জম্বি : হলিউড যে মুসলিম সেনানায়ককে প্রেতাত্মায় রূপান্তর করেছে

মুজাহিদুল ইসলাম:

শারীরিক অবকাঠামো ও রঙের ওপর মানুষের কোন এখতিয়ার না থাকলেও তা নিয়ে সমাজ ও জগত বহুবার বহুভাবে বিভক্ত হয়েছে। আজকের কথিত আলোকিত সমাজ ও রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কাগজে-কলমে কালোদের প্রতি বৈষম্যবিলোপ হলেও শেতাঙ্গদের অন্তরের বিদ্বেষের বিলোপ সম্ভব হয়নি। একটি দেশের গণমাধ্যম ও রুপালি জগত তাদের ভোক্তাদের উপেক্ষা করে চলে না। মার্কিন রুপালি জগতের কেন্দ্রবিন্দু হলিউড। তারা তাদের সমাজের মানুষদের আমরা ও তারা হিসেবে বিভক্ত করেছে। ওখানের ফিল্মজগতে পার্শ্ব চরিত্রের জন্য কালোদের আসন সুরক্ষিত। কালো-শাদার ভালবাসা সাধারণভাবে অমার্জনীয় অপরাধ। খলচরিত্রের জন্য কালোদের ব্যবহার বৈ তার উৎকৃষ্টতা প্রমাণ সম্ভব নয়।

মুভিজগতে রোমান্স, এ্যাকশন, ফিকশন, কমেডি ও হররসহ বহু ধরণের নাম পাওয়া যায়। জম্বি বলতেই দৃশ্যপটে মানুষখেকো পোষাকহীন ক্ষতবিক্ষত হেলেদুলে চলা মনুষ্যপ্রাণীর ছবি ফুটে ওঠে। বিশ্বজুড়ে এক আতংকের নাম মুভির চরিত্রে থাকা জম্বি। মুভিতে কথিত জম্বি বলতে সাধারণত এক ধরনের জীবন্ত লাশকে বুঝায়, যা বিশেষ ধরনের ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে বুদ্ধি-বিবেক হারিয়ে হয়ে ওঠে মানুষ-খেকো। যাকে কামড় দিবে,সেই জম্বির মতো অর্ধ মৃত ও হিংস্র হয়ে যায়। কথিত ধারণা অনুসারে জম্বি ভাইরাস যদি সংক্রমণ কারা শুরু করে, তাহলে কয়েকদিনের মধ্যে মানবজাতির বিলুপ্তি ঘটবে।

মানুষের চিন্তায় প্রতিষ্ঠিত ভয়ংকর জম্বিকে যখন কেউ মুসলিম বীরের পরিচয়ে তুলে ধরবে, তখন অবচেতন মনে ভেসে উঠবে। হ্যাঁ! মুসলিমই এমন হতে পারে কিংবা তার পক্ষেই এমন ভয়ংকর হওয়া সম্ভব। এই পরিচয়ই উঠে আসবে মানুষের দৃশ্যপটে। আর ঘৃণা ও বিদ্বেষ চর্চার ময়দান আরো প্রশস্ত হবে।

জম্বিমুভির চরিত্রে মানবজাতিকে ধ্বংসের জন্য জম্বিকে ব্যবহার করা হয়। আর কথিত সুসভ্যরা এই বিশাল ভেড়ার পালের মতো গোষ্ঠীকে প্রতিরোধ করার জন্য নিজেদের উৎসর্গ করে, জম্বিদের নির্বিচারে নিধন করে। তাদের মতে বনেজঙ্গলে জম্বিরা রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে সভ্যতার বিনাশ সাধন করছে।

কথিত প্রথম জম্বি মুভি ১৯৩০ সালে ‘হোয়াইট জম্বি’ নামে মুক্তি পায়। তবে ১৯৬৮ সালে ‘নাইট অব দ্য লিভিং ডেড’ নামে মুক্তি পাওয়া মুভিটির মাধ্যমে জম্বি আধুনিক রূপ প্ররিগ্রহ করে। তারপর থেকে শত-শত মুভি মুক্তি পেয়েছে। এখন পাশাপাশি চলছে অনলাইন ও অফলাইন গেম। যার সর্বশেষ ভার্সন পাবজি।

জম্বি বলতে কি আসলে কিছু ছিল? হলিউডে চিত্রায়িত চরিত্রানুসারে বাস্তবতায় জম্বি বলতে কিছু থাকুক আর না থাকুক, জম্বি নিয়ে বহু রূপকথা প্রচলিত আছে। যেমন–হাইতির বাসিন্দাদের ধারণা অনুসারে তাদের দেবতারা মৃত মানুষদেরকে স্বর্গীয় জীবন দেয়ার জন্য পুনরায় জীবিত করতো।

কখনো কি এই নামের মূল উৎস সম্পর্কে চিন্তার সুযোগ এসেছে? হ্যাঁ, এই লেখায় সেই জম্বির খোঁজ করার চেষ্টা করা হয়েছে।

কে এই জম্বি?

জম্বি ছিলেন সাহসী একজন মুসলিম সেনানায়ক। ইসলাম ও মানবতার জন্য পশ্চিমা বিশ্বে তাঁর আছে বিপুল অবদান। ব্রাজিলের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাষ্ট্রের স্বাধীনতা রক্ষায় তাকে অনেক কুরবানি দিতে হয়েছে। আসুন, জেনে নিই তার বিস্তারিত পরিচয়। পাশাপাশি জেনে নিই পশ্চিমা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি আজ কেন ভিলেনরূপে চিহিৃত?

তিনি ছিলেন ব্রাজিলে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য লড়াইকারী এক আফ্রিকান মুসলিম নেতা। তাঁর জীবনী আলোচনার মধ্য দিয়ে আফ্রিকানদের ব্রাজিলে আসার প্রেক্ষাপট, বেড়ে ওঠা, স্বাধীনতা রক্ষার জন্য লড়াই থেকে নিয়ে বেদনাদায়ক পতন পর্যন্ত বিভিন্ন তথ্য উঠে আসবে এই লেখায়।

পশ্চিমা কলোনিয়ালিজমের পেছনের কথা

পাশ্চাত্যের কলোনিয়ালিজমের ইতিহাস বেশ পুরাতন। একেক সময় তাদের একেক গোষ্ঠী কলোনিয়ালিজমের নেতৃত্ব দিয়েছে। কলোনিয়ালিজমের বাস্তবায়নে স্থানীয়দের প্রতি কোনো মানবিকতা থাকতে নেই, এটা তাদের নিকট মৌলিক মানদণ্ড। বিশেষত পশ্চিমা নবজাগরণের প্রাক্কালে প্রয়োজন জনশক্তি। ষষ্ঠদশ থেকে উনবিংশ শতাব্দী অব্দি ইউরোপে গোলাম বেচাকেনার রমরমা ব্যবসা চলছিল। আমেরিকা আবিস্কৃত হয়। কলোনিয়ালিজমের ‘মহান’ দায়িত্ব পালন করছিল পর্তুগিজরা। আধিপত্যবাদ কায়েমের নেশা থেকে জনশক্তির রমরমা মার্কেট আফ্রিকার দিকে নজর পড়ে এই শকুনদের। আফ্রিকার স্থানীয় নীতিহীন কিছু মানুষ কলোনিয়াল শক্তির দালাল হিসেবে কাজ করতো। তারা স্থানীয় বিভিন্ন অঞ্চলে আকস্মিক আক্রমণের মাধ্যমে লোকদের আটক করে সমুদ্রতীরে অপেক্ষমান কলোনিয়াল জাহাজে তুলে দিত অর্থের বিনিময়ে। হাত-পা শিকলে বেঁধে জাহাজের ভেতরে তাদের ফেলে রাখত। যারা মারা যেত, তাদের সমুদ্রেই ফেলে যেত। ঐতিহাসিকদের মতে, আফ্রিকা থেকে ইউরোপে আনা মানুষদের সংখ্যা মিলিয়নকে মিলিয়ন।

এভাবে পর্তুগিজরা আফ্রিকা থেকে কিছু মানুষকে ব্রাজিলে গোলাম বানিয়ে আনতে থাকে। ব্রাজিলে আনা মানুষদের সংখ্যা ছিল পাঁচ লক্ষ। এই আফ্রিকানদের ছিল বিভিন্ন যোগ্যতা, যা তাদের কথিত মনিবদের ছিল না। শেতাঙ্গদের মাথা আর কৃষ্ণাঙ্গদের শ্রমে গড়ে উঠতে থাকে নতুন সভ্যতা।

গোলামদের স্বাধীন সত্ত্বা গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপট

এদের অনেকেই ছিলেন মুসলিম। অবধারিতভাবে একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে শৃংখলা রক্ষার্থে সামাজিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধর্মীয় ব্যক্তি থাকার সুবাদে তারা কুরআন পড়ত। ধর্মীয় নিয়মকানুন পালন করত। কিন্তু তাদের কথিত মালিকরা শংকিত হয়ে পড়ল; শিক্ষিত ও সভ্য কাউকে পরাধীন রাখা সম্ভব নয় অনুধাবন করে। শুরু হয় দাসত্বের পর বিভিন্ন নির্যাতন। ধর্মীয় শিক্ষা ও স্বভাবজাত স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকার আদায়ের স্পৃহা তৈরি হয় তাঁদের মধ্যে।

স্বাধীনতা লড়াইয়ের জন্য স্থানত্যাগ ও প্রস্তুতি

শেতাঙ্গদের সাথে লড়াইয়ের জন্য তাঁরা লোকালয় ত্যাগ করে চলে যায় বনে জঙ্গলে। গড়ে তোলে নতুন নতুন বসতি। গড়ে ওঠে নতুন সভ্যতা। প্রায়ই পর্তুগিজ ও তাঁদের মধ্যে লড়াই চলত। যদিও আধুনিক সমরাস্ত্রের মুকাবেলায় আফ্রিকান মানুষগুলো অনেক সময় পরাজিত হতো। এদের নির্মিত বিভিন্ন বসতির মধ্যে একটির নাম ছিল পালমারা। যা বর্তমান ব্রাজিলের আলাগোসা প্রদেশের একটি শহর।

স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল পালমারা

পালমারা শহরটি অনেকটা স্বায়ত্বশাসন ভোগ করত। সেখানে প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষের বাস। তাঁদের সাথে কিছু রেড ইন্ডিয়ান ও দরিদ্র শেতাঙ্গরাও যুক্ত হন। পালমারা কৃষিতে বেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। তাঁরা তামাক, আখ ও আলু চাষ করত। পশু পালনও ছিল তাদের জীবনের একটি অংশ। এমনকি পার্শ্ববর্তী বসতির সাথে বিনিময়-প্রথা ছিল তাঁদের। রাষ্ট্রীয় সকল ব্যবস্থা ছিল তাঁদের; সীমান্ত নির্ধারণ থেকে নিয়ে তা পাহারা দেয়া। সেনাবাহিনী গঠন থেকে নিয়ে যেকোনো আক্রমণ প্রতিহত করতে আধুনিক যুগের মতো ওয়াচটাওয়ারও তৈরি করেছিল তারা। জনগণের নিকট থেকে কর আদায় করে জনকল্যাণ ও প্রশাসনিক কাজে তা ব্যয় করত। জেনা-ব্যভিচার ও চুরির জন্য মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন ফৌজদারি অপরাধের জন্য সুষম আইন ছিল।

জম্বির জন্ম

এই সভ্য ও লড়াকু জাতির স্বাধীন প্রজন্মের সন্তান জম্বি ১৬৫৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মামা জুম্বা ছিলেন বসতির নেতা। পর্তুগিজদের সাথে বিভিন্ন লড়াইয়ে দুর্বল হয়ে চুক্তিবদ্ধ হন তিনি। চুক্তিতে পর্তুগিজদের বশ্যতা স্বীকারের শর্তে পালমিরায় পলায়নকারী দাসদের মুক্তির কথা বলা হয়।

দায়িত্বগ্রহণ ও ইসলামী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা

চুক্তিকে জনবিরোধী আখ্যায়িত করে অভ্যুথানের মাধ্যমে বসতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন জম্বি। দায়িত্বগ্রহণ করেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ইসলামিকরণের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হন। ধর্মীয় ব্যক্তিদের মাধ্যমে নৈতিকতা ও শরিয়তের বিধিবিধান অনুসরণে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন। এক সময়ে তিনি ‘ইসলামি স্টেট অব ব্রাজিল’-এর ঘোষণা দেন।

যুদ্ধ ও পালমারার পতন

জম্বি ১৬৭৮ থেকে ১৬৯৪ পর্যন্ত পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যান। বর্তমান বাহায়াহ রাজ্যের বিশটির বেশি অঞ্চলকে তাঁর সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক রাষ্ট্রের সাথে যুক্ত করেন। তবে অনবরত লড়াইয়ের কারণে রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। এক লড়াইয়ে আহত হয়ে পড়েন জম্বি। এবং পালমারার পতন হয়।

সহচরের বিশ্বাসঘাতকতায় গ্রেফতার, অতপর …

যেহেতু বিজয়ীরা ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে। তাই পালমারার ইতিহাসে পর্তুগিজরা পরাজিতদের নেতিবাচকভাবেই উপস্থাপন করেছে। ভারী কামান দ্বারা পর্তুগিজরা পালমারার শহররক্ষা-দেয়ালে গোলা বর্ষণ করে শহরের পতন ঘটায়। এবং ১৬৯৫-এর ২০ নভেম্বর জম্বি তাঁর এক সহচরের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে গ্রেফতার হন। দখলদার শক্তি তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। জম্বির মরদেহ থেকে মাথা ও পুরুষাঙ্গ কেটে বিকৃত করা হয়। এবং দখলদারদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে তা সমস্ত শহরে ঘুরানো হয়।

গণহত্যা ও খ্রিস্টান বানানোর প্রক্রিয়া

নেতৃত্বশূন্য করে দেয়ার পর পালমারায় শুরু হয় গণহত্যা ও খ্রিস্টান বানানোর প্রক্রিয়া। সে সময়ের প্রশাসনিক সবকিছু পুড়িয়ে দেয়া হয়। ব্রাজিলে জম্বির তৈরি সকল সভ্যতার নির্দশন মিটিয়ে দিতে যা যা করা লাগে, সব তারা করে।

জম্বির স্মরণে ব্রাজিলে জাতীয় দিবস

মানবতা ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে জম্বির অবদানকে স্বরণীয় করে রাখতে ব্রাজিলে জম্বির ব্রোঞ্চের প্রতিকৃতি রয়েছে। বহু মানুষের আত্মত্যাগের পর একসময় দাসপ্রথায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ব্রাজিলে আফ্রিকান বংশোদ্ভুত নাগরিকদের দাবির প্রেক্ষিতে প্রতিবছর ২০ নভেম্বর ‘আফ্রিকান সচেতনতা দিবস’ পালন করা হয়।

কেন হলিউড জম্বি নামকে বিকৃতি করল?

পশ্চিমাবিশ্ব শারীরিকভাবে কলোনিয়ালিজম ত্যাগ করেছে, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি তো ভিন্ন জিনিশ। নিজেদের জাত্যাভিমান আর বড় দেখানোর প্রাচ্যবাদের থিমের চিত্রায়ন হলিউডের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে।

আর এ কারণেই ‘আমেরিকান স্নাইপার’ মুভিতে দেখানো হয়, ইরাকি মা তাঁর শিশুসন্তানকেও যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করছে। ‘লরেন্স অভ আ্যারাবিয়া’ মুভিতে আরবদের স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশদের লড়াইয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়। ‘ব্ল্যাক হক ডাউন’ মুভিতে সোমালিয়ার মানুষদের জন্য এখনও মার্কিন সৈন্য জান দিয়ে আসছে বলে দেখানো হচ্ছে। এই মানসিকতা থেকেই মূলত জম্বিকে খলনায়ক হিসেবে উপস্থাপন করতে করতে এখন একদম প্রেতাত্মায় রূপান্তর করেছে তারা। প্রতিহিংসা আর জাত্যাভিমানের এ এক নিকৃষ্ট ও জ্বলন্ত উদাহরণ।

আল জাজিরা অবলম্বনে

আগের সংবাদআফগানিস্তানের গজনীতে বিমান হামলায় নিহত ১৫
পরবর্তি সংবাদকরোনায় বিএনপি নেতা এমএ হকের ইন্তেকাল