‘জীবনে যখন যা শিখেছি, কিছুই বৃথা যায়নি’

লেখক-সাংবাদিক তামীম রায়হানের প্রথম পরিচয় তিনি মাসিক ছোটকাগজ ‘নবধ্বনি’র সম্পাদক। মাদরাসায় পড়া কালে তারুণ্যের সূচনা লগ্নে শুরু করা এ কাগজটি একযুগ হলো তিনি সম্পাদনা করছেন। পেশাগত জীবনে বর্তমানে কাতার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গণমাধ্যম গবেষক হিসেবে কর্মরত। পাশাপাশি দৈনিক প্রথম আলো ও প্রথম আলো সাপ্তাহিক উপসাগরীয় সংস্করণের কাতার প্রতিনিধি। জড়িয়েছেন প্রকাশনা-ব্যবসার সাথেও। ঢাকার অভিজাত প্রকাশনা-প্রতিষ্ঠান নবপ্রকাশ-এর চেয়ারম্যান। রাজধানীর লালবাগ জামিয়া থেকে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করার পর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য স্কলারশিপ নিয়ে পাড়ি জমান কাতারের দোহা ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াশোনার সুবাদে কয়েক বছরের মাথায় কাতার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকুরি পান, সেই সঙ্গে জড়ান প্রথম আলোর সাথেও। তাঁর পড়াশোনা, ক্যারিয়ার এবং বৈচিত্রময় কর্মঅভিজ্ঞতা বিষয়ে আলাপ হয় ফাতেহ টোয়েন্টি ফোরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফাতেহ-সম্পাদক ইফতেখার জামীল।

মাদরাসা জীবনের শেষ দিকে আপনারা ছোটকাগজ নবধ্বনির উদ্যোগ হাতে নেন। উদ্যোগের শুরুটা কেমন ছিল?

আমরা নবধ্বনি প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলাম ২০০৬ সালে। উদ্যোগের শুরুটা স্বপ্নময় ছিল, কিন্তু অবাস্তব বা কল্পনাবিলসী কোনো স্বপ্ন আমাদের ছিল না। শুধু অনুভব করেছিলাম, ওই সময়ে বা আমাদের ওই বয়সে আমরা যা বলতে চাই এবং যা শুনতে চাই, তা কেউ বলছে না, বললেও শুনছে না। আমরা চাইলাম, আমাদের নবধ্বনি সেকালে প্রচলিত ইসলামি ধারার ম্যাগাজিনগুলোর চেয়ে বিষয়বৈচিত্রে ভিন্ন হোক। পাশাপাশি এটি শুধু তরুণদের জন্য হোক। এসব বিবেচনায় রেখে আমরা নবধ্বনি প্রকাশ করতে শুরু করি। তখন থেকে আজ অবধি নবধ্বনি সেই ভিন্নধারা বজায় রাখতে চেষ্টা করছে।

আমাদের পথচলার শুরুটা বেশ সহজ ছিল, কারণ তখন আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির যুগ শুরু হয়ে গেছে, পাশাপাশি এটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত হওয়ায় দেশের সর্বত্র আমরা খুব সহজে পৌঁছাতে পেরেছিলাম। আমরা তরুণ ছিলাম এবং আমাদের সবাই নিঃস্বার্থভাবে আন্তরিক ছিলাম, এটিই ছিল আমাদের মূল শক্তি।

আপনার একটা বন্ধুমহল ছিল, পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সাথেও জড়িয়েছিলেন, ঐ সময়ের পরিবেশ ও প্রতিবেশের গল্প শুনতে চাই।

আমার যে বন্ধুমহল ছিল, সেটি মূলত গড়ে ওঠে লালবাগ মাদরাসা ঘিরে। এখানেই আমার মাদরাসাজীবনের শিক্ষা সমাপ্ত হয়। লালবাগে থাকাকালে যাদের সঙ্গে সখ্যতা ও বন্ধুত্ব হয়, তাদের সঙ্গে এখনও বেশ দৃঢ় সম্পর্ক বজায় আছে।

জীবনের ধাপে ধাপে এই বন্ধুমহল থেকে আমি নানাভাবে উপকৃত হয়েছি। আমার বর্তমান কর্মকাণ্ডের সঙ্গে এই বন্ধুমহলের বন্ধুরা-ই জড়িয়ে আছে। ফলে কোনো কাজ করতে গিয়ে কখনো অপরিচিত কাউকে নিয়ে আমাকে দ্বিধাগ্রস্ত হতে হয়নি বা থেমে যেতে হয়নি।

মাদরাসাশিক্ষা শেষ করে আপনি সাধারণ শিক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন। পরবর্তীতে বিদেশও গিয়েছেন। এর পেছনে ঠিক কী উদ্দেশ্য কাজ করেছিল?

২০১০ সালে কাতার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কলারশিপ (শিক্ষাবৃত্তি) পাই। সেসময় আমি ঢাকায় আমার সব ব্যস্ততা ছেড়ে কাতারে চলে আসি। বিদেশে পড়তে আসার পেছনে আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল পড়াশোনা। আমি নিজের ভেতর থেকে অনুভব করছিলাম, যা পড়েছি, এর চেয়েও অনেক অনেক গুণ বেশি পড়া বাকি রয়ে গেছে। বিদেশে চলে না গেলে এই পড়া আমার আর হতো না। আর যেহেতু পারিবারিক বা আর্থিক কোনো চাপ ছিল না, সেজন্য দেশ থেকে দূরে গিয়ে কিছুকাল পড়াশোনার জগতে নিমগ্ন থাকা আমার জন্য সহজ হয়েছিল।

২০১৫ সালে কাতারের নায়েবে আমির শেখ আব্দুল্লাহ বিন হামাদ আলথানির হাত থেকে ‘কাতার বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণপদক’ গ্রহণ করছেন তামীম রায়হান। ছবি : দৈনিক আলআরব পত্রিকার বিশেষ ক্রোড়পত্র

আপনার জীবনে মাদরাসায় কাটানো সময়টা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল? আপনি কি আপনার সন্তানকে মাদরাসায় দেবেন? যদি দেন, তাহলে ততদিনে ঠিক কেমন সংস্কার আশা করেন?

আমার জীবনে মাদরাসায় অতিবাহিত সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি কেবল কথার কথা হিসেবে নয়, বরং আক্ষরিক অর্থে এই কথা আমি বিশ্বাস করি। আমার মানসিক ও চিন্তার জগত গঠনে মাদরাসা শিক্ষা-ই মূল ভিত্তি গড়ে দিয়েছে। ফলে জাগতিক কৃত্রিমতা ও মোহ কখনো আর আমাকে ছুঁতে পারেনি।

আমার সন্তানকে আমি মাদরাসায় দেব, তবে মাদরাসার নাম ও পরিচিতি কিংবা শিক্ষার মান দেখে নয়, বরং শিক্ষকের গুণাগুণ বিবেচনা করে। আর মাদরাসার সংস্কার নিয়ে আমার কথা বলা সমীচিন নয় বলে মনে করি।

কাতারে পড়াশোনার অভিজ্ঞতাটা কীভাবে উপভোগ করছেন, উচ্চশিক্ষা আপনার চিন্তা, কর্মপন্থা ও জীবনযাপনে মোটাদাগে ঠিক কী কী পরিবর্তন ঘটিয়েছে?

কাতারে পড়াশোনা করতে এসে আমি অনুভব করলাম, মাদরাসাগুলোতে মাধ্যমিক স্তরে যেসব জটিল ও কঠিন বিষয়ে পড়াশোনা হয়ে থাকে এবং সেসব যেভাবে পড়ানো হয়ে থাকে, সাধারণ ধারায় বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেও সেরকম জটিল ও কঠিন কিছু থাকে না। ফলে অনারব দেশের মাদরাসা থেকে পড়ে আরব দেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে আমি দেখেছি, আমরা যে পদ্ধতিতে পড়েছি ও পরীক্ষা দিয়েছি, সেই তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক পড়াশোনার পদ্ধতি ও পরীক্ষা অনেক সহজ। তবে পদ্ধতিগত আধুনিকতার কিছু সুফল আছে, যা মাদরাসাগুলোতে থাকলে শিক্ষার্থীরা আরও ব্যাপকভাবে উপকৃত হতো বলে আমি মনে করি।

উচ্চশিক্ষা আমার চিন্তা ও কর্মপন্থায় অবশ্যই পরিবর্তন এনেছে। আমার বয়সী একজন শুধু-মাদরাসা-পড়ুয়া কোনো বিষয়কে যেভাবে দেখেন বা ভাবেন, আমি তাঁর চেয়ে একটু ভিন্নভাবে দেখি এবং ভাবি। এটুকু পার্থক্য আমি উপলব্ধি করি। এই বিষয়টি ছাড়া বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে আমার আরও নানারকম অভিজ্ঞতা হয়েছে, যেগুলো খুব অল্পকথায় বলে ফেলা মুশকিল।

কাতার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গণমাধ্যম গবেষক হিসেবে আপনি কর্মরত। এই পদে আপনার যোগদান, কাজ এবং কাজের অভিজ্ঞতা বিষয়ে কিছু শুনতে চাই।

কাতার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গণমাধ্যম গবেষক হিসেবে আমার যোগদানের ব্যাপারে বলতে গেলে শুধু বলব, আগ্রহ ও চেষ্টা এবং নূন্যতম যোগ্যতা থাকলে এসব দেশে অন্যের পরিচয় ও সুপারিশ ছাড়া চাকুরি পাওয়া যায়। কাজ এবং কাজের অভিজ্ঞতা এই দেশের অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রীয় বিষয় হওয়ায় সেসব না বলা ভালো। এককথায় বলতে পারি, জীবনে যখন যা কিছু শিখেছি, কর্মজীবনে এসে উপলব্ধি করতে পারি, কোনোকিছুই বৃথা যায়নি।

আপনি প্রথম আলোর সাথে জড়িত আছেন। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক অনলাইন পোর্টাল ও নবধ্বনি পরিচালনা করছেন। প্রচারমাধ্যমের সাথে এই যে সংশ্লিষ্টতা, একে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

প্রথম আলোয় কাজ করতে পারা আমার লেখালেখি ও সাংবাদিকতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারণ, লেখালেখি ও সংবাদচর্চায় গুণগত মান বজায় রাখা, বস্তুনিষ্ঠ ও পক্ষপাতমুক্ত সাংবাদিকতার চর্চা, প্রতিনিয়ত মান-উন্নয়নে সচেষ্ট হওয়া, সময়ের গুরুত্ব এবং সাহসিকতা–এমন অনেক প্রয়োজনীয় বিষয় আমি প্রথম আলোয় কাজের সুবাদে শিখেছি এবং শিখছি। আমি অনুধাবন করি, প্রথম আলো কেবলই একটি সংবাদপত্র নয়, এটি একটি প্রতিষ্ঠান, যার ভিত্তি ও বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত সুদৃঢ় এবং সময়োপযোগী।

আর যেহেতু আমি সাংবাদিকতায় পড়াশোনা করেছি, তাই প্রচারমাধ্যমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকা আমার কাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই সংশ্লিষ্টতা কেবল পেটের দায়ে নয়, বরং নিজের ভালোলাগা ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা এখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

ভবিষ্যতে প্রচারমাধ্যমে কীভাবে কাজ করতে চান। প্রধান প্রধান লক্ষ্যগুলো ঠিক কী?

প্রচারমাধ্যমে কাজের ব্যাপারে আমার নিজস্ব কিছু পছন্দ ও নীতি আছে। ফলে সব ধরনের প্রচারমাধ্যমে আমি জড়াবো না, এটা আমার পুরনো সিদ্ধান্ত। প্রচারমাধ্যমে কাজের বেলায় আমার একটিই লক্ষ্য, আমি এই মাধ্যমে এমন কিছু তুলে ধরব, যা অন্য কেউ পারে না। এই স্বকীয়তা বজায় রেখে আমি কাজ করে যেতে চাই।

ইদানীং আপনি প্রকাশনা-ব্যবসার সাথেও জড়িয়েছেন। কয়েকবছর হয়ে গেল। অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিল?

প্রকাশনা ব্যবসায় আমার জড়িত হওয়ার পেছনে নিজস্ব লেখালেখি, নিয়মিত মাসিক নবধ্বনি প্রকাশ করাসহ বেশকিছু বিষয় জড়িয়ে আছে। মাসিক ওই কাগজ প্রকাশ করতে গিয়ে যদিও কখনো এমন প্রকাশনা ব্যবসার কথা ভাবিনি, কিন্তু প্রকাশনা সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা থাকায় বই প্রকাশনা যখন শুরু করি, তখন তা আর কঠিন থাকেনি। ফলে পথচলাটা সহজভাবে শুরু হয়।

এই অঙ্গনের সঙ্গে জড়িয়ে যে অভিজ্ঞতাটা আমার হলো, সেটি হচ্ছে–বাংলাদেশে পাঠকদের রুচি ও চাহিদার জগতে বেশ বড় পরিবর্তন এলেও লেখক ও প্রকাশকরা সে ব্যাপারে যত্নবান নন। লেখকরা নিজের পছন্দ অনুযায়ী বিষয়ের কথা ভাবেন এবং প্রকাশকরা অল্প বিনিয়োগে বেশি আয়ের পথে হাঁটেন, ফলে বাংলাদেশের বই-প্রকাশনা জগত এখনো পিছিয়ে আছে। এটি মৌলিক এবং অনুবাদ–দু ব্যাপারেই সত্য বলে আমি মনে করি।

আগের সংবাদকাশ্মীরের আজাদী ও ভারতীয় ঔপনিবেশিক শক্তি
পরবর্তি সংবাদকেমন আছেন পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা?