রাকিবুল হাসান নাঈম:
আগামী ২০২৩ সাল বিশ্ববাসীর জন্য সংকটের বছর হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আবহাওয়া পরিবর্তন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ বৈশ্বিক নানা কারণে আগামী বছরটি মন্দার হবে বলে আভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ইতোমধ্যে সেই মন্দা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে বাংলাদেশেও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে উদ্বেগের সঙ্গেই এ রকম কথা বলছেন। তিনি সম্প্রতি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করে এসেছেন। ভ্রমণের সময় বিশ্বের বহু নেতা ও রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরাই নাকি তাঁকে আসছে ২০২৩ সালে মন্দা ও দুর্ভিক্ষের আভাস দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এডিবি, আঙ্কটাডসহ বিশ্বখ্যাত গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও দাতাসংস্থাগুলোর পূর্বাভাস তুলে ধরেও খাদ্যসংকট ও দুর্ভিক্ষের শঙ্কার কথা বলছেন।
তার বক্তব্য কতটা উদ্বেগের? আসলেই কি দুর্ভিক্ষ আসছে? দেশের আলেম সমাজ কী ভাবছেন?
‘প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য হালকাভাবে নেয়া যাবে না’
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য হালকাভাবে নেয়া যাবে না বলে মনে করেন আলেম লেখক ও গবেষক ড. আ ফ ম খালিদ হুসাইন। তিনি ফাতেহকে বলেন, একজন প্রধানমন্ত্রী যখন দুর্ভিক্ষের আগাম বার্তা শোনান, তার বার্তাকে হালকাভাবে নেয়া যাবে না। তিনি সবদিক বিবেচনা করেই কথা বলেন। তিনি বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যপণ্যের ঘাটতি, জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি, অস্বাভাবিকভাবে ডলারের দর বাড়ার ফলে দেশে যে টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এটা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছেন; এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে এর প্রভাব কেমন হতে পারে, তারও একটা হোমওয়ার্ক করেছেন। তারই আলোকে তিনি বারবার মানুষকে সতর্ক করছেন এবং সময় থাকতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছেন। আমি মনে করি, এটা খুবই ইতিবাচক যে প্রধানমন্ত্রী এটা নিয়ে আগেভাগেই ভেবেছেন।’
বাংলাদেশের সামনে সংকটগুলো তুলে ধরে এই আলেম গবেষক বলেন, আমাদের রিজার্ভ আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। ডলার আয়ের সবচেয়ে বড় খাত রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। গত মাসে দুটোই কমেছে। আমরা রফতানি কম করি, আমদানি বেশি করি। আমাদের অনেক মেগা প্রজেক্ট রয়েছে। যেগুলোর ঋণ পরিশোধ করা শুরু হবে ২০২৩ সালে। ফলে সবদিকে দিয়েই বাংলাদেশে একটা সংকটের মুখে আছে। এই সংকট কাটানোর জন্য পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে হবে।
সংকট কাটানোর জন্য কী করা যেতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, খাদ্য মজুত করতে হবে। উৎপাদশীলতা বাড়াতে হবে। কোনো পতিত জমি অনাবাদ রাখা যাবে না। কৃষির জন্য সার দরকার। বাংলাদেশের ৮৬ ভাগ পটাশিয়াম সার রাশিয়া থেকে আসে। অন্যান্য সারও আসে বিভিন্ন দেশ থেকে। এখন থেকেই আমাাদেরকে সার এনে মজুত করতে হবে। শুধু মজুত না, সার তৈরী করতে হবে। চাল, তেল , গমসহ আরও বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবারপণ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। সরকারকে পারিকল্পনামাফিক এসব করতে হবে।
তিনি বলেন, পরিকল্পনামাফিক কাজ করলে আসন্ন দুর্ভিক্ষে আমরা সহনীয় দিন যাপন করতে পারবো।
সিপিডির গবেষণা
বৈশ্বিক মন্দা এবং সুপরিকল্পনার অভাবে সত্যিই বাংলাদেশ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে যাচ্ছে বলে এক গবেষণায় জানিয়েছে অর্থনীতির থিঙ্ক ট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। গবেষণায় বলা হয়েছে, বর্তমানে ৭টি সঙ্কটের মুখে বাংলাদেশ। সেগুলো হলো—ডলার সঙ্কট, জ্বালানি সঙ্কট, মূল্যস্ফীতি সঙ্কট, খাদ্য সঙ্কট, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ সঙ্কট, করোনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সঙ্কট।
গবেষণায় বলা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে এ ৭টি সঙ্কট বাংলাদেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতির পথে কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামী ছয় মাস-এক বছরের মধ্যে তা কেটে যাবে, এমনটি মনে করার শক্ত কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে স্বল্পকালীন পদক্ষেপ হিসেবে সঙ্কট উত্তরণের একমাত্র পথ হলো জাতীয়ভাবে ব্যয় সাশ্রয়ী পদক্ষেপের সঙ্গে থাকা এবং ব্যয়ের খাতে শুধু উৎপাদনশীল খাতেই বিনিয়োগ করে যাওয়া যাতে তার রিটার্ন আসে।
দুর্ভিক্ষ এড়াতে সিপিডির বলছে, এখনই খাদ্য মজুদ গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর ৪৫টি দেশ খাদ্য সঙ্কটের আশঙ্কায়। অথচ বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তা গড়ে তোলা হয়নি। মানুষ খাবার কমিয়ে দিলেও কমপক্ষে ২৯টি খাদ্যসামগ্রী আমদানিতে বর্তমানে উচ্চ কর ও শুল্ক আদায় হচ্ছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ওপর আমদানি শুল্কের হার কমানো ও বেসরকারি খাতে মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় বেতন বাড়াতে হবে। সার্বিকভাবে এ বহুমুখী সঙ্কট উত্তরণের উত্তম সমাধান হলো অতি দ্রুত কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, অর্থ মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, বিডাসহ বেসরকারি খাত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয়ভাবে বহুমুখী সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন করা। যাতে বাস্তবায়ন পর্যায়ে কোনো একটি উদ্যোগে আরেকটি সংস্থা, বিভাগ বা মন্ত্রণালয় বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।
উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি ‘বিশ্বে কি মন্দা আসন্ন’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতির তিন মূল চালিকাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপের অর্থনীতি দ্রুত গতি হারাচ্ছে। ফলে আগামী বছরে সামান্য আঘাতেও মন্দা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। সেই প্রতিবেদনের পরই মূলত মন্দার বিষয়টি আলোচনায় আসে। ৪ অক্টোবর দুর্গোৎসব উপলক্ষে এক মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম মন্দার বিষয়টি জোরালোভাবে আলোচনা করেন। এরপর ৬ অক্টোবর বিকেলে গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত বলেন সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী একটা আশঙ্কা, ২০২৩ সাল একটা মহাসংকটের বছর হবে। সেজন্য আগে থেকেই আমাদের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টা বেশি বিবেচনা করা দরকার। যার যার জায়গা আছে, চাষ শুরু করে দেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্য যেটুকু বিদ্যুৎ দরকার সেটুকু দিতে পারব। জনগণের কষ্ট যেন না হয়, সে দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিচ্ছি।’