দ্বিতীয় দশকের বাংলাদেশ: সেকুলারিজম এর প্রথম দশকে ইসলাম

মোনায়েম বিন মুজিব:

৩০ জুন, ২০১১ এ সংবিধানের ১৫শ সংশোধনী সেকুলারিজমকে পুনর্প্রতিষ্ঠিত করে। তখনও স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তির মাত্র কয়েকমাস বাকি। স্বাধীনতার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে সেকুলারিজমের পরিবর্তে ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ প্রতিস্থাপন করা হয়। তাই দীর্ঘ ৪ দশকের মাত্র ৫ বছরেরও কম সময় বাংলাদেশ ছিল সাংবিধানিকভাবে সেকুলার রাষ্ট্র। এই দীর্ঘ সময় বরং “আল্লাহর উপর পূর্ন আস্থা ও বিশ্বাস” তথা ইসলামী একত্ববাদ ছিল রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি। কিন্তু ২০০৫ সালে হাইকোর্ট বিভাগের এক রায়ে ৫ম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এতে হাওয়া উল্টো দিকে বইতে শুরু করে। ২০১০ সালে আপিল বিভাগ তার রায়ে হাইকোর্ট বিভাগের রায় বহাল রাখলে সংবিধানে সেকুলারিজম ফিরে আসার পথ সুগম হয়। ২০১০ সালে আপিল বিভাগ রিভিউ আবেদনও খারিজ করে দেয়। কিছুদিনের মধ্যেই ১৫শ সংশোধনী পাশ করে সেকুলারিজমকে পুনর্বহাল করা হয়। ফলে বাংলাদেশ আবারও সাংবিধানিকভাবে সেকুলার রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

এরপর এক দশকের বেশি সময় গত হয়েছে। বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূরণ করেছে। এই অর্ধশত বছরের মাঝে দুই মেয়াদে সেকুলারিজমের জীবন কাল দুই দশকেরও কম। তাই একথা স্পষ্ট যে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকই বাংলাদেশে সেকুলারিজমের প্রথম দশক।

শুরুতেই একটা নোট দিয়ে রাখি। বাংলাদেশের সংবিধানে সেকুলারিজমের বাংলা হিসেবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু তা প্রতিশব্দ হিসেবে বহূল বিতর্কিত রয়ে গেছে। তাই আমি এ লেখায় সেকুলারিজম শব্দটিই ব্যবহার করব।

অন্যান্য মুসলিম দেশে সেকুলারিজমের বিভিন্ন চরিত্র দেখা গেছে। যেমন তুরস্কে সেকুলারিজম এসেছিল আগ্রাসী রূপে। মুসলিমদের নিতান্ত ধর্মীয় স্বাধীনতা দিতেও তারা ছিল অনিচ্ছুক। উল্টো সেকুলারিজম যেন ইসলামের সকল নিশানা মুছে ফেলার ক্রুসেড ঘোষণা করেছিল। আবার মিশর কিংবা সিরিয়িায় দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। সেখানে সেকুলারিজম শত্রুতামূলক মনোভাব দেখায়নি। বরং একরকম সহাবস্থান বা সীমিত পরিসরে জায়গা দেয় ধর্মীয় অঙ্গনকে। বাংলাদেশে সেকুলারিজমের প্রথম দশক কেমন ছিল? সেকুলার বাংলাদেশে ইসলামের অবস্থান কোথায় ছিল তা অনুসন্ধান করাই এ লেখার উদ্দেশ্য।

বাংলাদেশে সেকুলাজিমের প্রথম সংক্ষিপ্ত জীবন যেমনই হোক তার পুনরুত্থানের পিছনে বেশ কটি যুক্তি দেখানো হয়। এর একটি হলো বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়া। তবে সবচেয়ে বড় যুক্তি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সমঅধিকার নিশ্চিত করা। সেকুলারিজমের বাংলা প্রতিশব্দ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ থেকেই তা বুঝা যায়। বাহাত্তরের সংবিধান রচনাকালীন বিতর্কও তা পরিষ্কার করে। সেখানে সেকুলারিজমের অন্তর্ভুক্তির প্রধান যুক্তি ছিল সব ধর্মের সমানাধিকার বা অসাম্প্রদায়িকতা। অর্থাৎ এখানে সেকুলারিজম মানে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে তথা সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ইসলামকে আলাদা করা লক্ষ্য নয়। বরং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের জন্য সমানাধিকার নিশ্চিত করাই হলো মূল উদ্দেশ্য। তাই এখানে রাষ্ট্র সেকুলার হলেও রাষ্ট্রধর্ম নামের একটা অনুচ্ছেদও যুক্ত করা আছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র সেকুলার হলেও তার ধর্ম ইসলাম! এটাকে কোনো কোনো গবেষক ইতোমধ্যে ‘ইসলামী সেকুলারিজম’ বলে অভিহিত করেছেন।

সংখ্যালঘু সুরক্ষায় সেকুলারিজম কতটুকু জরুরী বা কার্যকর সে আলাপে আমি যাব না। কিংবা সেকুলার রাষ্ট্রে রাষ্ট্রধর্ম এর বিধান কতটুকু যৌক্তিক বা আইনসম্মত তা আলোচনা করাও আমার উদ্দেশ্য না। এ লেখায় আমি দেখাতে চেষ্টা করব যে, যে উদ্দেশ্যেই সেকুলারিজম এর পুনরুত্থান ঘটানো হোক না কেন গত এক দশকে রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ইসলামের অবস্থান ও অংশগ্রহণ ক্রমেই সংকুচিত হয়েছে। অন্যদিকে গত দশক ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য পূর্ণ সেকুলারিজম প্রতিষ্ঠার এক প্রস্তুতিপর্ব যার বিভিন্ন নিদর্শন ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। এ জন্য রাজনীতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে আমার টেস্ট কেস হিসেবে ব্যবহার করব। সবশেষে বর্তমান চিত্রের বিবরণ দিয়ে আমার আলোচনা শেষ হবে।

১. রাজনীতি

প্রথমেই আসা যাক রাজনীতির কথায়। বাংলাদেশে সেকুলারিজম প্রতিষ্ঠার অন্যতম অনুষঙ্গ হলো ধর্মভিত্তিক রাজনীতি তথা ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। দেশে ইসলামী রাজনীতির প্রধানতম প্রতিনিধি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ইতোমধ্যেই আদালতের আদেশে তার দলীয় নিবন্ধন হারিয়েছে। আদালতের আদেশে তার নির্বাচনী প্রতীকও বাতিল করা হয়েছে। তাই তারা দলীয় পরিচয়ে আর কোনো নির্বচনে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। যুদ্ধাপরাধের চলমান বিচারে দলের শীর্ষনেতাদের ইতোমধ্যেই ফাঁসি হয়েছে। কেউ কেউ কারাগারে দন্ডরত অবস্থায় মারা গেছেন বা দন্ডরত আছেন। বিচার চলমান রয়েছে কারো কারো। প্রকাশ্য রাজনৈতিক কার্যক্রম অঘোষিতভাবেই নিষিদ্ধ হয়ে আছে। সবমিলে জামায়তের রাজনীতি একটি সন্ধিক্ষণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এটি বলাই যায়।

অন্যান্য ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থাও কমবেশি অনুরূপ। মাঝে অরাজনৈতিক আবরণে হেফাজতে ইসলাম এর উত্থান হলেও তা এখন নিষ্প্রভ। অন্যান্য ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর আঞ্চলিক প্রভাব থাকলেও জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতি বা রাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করার পর্যায়ে নেই। মোটকথা, রাজনৈতিক অঙ্গনে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো বলার মতো কোনো অবস্থানে নেই। এমতাবস্থায়, রাজনীতিতে সেকুলারায়নের উদ্দেশ্য অনেকটাই বাস্তবায়িত হয়ে গেছে বলা যায়।

বাকী থাকে বিএনপির কথা। কেননা জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিএনপিই সর্বপ্রথম সংবিধানে সেকুলারিজমের বদলে ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ স্থাপন করেছিল। সেকুলারিজমের প্রত্যাবর্তনে বিএনপি প্রথম দিকে প্রতিবাদী হলেও ক্রমেই তাদের আন্দেলন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সুষ্ঠু নির্বাচন, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রের পুন:প্রতিষ্ঠা ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। অদূর ভবিষ্যতে বিএনপি সেকুলারিজমের পরিবর্তে ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনর্স্থাপন করতে চাইবে তা বলা মুশকিল। তাই সাংবিধানিক রাজনীতিতে বাংলাদেশ সেকুলার রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আর এ অবস্থা সহসাই পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।

২.  শিক্ষাঙ্গন

শিক্ষাঙ্গনের ব্যাপারটা একটা জটিল কেস আমাদের সামনে হাজির করে। গত এক দশকে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় নামে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এটি ছিল আলিয়া মাদরাসাগুলোর দীর্ঘদিনের দাবি। অন্যদিকে দেশের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় শিক্ষাধারার পতাকাবাহী কওমী মাদরাসাগুলো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছে। হেফাজতে ইসলামের সাথে কথিত সমঝোতার মাধ্যমে স্কুল পাঠ্যক্রমেও কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষাঙ্গনগুলোকে যেই মাত্রায় সেকুলারায়ন করা হয়েছে তার তুলনায় এগুলো একেবারেই নগণ্য। কেন তা ব্যাখ্যা করছি।

গত এক দশকে ডজন দুয়েক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সব মিলে এখন সরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫২ টি। এসময় একটিও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ই একমাত্র বাতিঘর হয়ে আছে। যদিও সেটি ইতোমধ্যেই সেকুলার প্রশাসনের হাতে গিয়ে তার মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হতে শুরু করেছে।

এই সময়ে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও পঞ্চাশের অধিক। এদের মাঝে একটিও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় নয়। পূর্বে প্রতিষ্ঠিত তিনটিই এখনো বেসরকারি পর্যায়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তদুপরি, সম্প্রতি এসকল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় আমূল পরিবর্তন এনে সরকার ঘনিষ্ঠ সেকুলার ব্যক্তিদের বসানো হয়েছে। এসকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী চরিত্র কতটুকু অক্ষুণ থাকে তা সময়ই বলে দেবে।

ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা কিংবা কওমী মাদরাসার স্বীকৃতি কোনোটাই অবস্থার বিন্দুমাত্র উন্নয়ন নয়। বরং অবস্থার স্বীকৃতি মাত্র। আরবি বিশ্ববিদ্যালয়কে বড়জোড় আলিয়া মাদরাসার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায়। এ স্বীকৃতি ইসলামী অঙ্গনে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জরুরত পূরণে আদৌ কোনো ভূমিকা রাখছে কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এখনো পর্যন্ত ইসলামী বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য আরব দেশগুলো বা মালয়েশিয়া-তুরস্কই প্রধান গন্তব্য হয়ে আছে। এর মানে এই নয় যে সেকুলার প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশ্বমানের গবেষণা চলছে। নিশ্চয়ই সেগুলোর অবস্থাও করুণ। কিন্তু তুলনামূলকভাবে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ আরো মানবেতর রয়ে গেছে। সেকুলার প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারি বরাদ্দের পরিমাণ কিছুটা হলেও বেড়েছে। সে হিসেবে ইসলামী শিক্ষা তার ন্যায্য হিস্যা পায়নি।

দেশের উচ্চশিক্ষায় আশা জাগানিয়া কোনো উন্নতি নাই একথা ঠিক। কিন্তু মাদ্রাসা পড়ুয়াদের এতটুকু উচ্চশিক্ষার অভিনয় করার বিলাসিতাও নেই। কওমী সনদ দেশের কর্মবাজরে প্রবেশের নতুন কোনো পথও খোলেনি। তাই এ স্বীকৃতি আওয়ামী লীগ-হেফাজতের মধ্যকার ক্ষণস্থায়ী বন্ধনের নিদর্শন হয়েই যেন দাঁড়িয়ে আছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের একচ্ছত্র আধিপত্য বিরাজমান। যেকোনো ধরণের ধর্মীয় ছাত্রসংগঠন করা অলিখিতভাবেই নিষিদ্ধ। শুধু তাই নয়, নিছক ধর্মীয় ছাত্রসংগঠন করার অভিযোগে সাধারণ ছাত্ররা প্রায়ই হেনস্থার শিকার হয়। বুয়েটের আবরার ফাহাদ হত্যা যার জলন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। প্রশাসন ও আইন শৃংখলা বাহিনীর ভূমিকাও এক্ষেত্রে আশানুরূপ নয়। ক্রমেই সন্দেহের চোখ তীব্র হয়েছে ইসলামী আচরণ ও বেশভূষার প্রতি। নিছক সালাম দেয়া কিংবা টাখনু উপর প্যান্ট পড়াকেও জঙ্গিবাদের চিহ্ন হিসেবে নির্দেশ করার চেষ্টা হয়েছে। এর প্রতিবাদে যারা এগিয়ে  এসেছে তারাও সেকুলারিজমের দেয়া ধর্মীয় স্বাধীনতা বা লিবারেল ব্যক্তিস্বাধীনতার যুক্তিকে সামনে নিয়ে এসছে। ফলে তারাও অজান্তে বা অবচেতনে সেকুলার কাঠামোর মধ্যে ঢুকে গেছে।

মাধ্যমিকে বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম বরাবরই এক তীব্র বিতর্কের বিষয় হয়ে ছিল। বাংলা সাহিত্যের পাঠ্য গদ্য-পদ্যের সামান্য পরিবর্তনকেও সরকারের তরফে আঁতাত/আপোষের চিহ্ন হিসেবে সমালোচিত হয়েছে। অন্যদিকে ইসলাম শিক্ষা নামের পাঠ্যবইকেও ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ নামকরণ করা হয়েছে। এই নামটিই সেকুলারিজম এর আওতার মধ্যে ধর্মের জন্য বরাদ্দকৃত ব্যক্তিগত স্থানকে নির্দেশ করে। উচ্চ মাধ্যমিকে ইসলাম শিক্ষাকে ঐচ্ছিক বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে। এসকল পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি আধুনিক সেকুলার প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য যাবতীয় আয়োজন করা হয়েছে। ফলশ্র্রুতিতে রাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষাঙ্গনেও ইসলাম অধিকতর কোণঠাসা অবস্থায় উপনীত হয়েছে।

৩.  ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন

এবার আসি ধর্মীয় ও সাস্কৃতিক অঙ্গনে ইসলামের অবস্থানের বিচারে। সেকুলারিজমের অধীনে গত এক দশকেরও বেশি সময় গেল। এই সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে ভিন্ন রকম এক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে যা আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি। এসকল পরিবর্তন একটু একটু করে সেকুলারিজমকে প্রথমে রাষ্ট্রে ও ধীরে ধীরে সমাজে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পেয়েছে। সেকুলারিজম এর বর্তমান কামব্যাক বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সমাজকে ক্রমেই আরো সেকুলার হিসেবে পরিগঠন করছে। বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতা একটা সেকুলার বাস্তবতা যেখানে ইসলামের অবস্থা ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে আসছে।

যুদ্ধাপরাধ এর বিচারকে কেন্দ্র করেই প্রথম একুশ শতকের বাংলাদেশে সেকুলার আন্দোলন নবজীবন ধারণ করে। অন্যভাবে বললে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বাইনারি বয়ানের উপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশে সেকুলারিজমকে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ২০১৩ সালে গজিয়ে উঠা শাহবাগ আন্দেলন। বাংলাদেশে সেকুলারিজম এর নবযাত্রায় ২০১৩ সাল তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ এক ল্যান্ডমার্ক।

সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শাহবাগ এর বৃহত্তর প্রকল্প ব্যর্থ হলেও তার আসল উদ্দেশ্য কিন্তু সফল হয়েছে। তাছাড়া সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে এর ছায়া এখনো বহাল তবিয়তেই আছে। বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইস্যুতে জেগে ওঠা বিতর্কগুলো কিন্তু তারই জানান দেয়। শাহবাগ ব্যর্থ হলেও তার পদচ্ছায়া এখনো রয়ে গেছে।

আমরা দেখেছি, সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষাই ছিল সেকুলারিজম এর পুনর্প্রতিষ্ঠার প্রধান কারণ। কিন্তু দু:খজনকভাবে বাংলাদেশে সেকুলার শাসনের অধীনে সংখ্যালঘুদের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটেছে। এমনকি শুধু সংখ্যালঘুই নয়, বাংলাদেশে সেকুলারিজম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অধিকারকেও খর্ব করেছে। ব্যক্তিজীবনে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলাকেও সেকুলারিজম সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেছে। বিভিন্ন ট্যাগ দিয়ে একধরনের ছাঁচে ফেলার চেষ্টা করেছে সবসময়। ফলে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার যুগোপৎ ট্রাম্পকার্ড দিয়ে প্রতিদ্বন্দি ইসলামকে ঘায়েল করতে চেয়েছে। রাষ্ট্রীয় সেকুলারিজম সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অধিকার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় অধিকারটুকুও কেড়ে নিয়েছে। একই সাথে সংখ্যালঘুদের ধর্ম ও জীবন বিপন্ন হওয়ার জন্য ধার্মিক মুসলিম জনগোষ্ঠীকেই দায়ী করেছে। এ অবস্থা মুসলিমদের জন্যও বহূমুখী এক সংকট সৃষ্টি করেছে।

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্রত্যেক উপজেলায় মডেল মসজিদ প্রতিষ্ঠার ঘোষণাকেও সেকুলারিজমের ভেতরে সংখ্যাগুরুকে প্রদত্ত ধর্মীয় বাড়তি সুবিধা হিসেবেই দেখা যায়। এটি কোনোক্রমেই ইসলামীকরণ নয়। তদুপরি সংখ্যাগুরু তোষনের দৃষ্টান্ত হিসেবেও এগুলো মন্দ নয়।

তাছাড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ইসলামী ফাউন্ডেশন এরই মধ্যে তার প্রতিষ্ঠাকালীন জৌলুস হারিয়েছে। এখান থেকে সেরকম গবেষণাকর্ম বা ভালো অনুবাদও আজ আর দেখা যায় না। মসজিদভিত্তিক শিশুশিক্ষা কার্যক্রম দারুল আরকাম কতটুকু সফল হচ্ছে তা এখনো কোনো ভালো গবেষণায় উঠে এসছে বলে দেখা যায়নি। বিশ্বব্যাপী হালাল অর্থনীতির ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটলেও ইসলামী ফাউন্ডেশনের হালাল সনদ প্রদান কার্যক্রম গত পাঁচ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি।

৪. ভিন্ন এক চিত্র

এখানেই শেষ নয়। রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে চাপ বাড়লেও ব্যক্তিগত দাওয়াতে একধরনের সফলতা শাহবাগ পরবর্তী বাংলাদেশে দৃশ্যমান হয়েছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের মাঝে কথিত ‘দ্বীনে ফেরা’র প্রবণতা প্রায়ই লক্ষ করা যায়। এ যেন এক কূল ভেঙ্গে আরেক কূল গড়ে উঠা! কিন্তু এই দ্বীনে ফেরার মাঝে এক দশক আগের প্রবণতাগুলোও আশ্চর্যজনকভাবে অনুপস্থিত। স্পষ্টতই এসময় একটি ভিন্ন চিন্তা ও ব্যাখ্যা বিস্তৃতি লাভ করেছে। রাজনৈতিক প্রকাশ ও বিকাশকে রুদ্ধ করায় এধরণের তাৎক্ষণিকতামুখী প্রবণতার বিস্তার ঘটেছে। তা একদিকে তরুণ প্রজন্মকে চরমপন্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। যার প্রকাশ হলি আর্টিজানসহ অন্যান্য ঘটনায় দেখা গেছে। অন্যদিকে ইসলামকে শাসন ও দমন করার মোক্ষম হাতিয়ার তুলে দিয়েছে।

২০২২ সালের অক্টোবরে এসে আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের বছরের মুখোমুখি আমরা। সাধারণত নির্বাচনের বছর বা তার আগের সময় ধর্মীয় তুষ্টিবাদী পদক্ষেপ নিতে দেখা যেত। এখন নির্বচন তার আগের জৌলুস ও গুরুত্ব হারিয়েছে। তাই এখন এরূপ সম্ভাবনা কম। ভেতরের ও বাইরের যুগপৎ ধাক্কা সামলাতে না পেরে হেফাযতও ম্রিয়মান। তাই কোনো বড় ধরনের সরকার বিরোধী আন্দোলনের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। তাছাড়া বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনীতি খুব দ্রুতই ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র নিয়ে হাজির হচ্ছে। ফলে গত এক দশকের সেকুলার (স্থিতিশীলতা?) সেকুলাজিমকে রাষ্ট্র থেকে সমাজে ছড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ  করে দিয়েছে। আগামীতে সেকুলারিকরণের পদক্ষেপগুলো পূর্বের ন্যায় বিরোধিতার মুখে পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

এছাড়াও কিছুটা নিয়ন্ত্রিত বিরোধিতা সরকারের জন্য ঘরে-বাইরে অনুকূল পরিবেশই সৃষ্টি করবে। এটা দেখাবে যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে আবার ইসলামী উত্থানের আশংকাকেও তুলে ধরবে। এরূপ পরিবেশ দেশের ভেতরে-বাইরে চলমান ক্ষমতাকাঠামোর অপরিহার্যতাই স্পষ্ট করবে কেবল। ফলে একথা বলাই যায়, চলতি দশক হয়ত বাংলাদেশকে আরো অধিক পরিমাণে সেকুলার সমাজ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেবে।

এসকল ঘটনা থেকে উপসংহারে পৌঁছা যায় যে, গত এক দশক ছিল বাংলাদেশে সেকুলারিজমকে পুনর্প্রতিষ্ঠার এক প্রস্তুতিপর্ব যার শুরু হয়েছে সংবিধানে সেকুলারিজমের পুনর্বহালের মধ্য দিয়ে। রাজনৈতিক অঙ্গনকে ইসলামী রাজনীতি মুক্ত করার মধ্য দিয়ে যার ভিত্তি মজবুত হয়েছে। এবং ক্রমেই ইসলামের সার্বিক পরিসরকে সংকুচিত করে  সেই সেকুলারিজম সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতিতে দৃশ্যমান হচ্ছে। একে রাষ্ট্র থেকে ধীরে ধীরে সমাজের পথে সেকুলারিজমের যাত্রা হিসেবেও পাঠ করা যায় যা উপর থেকে নিচে আসার দৃশ্যকে চিত্রায়িত করে।

 

আগের সংবাদআজানের সময় পূজামণ্ডপে বাদ্যযন্ত্রের শব্দ সহনীয় রাখার নির্দেশ
পরবর্তি সংবাদএবছর পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের অভিযানে ১০০ ফিলিস্তিনি নিহত