রাকিবুল হাসান নাঈম:
দরস-সংশ্লিষ্ট কিতাবের যথেষ্ট সংগ্রহ থাকলেও দেশের অনেক মাদরাসায় নেই পাঠাগার। পাঠাগার থাকলেও সেখানে নেই ইতিহাস-ঐতিহ্য-সহ বিভিন্ন জনরার বই। গোটা কয়েক বই দিয়েই চলে বছরের পর বছর। সেখানে নতুন কোনো বই যুক্ত হয় না। আর পাঠাগারের জন্য নির্দিষ্ট কোনো দায়িত্বশীল না থাকার কারণে পাঠাগার নিয়ে ভাবতেও চান না কেউ কেউ।
মাদরাসা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সব মাদরাসায় পাঠাগার না থাকলেও একটি করে কুতুবখানা আছে। মাদরাসাভেদে সেই কুতুবখানার দৈর্ঘ ও সংগ্রহ বড় হয়। তবে অধিকাংশ মাদরাসাতেই সেই কুতুবখানায় প্রবেশের অনুমতি ছাত্রদের থাকে না। ফলে বড় কুতুবখানা থাকলেও উচ্চতর বিভাগের ছাত্র ছাড়া আর কেউ সেখানে প্রবেশের সাধারণ অনুমতি পায় না।
পাঠাগারে জমে অবহেলার ধূলো
দেশের কয়েকটি বড় বড় মাদরাসায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাদের মাদরাসায় ছোট হলেও পাঠাগার আছে। একসময় পাঠাগারের কার্যক্রম নিয়মিত থাকলেও এখন নিয়মিত নেই। অবহেলায় অবহেলায় বইয়ের তাকে জমেছে ধূলো। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, মাদরাসাগুলোতে পাঠাগার আছে ঠিক। কিন্তু গুটিকয়েক পুরোনো বই ছাড়া নতুন কোনো বই সেখানে সংযোজন হয় না। ফলে ছাত্ররাও একসময় আর তার প্রতি আগ্রহী থাকে না।
রাজধানীর উপকণ্ঠের একটি বড় মাদরাসার ছাত্র সামিউল হক জানান, ‘মাদরাসাটিতে পাঠাগার এখন বন্ধ। আগে সপ্তাহের নির্দিষ্ট একটি দিন বই বিতরণ করা হতো। কিন্তু এখন করা হয় না। গত ৫ বছরে পাঠাগারে নতুন কোনো বই সংযোজন হয়নি।’
এ প্রসঙ্গে কথা হয় আলেম লেখক ও শিক্ষক মাওলানা হামমাদ রাগিবের সঙ্গে। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘মাদরাসা কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে খুব বেশী সচেতন না হলেও বিভিন্ন মাদরাসায় স্বতন্ত্র ছাত্র সংসদ গড়ে ওঠার ফলে ছাত্র সংসদের আলাদা পাঠাগার তৈরি হয়েছে। কিন্তু এসব পাঠাগারের দশা খুবই দৈন্য। কেবল শোঅফের জন্য বাংলা সাহিত্যের কিছু বইপত্র রাখা হয়। ছাত্র সংসদের পাঠাগার সম্পাদক থাকলেও ছাত্রদের বইপাঠের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে সেই দায়িত্বশীল বা তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যায় না।’
শোআফ হিসেবে পাঠাগার রাখার প্রসঙ্গে কথা বলেছেন আলেম লেখক ও শিক্ষক মাওলানা কাজী একরাম। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘একটা জামেয়া, অথচ পাঠাগার নেই, এটা হতে পারে না। দরসিয়াত আমাদের জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে ভিত্তিমূলক নলেজ সরবরাহ করে, পক্ষান্তরে বিকাশের জন্য জরুরি হলো পাঠাগার, নিজের রুচি ও আগ্রহের বিষয়ে উম্মুক্ত অধ্যয়নের ব্যবস্থা ও বইপত্র। আমাদের মাদ্রাসায়ও একটা বড়সড় পাঠাগার ছিল। কিন্তু বড় দুঃখ ও দুর্ভাগ্যের কথা হলো, সেই পাঠাগারে ছাত্রদের প্রবেশ করার, পড়ার অনুমতি ছিল না! দিন-রাত যেন সেখানে নিস্তব্ধতা বিরাজ করত।
অজুহাত ছিল বই নাকি এদিক সেদিক হয়ে যাবে। চুরি হয়ে যাবে ইত্যাদি! নিয়ম না থাকায় ভেতরে প্রবেশেরও অবকাশ ছিল না।’
ছাত্রদের আগ্রহ কমছে?
পাঠাগার সঙ্কটের পেছনে আংশিক কারণ হিসেবে কেউ কেউ তুলে ধরেছেন ছাত্রদের অনাগ্রহের কথাও।
ছাত্রদের পাঠাগার থেকে বই নিয়ে বই পড়ার আগ্রহ আগের মতো নেই উল্লেখ করে মাওলানা হামমাদ রাগিব ফাতেহক বলেন, ‘কিছু মাদরাসায় অবশ্য বই পড়ানোর কিছু চেষ্টা-তদবির করা হয়। কিন্তু ছাত্রদের তরফে তেমন সাড়া পড়ে না। তবে দু-একটি মাদরাসা ব্যতিক্রম আছে। আমি যেহেতু গহরপুর পড়েছি, সেখানকার আমাদের সময়ের কথা উদাহরণ হিসাবে বলতে পারি। আমরা যখন ছিলাম, ছাত্র সংসদ পাঠাগারের সংগ্রহশালা খুব সমৃদ্ধ ছিল না, কিন্তু ছাত্ররা সেই স্বল্প সংগ্রহগুলোই নিয়মিত পড়ত। বই বিলির আলাদা খাতা ছিল, প্রতি বুধ ও শনিবার বই সংগ্রহ ও জমা নিতেন পাঠাগার সম্পাদক। সেখানে আমরা নিয়মিত পাঠচক্রও করতাম। তবে, এ ধরনের চিত্র খুব সুলভ নয়।’
রাজধানীর এক মাদরাসার শিক্ষক মুফতি আবু সাঈদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়। তিনি ফাতেহকে জানান, ‘মাদরাসার পাঠাগারগুলোতে যে কিতাবগুলো থাকে, সেগুলো দিয়ে প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। তবে ছাত্রদের প্রয়োজন পূরণে তা যথেষ্ট নয়। তবে যেসব মাদরাসায় ল্যাপটপ বা অন্য কোনো পন্থায় প্রযুক্তি অবলম্বনের সুযোগ থাকে, সেখানে ওই প্রয়োজনটা কিছুটা কেটে ওঠা সম্ভব হবে। আমাদের মাদরাসায়ও পাঠাগার আছে। সেসব দ্বারা প্রয়োজন পুরো করা সম্ভব। তবে অতটুকুই ছাত্রদের জন্য যথেষ্ট নয়। আমার এ কথার উদ্দেশ্য হলো, আসলে যেসব মাদরাসায় পড়ার উপযুক্ত ছাত্র আছে, সেসব মাদরাসায় কমবেশি কিতাবাদিও থাকে। যেখানে তেমন ছাত্র নেই, সেখানে অত কিতাব থাকে না। সেখানে তাদের বেশি দরকারও পড়ে না।’
এ প্রসঙ্গে কথা হয় কুমিল্লার রহমতপুর মাদরাসার একজন শিক্ষকের সঙ্গে। মাদরাসার বয়স অর্ধশতাব্দী পেরিয়েছে। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘গ্রামের মাদরাসা। কুতুবখানা আছে, কিন্তু দরসের বাইরের বইয়ের কোনো পাঠাগার নেই। ছাত্ররাও পড়তে চায় না। মাদারাসাও দেয় না।’
কুতুবখানা আছে, অনুমতি নেই
পাঠাগার অপ্রতুল হলেও কুতুবখানা আছে দেশের প্রতিটি মাদরাসাতেই। কওমি ঘরানার ছোটবড় সব মাদরাসায়ই সাধারণত কুতুবখানা থাকে। এমনকি প্রায় মাদরাসায় নাজিমে কুতুবখানা পদবীধারী এক বা একাধিক দায়িত্বশীলও নিযুক্ত থাকেন। এটা মাদরাসার গুরুত্বপূর্ণ একটি বিভাগ। দরসি কিতাবাদি ও সংশ্লিষ্ট ব্যাখ্যাগ্রন্থসমূহ এসব কুতুবখানার প্রধান সংগ্রহ। পাশাপাশি, তাফসির, হাদিস, সিরাত ও ইসলামি ইতিহাসের আকরগ্রন্থ মর্যাদার কিতাবাদিও বড় বড় মাদরাসাগুলোর কুতুবখানায় পাওয়া যায়।
মাওলানা হামমাদ রাগিব ফাতেহকে বলেন, ‘উলুমে ইসলামিয়ার নির্ভরযোগ্য কিতাবাদি যেহেতু আরবি ভাষায় রচিত, তাই কুতুবখানাগুলোতে আরবি কিতাবাদির সংখ্যাই বেশি থাকে। আর উপমহাদেশের আলেমদের যেহেতু উর্দু ভাষার সঙ্গে যোগাযোগ ও বোঝাপড়া অনেক বেশি, তাই উর্দু কিতাবাদির বড় একটা সংগ্রহ স্বাভাবিকভাবেই থাকে। সে তুলনায় বাংলা বইপত্র সেখানে নেই বললেই চলে। উসতাযরাও খুব একটা জরুরত বোধ করেন না। আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, বাংলা বইপত্র এ ধরনের কুতুবখানায় রাখা কুতুবখানার জন্য খানিকটা শ্রীহীন হিসাবেই জ্ঞান করেন মাদরাসার কর্তৃপক্ষ ও উসতাযগণ।’
তিনি আরও বলেন , ‘দুঃখের বিষয় হলো, কুতুবখানাগুলোতে ছাত্রদের যাতায়াত কম, কোনো কোনো মাদরাসায় অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধও।’
সামিউল হক জানান, রাজধানীর উপকণ্ঠের যে মাদরাসায় তিনি পড়েন, সেখানে বড় একটি কুতুবখানা আছে। সেখানে কিতাবের সংগ্রহও অাছে অনেক। কিন্তু ইফতা ও উলুমুল হাদিসের ছাত্রদের ছাড়া অন্য কোনো ছাত্রের সেখানে প্রবেশের অনুমতি নেই। অনুমতি পেতেও ঝামেলা পোহাতে হয়। অনেকেরে আগ্রহ থাকলেও অনুমতি নেয়ার ঝামেলার কারণে তারাপ কুতুবখানায় যেতে চান না।’