ছাত্রদের জবানিতে মুফতি নূরুল আমীন: ‘ছাত্র-দরদী এক শিক্ষকের গল্প’

রাকিবুল হাসান নাঈম:

ঢাকার আকাশে আজ শোকের বাতাস। ফরিদাবাদ মাদরাসামুখী টুপি-পাঞ্জাবির ঢল। এই মাদরাসার নায়েবে মুহতামিম এবং শাইখুল হাদিস হযরত মাওলানা মুফতি নূরুল আমীন সাহেব ইন্তেকাল করেছেন। তিনি কেবল এই মাদরাসার ছিলেন না, ছিলেন পুরো বাংলাদেশের, পুরো কওমি সমাজের। ছিলেন আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ এর অন্যতম সদস্য, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ এর সহকারী মহাসচিব। তার ইন্তেকালে তার স্মৃতিচারণ জানতে ফাতেহ দারস্থ হয়েছিল ফরিদাবাদ মাদরাসার ফারেগ, হুজুরের কয়েকজন ছাত্রের। তাদের স্মৃতিচারণগুলো তুলে ধরা হলো। এখান থেকে জানা যাবে, হুজুর কেমন ছাত্রবান্ধব ছিলেন।

লামিন ইসলাম

আমি হুজুরের সর্বশেষ ক্লাসে উপস্থিত ছিলাম। ৮ নভেম্বর, বুধবার। ৯.১৫ মিনিটে ক্লাসে এসে হুজুর বললেন, হাজিরা ডাকব? ছাত্ররা হেসে বললো, জি না। হুজুর বললেন, ‘মরেই তো যাব। হাজিরাটা ডেকেই মরি।’ এরপর হুজুর আর হাজিরা ডাকেননি। পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে হুজুর স্টোক করেন।

আব্দুল্লাহ হাশেম

হুজুর অত্যন্ত ঠান্ডা মেজাজের মানুষ ছিলেন। ছাত্রদের সঙ্গে রাগারাগি করার প্রশ্নই আসে না। উদাহরণস্বরূপ হুজুরের বুখারির ঘণ্টা। হুজুরের দরস ছিল সকালের প্রথম দরস। হুজুর দরসে আসতেন। কিন্তু ছাত্ররা অনেকে ঘুম থেকে উঠে আসতে দেরী করতো। দরসগাহ ফাঁকা থাকতো। কিন্তু হুজুর এটা নিয়ে উচ্চবাচ্য করতেন না। মন দিয়ে নিজের পড়ানোটা পড়িয়ে যেতেন। তবে ছাত্রদের তরবিয়তের জন্য কখনও কখনও হাজিরা ডাকার চেষ্টা করতেন। কিন্তু সেটা নিয়ে বেশি কাঠিন্যতা আরোপ করতেন না।

আরেকটি বিষয় হলো, হুজুর খুব ছাত্রবান্ধব ছিলেন। ছাত্রদের যেকোনো সমস্যা খুব দ্রুত ও সহজভাবে সমাধানের চেষ্টা করতেন । ফরিদাবাদ মাদরাসায় যেহেতু অনেক ছাত্র, প্রতিদিন ডাস্টবিনে আবর্জনাও জমতো অনেক। সিটি করপোরেশনের ভ্যান এসে সেগুলো নিয়ে যেতো। কিন্তু ছোট ভ্যান এসব নিয়ে কুলোতে পারতো না। আবর্জনা জমে বাতাস দূষিত হয়ে উঠতো। ছাত্রদের বেশ কষ্ট হতো। তখন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র ছিলেন সাঈদ খোকন। হুজুর তার কাছে গিয়ে সমস্যার কথা তুলে ধরলেন। বিষয়টির সহজ সমাধান হয়ে গেলো। সিটি করপোরেশন থেকে ট্রাকে করে বর্জ্য নিয়ে যাওয়ার বিশাল একটি বাস্কেট দেয়া হলো। ট্রাকে করে সেই বাস্কেট প্রতিদিন পরিস্কার করে দিয়ে যেতো।

সরকারি মহলের সঙ্গে হুজুরের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তিনি সেই সম্পর্ক কাজে লাগাতেন কওমি মাদরাসার কল্যানে। রাতে ঘুমানোর আগে হুজুরের রুমে ছোটখাটো মজলিস হতো। হুজুর যেহেতু রাত করে ফিরতেন, তাই সেই মজলিসে ছাত্রসংখ্যা থাকতো অনেক কম। তবে যে কারও সেই মজলিসে বসার অনুমতি ছিল। হুজুর তখন অনকে গল্প বলতেন। বেফাক, হাইয়ার কাজ করতে গিয়ে কোথায় কী অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন, কোথায় কোন রাজনীতি চলছে এসব। এতবড় মানুষ হয়েও হুজুর ছাত্রদের সঙ্গে যেভাবে গল্প করতেন, তা বিস্ময়ের এবং শ্রদ্ধার।

শোয়াইব মুমিন

উস্তাদে মুহতারাম মুফতি নুরুল আমীন সাহেব হুজুরের সাথে আমার একটা মজার ঘটনা আছে। হুজুর ফরিদাবাদে বায়যাবি শরীফ পড়াতেন। আমিও খেদমতের প্রথম বছর থেকে দুই বছর ধরে বায়যাবি শরীফ পড়াচ্ছি। আমাদের মেশকাতের বছর হুজুরের অনেক বেশি ব্যস্ততা ছিল। যার ফলে দিনের বেলায় ঘণ্টা করতে পারতেন না। রাতে ঘণ্টা করাতেন। ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে এশার পরে ক্লাস শুরু হয়। আনুমানিক রাত দশটা থেকে ক্লাস শুরু হয়। ঘণ্টা করতে করতে পৌনে বারোটা বা সাড়ে এগারোটা বেজে যায়। হুজুর কিতাব বন্ধ করে দরস থেকে উঠে যাবেন এমন সময় আমি একটা চিরকুট দিলাম। ‘উস্তাদজি, আমরা বায়যাবি শরীফের দরসের মাধ্যমে নতুন বছর মানে ২০১৮ সাল শুরু করতে চাই’। প্রস্তাবটা হুজুরের মনে ধরলো। আবার কিতাব খুলে পড়াতে শুরু করলেন। রাত সোয়া বারোটা পর্যন্ত ক্লাস করালেন। শেষে বললেন, ২০১৭ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত একটানা একটা ক্লাস হয়ে গেল। ছাত্ররা সবাই হেসে দিল। আজকে বায়যাবি পড়াতে গিয়ে ছাত্রদেরকে হুজুরের এই ঘটনাটা শুনালাম। এবং ছাত্রদেরকে নিয়ে কয়েক ফোঁটা চোখের অশ্রু ছেড়ে হুজুরের জন্য দুয়া করলাম। আল্লাহ তায়ালা হুজুরকে জান্নাতুল ফিরদাউসের সুউচ্চ মাকাম নসীব করুন। আমিন।

মাহদী হাসান খালেদ

হুজুর একজন ছাত্রবান্ধব উসতাদ ছিলেন। ছাত্রদের কিসে ভালো হবে, সবসময় তার খেয়াল রাখতেন। ছাত্রদেরকে নিজের সন্তানের মতো মনে করতেন। কওমি মাদরাসার শিক্ষাবোর্ড বেফাক হাইয়ার কোনো কাজ এলে তিনি নিজের সুস্থতা-অসুস্থতার দিকে খেয়াল করতেন না। নিজের সাধ্য থাকা অবস্থায় বেফাক-হাইয়ার কোনো মিটিং মিস দিতেন না।

হুজুরের আরও একটি বড় গুণ হলো, হুজুর কাজ করতেন গোপনে। কখনও প্রকাশ্যে আসতে চাইতেন না। বলতেন, কাজগুলো গোপনই থাকুক। আমার প্রতিফল দিবেন আল্লাহ।

শোয়েব আদনান

হুজুরের ছাত্রবান্ধব হওয়ার আরেকটি ঘটনা বলেছেন ফরিদাবাদ মাদরাসার ফারেগ মাওলানা শোয়েব আদনান। তিনি বলেন,২০১৯ সালে টানা ৩দিন বৃষ্টি হয়েছিলো। ফলে আন্ডারগ্রাউন্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম কর্ণারে ফোটা ফোটা পানি পড়া শুরু হয়। ভিজতে শুরু করে আমাদের বেড, কিতাবগুলো। ভাবছিলাম, দফতরে আবেদন করলে কখন ঠিক হয় কে জানে। তাই সমস্যা সমাধানের জন্য আমি আর এক সাথি বের হই। মাঠে নেমে দেখি নুরুল আমীন সাহেব মাদরাসার কোনো এক বিষয় নিয়ে ব্যস্ত। আমরা দফতর থেকে হুজুরের পিছনে গিয়ে দাঁড়াই। একটু ভয়ে ভয়ে নিচু কন্ঠে সালাম দেই। হুজুর আমাদের দিকে তাকিয়ে সালামের উত্তর নিলেন আর বললেন, জ্বী বলেন। আমরা উক্ত সমস্যার কথা জানালাম। হুজুর ব্যস্ততার মাঝেই সাথে সাথে বললেন, চলেন দেখে আসি। আমরা হুজুরকে নিয়ে গেলাম। সেদিনই সমস্যা সমাধান হয়ে গেলো।

নাঈমুল ইসলাম

দারুল উলুম বরুড়া যখন নিচের জামাতগুলাতে পড়তাম, তখন প্রায় সময় হুজুররা ছাত্রদেরকে কিতাবি ও ফন্নি এস্তেদাতের কথা বললে মুফতী নূরুল আমীন সাহেবের উদাহরণ দিতেন। ফরিদাবাদ যখন গেলাম, মেশকাতে হুজুরের তাফসীরে বায়যাবীর ক্লাসে বসলাম, তখন বুঝতে পেরেছিলাম কিতাবি এস্তেদাদ হুজুরের কেমন ছিলো। মান্তেকের ইমাম বলা যেতে পারে হুজুরকে। হুজুরের মুখে কয়েক বার শুনছি, হুজুর ছোটবেলা থেকেই বাতিল ফেরকার মোকাবেলায় অনেক পন্ডিত বা পারদর্শী ছিলেন। হুজুরের আকাবিরদের জীবনী কঠিনভাবে মুখস্থ ছিলো। হুজুরকে কাছ থেকে যতটুক দেখেছি ও জেনেছি, হুজুর লোভি মানুষ ছিলেন না, অনেক চালাক ও ফিকরি মানুষ ছিলেন।হুজুর বোখারীর দরসে হাদিসের সাথে বাবের মুনাসাবাতগুলা এতো আনুখা ও দুর্লভ উদাহরণ দিয়ে বুঝাতেন, যেগুলো গভীর চিন্তা না করলে বলা সম্ভব ছিলো না।

মুঈনুল ইসলাম

হুজুরের দরসগুলো ছিলো ডিফ্রেন্ট টাইপের। কখনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখা তুলে ধরতেন। কখনও মানতেক এবং ফালাসাফার থিওরি উল্লেখ করে আলোচিত বিষয়কে বোধগম্য করে তুলতেন। হুজুরকে কখনো কোন ছাত্রের উপর রাগ করতে দেখিনি আমি। হুজুর ছিলেন সুভাষী। হুজুরের সাথে প্রথম সাক্ষাতে আমি একটু ভয়ে ইতস্ততায় ছিলাম। হুজুরই ডাক দিয়ে কাছে নিলেন। এম ভাবে কথা শুরু করে দিলেন; মনে হলো যুগ যুগ থেকে পরিচিত কেউ।

 

আগের সংবাদমুফতি নূরুল আমীনের জানাজা বাদ মাগরিব
পরবর্তি সংবাদমুফতি নূরুল আমীন কোন মাকবারায় শায়িত হবেন?