‘কেয়ার নাকি কন্ট্রোল’ : সন্তানদের সাথে বয়স্ক পিতামাতার টানাপোড়েন

জহুরুল ইসলাম:

তিন মাথার সেই গল্পের কথা মনে আছে তো?
সেই যে কবে এক দুঃখী লোক বোকা তিনটে ছেলে ঘরে রেখে দূরদেশে পাড়ি জমাল আর সন্তানদের উপদেশ দিয়ে গেল— “সবসময় তিন মাথার বুদ্ধি নিয়ে চলবি!”

বাবার আদেশ বলে কথা! ছেলেরা দেশ-বিদেশ ঘুরে হয়রান। কোত্থাও তিন মাথাওয়ালা লোকের হদিস মিলল না। ছেলেদের মনে দুঃখ— বাবার শেষ আদেশ বুঝি পালন করা গেল না।

ফেরার পথে দেখা মিলল এক বুড়োর— গাছতলায় বসে দু’ হাঁটুর মাঝখানে মাথা সেধিয়ে ঝিমুচ্ছেন। বৃদ্ধের কাছে তারা আদ্যোপান্ত শোনাল। বৃদ্ধ একগাল হেসে বললেন, “তিন মাথাওয়ালা মানুষ জগতে কোথায় পাবে বাপু? বাবার কথার অর্থ তোমরা বোঝো নি। শেষ বয়সে মানুষের মাথা নুয়ে দুঁ হাটুর মাথার সঙ্গে মিলে যায়। এ–ই হচ্ছে তিন মাথার রহস্য। অর্থাৎ, তোমাদের বাবা কোন বয়স্ক লোকের পরামর্শ নিয়ে তোমাদের দিনগুজরান করতে বলেছেন!”

এই গল্পের ভেতর দিয়ে জগতের এক চিরায়ত বাস্তবতার কথা বলা হয়েছে। জীবন একটা দীর্ঘ পথ। এই পথে যে যত দীর্ঘ সময় হেঁটেছে, যতদূর এগিয়ে গেছে, এর চড়াই-উৎরাই সেই বেশি চিনবে। তার দেয়া নির্দেশনা নিয়ে পথচলাই তো নিরাপদ।

ষাটোর্ধ্ব জীবন পূর্ণ জীবন। পৃথিবীর সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ মানুষ— নবীজি সা. ষাটের পরে তিন বছর হায়াতে ছিলেন এবং তিনি বলে গেছেন, আমার উম্মতের আয়ুষ্কাল ষাট-সত্তরের মাঝামাঝি। এখানেও ষাটের ঘরে গিয়ে জীবনের পূর্ণতা লাভের একটা ইঙ্গিত রয়েছে।

সাধারণভাবেই বোঝা যায়— দীর্ঘ একটা সময় যিনি পৃথিবীর আলো-বাতাস নিয়েছেন, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন, যাপিত জীবনের সুখ-শান্তি-ভালোবাসা ও দুঃখ-কষ্ট-জটিলতার ভেতর দিয়ে ভাসতে ভাসতে একটি স্থির পাটাতনে এসে দাঁড়িয়েছেন, জীবনের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি হবে অপেক্ষাকৃত নির্ভুল। এ এক সহজ হিসাব।

বৃদ্ধকাল প্রজ্ঞায় যেমন ভারি, অধিকারের হিসেবেও তার স্থান আগে। পৃথিবীর বুকে লম্বা সময় কাটানোর পর জীবন ও জগতের কাছে বৃদ্ধদের কিছু অঘোষিত পাওনা তৈরি হয়ে যায়। শুধু বৃদ্ধজনই নয়— বরং মানুষে মানুষে গড়া প্রতিটি সম্পর্কেই অগ্রজরা অনুজদের কাছে ন্যায়সঙ্গত কিছু অধিকার পেয়ে থাকে। এসব অধিকারের মধ্যে সন্তানের প্রতি মা-বাবার অধিকারই বুঝি অগ্রগণ্য।

বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবার সেবা, তাদের অধিকার ও দাবিগুলো পূরণ করা যুক্তিসম্মত তো বটেই, বরং এখানে কমতি হলে ইসলামে রয়েছে শাস্তির ঘোষণা।

বৃদ্ধ মা-বাবার সেবা-যত্নের প্রথা আবহমান কাল থেকেই আমাদের সমাজে প্রচলিত। পরিবারের সন্তানেরা মা-বাবার এই যত্ন-আত্তি আগ্রহের সঙ্গেই করে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই বার্ধক্যে তৈরি হওয়া কিছু আচরণগত বিষয় উভয়পক্ষের সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি করে।

দীর্ঘ জীবন কাটিয়ে ওঠার পর মানুষ একধরনের ক্লান্তিবোধ করে। এটা সাময়িক কোনো ক্লান্তি নয়। এটা আটপৌরে জীবনের প্রতি একরকম বিরক্তি। জাহিলি যুগের বিখ্যাত কবি যুহাইর ইবনু আবি সুলমা এই অবসাদকে কবিতায় ব্যক্ত করেছেন—

“জীবনের ভার বয়ে বয়ে আজ আমি বিরক্ত খুব
আশি বছরের যাতনা সইবে যে, তারও হাল হবে অনুরূপ”

আর বার্ধক্যের এই ক্লান্তি থেকেই মানুষের মধ্যে জন্মায় বিভিন্ন অসংলগ্ন আচরণ। অনেকের ক্ষেত্রেই প্রকাশ পায় বাচ্চাসুলভ মানসিকতা। এ-সময় বৃদ্ধ মা-বাবা সন্তানের কাছে নানা বিষয়ে আহ্লাদি আবদার করে বসে। তাদের স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। তারা সবকিছু এলোমেলো করতে থাকে। তখন তাদের সামাল দেয়া সন্তানের জন্য হয় কিছুটা কষ্টের।

এ তো তাও এক প্রকার। যখন বার্ধক্যজনিত বিরক্তিতে তার মেজাজ খিটমিটে হয়ে যায়, তখন অবস্থা হয়ে দাঁড়ায় আরেকটু কঠিন। কথায় কথায় রেগে যাওয়া, খেদমতের সামান্য এদিক-সেদিকে অভিমান করা, পান থেকে চুন খসলে দুনিয়া মাথায় তোলা ইত্যাদি তখন তাদের নিত্য মামুলাতে পরিণত হয়।

এই পর্যায়ে এসে তার জীবনের চিত্রটা পাল্টে যায়। সন্তান তাকে আবিষ্কার করে এক নতুন অবয়বে। তার চিরচেনা প্রিয় বাবা— যিনি তাকে পৃথিবীর পথে একটু একটু করে হাঁটতে শিখিয়েছেন, তার একটু সুখের জন্য হাজারটা কষ্ট সয়েছেন, বয়সকালে সেই পিতাকে এমন ভিন্ন চরিত্রে আবিষ্কারের অভিজ্ঞতা সন্তানের কাছে বেদনার।

বার্ধক্যজনিত এই বিরক্তির প্রকাশ কখনো আবার এতটাই সীমা ছাড়িয়ে যায়, যখন মা-বাবাকে নিয়ন্ত্রণ— এমনকি সময়ে সময়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করাও খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

সম্পর্কের এই টানাপোড়েনে ভারসাম্য রক্ষার অনুশীলন সন্তানের জন্য হয়ে দাঁড়ায় মহা ভাবনার বিষয়। তবু সন্তানকে এখানে মানিয়ে নিতে হয়। একে তো মা-বাবার থেকে পাওয়া আজন্ম ভালবাসা ও অনুগ্রহের ঋণ পরিশোধের কোশেশ, এছাড়াও তা সন্তানের প্রতি আল্লাহ তায়ালার সরাসরি আদেশ। কুরআনের আয়াত দেখুন—

“তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে ‘উফ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বলো। মমতাবশে তাদের প্রতি নম্রতার ডানা বিছিয়ে দাও এবং বলো, হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া করো, যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছেন।”(বনি ইসরাইল : ২৩–২৪)

শেষে একটি হাদিসের ঘটনা বলি।
এক লোক নবীজি সা.–এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমি তো আমার মায়ের পেছনে যথেষ্ট টাকা-পয়সা খরচ করি। কিন্তু তিনি সারাদিনই আমাকে বকাঝকা করেন। নানা কটু কথা বলে কষ্ট দেন। আমি এখন কী করতে পারি?

নবীজি সা. বললেন, তার হক আদায় করতে থাকো। তুমি কি জানো না, তার পায়ের নিচে তোমার বেহেশত?

লোকটি কিছুসময় চুপ থেকে বলল, আল্লাহর কসম! আমি এসব অসদাচরণের বিনিময়ে তাকে কিছুই বলবো না। এই বলে সে তার মায়ের কাছে ছুটে গেল। তার পায়ে চুম্বন করতে লাগল এবং বলল, নবীজিই আমাকে এই কাজের আদেশ দিয়েছেন!

আগের সংবাদছাগল চুরির অভিযোগে আওয়ামী লীগ নেতা কারাগারে
পরবর্তি সংবাদমাইক্রোবাসের ১১ যাত্রী নিহত: গেটম্যানের বিরুদ্ধে মামলা