কী বলছেন?

‘নারীদের জন্য ইফতা বিভাগ’ টপিকে কথা বলেছিলাম শাইখ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদের সাথে। তিনি বললেন, ‘অতটুকু ইলম শিক্ষা করা ফরজ, যতটুকু দ্বারা দ্বীনের ওপর চলা যায়। নারীদের ক্ষেত্রেও একই কথা। এর অতিরিক্ত শিখতে চাইলে শিখতে পারে। বাংলাদেশে ফতওয়া দেবার জন্য পুরুষ মুফতি আছেন। এখন নারীদের মুফতি হয়ে ফতওয়া দিতেই হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা কিংবা প্রয়োজন নেই। তবুও যদি আগ্রহী নারীরা মুফতি হতে চান, হতে পারেন। তবে শর্ত হলো—নারী শিক্ষিকার কাছে পড়বে। নারী শিক্ষিকা না থাকলে, কোনো মুফতির মেয়ে তার বাবার কাছে অথবা কোনো নারী তার স্বামীর কাছে ইফতা পড়বে। তারপর সে আরেকজনকে পড়াবে। অর্থাৎ মাহরামের কাছেই নারী ইফতা পড়বে। এভাবে পড়লে ইফতা পড়া যেতে পারে। কোনো মাদরাসা যদি এমন ব্যবস্থাপনা করতে পারে, তাহলে ইফতা বিভাগ খোলা যায়। তাই ঢালাওভাবে সবাইকে সব জায়গায় ইফতা পড়ার অনুমোদন করি না।’

ইফতা পড়ানোর জন্য বাংলাদেশে নারী শিক্ষিকা পাওয়া কষ্টকরই হবে। তাহলে কি নারীদের জন্য ইফতা বিভাগ খোলা যাবেই না? জামিয়া আারাবিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ মাদরাসার মুফতি ও মুহাদ্দিস মাওলানা ইমাদুদ্দিন বলেন, ‘বাংলাদেশে নারীদের জন্য ইফতা সবেমাত্রই শুরু হয়েছে। এখনই নারী শিক্ষিকা পাওয়া যাবে না। নিয়মিতভাবে কয়েকবছর যদি নারীদের ইফতা পড়ানো হয়, তাহলে নারী শিক্ষক তৈরী হয়ে যাবে। একটা সময় মহিলা মাদরাসায় পড়ানোর জন্য শিক্ষিকা পাওয়া যেতো না। এখন অনেক মাদরাসায় নারী শিক্ষিকারাও হেদায়ার মতো কিতাব পড়াচ্ছেন।’

মুফতি ইমাদুদ্দিন আরও বললেন, ‘তবে পুরুষদের মতো সব নারীদেরও ঢালাওভাবে ইফতা পড়ার অনুমোদন করি না। যারা যোগ্য, তারাই পড়বে। ঢালাওভাবে সবাই ইফতা পড়লে ইফতা বিভাগের কলঙ্ক হবে। যোগ্য নারীদের জন্য ইফতা বিভাগের আয়োজন করতে হবে পুরুষদের মতোই। শিক্ষার ক্ষেত্রে সবার একই অধিকার। আর নারীদের মাসআলাগুলোর ফতওয়া যদি নারীরা দিতে পারেন, তাহলেই তো ভালো হয়। সবকথার পরও একটা কথা থেকে যায়। তা হলো—প্রতিষ্ঠানের শরিয়তসম্মত সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। এই ব্যবস্থাপনাটা করতেই হবে।’

নারীদের জন্য ইফতা বিভাগ হাতেগোনা হলেও এর গুরুত্ব অস্বীকার করছেন না কেউ। বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, সমাজে নারী মুফতিরাও ভূমিকা রাখতে পারেন তাদের নিজস্ব পরিমণ্ডলে। এটাকে এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই। এখন হয়ত ব্যবস্থাপনা অপ্রতুল, নারী শিক্ষিকার সঙ্কট, কিন্তু একদিন সব কেটে যাবে। তবে নারী মুফতিরা বলছেন, উদ্যোগ নেয়া হলে শিক্ষিকার সংকট মেটাতে খুব বেশিদিন লাগবে না। এখনো নারীদের জন্য ইফতা বিভাগের প্রচলন হয়নি বাংলাদেশে। প্রচলন হয়ে গেলে আস্তে আস্তে সঙ্কট দূর হয়ে যাবে।

 

আগের সংবাদহিজাব: নারীর জন্য পর্দা কেন জরুরী?
পরবর্তি সংবাদনারী : প্রেক্ষিত ইসলাম ও বস্তুবাদ