দেওবন্দ-পূর্ব মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থা : একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনা

হুসাইন আহমাদ:

ভারতবর্ষে ইসলামি শিক্ষার সূচনা হয় ইসলামের আগমনের পর থেকেই, আরব বণিকদের মাধ্যমে। তাঁদের থেকেই প্রথম উপমহাদেশের মানুষ ইসলামের সুমহান বাণী ও শিক্ষা সম্পর্কে অবগত হয়। এরপর মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু ও মুলতান বিজয়ের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে ইসলামি শিক্ষা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায় এবং বিস্তৃতি লাভ করে। এ সময় আরব থেকে বহু আলেম মুবাল্লিগ সিন্ধু এসে ইসলাম প্রচার করতে থাকেন। তাঁরা বহুসংখ্যক মসজিদ-মক্তব প্রতিষ্ঠা করে মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষায় গড়ে তুলতে থাকেন। ফলে সিন্ধু ও মুলতান তখন গোটা ভারতবর্ষের ইসলামি শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। গজনবি আমলে মুলতানে অনেক আলেম-ওলামার সমাবেশ ঘটে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মাত্রা তখন অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীতে ঘুরি শাসকরা দিল্লি জয় করলে সেখানে তাঁরা বহুসংখ্যক মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র তখন দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়। রাজধানী হওয়ার সুবাদে মুঘল আমলের শেষপর্যন্ত দিল্লিই ছিল মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থার প্রধানকেন্দ্র।

ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় দিল্লিতে এমন অনেক মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয় যেগুলো গোটা ভারতের মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। সুলতান মুইজুদ্দিন ঘুরির আমলে দিল্লিতে ‘মাদরাসায়ে মুইজ্জি’ নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। দিল্লির প্রসিদ্ধ আলেম বদরুদ্দিন ইসহাক বুখারি এখানে দরস প্রদান করতেন। যিনি নকলি ও আকলি উভয় বিষয়ে সমান পারদর্শী ছিলেন। এ ছাড়া সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদের আমলে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মাদরাসায়ে নাসিরিয়া’, আলাউদ্দিন খিলজির সমাধিস্থলে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মাদরাসায়ে মাকবারাহ’, মুহাম্মদ তুঘলুকের খরমাবাদের মাদরাসা এবং মাদরাসায়ে খুসখাস ও মাদরাসায়ে ফিরোজশাহি হল দিল্লিতে প্রতিষ্ঠিত সুলতানি আমলের উল্লেখযোগ্য মাদরাসা।

এভাবে মুঘল আমলেও দিল্লিতে বড় বড় মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। মুঘলদের প্রতিজন সম্রাট ছিলেন বিদ্যাবান্ধব ও জ্ঞানপ্রেমী। শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁদের প্রত্যেকেরই রয়েছে কালজয়ী অবদান। সম্রাট হুমায়ুন নিজে ছিলেন জ্যোতির্বিদ্যা ও ভূগোলশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শিতার অধিকারী। পদার্থবিদ্যার ওপর তিনি পুস্তিকাও রচনা করেছেন। হিন্দুস্তানের মাদরাসাগুলোতে ‘এ্যাস্ট্রোল্যাব’ ব্যবহারের প্রবর্তন করেছিলেন তিনিই। সম্রাট হুমায়ুন দিল্লিতে একটা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। হুমায়ুনের মাজারের যে ভবনটি বর্তমান পর্যটকদের বিশেষ আকর্ষণ, সেকালে এটি মূলত একটি মাদরাসা ছিল। এর চারপাশের ছোট ছোট কামরাগুলো ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহার হত। সমকালীন বিখ্যাত শিক্ষাবিদগণ সেখানে পাঠদান করতেন। আকবরের শাসনামলে তাঁর দুধমাতা মাহাম বেগম দিল্লির পুরানা কেল্লার পশ্চিমপাশে ‘খাইরুল মানাযিল’ নামে একটি মাদরাসা স্থাপন করেন।

শায়েখ আব্দুল হক দেহলভি রহ. আখবারুল আখইয়ার গ্রন্থে বলেন, দিল্লির যে মাদরাসাটিতে তিনি লেখাপড়া করেছেন সেটি সকালে শুরু হয়ে দুপুরে বিরতি হত। আবার জোহরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্লাস চলত। তিনি দৈনিক বাড়ি থেকে মাদরাসায় গিয়ে ক্লাস করতেন। শাহজাহান ও বাহাদুর শাহের আমলেও দিল্লিতে মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। মুঘল আমলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও ঐতিহাসিক মাদরাসা হল শাহ আব্দুর রহিম রহ. প্রতিষ্ঠিত ‘মাদরাসায়ে রহিমিয়া’। যেখান থেকে হিন্দুস্তানে ইসলামি রাজনীতির নবজাগরণ শুরু হয়। তৈরি হয় শাহ ওয়ালিল্লাহ, ছানাউল্লাহ পানিপথি, শাহ আবদুল আযিয ও শাহ ইসমাইল, ইসহাক ও আবদুল কাদের প্রমুখ বিখ্যাত ও ইতিহাস সৃষ্টিকারী ব্যক্তিবৃন্দ।

দিল্লি ছাড়াও উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সুফি-দরবেশ ও বিজয়ী মুসলিম বীরদের মাধ্যমে গড়ে ওঠে ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা। যেমন :

বাংলা ও বিহার

বাংলা ও বিহার অঞ্চলে ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি ( মৃত্যু ১২০৫ খ্রি. ) এর মাধ্যমে। তিনি এই অঞ্চল বিজয়ের পর ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রাসারে বিশেষ মনোযোগী হন এবং অসংখ্য মসজিদ-মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন শাসনামলে এখানে বড় বড় মাদরাসা গড়ে ওঠে। তন্মধ্যে শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা রহ. এর সোনারগাঁও মাদরাসা ও মুর্শিদাবাদের মাদরাসা ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে আছে।

কাশ্মীর

সুলতান সেকান্দারের মাধ্যমে কাশ্মিরে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় উৎকর্ষ আসে। আবুল হাসানাত নদভি বলেন, তাঁর শাসনামলে কাশ্মির জ্ঞান চর্চায় ইরাক ও খোরাসানের কাছাকাছি উন্নীত হয়েছিল। সেকান্দার ছিলেন শিক্ষিত ও বিদ্যানুরাগী শাসক। তিনি কাশ্মিরে বহু মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং দেশ-বিদেশের আলেমদের আমন্ত্রণ জানিয়ে কাশ্মিরে নিয়ে আসেন। ৮১৯ হিজরিতে তাঁর মৃত্যু হয়। এরপর সুলতান জয়নুল আবেদিন কাশ্মিরকে শিক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। মুঘল সম্রাট আকবরের কাশ্মির দখলের পরও সেখানে শিক্ষাব্যবস্থা আগের মতই অব্যহত ও উন্নত ছিল।

গুজরাট

শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় গুজরাটও পিছিয়ে ছিল না কোনদিকে। গুজরাটের ইতিহাসে সুলতান মাহমুদ বিগড়াহ (৮৬৩–৯১৭ হি.) এর আমলে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানচর্চা হয়। ‘তারিখে মিরয়াতে আহমদি’ এর গ্রন্থকার বলেন, এই বাদশা ( মাহমুদ বিগরা) মুসাফিরদের বিশ্রামের জন্য সরাইখানা, তালেবে ইলমদের ইলম অর্জনের জন্য মাদরাসা ও মুসলমানদের ইবাদতের জন্য মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন।

এভাবে উপমহাদেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে এবং শিক্ষার আলো ছড়াতে থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতার কারণে এসব অঞ্চল গোটা ভারতের শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনি, করলেও তা বেশিদিন টেকেনি।

আজকাল যত মাধ্যম ও উপকরণ শিক্ষাকে আমাদের জন্য সহজ করে দিয়েছে সেকালে সে সুযোগ ছিল না। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা দূরের প্রতিষ্ঠানে গিয়ে লেখাপড়াকে দূরহ করে তুলেছিল। ফলে শিক্ষার এতোসব প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনের বাইরেও সর্বশ্রেণি ও সববয়সী মানুষের জন্য মুসলিম শাসকরা গণশিক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। দূরবর্তী প্রত্যেক এলাকায় স্থানীয় শিক্ষিত লোকদের রাষ্ট্রের তরফ থেকে ভাতা প্রদান করা হত যাতে তাঁরা নিজ এলাকায় সাধারণ মানুষদের শিক্ষাদানে নিয়োজিত থাকেন।

পাঠ্যক্রম

প্রখ্যাত গবেষক আল্লামা আব্দুল হাই হাসানি তাঁর রচিত ‘আস সাকাফাতুল ইসলামিয়্যা ফিল হিন্দ’ গ্রন্থে ভারতবর্ষের পাঠ্যক্রমের ক্রমবিবর্তনকে চারটি যুগে বিভক্ত করেছেন। উপমহাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বুঝতে তা অনেক জরুরি। তাই কিছু পরিবর্ধন সহ এখানে আমরা তুলে ধরছি।

প্রথম যুগ

হিজরি সপ্তম শতাব্দি থেকে দশম শতাব্দি পর্যন্ত। মুহাম্মাদ ঘুরির ভারত বিজয়ের প্রাক্কাল থেকে পরবর্তী প্রায় দুইশ বছরের বেশি সময়কাল এই পাঠ্যক্রম চালু ছিল। এ যুগের পাঠ্যসূচি ছিল নিন্মরূপ :

সরফ-নাহু (আরবি ব্যাকরণ) : মিসবাহ, কাফিয়া, লুব্বুল আলবাব ও ইরশাদ।
আরবি সাহিত্য : মাকামাতে হারিরি মুখস্ত করানো হত।
ফিকাহ : মুত্তাফাক, মাজমাউল বাহরাইন, কুদুরি ও হেদায়া।
উসুলে ফিকাহ : মানার ও তার শরাহ এবং উসুলে বাযদাভি।
মানতেক (তর্কশাস্ত্র) : শরহে শামসিয়া।
ইলমুল কালাম : শরহুস সাহায়েফ অথবা আকিদায়ে নাসাফিয়্যা।
তাসাউফ (আত্মশুদ্ধি) : আল আওয়ারেফ ওয়াত তায়াররুফ, ফুসুস, নকদে ফুসুস ও লাময়াত।
ফালসাফা (দর্শন) : শরহু হেদায়াতিল হিকমাহ।
তাফসির : মাদারেক, বায়যাবি ও কাশশাফ।
হাদিস : মাশারিকুল আনওয়ার ও মাসাবিহুস সুন্নাহ।

এই যুগের শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যক্রমে ফিকাহ ও উসুলে ফিকাহ এর গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। এমনকি শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড দাঁড়িয়েছিল অধিক ফিকাহ জানার ওপর। হাদিসের সাথে এ যুগের আলেমদের তেমন গভীর সম্পর্ক ছিল না। যদিও পাঠ্যক্রমে দুয়েকটা হাদিসের কিতাবও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর কারণ হল, ভারতের মুসলিম বিজয়ী ঘুরি ও গজনবিরা ছিলেন মধ্য এশিয়া থেকে আগত। আর মধ্য এশিয়ার আলেমদের মধ্যে তখন ফিকাহ উসুল ফিকাহ ও মানতেক-ফালসাফার চর্চা ছিল অধিক। তাই তাঁদের প্রণীত ভারতের পাঠ্যসূচিতে এর প্রভাব পড়েছিল পূর্ণমাত্রায়।

দ্বিতীয় যুগ

হিজরি নবম শতাব্দীর শেষভাগে তৎকালীন ভারতবর্ষের ইসলামি শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র সিন্ধু ও মুলতান আক্রান্ত হলে সেখান থেকে আলেমগণ দিল্লি চলে আসেন। দিল্লির সুলতান সিকান্দার লোদি তাঁদের সাগ্রহে বরণ করে নেন। ফলে দিল্লিতে তখন ইসলামি জ্ঞানচর্চা তখন বহুগুণে বেড়ে যায়। এ সময় মুলতান থেকে আগত শেখ আবদুল্লাহ ও শেখ আজিজুল্লাহ নামে দুজন বিখ্যাত আলেমের প্রচেষ্টায় পূর্বের পাঠ্যক্রমে বেশকিছু পরিবর্তন আসে। তাঁরা ‘ইলমে নকলি’ তথা বর্ণনাভিত্তিক লেখাপড়ার সাথে ‘ইলমে আকলি’ তথা বুদ্ধিবৃত্তিক পড়াশোনার ব্যাপক প্রচলন ঘটান। পূর্বের সিলেবাসের সাথে যুক্ত হয় জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত ও চিকিৎসা শাস্ত্র। বৃদ্ধি পায় মানতেক-ফালসাফার প্রভাব এবং পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয় শরহে আকাইদ, শরহে জামি, শরহে বেকায়া ও মুখতাসারুল মাআনি সহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কিতাব।

তৃতীয় যুগ

দ্বিতীয় যুগে পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন পরিবর্ধনের ফলে পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন আসাটা স্বাভাবিক হয়ে যায়। উপরন্তু এ যুগে আকবরের শাসনামলে পাঠ্যক্রমে কিছু পরিবর্তন হয় যা সর্বত্র সমাদৃত হয়। এ সময় পূর্ববর্তী আলেমগণের লিখিত বইপত্র পড়ানো শুরু হয়। পাঠ্যক্রম আগের তুলনায় সুবিন্যস্ত ও বিস্তৃত হয়। এই যুগের শেষদিকে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভি রহ. আরবে গিয়ে হাদিস শাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করে দেশে আসেন। তখন থেকে তিনি এবং তাঁর সন্তানরা হাদিসের পাঠদান চালু করেন। কিন্তু তাঁদের হাদিসের এই পাঠদানে ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থায় তেমন সাড়া পড়েনি। বরং মানতেক-ফালসাফার প্রভাব সেই আগের মতই রয়ে যায়।

চতুর্থ যুগ

এই সময় থেকে শুরু হয় দরসে নেজামি বা নেজামি পাঠ্যক্রমের শিক্ষাধারা। যে দরস বা সিলেবাস অনুসরণ করে আজও ভারতীয় উপমহাদেশের কওমি মাদরাসাগুলো শিক্ষা পরিচালনা করছে। আব্দুল হাই হাসানি নদভির বরাতে আমরা দেখেছি যে, উপমহাদেশে মুসলিম শিক্ষার ক্রমবিকাশের দ্বিতীয় ও তৃতীয় কালপর্বে বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানশাখার চর্চা ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। এই ধারার পরিবর্তনে ব্যাপক চেষ্টা চালান মোল্লা কুতুবুদ্দিন শহিদ আনসারি। মোল্লা কুতুবুদ্দিন আনসারি ছিলেন একজন বিখ্যাত আলেম। মাকুল ও মানকুল তথা বুদ্ধিবৃত্তিক ও বর্ণনাভিত্তিক উভয় প্রকার জ্ঞানশাখায় সমান দক্ষ। তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিল হেরাতের অধিবাসী, সাহাবি আবু আইয়ুব আনসারি রা. এর বংশধর। মুঘল সম্রাট আলমগির তাকে বিশেষ সম্মান করতেন। তিনি বাস করতেন উত্তরপ্রদেশের রাজধানী লখনৌ থেকে ২৮ মাইল দূরে সহালি নামক এলাকায়।

১০৮৮ হিজরি মোতাবেক ১৬৭৭ খ্রিস্টাব্দে সাহেলিতে মোল্লা নিজামুদ্দিনের জন্ম। চৌদ্দ বছর বয়সে তাঁর পিতা কুতুবউদ্দিন দুর্বৃত্তদের হাতে শহিদ হলে তিনি ভাইদের নিয়ে পালিয়ে লখনৌ আশ্রয় নেন। কিছুদিন পর সম্রাট আলমগির তাঁর পিতার হত্যার বিচার করেন এবং তাদের জন্য ফিরিঙ্গি মহল এলাকায় একটি বাড়ি বরাদ্দ দেন। সেখানে থেকে তিনি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল সফর করে ইলম অন্বেষণ করতে থাকেন। পিতার মতো তিনিও আকল ও নকল তথা বুদ্ধি ও বর্ণনা উভয় প্রকার জ্ঞানশাখায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। আত্মশুদ্ধিতেও লাভ করেন চরম উৎকর্ষ। পড়াশোনা শেষে তিনি ফিরিঙ্গি মহলে দরস দেওয়া শুরু করেন। দরস দানকালে নতুন একটি পাঠ্যক্রম চালু করেন। সেই পাঠ্যক্রম মূলত তিনি পিতা মোল্লা কুতুবুদ্দিনের উদ্ভাবিত পন্থাকে সামনে রেখে প্রণয়ন করেন। ধীরে ধীরে তা পরিবর্তন পরিমার্জন করতে থাকেন। কিছুদিনের মধ্যেই সেই পাঠ্যক্রম ‘দরসে নেজামি’ নামে গোটা ভারতবর্ষে প্রসিদ্ধি ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। তিনি ১৭৪৮ সালে ইন্তেকাল করেন।

দরসে নেজামি একটি সফল ও আধুনিক পাঠ্যক্রম হিসেবে স্বীকৃতি পায়। শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. দরসে নেজামির কৃতি সন্তান। মূলত শাহ সাহেবের সময়কাল থেকেই ভারতবর্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে সিহাহ সিত্তার পঠনপাঠন শুরু হয় এবং পরবর্তীতে তা দরসে নেজামির সর্বোচ্চ স্তরের পাঠ্য হিসেবে সংযুক্ত হয়। তৎকালীন ভারতের প্রায় সকল শিক্ষাকেন্দ্রে এই দরস অনুসরণ করে শিক্ষাদান করা হতে থাকে। এমনকি ১৭৮০ সালে বৃটিশ সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কলকাতা আলিয়া মাদরাসার পাঠ্যক্রমেও অনুসরণ করা হয় দরসে নেজামিকে। যদিও আস্তে আস্তে তাতে পরিবর্তন আনা হয়। সর্বশেষ সময়ের প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম দেওবন্দের পাঠ্যসূচিকেও সাজানো হয় দরসে নেজামিকে মূল রেখেই।

ভারতবর্ষে যুগ যুগ ধরে চলে আসা মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থায় কোন ধারা-উপধারা ছিল না। ছিল না ধর্মীয় ও জাগতিক শিক্ষার কোন বিভাজন। একই প্রতিষ্ঠানে একই শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় ও জাগতিক উভয়ধরণেরই শিক্ষা দেওয়া হত। শিক্ষা শেষে প্রত্যেকের বিশেষ পাঠ্যবিষয় ও দক্ষতা অনুযায়ী সনদ ও পদবি দেওয়া হতো। মাদরাসা থেকে শিক্ষা সমাপ্তকারীরা শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রশাসন, বিচার বিভাগ সহ রাষ্ট্রের সকল অঙ্গনে কর্মে নিয়োজিত হতেন। ফলে মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় ও জাগতিক শিক্ষিত বলে কোন বিভাজন ছিল না।

সূত্র :
১. আস সাকাফাতুল ইসলামিয়্যা ফিল হিন্দ, আবদুল হাই হাসানি নদভি।
২. হিন্দুস্তান কি কাদিম ইসলামি দরসগাহেঁ, আবুল হাসানাত নদভি।
৩. https://cutt.ly/XJL21Y7

আগের সংবাদপ্রস্তাবিত বাজেট মন্ত্রিসভায় অনুমোদন
পরবর্তি সংবাদপদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে ২৫ জুনের এসএসসি পরীক্ষা ২৪ জুন