রাকিবুল হাসান নাঈম:
বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত ইসলামি সংগীতের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছে। সংগীতের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও জনপরিসরে ইসলামি ভাবধারার সংগীত সোশ্যাল মিডিয়া ও প্রযুক্তির কল্যাণে ব্যাপক সমাদৃতি পাচ্ছে। ফলে ইসলামি অঙ্গনে গড়ে উঠেছে বেশকিছু সংগীত-দল। সংগীত-দলের বাইরে থেকে ব্যক্তি পর্যায়েও গানের চর্চা করছেন অনেকে। সবার সুর ও মেধায় ভর করেই বিস্তৃত হচ্ছে ইসলামি সংগীতের জগত। সংশ্লিষ্টগণ বলছেন, কথা, সুর ও বুননে ইসলামি সংগীতে এখন একটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আগে কেবল হামদ ও নাত গাইলেও এখন শিল্পীরা জীবনমুখী সংগীতও করছেন। ফলে সংগীতগুলো আগের তুলনায় বেশি মানুষের হৃদয় স্পর্শ করতে পারছে।
ফেসবুক ইউটিউবে বাড়ছে শ্রোতা
ইসলামি সংগীতের বিস্তৃতির ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখছে ফেসবুক ইউটিউব। করোনার আগে ব্যাপকভাবে কনসার্ট হলেও করোনার পর তা কমে গেছে। ফলে ফেসবুক ইউটিউবই সংগীত ছড়িয়ে দেয়ার একমাত্র মাধ্যম হয়ে উঠেছে। শ্রোতাগণও নিচ্ছেন বেশ ভালো করেই। নিত্য নতুন তৈরী হচ্ছে নতুন মাইলফলক।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় সংগীতশিল্পী আবু উবায়দার সঙ্গে। তিনি একইসঙ্গে গীতিকার, সুরকার ও কম্পোজার। ইউটিউবে তার সাবসক্রাইবার ৩ লাখ ২৫ হাজার। ফাতেহকে তিনি জানান, ‘ইসলামী সংগীতের প্রচারে অবশ্যই ফেসবুক ইউটিউবের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। নয়ত এত মানুষের কাছে সংগীত পৌঁছত কিভাবে।’ আবু উবায়দা জানান, ১৩ আগস্ট তার চ্যানেলে ‘আস সুবহু বাদা’ শিরোনামে একটি সংগীত প্রকাশ করেন। প্রকাশের দুই মাস না পেরুতেই গানটি উঠে এসেছে তার সবচে বেশিবার শোনা গানের তালিকার প্রথমে। ফেসবুক-ইউটিউব মিলিয়ে এ গানটির ভিউ ১০০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে।
গত দু’ এক বছরে অনেকগুলো গান ইউটিউবে কয়েক মিলিয়ন ভিউ পার করেছে। এরমধ্যে কলরবের সংগীতশিল্পী আহমদ আব্দুল্লাহর গান ‘ইশকে নবী জিন্দাবাদ’ কেবল ইউটিউবে ভিউ হয়েছে ১৪ মিলিয়ন। গানটি প্রকাশ পেয়েছে হলি টিউনে। আহমদ আব্দুল্লাহর নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলও রয়েছে। তাতে ১ লাখ ৪০ হাজার সাবসক্রাইবার রয়েছে। সেই চ্যানেলের কোনো কোনো গানের ভিউ মিলিয়ন স্পর্শ করার পথে।
বর্তমান ইসলামি সংগীতের জগতে চেনামুখ শেখ এনাম। তার সবচে বেশি আলোচিত সংগীতের নাম ‘ইশক কি রং মে’। গানটি প্রকাশ করেছে সিরাত মিডিয়া”। ভিউ পেয়েছে ৪.৬ মিলিয়ন। শেখ এনাম জানান, ফেসবুকের ভিউ ধরলে কত হবে, সেটা বলা যাচ্ছে না।
কেন জনপ্রিয়তা বাড়ছে ইসলামি সংগীতের?
ইসলামি সংগীতের জনপ্রিয়তা বাড়ার পেছনে বিভিন্নজন বিভিন্ন কারণ দেখিয়েছেন। প্রত্যেকেই তুলে ধরেছেন তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। তবে সবাই একটা কথা স্বীকার করেছেন, এর পেছনে সবচে বড় কারণ সবার সম্মিলিত আন্তরিক প্রচেষ্টা।
আবু উবায়দা ফাতেহকে বলেন, কারও একক প্রচেষ্টায় ইসলামি সংগীতের এ জনপ্রিয়তা তৈরী হয়নি। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এটা হয়েছে। ২০০১ সাল পর্যন্ত আমরা ভালো ভালো গান পেয়েছি। এরপর দীর্ঘ সময় আমরা কালজয়ী গান পাইনি। ২০১৫ সালের পর ইসলামি সংগীতের জগতে নতুন একটা জোয়ার শুরু হয়। বছর খানেক আগে হলি টিউনের অফিসে আমরা সংগীতশিল্পীরা একত্রে বসেছিলাম। পরামর্শ করেছিলাম, কিভাবে ইসলামি গানের জগতকে বিস্তৃত করা যায়। সবাই পরামর্শ দিয়েছিল, কন্টেন্ট ভালো করতে হবে। তারপর সবাই ভালো করার চেষ্টা করেছে, তার একটা ফলও দেখতে পাচ্ছি।’
আবু উবায়দা আরও জানান, ‘ইসলামি সংগীতের জগতে এখন বিরহ, বেদনা, অনুভব, রোমান্টিকতাও আসছে। ফলে মানুষ ভাবছে, মিউজিক দিয়ে না শুনে বরং মিউজিক ছাড়া এ গানগুলো শুনলে ভালো। তাই তারা এগুলো বেশি শুনছে, ভাবছে। মানুষের অনুভব চাঙ্গা করে, মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে, এমন সংগীত আমাদেরকে আরও বেশি গাইতে হবে।’
ইসলামি সংগীতের জগতে জনপ্রিয় একটি নাম হলি টিউন। ইসলামি সংগীত প্রকাশকারী এই ইউটিউব চ্যানেলের সাবসক্রাইবার ৬.২৯ মিলিয়ন। চ্যানেলটিতে বিশেষভাবে কাজ করছেন দেশের জনপ্রিয় ইসলামী সংগীতের শিল্পীগোষ্ঠী কলরবের শিল্পীরা। এর সিইও হিসেবে রয়েছেন কলরবের সিনিয়র শিল্পী ও নির্বাহী পরিচালক মুহাম্মাদ বদরুজ্জামান। এই চ্যানেলের বেশ কয়েকটি গান ৫০ মিলিয়ন ভিউ পার করেছে। এত জনপ্রিয়তার পেছনে বাণিজ্যিক ব্যবহারকেই কারণ হিসেবে দেখছেন তিনি। ফাতেহকে তিনি বলেন, ইসলামী সংগীতের বাণিজ্যিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে ‘হলিটিউন’ ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। ইসলামী সংগীতের বাণিজ্যিক ব্যবহার না হলে এ ইন্ডাস্ট্রি টিকবে না। সংগীত দিয়েই সংগীতের খরচ উঠানোসহ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের জীবন-জীবিকা পরিচালিত হলেই তবে এই ইন্ডাস্ট্রি সামনে এগোবে। শ্রোতাদের মতামত বিবেচনা করলে বুঝা যায়- হলিটিউনের ব্যবস্থাপনায় ইসলামী সংগীতের বাণিজ্যিক কার্যক্রমের মাধ্যমে সবচেয়ে বড় উপকার হলো ব্যাপকভাবে মানুষের কাছে ইসলামী সংগীত পৌঁছেছে। ইতোমধ্যে ইসলামী সংগীতের একটি বড় বাজার তৈরি হয়েছে। ‘শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাতে হবে’ এ প্রতিযোগিতা অব্যাহত থাকায় এটি সম্ভব হয়েছে।
মানুষের হামদ ও নাতপ্রীতি ইসলামি সংগীতের জনপ্রিয়তায় বেশ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন শেখ এনাম। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘ইসলামী সংগীতের পরিসর বৃদ্ধি হচ্ছে। যেমন আগে কেবল হামদ ও নাত হতো। এখন এ দুটোর মাঝামাঝি জীবনমুখী সংগীতও হয়, যেগুলো মানুষকে খুব স্পর্শ করে। ফলে মানুষ শোনেও বেশি।’
লিরিক ও সুরের অভাব
ইসলামি সংগীতের জনপ্রিয়তা বাড়লেও লিরিক ও সুরের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সবাই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কখনও ভালো লিরিকের অভাবে ভালো গান হয় না। কখনও লিরিক ভালো হয়, কিন্তু ভালো সুরের অভাবে ভালো গান হয় না, হৃদয় স্পর্শ করে না।
এ প্রসঙ্গে আবু উবায়দা ফাতেহকে বলেন, ‘ইসলামি গানের জগতে এখন ভালো লিরিকের খুব অভাব। যারা আসলেই লিখতে পারেন, তারা অনেকেই লিখেন না। কারণ, এখানে গীতিকারের কদর করা হয় না। সুরকারও টাকা পায়, কিন্তু গীতিকার টাকা পায় না। তাহলে মেধাবী লেখকরা এখানে মেধা খাটাবে কেন?’ এ সঙ্কট কাটাতে চেষ্টা করছেন বলেও জানান তিনি।
এ সঙ্কটের কথা স্বীকার করেছেন আহমদ আব্দুল্লাহ। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘গীতিকাররা এখানে অবহেলিত। আমি নিজেই তো লিরিক বিক্রি শুরু করেছি অনেক পরে। আমি যত গান লিখেছি, তার অর্ধেক গান লিখে আমি কোনো টাকা পাইনি। কিন্তু তবুও লিখে গেছি।’ এখন সবচে দামে ইন্ড্রাস্ট্রিতে তার লিরিক বিক্রি হয় বলেও দাবি করেন তিনি।
তবে লিরিকের অভাবের চেয়ে সুরের অভাবকে বেশি প্রকট করে দেখছেন বিশিষ্ট গীতিকার তানভির এনায়েত। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘একটা লিরিক সাধারণ হলেও সুরকারের সুর বসানোর কারণে সেটা আসাধারণ হয়ে যায়। শুধু সুরের পারফেক্ট ব্যবহারের কারণে গানটা হয়ে উঠে মধুর, বোধগম্য। কিন্তু আমাদের ইসলামি গানের জগতে দক্ষ সুরকারের অভাব। একটু অন্যরকম লিরিক হলেই তারা সুর বসাতে পারেন না।’ এর উদাহরণ দিয়ে তানভির এনায়েত বলেন, ‘অনেক ইসলামি গানের শিল্পী বিগ বাজেট পেলে তার গানের সুর করে দেয়ার জন্য শফিক তুহিন ও বাপ্পা মজুমদারের দারস্থ হন।’