দেওবন্দ, আলিগড় এবং নদওয়া : একটি তুলনামূলক পাঠ

কাজী একরাম:

১৮৫৭ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর ভারতীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে তাদের সামনে যে সংকটটি সবচেয়ে প্রকট হয়ে দেখা দেয় তা হলো, ব্রিটিশ সরকারের সহিত তাদের সম্পর্ক কিরূপ হবে, অসহযোগিতা-মূলক, না তোষণমূলক? এ প্রশ্নে ভারতের মুসলিম চিন্তানায়কদের দ্বিধাবিভক্ত দেখা যায়। যে দল ব্রিটিশকে চিরশত্রু মনে করে তাদের সহিত অসহযোগিতার পথ বেছে নিলেন, তারা ১৮৬৭ খ্রীস্টাদের ৩০ মে তারিখে, মাওলানা কাসেম নানুতুবির হাতে প্রতিষ্ঠা করেন দারুল উলুম দেওবন্দ। অপর পক্ষে, যাঁরা ভারতীয় হিন্দুদের মোকাবিলায় মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করে ব্রিটিশ তোষণ-নীতির পথ বেছে নিলেন, তাঁরা ১৮৭৭ খৃষ্টাব্দের ৮ জানুয়ারি, স্যার সৈয়দ আহমদের হাতে গড়ে তুলেন আলিগড় মোহামেডান এংলো ইন্ডিয়ান কলেজ।

বস্তুত, ইসলামি দুনিয়ায় এই ভারতবর্ষ ছিল প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সংঘর্ষের দ্বিতীয় ক্ষেত্র, যা বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণে এমনভাবে উদ্ভূত হয়েছিল, এর জন্য দুটি পথ অনুসরণ করা ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। আকিদা ও ঈমানের উপর ভিত্তি করে ইসলামি জীবনের অগ্রাধিকার, বা বস্তুগত শক্তি এবং বিকাশের উপর ভিত্তি করে পশ্চিমা জীবনের এক্তিয়ার। এমন জটিল মনস্তাত্ত্বিক ও সংকটময় পরিস্থিতিতে দুই ধরনের নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটে। প্রথম নেতৃত্বটি ছিল নানুতুবি নেতৃত্ব, যার নেতৃত্বে ছিলেন উলামায়ে কেরাম। দ্বিতীয় নেতৃত্বের পতাকাবাহী ছিলেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান, তার অধীনে ছিল আধুনিক চিন্তাধারার লোকেরা।

আবুল হাসান আলি নদভি তাঁর ‘মুসলিম মামালিক মেঁ ইসলাম আওর মাগরেবিয়্যত কি কাশমাকাশ’ কিতাবে লিখেন : আলেমগণ, নানুতুবি দৃঢ়তা, তপস্যা ও তাকওয়া, আত্মত্যাগ ও আন্তরিকতা, ধর্মীয় আত্মসম্মান এবং আত্মবিশ্বাস এবং ধর্মের পথে কুরবানি করার ক্ষেত্রে ইসলামি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এবং উপাদান হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন। কিন্তু নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা এবং অস্বাভাবিক নির্দয়তা ও নির্মমতার কারণে, যা মুসলমানদের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকার দেখিয়েছিল, যাদেরকে তারা ৫৭’ এর  রাষ্ট্রদ্রোহিতার প্রধান পথপ্রদর্শক ও নেতা বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল, এভাবে খ্রিস্টধর্মের প্রচার-প্রসারে সরকারের সক্রিয় তৎপরতা ও উৎসাহ এবং জনগণের মধ্যে পশ্চিমা সভ্যতার অসাধারণ দ্রুততায় জনপ্রিয় হয়ে উঠায় এবং মুসলমানদের বিশ্বাস ও নৈতিকতার ওপর এর প্রভাবের কারণে আলেমগণ আক্রমাণাত্মক পদক্ষেপ না নিয়ে আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নিতে বাধ্য হন। তারা ভাবতে শুরু করেন, নানুতুবি জযবা, ইসলামি চেতনা, ইসলামি জীবনের প্রকাশ এবং ইসলামি সভ্যতার সমস্ত অবশিষ্টাংশ সংরক্ষণ করা উচিত এবং ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্য সুরক্ষিত দুর্গ প্রস্তুত করা উচিত। অতঃপর এসব দুর্গে দীনের মুবাল্লিগ ও দাঈদের তৈরি করা উচিত।’

এই মহান সংস্কার ও শিক্ষা আন্দোলনের সূচনাকারী দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসেম নানুতুবি রহ. এর ব্যাপারে মাওলানা সৈয়দ মানাজের আহসান গিলানি ‘সাওয়ানোহে কাসেমী’তে লিখেছেন: ১৭৫৭ সালের যুদ্ধের ব্যর্থতার পর, তাঁর মন যুদ্ধ এবং লড়াইয়ের নতুন ফ্রন্ট এবং ময়দানের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দারুল উলূম দেওবন্দের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল এই কৌশলের সবচেয়ে বিশিষ্ট এবং কেন্দ্রীয় উপাদান। শামেলির ময়দান থেকে ফিরে আসার পর, চিন্তাবিদরা হতাশ হয়ে চিন্তা করা বন্ধ করে দেননি এবং অলসভাবে বসে থাকেননি, বরং তাদের মন-মস্তিষ্ক ‘ইসলামের অস্তিত্ব এবং ইলমে দ্বীনের সুরক্ষা’ লক্ষ্যকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠে।

কেউ কেউ হয়তো এ ধারণা পোষণ করে থাকবেন যে, দারুল উলূম দেওবন্দ কেবল দ্বীনি শিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান, কিন্তু এহেন ধারণা ভুল। কেননা সেরূপ হলে এই প্রতিষ্ঠানে সমর বিভাগ প্রতিষ্ঠা করার কোনো প্রয়োজনই হতো না। অথচ মাওলানা নানুতুবি রহ. অতি গুরুত্বের সাথেই এ বিভাগটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যদি শুধুমাত্র দ্বীনি ইলম শিক্ষা দেয়াই এর লক্ষ্য হতো, তবে এখানে বিভিন্ন কারিগরি বিভাগও খুলতেন না। কারণ এর সম্পর্ক তো কেবল অর্থনৈতিক সমস্যার সাথে জড়িত। অনুরূপভাবে যদি এটা কেবল একটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই হতো তবে এখানে শরিয়তি বিচার বিভাগ খুলে এখানে কোনো বিচারকও নিয়োগ করতেন না। কারণ এটা তো একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা। অনুরূপভাবে যদি দরস ও তাদরীস বা পঠন-পাঠনই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হতো তবে তিনি এ মাদ্রাসার কর্তৃত্বের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তুরস্কের শাসনকর্তা সুলতান আবদুল হামীদ সম্পর্কে প্রশংসামূলক কবিতা রচনা করে তুরস্ক সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করতেন না। বস্তুত তার উদ্দেশ্য ছিল দেশের বিভিন্ন জাতির সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে বহির্বিশ্বের সাথেও ঐক্যের বন্ধন স্থাপন করা। পরবর্তীকালে শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমূদ হাসান রহ. ঐ সকল মৌলিক নীতির ভিত্তিতেই দারুল উলূমের বিপ্লবী আন্দোলনের অগ্রগতিকে অধিকতর জোরদার করেছিলেন।

শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দি পূর্বোক্ত  ‘সাওয়ানেহে কাসেমী’এর গ্রন্থকারকে প্রশ্ন করে বলেন: উস্তাদ মহোদয় কি দরস-তাদরীস ও পঠন-পাঠনের জন্যই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন? অতঃপর তিনি নিজেই উত্তর দিয়ে বলেন, আমার সামনে মাদ্রাসা স্থাপিত হয়েছিল। আমি যতদূর জানি, ৫৭ এর বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পর, এই প্রতিষ্ঠানটি একটি কেন্দ্র স্থাপনের জন্য স্থাপন করা হয়েছিল যার অধীনে লোক প্রস্তুত করা হবে যাতে ৫৭ এর ব্যর্থতার ক্ষতিপূরণ করা যায়।

এই আন্দোলন এবং এর নেতারা ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে ধর্মের প্রতি ভালবাসা, শরীয়তের প্রতি শ্রদ্ধা, এবং এর পথে ত্যাগের শক্তি এবং স্বদেশের স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা রক্ষায় পশ্চিমা সভ্যতার মুখোমুখি হয়ে দুর্দান্ত অবিচলতা ও স্থিতি জাগিয়ে দিয়েছিল। দারুল উলূম দেওবন্দ ছিল এই ধারার অগ্রদূত এবং ভারতের প্রাচীন ইসলামি সংস্কৃতি, সভ্যতা ও প্রশিক্ষণের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র। আবুল হাসান আলি নদভি “মাদারিসে ইসলামিয়্যা কা মাকাম আওর কাম” গ্রন্থে (পৃ. ১৯) যেমনটা লিখেছেন, ‘ভারতীয় মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনে দারুল উলূম দেওবন্দের শিক্ষাপ্রাপ্ত আলেম-ফাযেলদের সংস্কার প্রচেষ্টার  উল্লেখযোগ্য প্রভাব স্পষ্ট। রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং প্রিয় মাতৃভূমির প্রতিরক্ষায়ও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।’

দ্বিতীয় নেতৃত্ব, যার পতাকা উত্থাপন করেছিলেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান। তাঁর চিন্তার বুনিয়াদে ছিল বস্তুগত শক্তি এবং উন্নতি তথা পশ্চিমা সভ্যতা ও সংস্কৃতির অবলম্বন। স্যার সৈয়দ আহমেদ পাশ্চাত্য সভ্যতা এবং এর বস্তুগত ভিত্তিকে অনুকরণ করার এবং আধুনিক বিজ্ঞানকে তার ত্রুটি ও বিচ্যুতিসহ এবং কোনো সমালোচনা বা পরিবর্তন ছাড়াই গ্রহণ করার প্রচারক ছিলেন। তিনি ইসলাম ও কুরআনের তাফসীর ও ব্যাখ্যা সেভাবে করতেন, যা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং পশ্চিমা সভ্যতার মানদণ্ড মোতাবেক এবং পশ্চিমের মানুষের রুচি ও মেজাজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেটা সে-সব গায়বি হাকিকত ও প্রাকৃতিক রহস্যের অস্বীকারের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল, যা ইন্দ্রিয় এবং অভিজ্ঞতার নাগাল থেকে অনেক দূরে এবং আপাত দৃষ্টিতে আধুনিক বিজ্ঞানের মোতাবেক বলে মনে হয় না।

স্যার সৈয়দ আহমদ খান নিজের চোখে দেখেছেন শেষ মুঘল সাম্রাজ্যের পতন (যা ছিল মুসলমানদের মহান শাসনের একটি অস্পষ্ট ও ফিকে ছবি) এবং দেখেছেন ১৮৫৭ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের ব্যর্থতা। তিনি এই পরাজয়, ভারতের জনগণের হৃদয়বিদারণ, তাদের মহান দলের উপর মুষ্টিমেয় বিদেশীদের বিজয় প্রত্যক্ষ করেছেন। মুসলমানদেরকে এই প্রচেষ্টার জন্য যে ভারী মূল্য দিতে হয়েছে তাও তিনি দেখেছেন। সেই জাতি যারা গতকাল শাসক ছিল, এর অপমান ও অবনতি, বড় বড় খান্দান ও পরিবারের দুর্দশা এবং ব্রিটিশদের জাঁকজমক (যা মুসলমানদের মহত্ত্বের ধ্বংসস্তূপের উপর নির্মিত হয়েছিল) এমনকি তাদের শাসন ও জাদুকরী সভ্যতার দৃশ্য দেখেছেন,  এছাড়াও চাকরি, বন্ধুত্ব এবং পরিচিতির মাধ্যমে তিনি ব্রিটিশদের সাথে দীর্ঘ মেলামেশা করেছিলেন, এবং তাদের জীবনকে খুব কাছ থেকে অধ্যয়নের সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি তাদের বুদ্ধিমত্তা, কর্মের শক্তি এবং তাদের সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি একজন মেধাবী, সূক্ষ্ম সংবেদনশীল, শ্রমসাধ্য এবং সহানুভূতিশীল মানুষ ছিলেন। তিনি মধ্যম স্তরের ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেছিলেন। এবং নানুতুবির উলূম এবং কিতাব ও সুন্নাহর উপর তাঁর গভীর ও প্রশস্ত অন্তর্দৃষ্টি ছিল না, তিনি দ্রুত মতামত তৈরি করতে এবং সাহসের সাথে তা প্রকাশ করতে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি ব্রিটিশদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, ঠিক যেভাবে কোনো পরাজিত বিজয়ী দ্বারা, বা দুর্বল শক্তিশালী দ্বারা প্রভাবিত হয়। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ইংরেজি, সংস্কৃতি এবং আচার-আচরণ গ্রহণ করেছিলেন এবং অন্যদেরকেও সোৎসাহে একই কাজ করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তার ধারণা ছিল, এই সমরূপিতা, শাসক জাতির সমাজ ও সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে তাদের সাথে আন্তরিকভাবে বসবাস করলে সেই হীনমন্যতার বোধ ও দাসত্বের বোধ দূর হয়ে যাবে, মুসলমানরা যার শিকার এবং শাসকদের  দৃষ্টিতে তাদের কদর ও মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে,  তারা একটি সম্মানিত এবং সমপর্যায়ের জাতির সদস্য হিসেবে পরিচিত হতে শুরু করবে। এই ধারণা এবং এই দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর কয়েকটি নিবন্ধে খুব পরিষ্কারভাবে পাওয়া যায়। এক জায়গায় লিখেছেন: ভারতের মুসলমানদেরকে একটি নিখুঁত স্তরের সভ্যতা অবলম্বন করতে উত্সাহিত করা উচিত, যাতে সভ্য জাতিগুলো তাদের যে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে তা দূর হয় এবং সেও জগতে সম্মানিত ও সভ্য মানুষ বলে পরিচিত হয়। (তাহযীবুল আখলাক, মাযামীনে স্যার সৈয়দ, ২ খণ্ড, পৃ. ১)

বস্তুত, স্যার সৈয়দ ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডকে এমন সময়ে দেখেছিলেন যখন তা তাদের সভ্যতা ও বিকাশের যৌবনে ছিল, আধুনিক বিজ্ঞান ও আধুনিক শিল্প ছিল শীর্ষচূড়ায়। সে সময় পশ্চিমা সমাজ ও সোসাইটিতে পতন ও অবক্ষয়ের কোনো লক্ষণ প্রতিভাত হয়নি, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দৃষ্টিবানদের চোখে স্পষ্ট ধরা দিয়েছিল। পশ্চিমা সভ্যতা তখনও জীবন এবং সৃজনশীল সক্ষমতায় পূর্ণ ছিল। তার বক্ষপটে সমস্ত বিশ্ব জয় করার এবং সমস্ত জাতিকে নিজের অধীনে আনার উত্তেজনা ভরপুর ছিল। এই উজ্জ্বল এবং চোখধাঁধানো দীপ্তিময় দিকটি তাকে পশ্চিমা সভ্যতা এবং সমাজের অন্ধকার এবং দুর্বল দিকগুলোর দিকে মনোনিবেশ করা থেকে বিরত রাখে। নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার অভাব, দেশদখলের লালসা, ঔদ্ধত্য এবং জাতীয় স্বার্থপরতা ব্রিটিশদেরকে একটি আন্তর্জাতিক অপরাধী জাতিতে পরিণত করেছিল এবং যেভাবে ভারতবর্ষে তা প্রকাশিত হয়েছিল—এই সত্য এবং এই দিকটি তার চোখের আড়াল থেকে যায়।

তিনি এই সভ্যতা ও সমাজের প্রতি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তার হৃদয়, মন, স্নায়ু এবং তার সমস্ত বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা এতে সংযুক্ত হয়ে পড়েছিল।  ১২ অক্টোবর, ১৮৭০-এ তিনি এই সভ্যতার একজন ভক্ত এবং ভারতের মুসলিম সমাজে সে-সব মূল্যবোধ ও নীতির ভিত্তিতে সংস্কার ও পরিবর্তনের প্রবল প্রবক্তা এবং প্রচারক হিসেবে স্বদেশে ফিরে আসেন। এবং সমস্ত আন্তরিকতা ও উষ্ণতার সাথে, তিনি এই আন্দোলন ও দাওয়াতের পতাকা উত্থাপন করেন এবং নিজের সমস্ত সামর্থ্য ও শক্তি এতে নিয়োজিত করেন। তার দৃষ্টি সম্পূর্ণরূপে বস্তুবাদী হয়ে ওঠে। তাকে বস্তুগত শক্তি এবং মহাবিশ্বের শক্তির সম্মুখে একবারে নতশির দেখা যেতে লাগে। তিনি নিজের আকিদা-বিশ্বাস এবং কুরআনের ব্যাখ্যাও একই ভিত্তিতে করতে শুরু করেন। তিনি এতে এতটা বাড়াবাড়ি করেছিলেন যে, আরবি ভাষা ও শব্দের স্বীকৃত নীতিমালা ও বিধিবিধান এবং ইজমা ও তাওয়াতুরের বিরুদ্ধে কথা বলতে দ্বিধা করেননি। তাই তাঁর তাফসীর নানুতুবি ও ইলমি মহলে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। ডক্টর মুহাম্মাদ আল-বাহি তার “আল-ফিকর আল-ইসলামী আল-হাদিস” (’الفکر الاسلامی الحدیث) গ্রন্থে তাঁর এই প্রবণতা সম্পর্কে  বলতে গিয়ে যথার্থ বলেছেন :

‘স্যার সৈয়দ আহমদ খানের আন্দোলন প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এবং পশ্চিমের বস্তুগত সভ্যতার প্রতি ভালবাসা ও মোহের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল, ঠিক যেমন কিছু সমসাময়িক চিন্তাবিদ বিজ্ঞান এবং এর উদ্ভাবন ও বিজয়ের দ্বারা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অভিভূত হয়েছেন, যার উপর ভিত্তি করে বর্তমান পশ্চিমা সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পদার্থ বিজ্ঞানের প্রতি এতটা সংযুক্তি ও আসক্তি, আধ্যাত্মিক এবং আদর্শিক মূল্যবোধের মূল্যকে হ্রাস করে, অথচ এই মূল্যবোধগুলোই ঐশ্বরিক ধর্মগুলোর মূল বুনিয়াদ, যা ইসলাম সবচেয়ে স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করেছে৷ প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সাথে এই অস্বাভাবিক সংযুক্তি, কখনও কখনও এমন কিছু অস্বীকারের দিকে নিয়ে যায়, যা মানুষের ইন্দ্রিয় এবং পর্যবেক্ষণের আওতায় আসতে পারে না।’

এসব প্রান্তিক বস্তুবাদী প্রবণতা, মানুষের বুদ্ধির পবিত্রতা এবং তার সীমা ও কর্মক্ষেত্রের অত্যধিক প্রসারতা, খোদার ক্ষমতা ও অভিপ্রায়কে প্রকৃতির নিয়ম ও বাহ্যিক কারণের অনুগামী মনে করা, কুরআনের ধৃষ্টতাপূর্ণ তাফসীর-ব্যাখ্যা– এমন যা এক নতুন চৈন্তিক বুদ্ধিবৃত্তিক বিশৃঙ্খলা, বিভ্রান্তি ও বিদ্রোহের দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে এবং পরবর্তীতে লোকেরা তা থেকে এমন গলদ ফায়দা উঠিয়েছে যে, দ্বীনের ব্যাখ্যা এবং কুরআনের তাফসীর শিশুর খেলায় পরিণত হয়।

স্যার সৈয়দের শিক্ষাগত ও সংস্কার পরিকল্পনার দুটি দিক এমন ছিল, যার কারণে এটি ইসলামি বিশ্বের জন্য একটি বিপ্লবাত্মক দাওয়াহ এবং ইতিবাচক ও গঠনমূলক পদক্ষেপ হিসেবে প্রমাণিত হতে পারেনি, যা আকীদা-ঈমান এবং রিসালাতে মুহাম্মদির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সোসাইটির অবস্থার অনুকূল হয়, ইসলামি বিশ্বের মন-মগজে পশ্চিমা সভ্যতা ও পদার্থবিদ্যার বিকাশের ফলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা পূরণ করতে পারে।

প্রথম দিকটি হলো, তারা এই শিক্ষাব্যবস্থাকে (যা পশ্চিমে চূড়ান্ত করা হয়েছিল) ভারতের মুসলিম সমাজের শর্ত-স্বার্থ ও প্রয়োজনীয়তার সাপেক্ষে করেনি, যেখানে এটি প্রয়োগ করা হবে। তিনি এটিকে পুনর্নির্মাণ এবং ইসলামি রূপ দেওয়ার কথা বিবেচনা করেননি। পাশ্চাত্য সভ্যতা এবং এর বস্তুগত চেতনা থেকে এটিকে শুদ্ধ করার দিকেও কোনো মনোযোগ দেননি যা একটি প্রাচ্যীয় ইসলামি দেশের প্রয়োজন ছিল না। তিনি পশ্চিম থেকে এই ব্যবস্থার সমস্ত বিবরণ, বৈশিষ্ট্য, এর চেতনা ও মেজাজ এবং এর সাথে জড়িত পরিবেশ ও ঐতিহ্য হুবহু আমদানি করেন। তিনি শুধু পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থার জন্যই নয়, পশ্চিমা সংস্কৃতি ও প্রাণ-চেতনাকে গ্রহণ করার জন্যও জোর দেন। কলেজের নিয়মে বলা হয়েছে যে, কলেজে কমপক্ষে একজন অধ্যক্ষ, দুইজন অধ্যাপক এবং স্কুলে একজন প্রধান শিক্ষক সর্বদা ইউরোপীয় হতে হবে। কলেজের আয়ের অবকাশ বিবেচনা করে এই সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। তাই, সিনিয়র শিক্ষকদের মধ্যে অন্তত চার-পাঁচজন অবশ্যই ইংরেজ ছিলেন, যারা বিভিন্ন বিভাগে প্রশাসন ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করতেন। কলেজের ব্যবস্থা এবং শিক্ষার্থীদের নৈতিকতার উপর তাদের গভীর প্রভাব পড়েছিল। এসব প্রভাব কাজে লাগিয়ে তারা দেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কলেজের অধ্যক্ষ মি. বাক ছিলেন একজন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ এবং ভারতের ইসলামি রাজনীতির প্রথম ব্রিটিশ নেতা। এই নির্দেশনার রাজনৈতিক পরিণতি মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রবণতার পক্ষে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক প্রমাণিত হয়েছে।

মোটকথা, পশ্চিমা সভ্যতার আমন্ত্রণের সাথে স্যার সৈয়দের দাওয়াহ ও শিক্ষাগত দৃষ্টিভঙ্গি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে একীভূত হয়ে যায় এবং এর ফলে জনগণের হৃদয়ে তার ব্যাপারে নানা সন্দেহের জন্ম নেয়। তার বিরুদ্ধে ধর্মীয় মহলে ঘৃণা ও বিতৃষ্ণার ঢেউ বয়ে যায়। এই আন্দোলনের সাথে তাকে বর্জন ও বয়কটের আন্দোলনও শুরু হয়ে যায় এবং যা তার পথে অনেক অপ্রয়োজনীয় অসুবিধার সৃষ্টি করে। যে ধর্মীয় আলিমগণ শুরুতে ইংরেজি শিক্ষা ও দরকারী জ্ঞান অর্জনের বিরোধী ছিলেন না, এটা দেখে যে, এই আন্দোলন প্রথম থেকেই ভুল পথে চলে গেছে এবং এতে অনেক অপ্রয়োজনীয় ও ভুল উপাদান অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যেমন, পশ্চিমা সভ্যতার প্রতি প্রকাশ্য মোহ এবং এর দাওয়াত, নৈতিকতা ও বিশ্বাসের উপর এর ক্ষতিকর প্রভাবে পড়ছে। ইংরেজি অধ্যাপক ও অধ্যক্ষদের সীমাহীন প্রভাবের কারণে, এই কলেজে অধ্যয়নরত মিল্লাতে ইসলামের নির্বাচিত ও বুদ্ধিমান যুবকরা ইংরেজ সমাজ ও সভ্যতা এবং ব্রিটিশ রাজনীতিতে মুগ্ধ ও মোহিত হয়ে পড়ছে। তারা এর বিরোধিতায় পূর্ণ সক্রিয়তা প্রদশন করেন। অন্যদিকে, সেই প্রভাব ও পশ্চিমা পরিবেশের কারণে যা কলেজের সর্বত্র ছেয়ে আছে, এমন একটি ইসলামি প্রজন্মের উদ্ভব ঘটে, যারা নামে মুসলমান এবং মন ও মস্তিষ্কে সম্পূর্ণরূপে পশ্চিমা। তারা সমাজ ও সংস্কৃতিতে ইংরেজ জীবনধারা ফলো করে এবং প্রমোট করে। আকীদা-বিশ্বাসে  কখনো কখনো দুর্বল এবং নড়বড়ে।

অন্য দুর্বলতাটি ছিল, তারা সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ করেছিলেন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য অর্জন এবং উচ্চশিক্ষার প্রতি। ব্যবহারিক বিজ্ঞানের (যা প্রগতির সিঁড়ি এবং পশ্চিমা দেশগুলোর অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির রহস্য। যার বৈপ্লবিক প্রভাব ও ফলাফল তিনি ইংল্যান্ডের প্রতিষ্ঠার সময় প্রত্যক্ষ করেছিলেন) প্রতি তারা খুব বেশি মনোযোগ দেননি। অথচ, যদি কোনো জিনিস যা পাশ্চাত্য থেকে নেওয়া যেতে পারে এবং তাতে পূর্ণতা অর্জন করা যেতে পারে, তা ছিল এটিই। বরং তিনি শিল্প ও কারিগরি শিক্ষার আন্দোলন ও প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন এবং এ বিষয়ে শক্ত ও তিক্ত প্রবন্ধ লিখেছেন। এই সিরিজের শেষ নিবন্ধটি ছিল যা তিনি ২৯শে ফেব্রুয়ারি ১৮৯৮ আলিগড় গেজেটে প্রকাশ করেছিলেন। যার উদ্দেশ্য ছিল (মাওলানা হালির মতে) “ভারতের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে উন্নত কারিগরি শিক্ষার (টেকনিক্যাল এডুকেশন) কিছুমাত্র প্রয়োজন নেই। বরং সর্বপ্রথম প্রয়োজন হলো উচ্চ স্তরের মানসিক শিক্ষা, যা এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ হয়নি।”

কয় বছর ধরে, অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাদের বক্তৃতায় কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা প্রকাশ করেছেন। এতে করে স্যার সৈয়দেরও এই আশঙ্কা হয়, সরকারের উদ্দেশ্য উচ্চশিক্ষা বা সাহিত্য শিক্ষা স্থগিত করা, এবং সে কারণেই যখন এমন কোনো বক্তব্য তাঁর দৃষ্টিগোচর হত, তখন তিনি অবশ্যই এর বিরুদ্ধে কিছু না কিছু লিখতেন। এই কারণে আলিগড়ের মোহামেডান অ্যাডুকেশনাল কনফারেন্সের পঞ্চম অধিবেশনে কারিগরি শিক্ষার বিরুদ্ধে একটি প্রস্তাব পেশ করেন এবং রেজুলেশন বা প্রস্তাবের সমর্থনে দীর্ঘ বক্তৃতা দেন যা কনফারেন্সের কার্যক্রমে লিপিবদ্ধ হয়।

ফলস্বরূপ, এই ইসলামি প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণরূপে জ্ঞান ও সাহিত্যিক প্রবণতা নিয়ে অগ্রসর হয় এবং পশ্চিমা সভ্যতার অনুকরণের স্বাদ এবং ইংরেজি সাহিত্যে দক্ষতা অর্জনের শখ এর বুদ্ধিমান ও উত্সাহী ছাত্রদের উপর প্রাধান্য পায়। এটি কিছু ভালো ইংরেজি বক্তা, লেখক, বিভাগীয় কর্মকর্তা এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা তৈরি করে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই গণিত, পদার্থবিদ্যা, কেমিস্ট্রি, টেকনোলজি এবং কারিগরি বিজ্ঞানে, যেগুলো ইসলামি ভারতের নিদারুণ প্রয়োজন ছিল, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব এবং অসাধারণ মানুষ তৈরি হতে পারেনি। এর কারণে, এর প্রভাববলয় সরকারি চাকরি এবং সাধারণ প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

এই সমস্ত বিবরণ এবং সমালোচনা সত্ত্বেও, এতে কোন সন্দেহ নেই যে, স্যার সৈয়দ আহমদ খান এত শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন, সেই সময়ের নেতাদের মধ্যে কেউ এর চেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব নজরে পড়ে না। তিনি একটি বিস্তীর্ণ ফ্রন্টে লড়াই চালিয়ে যান, তিনি যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন, তা এত সাফল্য লাভ করে এবং এটি মুসলমানদের নতুন প্রজন্মকে এতটা প্রভাবিত করে, যতটা অন্য কোনো আন্দোলনে ছিল না। স্যার সৈয়দ আহমদ খানের শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের প্রভাব ভারতের ইসলামি সমাজে অত্যন্ত ব্যাপক। তিনি ভাষা ও সাহিত্য এবং চিন্তাধারা ও বয়ানভঙ্গি সবকিছুকেই কমবেশি প্রভাবিত করেছেন। একটি সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক  বিদ্যালয়ের ভিত্তি স্থাপন করেছেন যেখানে মহান ব্যক্তিত্বের জন্ম হয়েছিল। স্যার সৈয়দ আহমদ খানের নেতৃত্বে অর্ধশতাব্দী ধরে আন্তরিকতা ও যোগ্যতার সাথে পরিচালিত এই মহান শিক্ষা আন্দোলন কিছু অনস্বীকার্য ফল বয়ে আনে।

এটি বৃটিশ শাসন এবং সরকার পরিবর্তনের পরে ভারতের ইসলামি সমাজে তৈরি হওয়া শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক শূন্যতা পূরণ করেছে। কিছু পরিমাণে, এটি মুসলমানদের হতাশা এবং বিরক্তিকে কমিয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানে যোগ্য কিছু যুবক, চিন্তাবিদ, সাংবাদিক, লেখক এবং নেতার জন্ম হয়েছিল যারা পরবর্তীতে খেলাফত আন্দোলন এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল। পরবর্তীতে, যখন পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হয় এবং তারপর ইসলামিক স্টেট অফ পাকিস্তান অস্তিত্বে আসে, তখন এই প্রতিষ্ঠানেই অনেক নেতা এবং যোগ্য প্রশাসক পাওয়া যায়, কিন্তু মুসলমানদের আধুনিক সংকটাপন্ন পরিস্থিতির সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়োজনীয়তা পূরণে এটি প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করেনি।

২.

বস্তুত, একটি মহান জাতির মধ্যে চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির শতবিচিত্র রঙ পাওয়া যাওয়া একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। তাই আমাদের জাতিতেও রয়েছে ভাবনার অসংখ্য রকমফের এবং চিন্তার অগণিত ধারা। তথাপি, কিছুটা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির এই অগণিত রঙের মধ্যে প্রধান এবং পোক্ত দু’টি রঙ রয়েছে; একটি আলিগড়ের এবং অন্যটি দেওবন্দের। বাদবাকি অন্যদের মধ্যে বা আশে-পাশে যে সব রঙ দেখতে পাওয়া যায়, সবগুলোই এই উভয়ের সংমিশ্রণ থেকে সৃষ্টি হয়েছে এবং তার কোনোটিতে আলিগড়ের রঙ বেশি প্রাধান্য পেয়েছে এবং কোনোটিতে দেওবন্দের।

যেন জাতির মহাসমুদ্রের আসল অভিমুখ এই দুটোই, যা প্রায় শত বছর ধরে ‘মারজাল বাহরাইন ইয়ালতাকিয়ান’এর মতো সম্পূর্ণভাবে সংলগ্ন এবং সংযুক্ত, কিন্তু ‘বায়নাহুমা বারযাখুল লা ইয়াবগিয়ান’এর ন্যায় বিচ্ছিন্নতা ও সম্পর্কহীনতার সাথে অবিরাম চলমান। এদের প্রত্যেকেরই একটি স্থায়ী অতীত এবং একটি সুনির্দিষ্ট আদর্শগত ভিত্তি রয়েছে। যেহেতু  এর পিছনে রয়েছে একটি বিশাল, বিস্তৃত, পোক্ত ও সুদৃঢ়  শিক্ষা ব্যবস্থা। সুতরাং এই দুটির প্রভাব হয়েছে অতীব সুদূরপ্রসারী।

১৮৫৭ ইং পরবর্তী ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায় এই দুই চিন্তাধারার উপর প্রতিষ্ঠিত মতবিরোধ উলামা এবং গায়রে উলামা, প্রাচীন শিক্ষায় শিক্ষিত এবং আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের মধ্যে এক বিরাট দূরত্ব দাঁড় করিয়ে দেয়। দুই শ্রেণীর মধ্যকার এই দূরত্ব ও মতবিরোধ দিন দিন বাড়তেই থাকে। যেহেতু দুই চিন্তাধারার প্রবক্তা, সমর্থক ও সংরক্ষকদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারাগত বিরোধ ছিল, ফলে গোটা জাতি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।

অবশ্য ক্রমবর্ধমান এই দূরত্ব ও বিভক্তি প্রথম থেকেই অনুভূত হয়েছিল এবং এটা দূর করার এবং উভয়ধারাকে একে অপরের কাছাকাছি আনার প্রয়োজনীয়তাও প্রথম থেকেই উপলব্ধ হয়েছিল। তাই উভয়ের মধ্যে সমন্বয় এবং সংযোগের প্রচেষ্টার স্বাক্ষর প্রথম থেকেই দেখতে পাওয়া যায়। নদওয়াতুল উলামা প্রতিষ্ঠা ছিল এই প্রচেষ্টার প্রথম প্রকাশ এবং দিল্লিতে জামিয়াতুল আনসার এবং জামিয়া মিল্লিয়া এর প্রতিষ্ঠা ছিল দ্বিতীয় প্রকাশ। তারপর এই প্রচেষ্টার তৃতীয় কেন্দ্র হয় জামেয়া ওসমানিয়া হায়দ্রাবাদ দেকান এবং এটিও আধুনিক ও প্রাচীনকে কাছাকাছি আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

নদওয়াতুল উলামার ক্ষেত্রে এমন বলা যথার্থ যে, এটা আলিগড়ের গর্ভ থেকে জন্ম লাভ করেছে। মরহুম মাওলানা শিবলি নোমানি যিনি প্রথমে আলীগড়ের ‘অধ্যাপক শিবলি’ এবং পরে নদওয়ার ‘আল্লামা শিবলি’ হয়েছিলেন। শুরুতে তিনি স্যার সৈয়দের অন্যতম কমরেড ও সমর্থক ছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর প্রতি মোহভঙ্গ হয়ে পড়েন এবং তাঁর শিক্ষা পরিকল্পনায় অসন্তুষ্ট হন, তাঁর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। এই বিচ্ছেদের কারণগুলো কী ছিল, তার আলোচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক, যদিও উপরের আলাপে কিছুটা ইঙ্গিত আছে। এখানে শুধু নদওয়া প্রতিষ্ঠার দিকটি নিয়ে আলোচনা হবে।  যাইহোক নদওয়া ছিল প্রাচীন ও আধুনিক এবং প্রগতি ও স্থবিরতার মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ইলমি ও ফিকরি (জ্ঞানিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক) পথ তৈরির প্রচেষ্টার সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশ।

নদওয়াতুল ওলামার (১৩১১ হি. মোতাবেক ১৮৯৩ খ্রি.) এই আন্দোলন, যা মাওলানা মুহাম্মদ আলি মুঙ্গিরি (রহ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর পরবর্তী বহুকাল পর্যন্ত মাওলানা শিবলি (র.) এবং তাঁর প্রখ্যাত সাথী-শিষ্যরা এটির পরিচালনা করেছেন। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও বিশেষত্ব বয়ান করে আবুল হাসান আলি নদভি লিখেছেন, প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুমের এই সক্ষমতা ছিল যে, এটি ইসলামি ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতি, উলামায়ে দ্বীন ও আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করবে এবং একটি ভারসাম্যপূর্ণ চিন্তা-ভাবনা গড়ে তুলবে যা প্রাচীন ও আধুনিক উভয়ের গুণাবলীর সমন্বয় সাধন করবে। এই চিন্তাধারার অগ্রনায়কদের ভাষায়–

“اصول و مقاصد میں سخت اور بے لوث اور فروع اور وسائل میں وسیع اور لچکدار ہو۔”

অর্থাৎ, “নীতি ও লক্ষ্যের প্রশ্নে কঠোর, নিঃস্বার্থ এবং শাখা ও উপায়ের ক্ষেত্রে প্রশস্ত ও নমনীয় হবে।”

তাঁদের মতে, ধর্মীয় পাঠ্যক্রম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের একটি পরিবর্তিত ও বিকশিত মাধ্যম ছিল, যা সময়ের পরিবর্তন ও প্রয়োজনীয়তার সাথে  (তার চেতনা এবং লক্ষ্য এবং মৌলিক উলূমের সুরক্ষার সাথে) অবশ্যই পরিবর্তিত ও বিকশিত হওয়া উচিত। তাঁদের দৃষ্টিতে, একটি স্থির, জীবাশ্মকৃত পাঠ্যক্রম হওয়ার পরিবর্তে একটি জীবন্ত দেহের মতো উন্নতি এবং সম্প্রসারণের সম্ভাবনায় পূর্ণ হবে এটি। অন্য কথায়, দ্বীন একটি চিরন্তন বাস্তবতা, যার মধ্যে কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। কিন্তু জ্ঞান একটি বিকাশমান বৃক্ষ যা ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। ইসলাম একটি সার্বজনীন ও শাশ্বত দ্বীন এবং জীবন। অতএব, মানব-মনের বিবর্তন, পতন ও পরিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ের মুখোমুখি হতে হয়। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, ধারণায় এবং চিন্তাধারায় পথপ্রদর্শনের দায়িত্ব আদায় করা এবং উদ্ভূত সন্দেহগুলো দূর করা একটি স্বাভাবিক বিষয়। এই উদ্দেশ্যেও এই শিক্ষা-মাধ্যমকে (যা ইসলামের প্রতিনিধি এবং এর ভাষ্যকারদের প্রস্তুত করে) নিজের পরিধিকে প্রশস্ত করতে থাকা এবং আপন যোগ্যতা এবং জীবনকে প্রমাণ করতে থাকা জরুরী।

এই নদওয়াতুল উলামার প্রতিষ্ঠাতারাই পাঠ্যক্রম সংস্কার ও সম্প্রসারণের সর্বপ্রথম আওয়াজ তুলেছিলেন। যা ছিল ভারতে (যা প্রাচীন পাঠ্যক্রমের সাথে দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত ছিল) একেবারেই অপরিচিত। অন্যান্য ইসলামি দেশেও পাঠ্যক্রম সংস্কারের আহ্বান তখনো ছড়িয়ে পড়েনি এবং জামিয়া আজহারও তখনো এই দিকটায় কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। এর কিছুটা অনুমান নিম্নোক্ত দুটি উদ্ধৃতি থেকে করা যায়, একটি নদওয়াতুল উলামার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ আলি মুঙ্গিরীর একটি লেখা থেকে নেওয়া হয়েছে, অন্যটি মাওলানা শিবলি নোমানির লেখা থেকে নেওয়া হয়েছে।

‘এই যুগে জিনিসগুলো পরিবর্তিত হয়েছে। পূর্বের দর্শনে যে আপত্তিগুলো উত্থাপিত হয়েছিল সেগুলো এখন আর জিজ্ঞাসিত হয় না, না আপত্তি তোলা সেই সম্প্রদায়গুলো অবশিষ্ট আছে। এখন তাদের আপত্তি-উত্তর শেখার দরকার নেই, এখন নতুন জগৎ, নতুন শস্য, নতুন পানি। আধুনিক দর্শনের ভিত্তিতে এ যুগের ইসলাম বিরোধীরা নতুন ধরনের আপত্তি উত্থাপন করেছে যা আগে ছিল না। এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর প্রাচীন দর্শন জেনে দেওয়া যাবে না, কেউ যতই দাবি করুক না কেন। এর কারণ হচ্ছে, আপত্তিকারীর পক্ষে উত্তর তখনই নিরাময়মূলক হতে পারে যখন তার চূড়ান্ত আপত্তি ভালভাবে বুঝে নেওয়া যাবে, এবং এটিও জানা যায় যে, তিনি কিসের ভিত্তিতে আপত্তি করেছেন?’

‘এই গ্রীক বিজ্ঞানগুলো না আমাদের ধর্মীয় বিজ্ঞান, না ধর্ম সম্পর্কে আমাদের বোঝা ও জ্ঞানলাভ করা সেগুলোর উপর নির্ভরশীল। ইমাম আল-গাজ্জালি তাঁর সময় থেকে এই বিজ্ঞানগুলোকে আলেমদের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। কারণ গ্রীক বিজ্ঞানের প্রভাবে, যা সেই সময় বেশিরভাগ বাতেনীদের দ্বারা ছড়িয়ে পড়েছিল, ইসলামি আলিম ও পণ্ডিতগণ ওয়াকিবহাল হয়ে সেই সময়ের নাস্তিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারেন। কিন্তু এখন না আর সেই নাস্তিক রয়েছে, না আছে গ্রীক বিজ্ঞান, আর না যুক্তির দাবিদাররা তাদের বিষয়গুলোর সঠিকতা সম্পর্কে নিশ্চিত। এজন্য তাদের প্রভাবটি আপনাআপনি চলে গেছে। এখন তার জায়গায় এসেছে নতুন বিজ্ঞান, নতুন সমস্যা এবং নতুন গবেষণা। তাই ইসলামের নতুন নতুন সমস্যা সমাধানের জন্য এবং নতুন সন্দেহের বস্তুনিষ্ঠ জবাব দেওয়ার জন্য আমাদের আলেমদের এই নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে সচেতন হওয়া দরকার।’

বস্তুত, নদওয়াতুল ওলামা আন্দোলন শুধুমাত্র নেসাব ও পাঠ্যক্রম সংস্কারের একটি আন্দোলন ছিল না, এটি ছিল একইসাথে একটি স্বতন্ত্র ও স্থায়ী ফিকির বা চিন্তাধারা, যা প্রাচীনতা এবং আধুনিকতার কাশমাকাশে বিপর্যস্ত প্রতিটি দেশকে অনুসরণ করা উচিত ছিল। কিন্তু এই আন্দোলনটি প্রাচীন ও আধুনিক উভয় শ্রেণীরই কার্যকর ও উত্সাহী সমর্থন পায়নি, যার প্রাপ্য এটি ছিল। এর প্রধান কারণ নির্দেশ করে আবুল হাসান আলি নদভি বলেন, সেই আহলে ফিকির ও আহলে দাওয়াহের অভাব ছিল, যারা এই দুটি সংস্কৃতির ধারক এবং উভয়কেই ভালোভাবে হজম করেছে। যারা পরস্পরবিরোধী বলে মনে হয় এমন উপাদান থেকে একটি খাঁটি, স্বাভাবিক, মনোরম এবং দরকারী ‘মিশ্রণ’ তৈরি করতে পারে, যেমন একটি মৌমাছি বিভিন্ন ফুল এবং গাছ থেকে মধু উৎপন্ন করে।’

মোটকথা, জাতির একটি বড় অংশ দুটি শ্রেণীর মধ্যে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, যার মধ্যে একটি এটিকে প্রাচীন শিক্ষাধারা ও মাসলাক থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুতি এবং একধরনের বিকৃতি ও বিদআত বলে মনে করেছিল। অপরদিকে দ্বিতীয় শ্রেণীটি পশ্চিম থেকে আগত সবকিছুকে মহত্ত্ব ও পবিত্রতার দৃষ্টিতে বিবেচনা করত এবং সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত মনে করত। এমনকি পশ্চিমের মানুষের চিন্তা-চেতনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবণতাও একে মহত্ত্ব ও সম্পূর্ণতার প্রতিচিত্র হিসেবে ধারণা করত এবং তারা এসবকে মানুষের মনের বিকাশের চূড়ান্ত বলে মনে করত।

এত কিছুর পরও বলা যায় নদওয়াতুল উলামার ধারণা একটি মধ্যপন্থী ও ভারসাম্যপূর্ণ ধারণা, যা এখনো এই নানুতুবি শিক্ষা ব্যবস্থাকে একটি নবজীবন দান করার ক্ষমতা রাখে এবং এর মাধ্যমে জাতিকে প্রাচীনতা ও আধুনিকতার দ্বন্দ্ব থেকে এবং দুই বিবদমান শ্রেণীর বিভক্তি থেকে বাঁচাতে পারে, যা প্রায়শই ইসলামি দেশগুলোতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে।  যার কারণে কিছু দেশ ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

সাইয়েদ সুলায়মান নদভি লিখেন, ‘প্রকৃতপক্ষে নদওয়াতুল উলামা উপমহাদেশের মুসলমানদের দূরদর্শিতা, ব্যাপক পরিমাণ সচেতনতা এবং ইসলামের ব্যাপকতর শিক্ষা জ্ঞানের উৎকৃষ্ট বিকাশ। নদওয়াতুল উলামার আহবান সময়ের আহবান। এর প্রতিষ্ঠা ছিলো সময়ের সবচেয়ে বড় দাবী। আজ একথা কে বলতে পারে যে, নদওয়াতুল উলামা উপমহাদেশের দীনি মাদরাসাসমূহের শিক্ষা সিলেবাসের মাঝে পরিবর্তন ও সংস্কারের যে আহবান জানিয়েছিল, তা অকৃতকার্য সাব্যস্ত হয়েছে। অথবা ছোটখাট মতভেদ এড়িয়ে চলে আসল দ্বীনের তাবলীগ ও প্রচার প্রসারের যে দাওয়াত দিয়েছিল, তা ভুল ও অপাত্রে হয়েছে। অথবা আজ তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে? আজ এমন জ্ঞানী ও বিজ্ঞ ব্যক্তি যারা ইসলামের ব্যাপকভিত্তিক তা’লীম সম্পর্কে ওয়াকিফহাল তারা কি একথা বলতে পারেন যে, ভূগোল, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান ইত্যাদি সম্পর্কে বেখবর কোন ব্যক্তি ইসলামের সত্যিকার যোগ্য মুবালিগ হতে পারে? সঠিকভাবে ইসলামের খিদমাত আঞ্জাম দিতে পারে? কে আজ একথা মেনে নিতে প্রস্তুত হবেন যে, ইসলামের সত্যিকার মুবাল্লিগ তারাই হতে পারে যারা এমন সব মাদরাসার সনদপ্রাপ্ত, সেখানকার সিলেবাসে অংক, ভূগোল, ইতিহাস, সাহিত্য, রাজনীতি, বিজ্ঞান ইত্যাদি অন্তর্ভূক্ত নেই? প্রকৃতপক্ষে নদওয়াতুল উলামার আহবান ছিলো ব্যাপক ভিত্তিক ইসলামী জীবনব্যবস্থার বিকাশ ও প্রকাশ।”

তথাপি, এই বহুবিধ অবদান ও সাফল্য সত্ত্বেও আলিগড়ের আধুনিক ধর্মীয় চিন্তা ও দেওবন্দের প্রাচীন ধর্মীয় চিন্তার মধ্যে কোনো বাস্তব ও কার্যকর সমন্বয় সৃষ্টি করতে নদওয়া খুব বেশি সফল হয়েছে এমনটা জোর দিয়ে বলা যায় না।

৩.

আলিগড়ে শায়খুল হিন্দের ঐতিহাসিক খুতবা

এখানে এটা উল্লেখ করে দেওয়া প্রাসঙ্গিক যে, আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উচ্চারণ করা মাত্রই সাধারণত আমাদের মন চলে যায় স্যার সৈয়দ আহমদ খান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মুসলিম ইউনিভার্সিটির দিকে এবং মনে করা হয় যে হযরত শায়খুল হিন্দের আয়োজক এই মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় আলিগড় ছিল। অথচ বিষয়টি এমন না। তিনি মূলত আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির কিছু নেতৃস্থানীয় লোকের পৃষ্ঠপোষকতা (যাদের মধ্যে একজন ছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ আলি জওহর) এবং তাদের প্রস্তাবিত “মুসলিম ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় আলীগড়” এর প্রতিষ্ঠার জন্য তশরীফ নিয়ে গিয়েছিলেন। এরাই এই সভাপতি-বক্তৃতার আয়োজক ছিলেন।  যাইহোক, ঘটনা হলো  এই প্রস্তাবিত মুসলিম ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মাওলানা মুহাম্মদ আলি জওহরের সাথে যারা ছিলেন, তারা মূলত আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়েরই সন্তান ছিলেন। তাই বলাই সঙ্গত যে, এই খুতবার মাধ্যমে ইংরেজদের থেকে আযাদির জন্য হযরত শায়খুল হিন্দ দেওবন্দ এবং আলিগড়ের রাজনৈতিক কেবলাকে একমুখী করার সূত্রপাত করেছিলেন।  ফলস্বরূপ, এই আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণীটি স্বাধীনতা আন্দোলন এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় ধর্মীয় উত্সাহের সাথে পূর্ণ অংশগ্রহণ করেছিল, যার ফলে ফিরিঙ্গি ক্ষমতার পতন সাব্যস্ত হয়েছিল এবং উপমহাদেশকে ছেয়ে ফেলা ৯০ বছরের দাসত্বের কৃষ্ণসূর্য অস্তমিত হয়েছিল।

১৯২০ সালের ২৯শে অক্টোবর অনুষ্ঠিত এই স্মরণীয় সভায় শায়খুল হিন্দ এর পক্ষ থেকে উদ্বোধনী ভাষণ দেন মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানি। এই খুতবায় সেই প্রস্তাবিত মুসলিম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কথা বলা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটিই পরে জামিয়া মিল্লিয়া নামে পরিচিতি লাভ করে। এখন ঐতিহাসিক সেই খুতবাটির গুরুত্বপূর্ণ অংশ উদ্ধৃত করছি।

হামিদান ওয়া মুসাল্লিয়ান!

সভার সাধারণ রীতির দাবি হলো, আমি সর্বপ্রথম এই সভাপতিত্বের সম্মানের জন্য যা অত্যন্ত আত্মোৎসর্গী, নিঃস্বার্থ এবং সাহসী একটি দলের পক্ষ থেকে পেয়েছি, তার জন্য কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করব। কিন্তু আমি মনে করি না যে এই কৃতজ্ঞতা কয়েকটি ভারী এবং বাগ্মী শব্দে প্রকাশ করা যেতে পারে, আর না শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক ও কৃত্রিম কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন আমাকে সেই ভারী দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিতে পারে যা আপনারা এই সম্মান দানের অধীনে আমার উপর অর্পণ করেছেন। কিছু শব্দ নিঃসন্দেহে সাময়িকভাবে সমাবেশকে আনন্দ দিতে পারে, কিন্তু আমি মনে করি আমার জাতি এই মুহূর্তে ফাসাহাত-বালাগাতের (বাগ্মিতা ও আলংকারিকতা) ক্ষুধার্ত নয়, এবং এই ধরনের সাময়িক আনন্দ তার ব্যথার প্রকৃত নিরাময় হতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন অবিরাম উদ্যমের, অত্যন্ত ধৈর্যশীল অধ্যবসায়ের, একটি সাহসী কিন্তু বিবেকী কর্মপদ্ধতির এবং নিজের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের। অর্থাৎ, একজন পরিণত, উচ্চ চিন্তার ধারক এবং একজন সচেতন মুহম্মদী হয়ে উঠার প্রয়োজন।

কোনভাবেই আমি আপনার লেকচারার এবং বাগ্মীতাপূর্ণ বক্তাদের অবজ্ঞা করছি না। কারণ আমি ভালো করেই জানি, যে জিনিসটি ঘুমন্ত হৃদয়ের দরজায় কড়া নাড়ে এবং সময়ের বাতাসে প্রথম তরঙ্গ সৃষ্টি করে তা হলো সত্যের আহ্বানের উত্তাল ভাষা।  হ্যাঁ, আমি এইটুকু গুজারেশ করছি যে, যতক্ষণ পর্যন্ত বক্তা ও সম্বোধনকারীর অন্তরে উত্তম প্রচেষ্টার প্রকৃত আবেগ, তার নৈতিকতায় সাহসী অধ্যবসায় ও আত্মত্যাগ, তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে কর্মের শক্তি, তার ইচ্ছা ও উদ্দেশ্যে পরিপক্কতা ও সচেতনতা না থাকবে, শুধু উষ্ণতাদায়ী বক্তৃতা এমন কঠিন এবং উচ্চ লক্ষ্যে আপনাকে সফল করতে পারে না।

হে ভদ্রলোকগণ! আপনি ভালো করেই জানেন যেই কণ্টকাকীর্ণ উপত্যকাকে আপনি নগ্ন পায়ে অতিক্রম করতে চান, সেটা কষ্ট আর কষ্টের জঙ্গল। ধাপে ধাপে, অসুবিধা ও সমস্যা অপেক্ষমাণ। সমস্ত ধরণের শারীরিক, আর্থিক এবং পদবির দিক থেকে অনভিপ্রেত পরিস্থিতি আপনার স্বাতন্ত্র্যের আস্তিনকে চিহ্নগুলোকে বিপর্যস্ত করতে চায়, কিন্তু আপনি যদি   حُفَّتِ الجَنَّۃُ بِالمَکارِہِ এর কথককে খোদার সত্য রাসুল বিশ্বাস করেন এবং অবশ্যই বিশ্বাস করেন, তবে নিশ্চিত হন যে, যেই কণ্টকাকীর্ণ মরুভূমিতে আপনি অবিচল হওয়ার এরাদা করেছেন, তার পথে স্বর্গের দরজাগুলো খুবই নিকটে।

এটি খোদা তাআলার অবিচ্ছিন্ন সুন্নাহ, যাতে কোনপ্রকার পরিবর্তন নেই। এমন কোনো জাতি আল্লাহ তায়ালার ভালবাসা এবং তার পথে চলার দাবিদার হয়নি, যাকে পরীক্ষা ও যাচাই করা হয়নি।  আল্লাহর মনোনীত পয়গম্বর, যাঁদের চেয়ে বেশি আল্লাহর ভালোবাসা কারো প্রতি হতে পারে না, তারাও এর ব্যতিক্রম নন। অবশ্যই তাদের মুজাফফর (সফল) ও মানসুর (সাহায্যপ্রাপ্ত) বানানো হয়েছিল। কিন্তু কখন? প্রচণ্ড পরীক্ষা এবং প্রচণ্ড ঝড়ের মুখোমুখি করার পর।

অতএব, হে তাওহীদের সন্তানগণ, আমি চাই তোমরা নবী-রাসূল ও তাদের উত্তরসূরিদের পথ অনুসরণ কর এবং বর্তমানে শয়তানের বংশধর ও আল্লাহর পবিত্র সেনাবাহিনীর মধ্যে যে যুদ্ধ চলছে তাতে নিরাশ হয়ো না এবং মনে রেখো, শয়তানের শক্তিশালী লোহার দুর্গগুলো খোদার সাহায্যের সামনে মাকড়সার জালের চেয়েও দুর্বল।

আমি এই বার্ধক্য এবং অসুস্থতার অবস্থায় (যা আপনারা নিজেরাই প্রত্যক্ষ করছেন) আপনাদের আমন্ত্রণে লাব্বাঈক বলে সাড়া দিয়েছি, কারণ আমি এখানে আমার হারানো সম্পদগুলোর একটি খুঁজে পাওয়ার আশাবাদী।

অনেক নেক বান্দা আছেন যাদের মুখমন্ডল নামাজ ও যিকিরের আলোয় উদ্ভাসিত, কিন্তু যখন তাদেরকে বলা হয়, উঠে দাঁড়াও এবং এই মৃত জাতিকে কাফেরদের কবল থেকে বাঁচাও, তখন তাদের অন্তরে ভয় ও আতঙ্ক বিরাজ করে। আল্লাহর নয়, বরং কিছু অপবিত্র অস্তিত্বের এবং তাদের অস্ত্র-শস্ত্রের। অথচ তাদের সবচেয়ে বেশি জানা উচিত ছিল যে, যদি ভয় পাওয়ার উপযুক্ত কিছু থাকে তবে তা হলো আল্লাহর গজব এবং তাঁর প্রতিশোধ।

হে স্বদেশের নবীনরা!  যখন দেখলাম আমার বেদনার ভারবাহী (যা আমার হাড় গলিয়ে দিচ্ছে) মাদ্রাসা, খানকায় কম এবং স্কুল-কলেজে বেশি, তখন আমি এবং আমার কয়েকজন আন্তরিক বন্ধু আলীগড়ের দিকে পা বাড়ালাম এবং এইভাবে আমরা হিন্দুস্তানের দুটি ঐতিহাসিক স্থানকে (দেওবন্দ ও আলীগড়) সংযুক্ত করলাম। সে দিন বেশি দূরে নয় যে আমার এই সফর নিয়ে অনেক নেক-নিয়ত বুজুর্গ সমালোচনা করবেন এবং বলবেন যে আমি আমার মরহুম বুজুর্গদের মাসলাক ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছি। কিন্তু দৃষ্টিবানরা বুঝেন যে, আমি যে পরিমাণ আপাতদৃষ্টিতে আলীগড়ের দিকে এসেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি আলিগড় আমার দিকে এসেছে।

আপনাদের মধ্যে যারা অনুসন্ধানী ও সচেতন তারা জানবেন যে, আমার মহান সালাফগণ কখনো কোনো বিদেশী ভাষা শেখা বা অন্য জাতির জ্ঞান ও শিল্প অর্জনের ব্যাপারে কুফরীর ফতোয়া দেননি।  হ্যাঁ, এটা বলা হয়েছে যে, ইংরেজি শিক্ষার এটাই যদি আখেরি প্রভাব হয় যা সাধারণত দেখা যায় যে, মানুষ খ্রিস্টধর্মের রঙে আচ্ছন্ন হয়ে যাবে, অথবা নাস্তিকতাবাদী ঔদ্ধত্যের সাথে নিজের ধর্ম ও ধর্মের অনুসারীদের উপহাস করবে, অথবা সমকালীন সরকারের উপাসনা করতে শুরু করবে, তাহলে  একজন মুসলমানের জন্য এ ধরনের শিক্ষা লাভ করার চেয়ে অজ্ঞ থাকাই উত্তম। এখন আপনি নিজেই বিচার করুন এটা শিক্ষা থেকে বিরত করা ছিল নাকি নাকি এর কুফল থেকে? এবং এটা কি তা-ই নয়, মিঃ গান্ধী আজ যা বলছেন, “এই কলেজগুলোতে উচ্চশিক্ষা খুব ভালো, পরিষ্কার এবং স্বচ্ছ দুধের মতো; যাতে কিঞ্চিৎ বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

মহান আল্লাহকে শুকরিয়া যে তিনি আমার জাতির যুবকদেরকে নিজেদের ক্ষতি ও কল্যাণ বিবেচনা করতে এবং দুধে মিশ্রিত বিষকে আলাদা করতে সক্ষম করেছেন। (শায়খুল হিন্দ এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিতব্য  মুসলিম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিকে বুঝিয়েছেন। যেটি পরবর্তীতে জামিয়া মিল্লিয়া নামে পরিচিত হয়)।

জাতিকে আর সাধারণ শিক্ষার ফজীলত বর্ণনা করার প্রয়োজন নেই। কারণ সময় ভালো করেই বুঝিয়ে দিয়েছে যে, উচ্চ কল্পনাশক্তি, বিচক্ষণতা ও সচেতনতার চারাগাছ শিক্ষার মাধ্যমেই বেড়ে ওঠে এবং এর আলোকে মানুষ মুক্তি ও সমৃদ্ধির পথে চলতে পারে। হ্যাঁ, জরুরত হলো এই শিক্ষা মুসলমানদের হাতে থাকবে এবং অপরের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হবে। কি আকীদা-বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণায়, নৈতিকতা এবং কর্মে এবং কি বেশভূষা এবং আচার-আচরণে, সবক্ষেত্রেই আমরা ‘পরের প্রভাব’ থেকে মুক্ত ও পবিত্র হব।

আমাদের মহান জাতির আর এমন সিদ্ধান্ত না হওয়া উচিত যে, আমরা আমাদের কলেজগুলো থেকে খুব সস্তা হারে দাস তৈরি করতে থাকব। বরং আমাদের কলেজগুলো বাগদাদ-কর্ডোবার বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং এমন মহান মাদ্রাসাগুলোর নমুনা হওয়া উচিৎ, যেগুলো ইউরোপকে তাদের ছাত্র বানিয়েছে। তাদেরকে আমাদের শিক্ষক বানানো তো দূর!  আপনারা হয়তো শুনে থাকবেন, বাগদাদে যখন একটি ইসলামি সরকারের হাতে মাদ্রাসায়ে নিজামিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেদিন আলেমরা সমবেত হয়ে জ্ঞানের মাতম করেছিল, আফসোস, আজ থেকে জ্ঞান সরকারি পদ পদবি অর্জন করার জন্যে পড়া হবে।

অবশ্যই মুসলিমদের শ্রেণীকক্ষে যেখানে আধুনিক বিজ্ঞানের উচ্চ শিক্ষা দেওয়া হয়, ছাত্ররা যদি তাদের মূলনীতি ও অনুষঙ্গ সম্পর্কে অসচেতন থাকে, তাদের জাতীয় অনুভূতি ও ইসলামি কর্তব্য ভুলে যায়, তাদের মধ্যে তাদের জাতি এবং তাদের সমজাতিদের সমর্থন নিতান্তই নিম্নস্তরে চলে যায়, তাহলে বুঝে নাও যে এই শ্রেণীকক্ষ মুসলমানদের শক্তিকে দুর্বল করার একটি হাতিয়ার। এজন্য ঘোষণা করা হয়েছে একটি স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধন করা হবে যা সরকারের সমর্থন ও প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এবং যার পরিচালনার পুরো ব্যবস্থা ইসলামি ও জাতীয় অনুভূতির ভিত্তিতে হবে।

আমি অবশ্যই সেই নেতাদের চেয়ে বেশি এই নবাগতদের উচ্চ সাহসিকতার প্রশংসা এবং সাধুবাদ জানাতে চাই, যারা এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাদের হাজার হাজার আকাঙ্খার উপর পানি ঢেলে দিয়েছে। সমস্ত আশা এবং ভয় সত্ত্বেও, তারা মোয়ালাতে নাসারার পরিত্যাগের উপর দৃঢ়তা ও স্থিতির সাথে অবিচল আছে এবং দেশ ও জাতির নামে নিজের প্রিয় জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছে।

এখন, আমি আপনাদের সকলকে মহিমান্বিত প্রভুর দরবারে আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করার জন্য অনুরোধ করছি, যাতে তিনি আমাদের লোকদের অসম্মানিত না করেন এবং আমাদেরকে কাফেরদের প্রশিক্ষণের পাত্র না বানান, আমাদের ভালো কাজে আমাদের সাহায্য করেন। (সমাপ্ত)

সত্যি বলতে, যদি কেউ এই খুতবাটি পরীক্ষা করে দেখে, যে কেউ হযরত শায়খুল হিন্দের দৃষ্টিভঙ্গির সূক্ষ্মতা ও দূরদর্শিতায় বিস্মিত হবে। আজ থেকে এক শতাব্দী আগে তিনি এমন কিছু দেখেছিলেন যা আমাদের অধিকাংশ আলেম আজ পর্যন্ত দেখতে পারেননি। শত বছর আগে হযরত দেশের নবীনদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য যে সমাধান দিয়েছিলেন এবং শিক্ষাকে যে দিকে পরিচালিত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তা গ্রহণ করা হলে, আধুনিক ও প্রাচীনের যুদ্ধ, মাদ্রাসা ও ইস্কুলের দ্বন্দ্ব এবং দ্বীনদার ও দুনিয়াদারের মধ্যে এতটা দূরত্বই সৃষ্টি হতে পারত না, যার ব্যবধান আজ অনতিক্রম্য হয়ে পড়েছে।  যার ফলে ধর্মীয় শিক্ষার সামাজিক ও উপযোগী দিক হারিয়ে গেছে এবং মাদ্রাসার সিলেবাস নিয়ে দেশবাসী বৈধ আপত্তি তোলার সুযোগ পেয়েছে। নানুতুবি ইলমের শিক্ষা সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায়, আজ তাকে পলাতক মানসিকতার এবং সমাজের জন্য অকেজো মানুষ তৈরি করার মতো উপহাসের মুখে পড়তে হচ্ছে। হযরত শায়খুল হিন্দ দেওবন্দ আন্দোলনের একজন অনুসৃত মনীষী হয়েও, আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির কাছে অত্যন্ত সদয়ভাবে এমন এক সাধারণ শিক্ষার একটি বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করেছিলেন, যা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল এবং যাতে মুগ্ধ না হয়ে বিদেশী ভাষাকে নিজেদের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার তরগিব দেওয়া হয়েছিল। সন্দেহ নেই, আজ এক শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও হযরত শায়খুল হিন্দের এই নীতিমূলক খুতবা আজও জাতীয় শিক্ষা কৌশল এবং সফল রাজনৈতিক কৌশলের জন্য অনেক অনেক দিকনির্দেশনা বহন করছে।

তথ্য সহায়তায়:

১. মুসলিম মামালিক মেঁ ইসলামিয়্যত আওর মাগরিবিয়্যত কী কাশমাকাশ, আবুল হাসান আলি নদভি, মাজলিসে নশরিয়্যাতে ইসলাম, করাচি, প্রথম প্রকাশ,  ১৯৬৩ খ্রি.।

২. সাওয়ানেহে কাসেমী, মানাজিরে আহসান গিলানি, ২য় খণ্ড, ১৯৭৫ খ্রি.।

৩. দেওবন্দ আন্দোলন একটি জিহাদ, এ. এম. এম. আব্দুল জলীল, ইসলামী গবেষণাকেন্দ্র ঢাকা, ১৯৮৪ খ্রি.।

৪. ইসলামী পুনর্জাগরণে দারুল উলূম দেওবন্দ, মাওলানা মুহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান, কওমি পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ১৯৯৩ খ্রি.।

৫. কওমি মাদ্রাসা : নেসাব ও নেযাম, সম্পাদক মাওলানা লিয়াকত আলী, ইদারাতুল মাআরিফ মাদ্রাসা দারুর রাশাদ ঢাকা, ২০০৩ খ্রি.।

৬. https://urdupub.com

৭. https://www.mukaalma.com

আগের সংবাদপ্রস্তাবিত বাজেট মন্ত্রিসভায় অনুমোদন
পরবর্তি সংবাদপদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে ২৫ জুনের এসএসসি পরীক্ষা ২৪ জুন