দখল

হাসান ইনাম:

শওকত সাহেব মারা গেলেন ভোর পাঁচটায়। পুরো মহল্লা তখন ঘুমে। গলির সামনে প্লাস্টিকের চেয়ারটা তখনও একা একা বসে আছে। বেলা একটু বাড়লেই আরো দশ থেকে বিশটা চেয়ার এসে বসলো গলির মুখে। গলির মুখে চেয়ার নামাতে দেখে মহল্লার অনেকেই বুঝে গেল কেউ একজন মারা গেছে । মহল্লাবাসী শওকত সাহেবের মৃত্যুর সংবাদটি শোনার পাশাপাশি আরো একটি সংবাদ শুনলো। সংবাদটি একই সঙ্গে সংবেদনশীল আর গুরুত্বপূর্ণ। এতটাই গুরুত্ব দ্বিতীয় খবরটার যে, শওকত সাহেবের মৃত্যুর সংবাদ এক প্রকার লীন হয়ে গেলো। যেন মরেছে ঠিকাছে, মরারই ছিল। কিন্তু তাই বলে? তাই বলে কী আর কেন এই দ্বিতীয় প্রশ্নের উদ্ভব, সেটা বলার জন্যই এই গল্পের অবতারণা।

শওকত সাহেব নিঃসন্তান। সহায় সম্পত্তি বলতে আছে তিন তলা একটা বিল্ডিং। মহল্লাবাসীদের ভিতর একটা কথা বেশ চাউর আছে গত কয়েক দশক যাবত। তারা বলে, শওকত সাহেবের সন্তান না থাকলেও তিন তলা বিল্ডিংটাকেই তিনি নিজের সন্তান মনে করেন। কথা অনেকাংশেই সত্য। নিচ তলা একদম মাটির নিচে চলে গেছে বলা যায়। বার কয়েক জায়গাটা বিক্রি করার লোভনীয় প্রস্তাব এলেও ফিরিয়ে দিয়েছেন শওকত সাহেব। ডেভলপার কোম্পানি এসেছে, বুঝিয়েছে নানান ভাগযোগ আর সুবিধার কথা। কিন্তু শওকত সাহেব অনড়। এই বাড়ি তিনি ভাঙবেন না। শেষমেশ সবাই গোমড়া মুখে ফিরে গেছে আর মনে মনে বলেছে মরে গেলেই তো শেষ। ছেলেপুলে তো দূরে থাক, কোনো আত্মীয় স্বজনের টিকিটাও তো দেখেনি কেউ। বিল্ডিং এর অবস্থা বেশি একটা ভালো না। পলেস্তারা খসে গিয়ে ইট আর চুন সুরকি বেরিয়ে আসছে। স্যানিটারি লাইনে সমস্যা। বৃষ্টি হলেই তিন তলার ভাড়াটিয়াদের মাথায় ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে। তবুও কোনো বিকার ছিল না শওকত সাহেবের। ভাড়া তুলনামূলক কম হওয়াতে ভাড়াটিয়ারা এসব সয়ে নিয়েছে। তবে কয়েক মাস পরপর অবশ্য ভাড়াটিয়া পাল্টায়। দেড় কাঠা জায়গার উপর ম্যাচের বাক্সের মতো দাঁড়িয়ে থাকা এই বিল্ডিংয়ে তিনটি ফ্ল্যাট। প্রতি তলায় এক ইউনিট। নিচ তলা পুরোপুরি খালি। কেউ থাকে না বললে ভুল হবে। মানুষ থাকতে পারে না বলে থাকতে পারে না। কয়েক দফা রাস্তা উঁচু করায় নিচ তলার সত্তুর ভাগ এখন মাটির নিচে। ইঁদুর, তেলাপোকাসহ নাম না জানা অনেক প্রাণী খুব নিরাপদে থাকে সেখানে। হামাগুড়ি দিয়ে ঢোকা যায়। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকা যায় না। নিচতলায় পানি জমেছে। নোংরা পানির ভকভক গন্ধ আর মশার উপদ্রপে টেকা দুষ্কর। দ্বিতীয় তলায় শওকত সাহেব একা থাকেন।

শওকত সাহেব মারা গিয়েছেন নিচ তলার একটা রুমে। লাশ কোনভাবেই বের করা যাচ্ছে না। মহল্লাবাসীর মুখে মুখে ছড়িয়ে যাওয়া দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ খবর এটাই। আর প্রশ্ন একটাই, লাশ বের করবে কিভাবে?

প্রশ্ন কেবল একটা না। বিল্ডিংটার কী হবে, শওকত সাহেব নিচ তলায় ঢুকলেন কিভাবে, নিচ তলায় ঢুকেই মারা গেলেন কেন, নিচ তলায় মারা গেলে সংবাদটা সবার আগে কে পেলো আর কিভাবে পেলো… এসব প্রশ্নও মুখে মুখে ঘুরছে। তবে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এটাই।

আমি খবরটা যখন পেয়েছি ততোক্ষণে জল অনেকদূর গড়িয়ে গেছে। পুরো মহল্লার লোকজন জড়ো হয়েছে শওকত সাহেবের বিল্ডিং এর সামনে৷ লাশ এখনও বের করা যায়নি৷ সন্ধ্যা নামবে একটু পর বায়ান্ন হাজার তেপান্ন গলির শহরে। আমি দুইদিনের ছোট একটা ট্যুরে চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম। ঢাকায় পৌঁছেছি চারটে নাগাদ। মহল্লায় ফিরতে বিকেল হয়েছে। নরেনের সেলুনের সামনে আসতেই খবরটা পেলাম। মৃত্যুর খবরটা পরে, আগে লাশ আটকে পড়ার খবর৷ আমাকে যেতে দেখেই নরেন বলে উঠলো, ‘লাশ এমুনভাবে আটকাইছে৷ অখন তরি বাইর করতে পারি নাইক্কা মামু।’ আমি কিছু বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলাম, ‘কার লাশ?’

আমি এখনও খবরটা জানি না দেখে নরেন কিছুটা হতাশ হলো বোধহয়। তবুও রসিয়ে রসিয়ে যে ঘটনাটা বললো সেই ঘটনা আমাকে এরপর আরো দশ থেকে বারোবার শুনতে হয়েছে৷ ঘটনাটা অনেকটা এমন– মাঝরাতে স্ত্রীর শোকে কাতর হয়ে স্ত্রীর স্মৃতিবিজড়িত রুমে গিয়েছিলেন শওকত সাহেব। নিচ তলার যে রুমটায় সস্ত্রীক থাকতেন শওকত সাহেব সেখানে গিয়েই বিষাক্ত সাপের কামড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন তিনি৷ ঘটনাটা বেশ পোক্তভাবেই চাউর হয়েছে। একেকজন এমনভাবে বলছে যেন তার সামনেই ঘটেছে ঘটনাটা। সাপ যখন ছোবল দিয়েছে তখন সে পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো।

বাসা পর্যন্ত আসতে আসতে সম্ভাব্য আরো কয়েকটা মৃত্যুর কারণ আর ঘটনা শুনলাম৷ তবে লাশ বের করা যাচ্ছে না এটাই এখন সবচেয়ে চিন্তার বিষয়। সরাসরি স্পটে চলে গেলাম আমি। শওকত সাহেবের সাথে আমার প্রায়ই কথা হতো। বিকেল বেলা বাসা থেকে বেরিয়ে গলির মাথায় একটা চেয়ার নিয়ে বসতেন। বয়সের থেকে বেশি বুড়িয়ে গিয়েছিলেন। বছর পাঁচেক আগে স্ত্রীকে হারানোর পর থেকেই এই অবস্থা। বিকেল বেলা টিউশনি থেকে ফেরার পথে উনার সাথে কথা হতো৷ সালাম দিতাম পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়৷ কেমন আছি, পড়াশোনা কেমন চলছে ছাড়াও টুকটাক আরো কয়েকটা বাক্যে স্থায়ী হতো সংলাপ। মহল্লাবাসীর জটলার কাছাকাছি হওয়ার একটু আগে চট করে মনে পড়লো ট্যুরে যাওয়ার আগের দিন সর্বশেষ যেদিন দেখেছি শওকত সাহেবকে, উনি চুপচাপ বসে ছিলেন। সালাম দিলে উত্তর দেননি, কথাও বলেননি। লোকটা কি তাহলে বুঝতে পেরেছিলেন কিছু?

মাগরিবের আজান যখন দিচ্ছে মসজিদে তখন নতুন এক সমস্যার কথা মাথায় এলো সবার৷ লাশ বের করতে না পারলে তো ফুলে উঠবে। পঁচে গন্ধ বের হবে। মুসল্লীরা নামাজে চলে গেলো৷ নামাজের পর ইমাম সাহেব সমেত এসে কিছুক্ষণ কেওয়াজ করে যে যার মতোন ফেরত চলে গেলো। রাত কিছুটা বাড়তেই লোকজন কমতে লাগলো। শওকত সাহেবের লাশটা এমন এক জায়গায় পড়ে আছে, কোনভাবেই সেটা বের করা যাচ্ছে না। প্রতি ফ্ল্যাটে মোট দুটো রুম। একটাতে চিপা একটা বারান্দা আছে। ওই বারান্দায় পড়ে আছে লাশটা। কোনরকম ওই বারান্দা পর্যন্ত পৌঁছানো যায় কিন্তু লাশ নিয়ে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। লাশটা বারান্দা থেকে বের করতে পারলে দড়ি বেঁধে বা টেনে হিঁচড়ে কোনরকম নিয়ে আসা যেতো৷ বারান্দার সাথে একদম লাগোয়া হাশেম সাহেবের বিল্ডিং৷ ছোট্ট একটা জানালা আছে বারান্দার দিকে মুখ করে। ওখান দিয়েই ফজরের নামাজের জন্য বের হওয়ার আগে লাশটা দেখেছিলেন হাশেম সাহেব। ওজু করে আকাশের দিকে দোয়া পড়েন তিনি। বাসায় ওজু করলে আকাশের দিকে তাকাতে পারেন না৷ আকাশ দেখা যায় না। তাই জানালার দিকে তাকান। পরিত্যক্ত বারান্দার গ্রিলের দিকে তাকিয়ে দোয়া পড়েন৷ আজ সকালে দোয়া পড়ার সময় হঠাৎ হাশেম সাহেব আৎকে উঠেন। গ্রিলের সাথে চিপকে আছে কিছু একটা। প্রথমে ভেবেছিলেন চোর। দ্রুত জানালার পাশে গিয়ে দেখেন শওকত সাহেব বারান্দায় শুয়ে আছেন। এক হাত দিয়ে রেলিংটা ধরা। হাশেম সাহেব কয়েকবার ডাকাডাকি করেছিলেন। কোনো সাড়া না পেয়ে ঘর মোছার স্ট্যান্ডটা দিয়ে ধাক্কা দিয়েছিলেন। রেলিংয়ে ধরা হাতটা ঝুপ করে পড়ে গেলো বুকের উপর। হাশেম সাহেব নাকি তখনই বুঝে গিয়েছিলেন শওকত সাহেব আর বেঁচে নেই। গলির মুখে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যা থেকে এসব গল্প তিনি ননস্টপ বলে যাচ্ছেন। স্ত্রীর শোকে কাতর হয়ে শওকত সাহেব নিচ তলায় এসেছিলেন এই কথাও হাশেম সাহেব বলেছেন সবার আগে। এর আগেও নাকি তিনি কয়েকবার দেখেছেন শওকত সাহেবকে নিচ তলার রুমে উবু হয়ে বসে থাকতে। শওকত সাহেব নাকি একবার মসজিদে বসে বলেওছিলেন ,তিনি রাতে নিচ তলায় পায়চারি করেন, যখন স্ত্রীর কথা বেশি মনে পড়ে। শওকত সাহেব আদৌ এই কথা বলেছিলেন কিনা সেটার সত্যতা এখন আর যাচাই করা সম্ভব না। তবে হাশেম সাহেবের মুখে এই কথা শোনার পর মুহূর্তেই কয়েকজন সহমত পোষণ করলো। তারাও এই কথা শুনেছে মসজিদে বসে। জীবনে কোনদিন মসজিদে না যাওয়া, নিজেকে নাস্তিক বলে পরিচয় দেওয়া রতন সাহেবকেও দেখলাম মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলছেন, তিনিও ছিলেন। হাশেম সাহেবের গল্প থেমে গেলো রাত আরেকটু বাড়তেই। লাশ পচে গন্ধ বের হলে কি করে থাকবেন সেই চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি। শওকত সাহেবের বর্তমান ভাড়াটিয়া নাম আরিফ। আরিফের ছোট্ট সংসার। গত মাসে এই বাসায় উঠেছে। শাহেদা অর্থাৎ আরিফের স্ত্রী সকালেই বাপের বাড়ি চলে গেছে। মরা বাড়ি সে থাকবে না। আমি রাতে খাওয়া-দাওয়া করে পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে দেখতে যখন বের হয়েছি তখন আরিফ, হাশেম সাহেব এবং আশেপাশের বিল্ডিংয়ের দুই একজন ছাড়া আর কেউ নেই। সবাই থমথমে মুখে গলির সামনে পেতে রাখা চেয়ারে বসে আছে। দিনভর চলা শোরগোল আর ভিড় কমে যাওয়ার পর এখন মনে হচ্ছে এটা একটা মরা বাড়ি। হাশেম সাহেবের পাশের চেয়ারটা খালি দেখে বসে পড়লাম।

‘ভাতিজা, দেখছো শওকত ভাই চইলা গেলো। আমাদেরও একদিন এমনে যাইতে হইবো।’ আমাকে দেখেই আর্দ্রকণ্ঠে বললেন হাশেম সাহেব।
‘জি আংকেল। সবাইকে তো যেতে হবে। কিন্তু শওকত আংকেলের মতো মৃত্যু যেন কারো না হয়।’
আমার কথা শুনে সবাই একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সমবেত দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয়ে উঠলো বাতাস।
‘লাশ কি তাহলে বের করাই যাবে না?’ প্রশ্ন করলাম আমি।
হাশেম সাহেব খানিক্ষণ চুপ করে থেকে বিড়বিড় করে বললেন, ‘রাত আরেকটু বাড়ুক।’

আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। সকাল সকাল ডেকোরেটরে ফোন দিয়ে চেয়ারগুলোর ব্যবস্থা যে হাশেম সাহেব করেছে, সেই তথ্য শুনলাম আরিফের কাছ থেকে। লাশ বের করার জন্য এখন অব্দি কী কী করা হয়েছে, কারা ভিতরে গিয়েছিল সেসবও শুনলাম। ঘড়িতে তখন সময় এগারোটা চল্লিশ। মহল্লার সবাই বাসায় ফিরে গেলেও সবার মন এখানে পড়ে আছে। একটা মানুষ মারা গেছে কিন্তু এখনও তার দাফন কাফনের ব্যবস্থা করা যায় নাই। শওকত সাহেবের কোনো আত্মীয়-স্বজন কি নাই? যদি স্বাভাবিক মৃত্যু হতো তাহলে দাফন-কাফন কারা করতো? প্রশ্নটা করেই ফেললাম। হাশেম আংকেল উত্তর দিলেন না। আরিফ বললো, ‘শওকত কাকার তো ছেলেপুলে নেই সবাই জানো। উনি হলোগে উনার বাপের একমাত্র ছুয়াল। উনার বউর গুষ্ঠির যারা আছে তারা সবাই বিদেশ থাহে। আসার মতোন কেউ নেই।’

আরিফের কথার মাঝখানে খুট করে একটা প্রশ্ন মাথায় নাড়া দিয়ে উঠলো। মাত্র এক মাস এসেই এতকিছু জানে কিভাবে আরিফ? আর শওকত সাহেব তো বেশ চাপা স্বভাবের মানুষ ছিলেন। এসব কথা উনি কাউকে বলেছেন বলে আমার মনে হয় না। তাহলে কি পরিকল্পিত কোনো হত্যাকাণ্ড? উঁহু, বেশি ভেবে ফেলছি আমি।

বারোটার কাছাকাছি সময়ে একজন লোক এলো গলির মুখে। গলায় মাফলার পেচানো। নাক অব্দি ঢাকা মাফলারে। হাতে একটা চটের ব্যাগ। গলির মুখে এসেই পকেট থেকে মোবাইল বের করলো লোকটা। কাউকে কল দিয়েছে। একই সময়ে হাশেম আংকেলের মোবাইলে রিং বেজে উঠলো। হাশেম কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে কল রিসিভ করলেন। আগন্তুক মোবাইল পকেটে রেখে দিয়ে দুই তিন পা সামনে এগিয়ে এসে হাশেম আংকেলের সামনে এসে দাঁড়ালো। যা ভেবেছিলাম তাই, লোকটা হাশেম আংকেলের কাছেই এসেছে।

‘ভাতিজা। বাইত যাওগা। রাত বাড়ছে। আমরা দেখি রাইতটা কোনরকম কভার কইরা সক্কাল সক্কাল লাশ বাইর করবার পারি নাকি।’

আমার উপিস্থিতে আগন্তুকের সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন না হাশেম আংকেল। আমি উঠে পড়লাম। কোনো কথা না বলেই বাসার দিকে চলে আসলাম। জার্নি করে আসার কারণে শরীর খুব ক্লান্ত ছিল। রহস্যের গন্ধ পেলেই সমাধানের দিকে এগোনোর এনার্জি ছিল না। রাতে ঘুমের ভিতর বিশাল বড় একটা স্বপ্ন দেখলাম। ঘুম থেকে উঠে স্বপ্নে দেখা ক্লু আর মাথায় আসা আরো কিছু ব্যাপার একসাথে করে একটা সমাধান দাঁড় করানোর চেষ্টা করলাম। হতে পারে আরিফ আর হাশেম আংকেল মিলে খুন করার পরিকল্পনা করেছিল শওকত সাহেবকে। হাশেম সাহেবের দূর সম্পর্কের কোনও আত্মীয় আরিফ অথবা ভাড়া করা লোক। শওকত সাহেবের বিল্ডিংটা কব্জা করতে পারলে কিছুটা বাড়ে হাশেম সাহেবের জায়গা। ডেভলপারদের কাছে দেয়ার জন্য যথেষ্ট জায়গা আরকি। ছোট জানালা থেকে লাশ দেখার যেই গল্প হাশেম সাহেব বলছে সেটাও বানোয়াট। কারণ উনার বিল্ডিংএর নিচ তলাও মাটির নিচে দেবে গেছে। এই ছোট্ট বিষয়টা কারো মাথায় আসেনি এখনও। আর সারাদিনে হয়তো কেউ আসলে ভিতরে যায়নি। হাশেম সাহেবের নিজের লোকেরাই ভিতরে ঢোকার ভান করেছে। বিল্ডিং দখল নেয়ার জন্য এই প্ল্যানটা করতে হয়েছে। মৃত্যুর খবরটা চারিদিকে চাউর করে দিয়ে একদিন অপেক্ষা করছে তারা। যদি কোনো উত্তসূরী আসে। যদি আসে তাহলে কী করবে? আর খুন যদি উনারা করেই তাহলে লাশটা বারান্দায় নিয়ে গেছে? নাকি অন্য কোথাও রেখেছে? নিজের দাঁড় করানো যুক্তি নিজের কাছেই বানোয়াট মনে হওয়া শুরু হয়েছে। বাসা থেকে বের হলাম। শওকত সাহেবের গলির কাছাকাছি হতেই দেখতে পেলাম জটলার পরিধি কলেবরে বেড়েছে অনেক। আশপাশের মহল্লা থেকেও এসেছে মানুষ। কিছুটা সামনে আগানোর পর শুনলাম পুলিশ আসবে একটু পর। হাশেম সাহেব থানায় ইনফর্ম করেছে। চব্বিশ ঘন্টার বেশি হয়ে গেছে। গন্ধ ছড়ানো শুরু করার আগেই লাশটার একটা ব্যবস্থা করা লাগবে। হাশেম সাহেব নিজেই পুলিশে খবর দিয়েছে! অতিরিক্ত থ্রীলার পড়ার কারণে আমার মাথার ভিতর যে সবসময় সাসপেন্স আর মিস্ট্রি কিলবিল সেটার আরো একটা প্রমাণ পেলাম। একটা স্বাভাবিক ঘটনাকে আমি কতকিছু ভেবে বসে আছি।

পুলিশ এসে প্রথমেই আরিফকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গাড়িতে উঠালো। হাশেম সাহেবকে কোনো প্রশ্ন করার আগেই উনি নিজের মতো করে সব বলতে লাগলেন এক নাগাড়ে। পুলিশের ছোট যেই দলটা এসেছে, তারা সবাই পুরো জায়গাটা ঘেরাও করে ফেললো। আমরা উৎসুক জনগণ গলি থেকে একটু বেরিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আরিফকে গাড়িতে উঠাতে দেখে খুশি হলাম আমি। কিন্তু মহল্লাবাসী হায় হুতাশ শুরু করলো। ছেলেটা গতকাল থেকে বসে আছে গলির মুখে। যদি দোষী হতো তাহলে তো বসে থাকতো না। আর তাছাড়া ছেলেটা কয়েকবার ঢুকেছে নিচ তলায়। লাশ বের করার চেষ্টা করেছে । সকাল সকাল ডেকোরেটরে ফোন দিয়ে চেয়ারও নাকি আরিফ নিয়ে এসেছে। এই তথ্য শুনে আমার সন্দেহ আরো কিছুটা বাড়লো। পুলিশ ঘণ্টা তিনেক পুরো বাড়ী তন্নতন্ন করে চলে গেলো। লাশ বের করার জন্য স্থানীয় ফায়ার সার্ভিসে খবর দিলো। লাশ বের করার সাথে সাথে থানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য দুইজন কনেস্টেবল রেখে গেলো। আরিফকে সাথে নিয়ে গেলো এটা নিয়েই সবার চিন্তা। লাশ বের করার চিন্তাটা কমতে শুরু করলো। জটলা আস্তে আস্তে পাতলা হতে শুরু করলো। পুলিশ জড়িয়ে গেছে এখন। যেকোনো সময় প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দী নেয়ার জন্য যে কাউকে নিয়ে যাবে। ঘটনা কোন দিকে যায় দেখার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। মহল্লায় চাপা উৎকণ্ঠা। গল্পগুলো এক ঝলকেই পাল্টে গেলো। গতকালকের সাপে কাটা গল্পটা ভুলে গেলো সবাই। আরিফ খুন করে লাশটা নিচে ফেলে রেখেছে এমন একটা গল্প মুখেমুখে ঘুরতে লাগলো। হাশেম সাহেবের বাড়িতে পুলিশ এলো আরিফকে নিয়ে যাওয়ার আধঘন্টা পর। পুলিশের কড়া নিষেধ থাকলেও পলকা ভিড় ঠেলে ঢুকে গেলাম হাশেম সাহেবের বাড়ির ভিতর। গেটে তিনজন কনেস্টবল দাঁড়ানো। আমাকে বাঁধা দিলো না। হাশেম সাহেবের বিল্ডিং চার তলা। ঢোকার পর প্রথমেই যেই ধাক্কাটা খেলাম সেটা হলো এই বাসার নিচ তলা মাটির নিচে দেবে যায়নি। সিঁড়িতে এসেই দেখলাম হাশেম সাহেব রসালো গলায় পুলিশ অফিসারকে সব সবিস্তরে বলছে। ঘন্টা চারেক আগেই যে তিনি একই অফিসারকে বলেছিলেন সেটা বেমালুম ভুলে গেছেন। একই রকম উত্তেজোনায় কথার মাঝখানে কাঁপছেন তিনি। আমাকে দেখেই একটা হাসি দিয়ে বলে উঠলেন, ‘এই যে আমার মহল্লার ভাতিজা। অয় গতকাল থিকা আমার পাশে। বিশ্বাস না হইলে ওরে জিগান।’ এইতো পড়লাম মহা ফাঁপরে। অতিরিক্ত উত্তেজোনায় ঢুকে গিয়েছি এই বাসায়। হাশেম আংকেল কোন ট্রাপে ফেলতেছে আমারে? কি জিজ্ঞেস করতে বলে?

অফিসারসহ উপস্থিত সবাই আমার দিকে তাকালো।
‘নাম?’
‘হাসান… হাসান মাহফুজ’
‘কই থাকো?’
‘তিন বাই এক, সামনের গলির তিনটা বিল্ডিং .. ’
‘ফ্যামিলি থাকে সাথে?’
‘না স্যার, আমার ফ্যামিলি নেই।’
‘ব্যাচেলর?’
‘জি। ব্যাচেলর।’
‘বাবা-মা কই থাকে?’
‘বাবা-মা নেই। মারা গেছেন…’
‘ওহ… আই এম এক্সট্রিমলি সরি। গতকাল তুমি সারাদিন উনার সাথে ছিলে?’
‘না স্যার, রাতে অল্প সময় ছিলাম।’

অফিসার চোখ ফেরালো হাশেম সাহেবের দিকে।

‘ওইটাইতো স্যার। মহল্লার সবার কাছে জিগান। আমি সারাদিন মহল্লায় ছিলাম। রাইতে যে ছিলাম অয় তো কইলোই। আপনারা হুদামিছা আমারে সন্দেহ করতেছেন কেন? আমিই না সবাইরে খবরটা দিলাম।’

হাশেম সাহেব যখন কথা বলছেন তখন বাইরে সাইরেনের শব্দ পাওয়া গেলো। ফায়ার সার্ভিস চলে এসেছে। অফিসার ইশারায় হাশেম সাহেবকে নিয়ে সামনে আগাতে বললো। পিছু পিছু আমিও এগোলাম। যেই রুম থেকে লাশটা দেখেছেন হাশেম সাহেব সেখানে যাওয়ার কথা বললো অফিসার। প্রথমে গড়িমসি করলেও সেই রুমের দিকে পা বাড়ালেন হাশেম সাহেব। লাশটা দেখার একমাত্র জায়গা হলো এই রুমটা। কিন্তু রুমে ঢুকে দেখা গেলো কোনো জানালা নেই। হাশেম সাহেব থরথর করে কাঁপছেন। অফিসার কোনো কথা বললেন না। ইশারায় এসআইকে কি যেন বললেন।

আমার ধারণা পুরোপুরি যে ভুল না সেটা বুঝতে পেরে খুশি হলাম। বাইরে খুব শোরগোল চলছে। বেরিয়ে এলাম অফিসারের পিছু পিছু। সুযোগ বুঝে পিঠটান দিতে হবে। কখন যেন আবার আমাকেও উঠিয়ে নেয়। ফায়ার সার্ভিসের গাড়িটা গলির মুখে দাঁড় করানো। লোকজনের ভিড় বেড়েছে আরো। লাশ কিভাবে বের করা সেটা নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কমান্ডার কথা বলছে। হাশেম সাহেবের বাড়ি থেকে পুলিশের ছোট দলটাকে বেরিয়ে আসতে দেখে শোরগোল কিছুটা কমে গেলো। চুপিসারে হাশেম সাহেবকে পুলিশের গাড়িতে তোলা হলো। আমি ভিড়ের ভিতর ঢুকে গেলাম। আপাতত নিজেকে বাঁচাই।

মহল্লা থেকেই বের হয়ে গেলাম। লাশ বের করতে পারুক আর না পারুক। এটা মার্ডার কেস হোক আর স্বাভাবিক মৃত্যু। আমার কী? আমি শুধু শুধু এই ঝামেলায় জড়াবো কেন!

ক্যাম্পাসে গিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিলাম সারাদিন। মহল্লার ঘটনা ভুলে থাকার চেষ্টা করলাম। রাতে ফিরলাম, মাঝরাতে বলা যায়। মহল্লায় ঢুকতেই মনে হলো কেবল সন্ধ্যা নেমেছে। সব মানুষ রাস্তায়। লাশ এখনও বের করা যায়নি। পুলিশ আরিফকে রেখে হাশেম সাহেবকে ছেড়ে দিয়েছে। লাশ দেখার যে গল্পটা উনি সবাইকে বলেছেন সেটা মিথ্যা। পুলিশের কাছে সব স্বীকার করেছেন। আরিফ মূলত খবরটা জানায় হাশেম সাহেবকে। আরিফই মূলত অনুরোধ করে সবাইকে এভাবে ঘটনাটা বলতে। সব শিখিয়ে দেয়। হাশেম সাহেব অনেকদিন যাবত এই জায়গাটা নেয়ার জন্য তক্কে তক্কে ছিলেন, সেটা আরিফ জানতো। তাই এই চালটা চালে। আরিফ এখনও কিছু স্বীকার করেছে কিনা জানা যায়নি। লাশ বের করার আগ অব্দি পুলিশ কিছু করতে পারছে না। পোস্টমর্টেম করে দেখার পর বুঝা যাবে এটা কি খুন নাকি স্বাভাবিক মৃত্যু। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন কোনভাবেই লাশ বের করতে পারেনি। পিছনের দেয়াল ভেঙে বের করার কথা উঠেছিল। কিন্তু মহল্লাবাসী রাজি হয়নি। সবাই এখন রাস্তায়; কারণ এই মুহুর্তে লাশ বের করার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং বসেছে পঞ্চায়েত অফিসে। যেহেতু শওকত সাহেবের কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই তাই পুরো মহল্লাবাসীই এখন তার আত্মীয়-স্বজন। এবং মহল্লাবাসীর পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত দিবে পঞ্চায়েত কমিটি। প্রশ্ন এখন একটাই। লাশটা অক্ষত বের করা না গেলে কি অন্য কোনো পন্থায় বের করা যায় কিনা…

লাশে ইতিমেধ্য পচন শুরু হয়েছে। গন্ধ বের হচ্ছে।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনলাম জামশেদ কসাইকে দিয়ে লাশ কেটে কেটে বের করা হয়েছে। টুকরো টুকরো লাশের অংশ রাতেই আজিমপুরে নিয়ে কবর দেয়া হয়েছে। আর আরিফকে কোর্টে চালান করা হয়েছে। শওকত সাহেব নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কায় আছেন বলে থানায় গিয়ে জিডি দায়ের করেছিলেন মৃত্যুর দুইদিন আগে। জিডিতে আরিফের নামসহ আরো কয়েক জনের নাম ছিলো। মহল্লাবাসী কেবল আরিফের নাম থাকা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে। আরিফ কেন শওকত সাহেবকে খুন করেছিল সেই তথ্য মহল্লাবাসী জানতে পারেনি তখনও। কারণ পরদিন সকালে আমার মতো সবাই শিউরে উঠেছিল যেই কথাটা শুনে সেটা হলো, শওকত সাহেবের মাথাটা থেকে গিয়েছে বারান্দায়। এই ঘটনা শুনে পিছনের সব ভুলে গিয়েছে সবাই। জামশেদ কসাই নাকি দুটো হাত কেটে যখন গলার কাছে ছুরি ধরেছে, তখনি নাকি কথা বলে উঠেছিল মাথাটা। কোনরকম হাত আর অন্যান্য কর্তিত অংশ নিয়েই বেরিয়ে এসেছে জামসেদ কসাই। এককালে বাঘা ডাকু থেকে পরবর্তীতে কসাই হওয়া জামসেদের ভয়ার্ত মুখ দেখে কেউ আর কোনো কথা বলেনি। পচা গন্ধের বদলে নাকি আতরের মিহি ঘ্রাণ আসতো নিচ তলা থেকে। এই খবরটাও সবার আগে হাশেম সাহেব দেন। ওই গলিতে মানুষের আনাগোনা কমতে থাকে। বাড়তে থাকে নানান গল্প মহল্লাবাসীর মুখে। হলে সিট পেয়ে যাওয়ার পর আমি বাসাটা ছেড়ে দেই।

আজ এই এত বছর পর শওকত সাহেবের গল্পটা কেন লেখলাম জানেন? গত পরশু গিয়েছিলাম পুরনো মহল্লায়। হাশেম সাহেবসহ তখন যতো মুরুব্বিরা ছিলেন সবাই মারা গেছেন। পুরনো বিল্ডিংগুলো ভেঙে বড় বড় সব আ্যপার্টমেন্ট হয়েছে। কেবল শতওত সাহেবের তিন তলা বাড়িটা টিকে আছে। উপরের লাল নিশানা উড়ে। নিচ তলা পুরোপুরি মাটিরে নিচে এখন। লোকজনের ভিড়বাট্টা বেশি না হলেও গলিতে সব সময় মানুষ থাকে। চানখারপুল থেকে কল্লা বাবার মাজারে যাবো বললে যেকোনো রিকশা এই বাড়ির সামনে এনেই নামিয়ে দিবে আপনাকে। শওকত সাহেব বাড়ির দখলদারিত্ব ছাড়েননি। মৃত্যুর পরেও না।

আগের সংবাদকেউ ফেরে খালি হাতে
পরবর্তি সংবাদবিষাদের পথ মাড়িয়ে