তাবলীগ ও তালেবান: প্রেক্ষিত দেওবন্দের বৈশ্বিক বিস্তৃতি

খালিদ মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ:

বিংশ শতকের শেষদিকে আফগান তালিব বৈশ্বিক রাজনীতিতে ধুমকেতুর মতো উদিত হয়। বিভিন্ন চিন্তা-কাঠামোতে মৌলবাদী, ফেনাটিক, মধ্যযুগীয় এবং সন্ত্রাসী মুভমেন্ট হিসেবে আলোচিত হলেও, তালিবান তার নিজস্ব পরিচয়ের সূত্র খুঁজেছে ‘দেওবন্দি-সুন্নি’ মাসলাকে। ১৮৬৭ সালে ভারতের দিল্লি শহরে প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম দেওবন্দের চেতনার সাথে সম্পৃক্ত ঘরানাকে সাধারণত ‘দেওবন্দি-সুন্নি’ মাসলাক বলি আমরা। অনেক তালেবানি তাদের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা সম্পন্ন করেছেন দারুল উলুম দেওবন্দ অথবা দেওবন্দি মাসলাকের প্রতিষ্ঠানে। বিশেষত, পাকিস্তানের দেওবন্দি-প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের রয়েছে বিশেষ সখ্যতা। তালেবানের বাইরেও দেওবন্দি-চেতনার বেশকিছু শাখাপ্রশাখা রয়েছে; বৈশ্বিক প্রভাবের দিক থেকে তাবলীগ অন্যতম।

তাবলীগের গোড়াপত্তন ঘটে মুলত মাওলানা মুহাম্মদ ইলয়াসের হাত ধরে, যিনি দেওবন্দের প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্র ছিলেন। তবে একথা সত্য যে, তালিবানের তুলনায় তাবলীগ দেওবন্দি-প্রতিষ্ঠানের নিরঙ্কুশ আনুকূল্য পেয়েছে, তাদের ব্যাপক সাংগঠনিক তৎপরতা এবং রাজনৈতিক বাধামুক্ত পরিবেশের সুবাদে। ফলে অনেকেই তাবলীগকে তুলনামূলক গতিশীল ও নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। একটি ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশের মাধ্যমে তাবলীগ যেভাবে বৈশ্বিক পরিমন্ডলে নিজের অবস্থানকে পোক্ত করে নিয়েছে, আদর্শিক কারণে তালেবান সে সুযোগ পায়নি। রাষ্ট্র ও রাজনীতির বিচিত্র সীমাবদ্ধতা তালেবানকে তার নিজের দেশেই প্রবাসী করে রেখেছিল দীর্ঘকাল। ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে, রুশ বাহিনীর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে তালেবান বৈশ্বিক পরিমন্ডলে দেওবন্দি-চেতনাকে নতুন মোড়কে হাজির করে। আল কায়েদার সঙ্গে তালেবানের বন্ধুত্বের জের ধরে অনেকের মনে জিজ্ঞাসা হাজির হয়েছিল, তালেবান তার নতুন মতাদর্শিক ঠিকানা নির্মাণ করবে কি না! কিন্তু বিভিন্ন গণমাধ্যমের ইন্টারভিউয়ে তালিবনেতারা দেওবন্দি-সুন্নি মাসলাকের প্রতিই নিঃশেষ আনুগত্য জাহির করেন। এই সুবাদে গোটাবিশ্ব দেওবন্দি-চিন্তার নতুন এক অবয়বের দেখা পায়।

পাশাপাশি বিতর্ক উঠেছে খোদ দারুল উলুম দেওবন্দে; গত বছরের ২২ আগস্টে, বিবিসি এবং ক‌ওমি আওয়াজ নামের এক উর্দু পত্রিকায় মাওলানা আরশাদ মাদানি সাক্ষাৎকারে দেওবন্দের সঙ্গে তালেবানের সম্পৃক্ততার প্রচারণাকে ইনকার করেন। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে আফগানে তারা কি ধরনের শাসনব্যবস্থা কায়েম করবে ইতিহাস সেটা দেখবে, তবে দেওবন্দের সঙ্গে তালেবানের কোন সম্পর্ক নেই। শাইখুল হিন্দ আফগানিস্তানে ‘স্বাধীন-রাষ্ট্র’ প্রস্তাব দিয়ে উবাইদুল্লাহ সিন্ধিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বরকতুল্লাহ ভোপালিকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন, সম্ভবত এর সূত্র ধরেই কেউ কেউ দেওবন্দের সঙ্গে তালেবানের সম্পৃক্ততা তৈরি করতে চেষ্টা করছে। প্রাতিষ্ঠানিক সূত্রে দেওবন্দি হলেও তাদের সার্বিক তৎপরতার দায়-দায়িত্ত্ব দারুল উলুম দেওবন্দ নেবে না; নিজস্ব দেশকাল ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে বিভিন্ন কর্মপদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ তাদের আছে। ১

আরশাদ মাদানির বক্তব্য পলিসি হিসেবে উপযুক্ত বটে এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতো তালেবানের সঙ্গেও দারুল উলুম দেওবন্দের প্রত্যক্ষ সংযোগ নেই। তবে তালেবান দেওবন্দি-সুন্নি মাসলাকের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তালেবানের শিক্ষা, সংষ্কৃতি, ফিকহ এবং আকিদাগত অবস্থান একথাই প্রমাণ করে। দেওবন্দ একটি চেতনা; দেশকাল বিবেচনায় প্রায়োগিক বাস্তবতা ভিন্ন হতে পারে। আফ্রিকা, ইউরোপ, আফগান, পাকিস্তান, ভারত এবং বাংলাদেশে দেওবন্দি চেতনার বিচিত্র প্রকাশ ঘটতে পারে, নির্দিষ্ট কোন পদ্ধতিকে সার্বজনীন বলা যাবে না। তাবলীগ, তালেবান এবং কেতাবি-আলেমদের মতো তাসাউফ-চর্চা-প্রতিষ্ঠান‌ও দেওবন্দের বাইরে না। মোটাদাগে বারবারা ম্যাটক্যাফের বিশ্লেষণ যথার্থ; তিনি দেওবন্দি মাসলাককে তিন শ্রেণীতে বিস্তৃত করে পাঠ করেন– তাবলীগ, তালেবান এবং দরস-তাদরিসে সংশ্লিষ্ট মাওলানা। তবে বৈশ্বিক বিস্তৃতি ঘটেছে কেবল তাবলীগ ও তালেবানের অসিলায়।

তাবলীগ-তালেবান সম্পর্ক

পশ্চিমে, এমনকি বৈশ্বিকভাবে তাবলিগ-তালেবান সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছিল একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে। সেটি হচ্ছে, একজন মার্কিন-যুবক তাবলীগী কার্যক্রমে অংশ নিয়ে পাকিস্তানে পৌঁছে, পরবর্তীতে সে তালেবানে যোগ দেয়। ঘটনাটিকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করে অনেকে তাবলীগ ও তালেবানকে হুবহু এজেন্ডা হিসেবে পাঠ করতে শুরু করে। ওয়েস্টার্ন একাডেমিয়ার Barbara matcalf এর বিশ্লেষণ খেয়াল করেন। তিনি বলেন, “Participants in tablighi activities define their efforts as jihad. This word is, of course, widely translated as “holy war” but its root meaning is “effort” or “struggle.” Following Prophetic hadith, jihad may be classified as “the greater jihad,” the inner struggle to discipline and moral purification that a person exerts upon the individual self, or as “the lesser jihad” of militancy or violence. For both kinds of jihad, the focus transcends the nation-state to a global umma.

Tablighis use the same discourse of jihad as do those engaged in militant action. Their leaders are amirs … a person who dies in the course of tabligh is a shahiid … Both militants and Tablighis, moreover, stress the obligation of the individual believer, not (in the case of mission) the `ulama, nor (in the case of militancy) the state.18 One of the fundamental characteristics of the reform movements of the colonial period and after was a diffusion of leadership and authority, a kind of “laicization,” evident here. ২

প্রথমত, বৈশিষ্ট্যগত তফাৎ সত্ত্বেও তাবলীগী কার্যক্রমে নিজেদের তৎপরতাকে ‘জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ বলা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, নেতাকে বলা হচ্ছে ‘আমির’। তৃতীয়ত, তাবলীগে থাকাকালে মৃত্যুবরণ করলে ‘শহীদ’ আখ্যা দেয়া হচ্ছে ; পোষ্ট কলোনিয়াল পিরিয়ডের আন্দোলনবাদি দলগুলোতে এসব পরিভাষা সচরাচর দেখা যায়। ফলে তালেবানের মতো জাতিরাষ্ট্র ভেঙে ‘গ্লোবাল উম্মাহ/ খেলাফত’ তৈরিও তাবলীগের লক্ষ্য, এ ধরনের ব্যাখ্যাধারা গড়ে উঠেছিল পশ্চিমে। এতে খুবই সরলীকরণ হয়েছে। কেননা, তাবলীগী কার্যক্রমে এসব পরিভাষা ব্যবহার নিয়ে খোদ ‘তালেবান’ এবং সচেতন আলেম শ্রেণীও নাখোশ। তবে ‘গ্লোবাল উম্মাহর’ ব্যাপারে তাবলীগের তেমন উচ্চাশা নেই; মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করাই মূল উদ্দেশ্য তাদের। উপমহাদেশের সুলাইমান নদভী এবং আলি নদভী কমবেশি নিজস্ব কর্মতৎপরতার মধ্য দিয়ে তাবলীগকে গ্লোবাল-উম্মাহ ও সমাজ-রাজনীতির বোঝাপড়ায় হাজির করতে চেয়েছিলেন।৩

তাবলীগ ও তালেবানের বৈচিত্র্য নিয়ে মোটাদাগে কয়েকটি নোক্তা দেওয়া যায়–

প্রথমত, উপনিবেশ এবং সাম্রাজ্যবাদে নিষ্পেষিত গণমানুষকে ঈমান-ইখলাসে বলিয়ান করে পাশ্চাত্যের যেহেনি গোলামি দূর করবার প্রচেষ্টা হচ্ছে তাবলীগ। অন্যদিকে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডে, নিজস্ব রাজনৈতিক সত্তা নির্মাণের প্রচেষ্টা হচ্ছে তালেবান।

দ্বিতীয়ত, মুভমেন্ট হিসেবে তালিবানের একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি আছে। শিক্ষাব্যবস্থা, আইন-আদালত, রাষ্ট্র ও সরকার নিয়ে আছে কাঠামোগত সংস্কার-প্রস্তাবনা। অন্যদিকে তাবলীগ নিছক প্রচারধর্মী তৎপরতা; সীমান্ত পেড়িয়ে ‘দাওয়াহ ইলাল্লাহ’কে বৈশ্বিক করবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে তাবলীগের যাত্রা। ফলে উভয়ের সুত্রে দেওবন্দি মাসলাকের বৈশ্বিক বিস্তৃতি ঘটলেও, আবেদনে ভিন্নতা রয়েছে।

তৃতীয়ত, দুটোর বৈশ্বিক বিস্তৃতির গতিপ্রবাহ সমান্তরাল নয়। ‘গ্লোবাল খেলাফতের’ অনুপ্রেরণা থাকলেও তালেবান শাখা-প্রতিষ্ঠান কিংবা বিশ্বব্যাপী কর্মতৎপরতা তৈরির দায় এখন পর্যন্ত অনুভব করেনি। ফলে তাবলীগের মতো মসজিদ ও কমিউনিটি ভিত্তিক প্রত্যক্ষ বিস্তৃতি তালেবানের ক্ষেত্রে ঘটে নি।

তথ্যসূত্র

১. Qawmi awaz, 2021

২. Traditionalist” Islamic Activism: Deoband, Tablighis, and Talibs, by Barbara D. Metcalf

৩. দেখুন সুলাইমান নদভীর ‘দ্বীনি দাওয়াত’

 

 

আগের সংবাদপ্রস্তাবিত বাজেট মন্ত্রিসভায় অনুমোদন
পরবর্তি সংবাদপদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে ২৫ জুনের এসএসসি পরীক্ষা ২৪ জুন