দরসে নেজামি : একটি পর্যালোচনা

নাসিম ইমরান:

ভারতবর্ষে মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থার ক্রমবিকাশ

আব্দুল হাই হাসানী নদভী উপমহাদেশে মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থার ক্রমবিকাশকে চার ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথম ভাগে সপ্তম হিজরী শতকের শুরু থেকে নবম হিজরী শতকের শেষপর্যন্ত প্রায় দুশো বছর। হিজরী নবম শতকের শেষে মুলতান থেকে শায়েখ আবদুল্লাহ উসমানী ও তার সাথী শায়েখ আজিজুল্লাহ দিল্লীতে আসেন ও তৎকালীন দিল্লীর সুলতান সিকান্দার লোদী (শাসনকাল ১৪৮৯–১৫১৭) তাদের প্রতি বিশেষ মর্যাদা প্রদর্শন করেন, এখান থেকেই শুরু হয় দ্বিতীয় কালপর্ব; এই সময়ে বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানশাখার চর্চা বৃদ্ধি পায়।

তৃতীয় কালপর্বেও এই ধারা অব্যাহত থাকে। আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬-১৬০৬) ইরানি কিছু ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানশাখার চর্চা ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। আবুল ফজল আল কাযরাবানী, আবুল ফজল হুসাইন ও ফাতহুল্লাহ শীরাযী বাদশা আকবরের নৈকট্য লাভ করেন ও শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আকবরের পিতা সম্রাট হুমায়ুন সেনানায়ক শেরশাহের কাছে পরাজিত হয়ে ইরানের সাফাবী শাসকদের সাহায্য গ্রহণ করেন ও ইরানি প্রভাবের পথ খুলে দেন। তবে এই তৃতীয় কালপর্বে কিছু ভারতীয় ব্যক্তিত্ব হিজাযে যান ও হাদিসের চর্চা বিস্তারে চেষ্টা চালান। চতুর্থ কালপর্বে দরসে নেজামী প্রভাব বিস্তার করে।

দরসে নেজামি

১৬৭৭-৭৮ সালে বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহালী শহরে জন্ম গ্রহণকারী মোল্লা নেজামুদ্দিন সাহালাভী কর্তৃক প্রণীত আরবী শিক্ষা পদ্ধতিকে দরসে নেজামি বলে আখ্যায়িত করা হয়। সামান্য পরিবর্তনসহ এই পদ্ধতিই আরবী মাদরাসা সমূহে আজও বিদ্যমান। এগারটি স্বতন্ত্র বিষয়ের সমন্বয়ে গঠিত হয় দরসে নেজামি।

বিষয় ও কিতাব সমূহ

১. ইলমুছ ছরফ (শব্দ ও তার রূপান্তর শাস্ত্র)

(১) সিরাজুদ্দীন আওধী, মীযানুছ ছরফ
(২) হামীদুদ্দীন কাকুরী, মুনশাআব
(৩) পাঞ্জেগাঞ্জ
(৪) মুফতী ইনায়াত আহমাদ কাকূরী, ইলমুছ ছীগাহ
(৫) সায়্যিদ আলী আকবার আনসারী, ফুসুলে আকবারী
(৬) ইবনে হাজিব, শাফিয়া

২. ইলমুন নাহু (ব্যাকরণ)

(১) শরীফ আল-জুরজানী, নাহবেমীর
(২) আবদুল কাহির আল-জুরজানী, নাজম মিয়াতে আমেল ব্যাখ্যাসহ
(৩) আবু হায়্যান আল-আন্দালূসী, হিদায়াতুন নাহু
(৪) ইবনুল হাজিব, কাফিয়া
(৫) জামী, আল-ফাওয়াইদুদ দিয়াইয়্যা (শরহু কাফিয়া)

৩. মানতিক (তর্কশাস্ত্র বা যুক্তিবিদ্যা)

(১) শরীফ আল-জুরজানী, সুগরা কুবরা
(২) আল-আবহারী মুখতাসার ঈসাগুজী
(৩) আত তাফতাযানী, তাহযীবুল মানতিক ওয়াল কালাম
(৪) আবদুল্লাহ য়াযদী, শরহু তাহযীব
(৫) কুতুবুদ্দীন রাযী, কুতবী (শরহুর রিসালাতিশ শামসিয়্যাহ)
(৬) শরীফ আল-জুরজানী, মীর কুতবী
(৭) মুহিব্বুল্লাহ বিহারী, সুল্লামুল উলূম

৪. হিকমাত ও ফালসাফা (দর্শন ও তত্ত্বজ্ঞান)

(১) কাদী মীর হাসান মায়বুষী, মায়বুযী (আল-আবহারী রচিত হিদায়াতুল হিকমাত এর শরাহ)
(২) মোল্লা সদরা, শরহু হিদায়াতুল হিকমাত
(৩) মাহমুদ জুয়ানপুরী, শামসে বায়িগা

৫. গণিত (رياضي) (অংক ও জ্যামিতি)

(১) আল-আমিলী, খুলাসাতুল হিসাব ওয়াল হানদাসা
(২) আত-তুসী, উসূলুল হানদাসাতিল ইকলীদাস (মাকালায়ে আদাবী)
(৩) আত-তুসী, তাশরীহুল আফলাক
(৪) রিসালাতু কুশজিয়া
(৫) মূসা রূসী, শরহু চুগমীনী, বাবে আউয়াল

৬. ইলমু বালাগাত (অলংকার শাস্ত্র)

(১) আত-তাফতাযানী, মুখতাসারুল মাআনী
(২) আত-তাফতাযানী, মুতাওয়াল (নির্দিষ্ট অংশ)

৭. ফিকাহ

(১) উবায়দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, শরহু বিকায়া
(২) আল মারগীনানী, হিদায়া (কামিল)

৮ . ইলমু উসূলিল ফিকাহ (ফিকাহ শাস্ত্রের মূলনীতি)

(১) মোল্লা জিয়ুন, নুরুল আনওয়ার
(২) উবায়দুল্লাহ ইবন মাসউদ, আত-তাওদীহ ফী হাললি গাওয়ামিদিত-তানকীহ
(৩) আত-তাফতাজানী, আত তালবীহ
(৪) মুহিব্বুল্লাহ বিহারী, মুসাল্লামুছ ছুবুত মাবাদী কালামিয়া

৯. ইলমে কালাম (ধর্মতত্ত্ব শাস্ত্র)

(১) আন-নাসাফী, আল-আকাইদুন নাসাফিয়া (মা’আ শরহি তাফ্ফাযানী)
(২) আদ-দাওয়ানী, শরহুল আকাইদিল-আদদিয়া

১০. তাফসীরুল কুরআন

(১) আল-মাহাল্লী ওয়াস-সুয়ূতী, তাফসীরু জালালাইন
(২) আল-বায়দাবী, আনওয়ারুত তানযীল ওয়া আসরারুত তা’বীল

১১. হাদীস

(১) মিশকাতুল মাসাবীহ

উক্ত পাঠ্যসূচী কেবল মোল্লা সাহেবেরই রচিত নয় বরং তাঁর পিতা মোল্লা কুতুবুদ্দীন এর সূচনা করেছিলেন এবং তাঁর স্থলাভিষিক্তরা এতে প্রচুর পরিমাণে সংযোজন করেছেন। স্থানীয় বিখ্যাত আনসারী পরিবারের সাথে মোল্লা সাহেবের সম্পর্ক ছিলো। হেরাতের প্রসিদ্ধ শিক্ষাবিদ শায়েখ আব্দুল্লাহ আনসারী ছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষ। আনসারী পরিবার তৎকালীন রাজনৈতিক মদদে শিক্ষা-বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে কর্তৃত্বের আসনে সমাসীন ছিলেন।

এখানে বলে রাখা ভালো, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার সাথে দরসে নেজামীর বিশেষ কিছু পার্থক্য আছে। আধুনিক ব্যবস্থায় শিক্ষক ও পাঠ্যপুস্তক নিছক সহযোগী; শিক্ষকরা পড়াশোনায় সমবায়ী অংশগ্রহণকারী নয়, পাঠ্যপুস্তকের মর্যাদাও তথ্য সরবরাহের চেয়ে বেশী কিছু নয়। দরসে নেজামি এ ক্ষেত্রে ভিন্ন অবস্থায় রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট বিষয়ে বিশেষায়িত শিক্ষাদানের চেষ্টা করা হয়, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বাইরে খুব বেশী যাওয়া হয় না। এ ক্ষেত্রেও দরসে নেজামির অবস্থা ভিন্ন।

দরসে নেজামীর মৌলিক দৃষ্টিকোণ

মোল্লা নেজামুদ্দিন উক্ত পাঠ্যসূচীতে প্রথমত শুধু হিন্দুস্তানী আলিমগণের কিতার অন্তর্ভুক্ত করেন। সিলেবাস প্রণয়নে তিনি সংক্ষিপ্তকরণ নীতি অনুসরণ করেন। প্রত্যেক বিষয়ের একাধিক কিতাব রাখেন, এবং সেগুলোর কিছু অংশ বাছাই করে সিলেবাসভূক্ত করেন। এই নীতি আধুনিক শিক্ষা-দর্শনের সাথে খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ। ছাত্ররা অধ্যয়নকালে যাতে গভীরভাবে চিন্তা-গবেষণা করার প্রশিক্ষণ পায় সে জন্য তিনি প্রতিটি বিষয়ের জটিল কিতাবসমূহকে সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করেন। অনুরূপ ছাত্রদের চিন্তার ভারসাম্য যাতে রক্ষা পায় এবং কোন একটি মতের দিকে অন্ধভাবে ঝুঁকে না পড়ে সেজন্য আরবী বিষয়ের সাথে দর্শন ও বৈষয়িক বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত করেন।

দরসে নেজামীর মূল উদ্দেশ্য ছাত্রদের মধ্যে ‘ইসতিদাদ’ তৈরি করা। ‘ইসতিদাদ’ অর্থ মৌলিক যোগ্যতা অর্জন ও উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতিগ্রহণ, বিশেষজ্ঞ তৈরি করা এই পাঠ্যক্রমের উদ্দেশ্য নয়। পাঠ্যভুক্ত কিতাবগুলোর দিকে তাকালেই বুঝা যাবে, এখানে ভাষা, ব্যাখ্যা, যুক্তি ও দর্শনে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। তৎকালীন সময়ে পৃথিবীর সর্বত্রই এসব বিষয়ে জোর দেওয়া হত। কেননা তখন শিক্ষাদানের মূল উদ্দেশ্য ছিল, কীভাবে ইলমি ভাষা পাঠ করতে হয়, পাঠ্যপুস্তকের জটিলতা সমাধান-হল করতে হয়, যুক্তি-প্রতিযুক্তি দিতে হয়, সেটা শেখানো; সববিষয়ে পরিপূর্ণ শিক্ষাদান এখানে উদ্দেশ্য নয়।

পাঠ্যক্রমে সংক্ষিপ্তভাবে সকল বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্য হল, যাতে মধ্যম ধরণের মেধাসম্পন্ন ছাত্রগণ ষোল-সতের বছর বয়সে পড়ালেখা শেষ করতে পারে। উসূলে ফিকাহর তুলনায় ফিকাহ কম রাখার উদ্দেশ্য হল যাতে আলিমগণের মধ্যে বিরোধিতা ও আপন পক্ষের সমর্থনের মনোভাব কম সৃষ্টি হয় এবং চিন্তাশক্তি প্রখর হয়। ফলে এর মাধ্যমে এমন সব আলিম তৈরী হবে যারা মুসলমানদের ধর্মীয় ব্যাপারে যে কোন আক্রমণকে যুক্তি ও চিন্তার সাহায্যে প্রতিহত করতে পারে।

এই পাঠ্যক্রমে প্রথম দিকে তাসাওউফ ও সুলুক (আধ্যাত্মিক বিদ্যা) বাদ রাখা হয়েছিল। এর কারণ হতে পারে, মোল্লা নিজামুদ্দীনের দৃষ্টিতে এই জাতীয় কিতাবের কেবল পাঠদান ততক্ষণ পর্যন্ত উপকৃত হতে পারে না যতক্ষণ না কামিল মুর্শিদের সাহচর্য লাভ হবে। তাই দরসে নেজামীতে শিক্ষক ও পাঠ্যপুস্তক অনেক জরুরী বিষয়। শিক্ষক ছাত্রদেরকে সূফী মুরুব্বীর মতো শিক্ষা দান করেন- অভিজ্ঞতা ও নৈতিকতা। শিক্ষক শিক্ষা দেন কীভাবে ধর্মীয়-নৈতিক জীবন যাপন করা যায়। পাঠ্যপুস্তকে সেই অভিজ্ঞতা সংরক্ষিত হয়। টিকা-ফুটনোটে সংযুক্ত হয় সংশ্লিষ্ট তর্ক-বিতর্ক। তাই শুধু পাঠ্যপুস্তকের মূলপাঠ নয়, এই টিকা-ফুটনোটগুলোও দরসে নেজামীতে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে পাঠ্যপুস্তক শুধু পড়ে যাওয়া হয় না, প্রশ্ন-প্রতিপ্রশ্নে যাচাই ও নিশ্চিত করা হয় আলোচ্য তথ্য।

পূর্বে পাঠ্যক্রমে সাহিত্য (আদব) ছিল না, কিন্তু পরবর্তীতে বহু প্রাচীন ও আধুনিক আরবী সাহিত্য সন্নিবেশিত করা হয়। হাদীস থেকে পর্যাপ্ত জ্ঞান লাভের জন্য শাহ ওয়ালিউল্লাহর তত্ত্বাবধানে একে পূনর্বিন্যাস করা হয় এবং দরসে নিজামী মাদরাসার শেষ বর্ষকে দাওরায়ে হাদীসের বর্ষ (কামিল, হাদীছ) বলা হয়। সিহাহ সিত্তাহসহ মোট দশখানা হাদীছ (আশারায়ে মুতাদাবিলা) এই বর্ষে পড়ানো হয়। কোন কোন মাদরাসায় দাওরায়ে কুরআনও চালু করা হয়। যেখানে তাফসীরের সাথে সাথে কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদও করানো হয়। দরসে নিজামীতে প্রাচীন কালের যুক্তিবিদ্যা, দর্শন ও তত্ত্ববিদ্যার কিতাবাদি পড়ানো হয়। এরূপ করার উদ্দেশ্য হল যাতে মুতাকাদ্দীমীন (পূর্ববর্তী) আলিমদের সাথে বর্তমান কালের আলিমদের চিন্তা ও গবেষণার সংযোগ বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায় ও তুরাসের সাথে সম্পর্ক অটুট থাকে। ঐ বিষয়গুলোকে কখনও ইলমে দীনের বিষয় মনে করা হয়নি। বরং ঐ সবের দ্বারা ইলমে দীনের সহযোগিতা চিন্তার প্রশস্ততার কাজে লাগানো হয়।

দরসে নেজামীর রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক রুপান্তর

মুঘল আমলেও আলেমরা সরাসরি রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন না, ব্যক্তিগতভাবে রাজনৈতিক সংস্কার ও মেরুকরণে ভূমিকা রাখলেও দলবদ্ধভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্ব করেননি। মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ও ব্রিটিশদের বিজয়ে মুসলমানরা নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে। আনসারী পরিবারও দলবদ্ধ রাজনীতি থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তাতে তাদের মাধ্যমে ধর্মীয় খেদমত হলেও তারা জনপরিসরে নেতৃত্বের আসন হারান। শাহ ওয়ালিউল্লাহের ধারার প্রভাব বাড়তে থাকে।

আব্দুল হাই হাসানী নদভী যেমন বর্ণনা করেছেন, তৃতীয় কালপর্বে অনেক ব্যক্তিত্ব হেজাযে গমন করেন এবং উপমহাদেশে আরবের ধারার প্রভাব বিস্তার করেন। এর মধ্যে কয়েকজনের নাম উল্লেখযোগ্য: শায়েখ মুহাম্মদ বিন তাহের, শায়েখ ইয়াকুব বিন হাসান কাশ্মীরি ও শায়েখ আবদুন নবী গাংগুহী। তবে এই ধারায় সর্বপ্রথম বিশেষ ভূমিকা রাখেন শায়েখ আবদুল হক দেহলবী। তিনি হজ্ব করতে হেজাযে যান ও সেখানে কয়েকবছর অবস্থান করে শিক্ষা অর্জন করেন। এই ধারার আলেমরাও হানাফি ছিলেন, তবে তারা আরব হানাফি মাজহাবের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। যেখানে হাদিসে বিশেষ জোর দেওয়া হত, ফিকাহ ও উসুলে ফিকাহের ক্ষেত্রেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হত। শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী এই ধারায় পরিপূর্ণতা দান করেন।

পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও আহমদ সারহিন্দী মুজাদ্দিদে আলফে সানী (১৫৬৩-১৬২৪ খ্রিস্টাব্দ) বিশেষ প্রভাব রাখতে সক্ষম হন। তিনি সম্রাট আকবরের দ্বীনে ইলাহির বিরুদ্ধে দাঁড়ান। পাশাপাশি স্থানীয় ভাববাদী ধারা ও খোরাসান-মধ্য এশিয়ান দার্শনিক ধারাতেও সংস্কারের আহ্বান জানান; এভাবে মুঘল সাম্রাজ্যে সংস্কারে আলেম সমাজের ভূমিকা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে। শাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী এই ধারায় আরও এগিয়ে যান- পতনের মুখোমুখি মোঘল সাম্রাজ্য বাঁচাতে তিনি
(ক) সম্রাটদের সতর্ক করে চিঠি লেখেন।
(খ) আফগানের শাসক রোহিলা সর্দার আহমদ শাহ আবদালীকে দিল্লীতে নিয়ে আসেন ও দিল্লীকে মারাঠা ও শিখদের হাত থেকে রক্ষা করেন।
(গ) নিজেই স্বতন্ত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। সাইয়েদ আহমদ শহীদ এই আন্দোলনকে সামরিক লড়াইয়ে রুপদান করেন।

ব্রিটিশ উপনিবেশে আনসারী পরিবারের ভূমিকাহীনতায় সামনে চলে আসে দেহলবী ধারা। যার কেন্দ্রে থাকে দিল্লীর মাদরাসায়ে রহিমিয়া, যা প্রতিষ্ঠা করেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবীর পিতা মাওলানা শাহ আবদুর রহীম। এখান থেকেই পরিচালিত হয় শাহ ওয়ালি উল্লাহর সংস্কার আন্দোলন। তার ছেলে শাহ আবদুল আযীয এখান থেকেই সংস্কার ও রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালনা করেন। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্রমবর্ধমান প্রভাব দেখে ১৮০৬ খৃস্টাব্দে শাহ আবদুল আযীয ঘোষণা করেন, উপমহাদেশ এখন দারুল হারব। মনে রাখা ভালো, ঠিক কাছাকাছি সময়ে আনসারী পরিবারের তৃতীয় ব্যক্তিত্ব আবদুল আলী ব্রিটিশদের প্রতি নমনীয়তা পোষণ করেন।

শাহ ওয়ালিউল্লাহর ধারার রাজনৈতিক আন্দোলন আরও এগিয়ে যায়। মূল নেতৃত্বে আসেন শাহওয়ালি উল্লাহর নাতি শাহ ইসমাইল শহীদ ও শাহ সাইয়েদ আহমদ শহীদ। তাদের রাজনৈতিক আন্দোলনে শিখ ও ইংরেজরা ভীত হয়ে যায়। ১৮৩১ খৃস্টাব্দে বালাকোটে তাদের সশস্ত্র কার্যক্রম বাহ্যিক অর্থে শিখ-ইংরেজ যৌথ ষড়যন্ত্রে পরাজিত হলেও কারবালার হুসাইনী আন্দোলনের মতো শাহ ওয়ালিউল্লাহর ধারাই উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রধান রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ধারায় রুপান্তরিত হয়। উপমহাদেশের কোন মুসলিম ধারার পক্ষেই ওয়ালিউল্লাহি ধারাকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়।

১৮৪৬ খৃস্টাব্দে মাদরাসায়ে রহিমিয়া বন্ধ বা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলেও এর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব আরও বিস্তারিত হয়। আনসারী পরিবারের দরসে নেজামীর সাথে এর মিথস্ক্রিয়া ঘটে। এই মিথস্ক্রিয়া থেকেই ১৮৬৬ খৃস্টাব্দে দারুল উলুম দেওবন্দের জন্ম হয়। দারুল উলুম দেওবন্দ মৌলিকভাবে দরসে নেজামির শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করলেও ওয়ালিউল্লাহি ধারার রাজনীতি ও সংস্কার প্রস্তাব অনেকাংশে গ্রহণ করে। এভাবে দরসে নেজামির রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক রুপান্তর ঘটে।

দরসে নেজামি : কাসেম নানুতুবী ও বর্তমান অবস্থা

তা’লীমী নেসাবের ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, যেই আধুনিক জ্ঞান, প্রযুক্তি বিদ্যা ও ভাষাদক্ষতা ছাড়া বর্তমান যুগে শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশেষত্ব অর্জন করা যায় না, দ্বীনি শিক্ষার সাথে তার সংযোগ কিভাবে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে? বর্তমানে অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম এ প্রশ্নের গুরুত্ব উপলব্ধি করছেন। কিন্তু এ সমস্যার সমাধান বুঝা যাচ্ছে না। দ্বীনি ইলমের পাশাপাশি আধুনিক জ্ঞানের বইও কি নেসাবভুক্ত করা হবে? না আধুনিক জ্ঞান ও বিদ্যার্জন থেকে অবসর হয়ে ইসলামী জ্ঞানাজর্নের সুযোগ তৈরী করা হবে? তৃতীয় আরেকটি সম্ভবনাও রয়েছে । মুসলমান ছেলেদেরকে প্রথমে স্বল্প সময়ে প্রয়োজন পরিমাণ দ্বীনের ইলম শিক্ষাদানের পর আধুনিক জ্ঞান ও বিদ্যা অজর্নের জন্য তাদেরকে কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করা হবে। এ ব্যাপারে কাসেম নানুতুবীর দৃষ্টিভঙ্গি কি ছিল?

শিক্ষা সমাপনকারী ছাত্রদেরকে সনদ ও পুরস্কার প্রদানের জন্য ৯ জানুয়ারি ১৮৭৪ সালে দেওবন্দে এক জলসার আয়োজন করা হয়। এ জলসার এটি একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য পরিদৃষ্ট হয়েছে যে, শিক্ষা সমাপনকারী ছাত্রদের দ্বারা জ্ঞানের কোন বিশেষ বিষয়ে প্রবন্ধ লিখানো হয়েছে অর্থাৎ ইউনিভার্সিটির সর্বোচ্চ স্তর থেকে সনদ অর্জনের জন্য যেরূপ থিসিস জমা দিতে হয়, দারুল উলূমে প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে এ নিয়ম চালু করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হল, তা পরে চালু থাকেনি। এ জলসায় নানুতুবী তাঁর ভাষণে বলেছেন, “এখন আমি সে বিষয়ের দিকে ইশারা করছি যা দ্বারা বুঝা যাবে, শিক্ষা ব্যবস্থায় এ বিশেষ পদ্ধতি কেন আমি অবলম্বন করেছি অর্থাৎ আধুনিক জ্ঞানকে কেন শামিল করা হয়নি। অন্যান্য কারণ অপেক্ষা বড় কারণ তো এটাই যে, শিক্ষাদান একক হোক বা সম্মিলিত হোক ঐ দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা চাই, যে দিক থেকে তাদের যোগ্যতায় ত্রুটি রয়ে গেছে। সুধীজনরা অবশ্যই লক্ষ্য করেছেন যে, বর্তমানে আধুনিক জ্ঞানের শিক্ষাদান অসংখ্য সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বদৌলতে এরূপ উন্নতি ও প্রসারতা লাভ করেছে যে, বিগত শাসকদের আমলেও প্রাচীন বিদ্যাসমূহ এতটুকু উন্নতি লাভ করেনি এবং বর্তমানে বিশুদ্ধ দ্বীনি জ্ঞানসমূহের এমন অধঃপতন হয়েছে যে, সম্ভবত এমন অধঃপতন কোন কালে হয়নি। এ অবস্থায় মুসলমানদেরকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলাকে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। তাই শুধু উলূমে নকলী তথা বিশুদ্ধ ইসলামী ও দীনী জ্ঞান এবং ঐ সকল জ্ঞানের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছে যেগুলো দ্বারা প্রচলিত জ্ঞানে দক্ষতা এবং আধুনিক শাস্ত্রসমূহের জ্ঞানাজর্নের যোগ্যতা উভয়ই অর্জিত হয়। অর্থাৎ মুসলমানগণ যেসব বিদ্যা থেকে বঞ্চিত থাকলে মুসলমান থাকে না এবং নতুন প্রশাসন যে সকল বিদ্যার পৃষ্ঠপোষকতা থেকে শুধু তাদের হাতই গুটিয়ে নেয়নি, বরং তাদের তৈরী করা পরিবেশে যার শিখা নির্বাপিত প্রায়, সেসব বিদ্যার পূনর্জীবন ও স্থায়িত্বের ব্যবস্থাপনা সাধারণ মুসলমানদের আর্থিক অনুদানে করা হবে “।

শুধু বিশুদ্ধ দীনী জ্ঞানসমূহের প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার দ্বিতীয় কারণ তিনি বলেছেন, “এ ব্যবস্থায় নিশ্চিতভাবেই আধুনিক জ্ঞানার্জনের যোগ্যতা অর্জিত হয় অর্থাৎ প্রচলিত নেসাব পড়ে যারা ফারেগ হয় তাদের মাঝে আধুনিক বিদ্যাসমূহ অজর্নেরও যোগ্যতা তৈরী হয়। এই হিসাবে দ্বীনি শিক্ষার সিলেবাসকে আধুনিক শাস্ত্রসমূহ শিক্ষার ভূমিকাও বলা যেতে পারে”। ভাষণের শেষে এসে সিলেবাসে বিশুদ্ধ ইসলামী শিক্ষা এবং দর্শন ও যুক্তিবিদ্যার অন্তর্ভুক্তির আলোচনা প্রসংগে তিনি তাঁর সঠিক তা’লীমী দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, “এরপর এ মাদ্রাসার ছাত্ররা যদি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেয়ে আধুনিক জ্ঞান অর্জন করে তাহলে তাদের যোগ্যতার ক্ষেত্রে তা অধিক কার্যকর প্রমাণিত হবে”।

দুঃখ-বেদনা আর মানসিক যাতনার সেই দিনগুলোতে, যখন মুসলমানদেরকে হিন্দুস্তানের মত সাম্রাজ্যের শাসন ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করে গোলাম বানানো হল, স্বাভাবিক ভাবেই তাদের হৃদয়ে সেই সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা আর প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিল, যারা তাদের এ মন্দ অবস্থার জন্য দায়ী। তাদের সাথে সম্পৃক্ত সকল জিনিসকে মুসলমানগণ অন্তর থেকে ঘৃণা করত। ইংরেজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যা কিছু পড়ানো হত তার কথা ভাবতেও তারা কুণ্ঠাবোধ করত। এমন পরিবেশে হযরত নানুতবি শুধু ইংরেজী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অন্তর্ভুক্ত হয়ে শিক্ষা অর্জনকে জায়েযই ফাতওয়া দেননি বরং কোন ধরণের লুকোচুরি ছাড়াই আলেমদের ভরা মাহফিলে ঘোষণা দিচ্ছেন যে, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কওমী মাদরাসা ভর্তি হয়ে আধুনিক জ্ঞান অর্জন করা উলামাদের জন্য ইলমী যোগ্যতায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন এবং অগ্রসরতার ক্ষেত্রে উপকারি প্রমাণিত হবে।

একদিকে সেইযুগে সংখ্যাগুরু আলেমগণ এই খেয়াল নিয়ে বসে ছিলেন যে, তারা যা কিছু পড়েছেন তাছাড়া এমন কিছু নেই যা পড়া যায় বা শেখা যায়। অন্যদিকে তাদেরই আলেমদের মধ্যে আহ্বানকারী আহ্বান করছেন যে, আলেমদের মধ্যে যারা স্বীয় ইলমী যোগ্যতায় অতিরিক্ত চমক অধিক দৃঢ়তা পয়দা করতে চায় তাদের উচিত আধুনিক শাস্ত্রসমূহ অধ্যয়ন করা এবং নতুন ভাষাজ্ঞান অর্জন করা।

আধুনিক জ্ঞান ও বিদ্যাসমুূহের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা সে যুগের আলেমদের সাধারণ রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু দেওবন্দী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তক ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক সঠিক সময়ে যুগোপোযোগী আধুনিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা মেনে নিয়েছেন। বরং তাঁর বক্তব্য সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর নির্দ্বিধায় এ দাবি করা যায়, তিনি তাঁর তা’লীমী দৃষ্টিভঙ্গি এটাই পেশ করেছেন যে, প্রথমে দর্শন ও যুক্তিবিদ্যাসহ ইসলামী শিক্ষার নেসাব সমাপ্ত করবে, এরপর আধুনিক বিদ্যাসমূহ অজর্ন করার জন্য সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলমান ছেলেদের ভর্তি করা হবে। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, তিনি সে সময়ই শিক্ষার সকল দিক ও তার বিবিধ ফলাফল সম্পর্কে সঠিক ধারণা নিয়েছিলেন।

দখলদার প্রশাসনের সহযোগিতার প্রতি সম্ভবত ভুলেও তাকানোকে তিনি পছন্দ করতেন না। কিন্তু পুরাতন ও আধুনিক জ্ঞানের সমন্বিত প্রচেষ্টার সুফল চিন্তা সম্ভবত এ সীমারেখা অতিক্রম করতে তাঁকে বাধ্য করেছিল। তাঁর সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল ভর্তি পরীক্ষার জন্য বয়সের বাধ্যবাধকতা। এ দিকে ইশারা করেই তিনি সরকারকে আহবান করেছিলেন, “যদি হিন্দুস্থানের গভর্নমেন্ট নতুন ছাত্রদের ভর্তির ক্ষেত্রে বয়সের বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে দিত”!

শুরুতে মাদ্রাসার শিক্ষার সময়সীমা দশ বছর নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু দু’বছর অতিবাহিত হওয়ার পর নেসাব, শিক্ষার সময়সীমা ইত্যাদি বিষয় পর্যালোচনা করার জন্য একটি বৈঠক বসে। বৈঠকে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, সকল কিতাবের জন্য ছয় বছর সময় নির্ধারণ করা হোক অর্থাৎ হাদীস, তাফসির, ফিকহ, উসুলে ফিকহ ও ফারায়েযসহ যে সকল কিতাব সে সময় পড়ানোর সাধারণ রীতি ছিল সবই এসময়ে খতম করা হবে। দশ বছর বয়সে ছয় বছরের এ নেসাব শুরু করে ষোল বছর বয়সে শিক্ষার্থী তা শেষ করতে পারত। বাইশ তেইশ বছর বয়সেই আধুনিক বিদ্যাসমূহ ও নতুন ভাষাজ্ঞান অর্জন করে গ্রাজুয়েট হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ এ নেসাব সৃষ্টি করে দিয়েছিল অর্থাৎ নানুতুবীর প্রবর্তিত ধারা অনুসারে নিয়মতান্ত্রিকভাবে একইসাথে মাওলানা ও যোগ্যতাসম্পন্ন একজন গ্রাজুয়েট হওয়ার বাস্তব সম্ভাবনা মুসলমানদের সামনে এসে গেল।

সঠিকভাবে বলা মুশকিল যে, এই তালীমী লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অনুযায়ী ভবিষ্যত কার্যসিদ্ধির পথে কোন জিনিস বাধা হয়েছিল। যার ফলে এই মূল্যবান সম্ভাবনা থেকে উপকৃত হওয়ার সুযোগ ঘটেনি। বয়স পঞ্চাশ বছরও পূর্ণ হয়নি, কাসেম নানুতুবী আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেলেন। আমার ধারণা, তাঁর তা’লীমী লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে সম্ভবত তাঁর মৃত্যুর ঘটনাই অনেকাংশে দায়ী।

যে সময়ে দারুল উলূম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং সেই যুগে যেই পরিবেশ ছিল তাতে যে কোন ব্যক্তির পক্ষে এই তালীমী লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং তার ফলাফল ও উপকারিতার সঠিক হিসাব করা সম্ভব ছিল না। মিটিংয়ের কার্যবিবরণীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তী লোকদের মাঝে তাঁর এ লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের চর্চা হয়নি। এমনকি এর স্মরণও লোকদের মাঝে অবশিষ্ট থাকেনি। চিন্তা ভাবনার বিষয়টি সম্ভবত ভাবনাকারীর সাথেই দাফন হয়ে গেছে।

ছয় বছরের এ সিলেবাসে পরবর্তীতে যে পরিবর্তন এসেছে তা দেখে মনে হয়, এ সিলেবাস দরসে নিজামিয়্যার আলেমগণ এ জন্যই গ্রহণ করেননি যে, এ সিলেবাসে একটি ছাড়া দর্শনের আর কোন কিতাব রাখা হয়নি। এরই ফলাফলে দারুল উলূমের সিলেবাসে দরসে নিজামিয়্যার একটি মা’কূলী কিতাব তার সকল শরাহসহ বিভিন্ন শ্রেণীতে পঠিত হয়ে আসছে, যাকে বের করে সিলেবাসকে সীমিত সময়ে শেষ করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ফারসি সাহিত্যের কিতাব সংযোজন করে দেশের প্রাচীন শিক্ষিত শ্রেণীকে সান্ত্বনা দেয়া হয়েছে। আরবী সাহিত্যের গদ্য ও পদ্যকে অন্তর্ভুক্ত করে আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণীর এই দাবী পূরণ করা হয়েছে যে, আরবী পড়া আলেমরা আরবী বলে ও লিখে আমাদের দেখাক।

মোটকথা, এসব কারণে দারুল উলূমের তা’লীমী নেসাব যথেষ্ট দীর্ঘ ও ভারী হয়ে গেছে। এ নেসাব শেষ করতে ছাত্রদের একটি দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়ে যায়। লম্বা লম্বা দাঁড়ি নিয়ে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার আর অবকাশ থাকে না। সে সকল আলেমদের তালীমী দৃষ্টিভঙ্গি শুধু ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিই হয়ে আছে। যদি তাই না হবে তাহলে এ আচরণের কি ব্যাখ্যা যে, সবকিছুতে পরিবর্তন আসছে অথচ কোন দিক থেকেই কোন বিরোধী আওয়াজ মজলিসে শুরায় উঠছে না।

নানুতুবীর সঠিক তালীমী দৃষ্টিভঙ্গি দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, দীনী তালীম হাসিলের পর মুসলমান ছেলেদের জন্য আধুনিক জ্ঞান ও নতুন ভাষাসমূহ শিক্ষার সুযোগ করা হবে এটাই যখন প্রত্যাশা করা হয়েছে তখন তা কেন হল না? কেন প্রায় দীর্ঘ এক শতাব্দীর ইতিহাসে ঐ তালীমী লক্ষ্য-উদ্দেশ্য মুতাবেক কোন একটি নমুনাও দারুল উলূম দেওবন্দ পেশ করতে পারেনি? প্রাচীন ও নতুন জ্ঞান ও ভাষার সংযোগ সাধনের যে গুরুদায়িত্ব কাসেম নানুতুবী আন্জাম দিতে চেয়েছিলেন, আফসুস! দারুল উলূম দেওবন্দের শিক্ষাব্যবস্থা আজ পর্যন্ত তা আন্জাম দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

আমাদের দরসে নিজামিয়্যার শিক্ষাব্যবস্থায় দর্শনের নামে যা কিছু পড়ানো হত তা এ যুগে নিঃসন্দেহে অসার প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের উলামায়ে কেরাম কেবল উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এই অজুহাতে মৃত ও দাফনকৃত দর্শনের কিতাবগুলো পড়িয়ে যাচ্ছেন। ছাত্রদের মূল্যবান সময় এবং জীবনের দামী মূহুর্তগুলো এমন এক ব্যস্ততায় যে বরবাদ হচ্ছে, এর জন্য কোন চিন্তাশীল মানুষের যতই রাগ আসুক তা অবশ্যই কম। দর্শনের চাহিদা পাশ্চাত্যের আধুনিক দর্শনই পুরা করতে পারত, কিন্তু তার প্রতি দরসে নেজামীর মা’কূলী আলেমগণ ভুলেও দৃষ্টি দেওয়াকে পছন্দ করতেন না। কাসেম নানুতুবী পুরাতন ইলমের সাথে নতুন ইলমের যে সংযোগ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যদি এ সংযোগ কায়েম হয়ে যেত তাহলে এই মৃত দশর্নের স্থলে আধুনিক দর্শন অধ্যয়নের সুযোগ আমাদের উলামাদের সহজেই হতে পারত।

দরসে নেজামী এখন ‘ধর্মীয়’ শিক্ষাব্যবস্থায় রুপান্তরিত হয়েছে, যেখানে সববিষয়ে মৌলিক যোগ্যতার চেয়ে ধর্মীয় পেশাজীবী তৈরি করা বিশেষ উদ্দেশ্যে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানশাখায় একচেটিয়া গুরুত্ব দেবার ফলে প্রতিযোগী হিসেবে দরসে নেজামীর মধ্যে ‘ধর্মীয়’ বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হবার চাপ বেড়েছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে দরসে নেজামী ভিত্তিক বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানশাখার পাঠ্যপুস্তকগুলো গুরুত্বহীনতায় ধীরে ধীরে যোগ্য শিক্ষক ও গবেষক হারিয়েছে। ফলে পাঠ্যক্রমে এগুলো এখন প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।

গ্রন্থপঞ্জি

১. সম্পাদনা পরিষদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, শিক্ষাদর্শন ও ইসলাম ২০০৪.

২. ইদারাতুল মা’আরিফ, মাদরাসা দারুর রাশাদ, কওমী মাদরাসা নেসাব ও নেজাম ২০০৩.

আগের সংবাদপ্রস্তাবিত বাজেট মন্ত্রিসভায় অনুমোদন
পরবর্তি সংবাদপদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে ২৫ জুনের এসএসসি পরীক্ষা ২৪ জুন