দ্বিতীয় দশকে ধর্মীয় ব্যাখ্যার নতুন সিলসিলা: ইসলামি নারীবাদের সাতকাহন

হুজাইফা মাহমুদ:

খেয়াল করলে দেখবেন, খুব ধীরে কিন্তু কার্যকরী উপায়ে ইসলামের পরিসরকে সঙ্কোচন করে আনার একটা জোরদার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। জাতীয়, আন্তর্জাতিক , রাষ্ট্রিয় ও সামাজিক, সকল ক্ষেত্রেই এই প্রক্রিয়ার দৃশ্যমান উপস্থিতি লক্ষ্যনীয়।  প্রফেসর ওভামির আঞ্জুম  যেটাকে বলেছেন , ইসলামকে মক্কান পিরিয়ডের দিকে ঠেলে  দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, ইসলামের প্রাথমিক যুগ তথা মক্কি যুগে যেভাবে কুরায়েশের মুশরিকরা সম্মিলিত হয়ে অস্ত্রের জোরে ইসলামের দাওয়াতকে ঠেকিয়ে রাখতে, এবং  ইসলামের পরিসরকে ক্ষুদ্র একটি বৃত্তের ভেতর বন্দি করে ফেলতে চেয়েছিলো,  সেই একই প্রচেষ্টার পূণরাবৃত্তি হচ্ছে এখন। ইসলামের অনেক নুসুস এবং শরিয়াহর অনেক বিধান আপনি এখন আর জন-পরিসরে সামনে আনতে পারবেন না। এমন কি রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত এমন অনেক মুসলিম সমাজ থেকেও এই পরিবেশটাকে নাই করে দেয়া হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে নারীদের সম্পর্কে শরিয়াহর বিভিন্ন নুসূস এবং ফিকহি বিধানাবলী, যা ইসলামের শুরু থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত সকল স্থান ও কালে সমানভাবে চর্চিত ও পালিত হয়ে আসছে,   সেগুলো কে সামনে আনা যায় না। আমাদের বক্ষমাণ আলোচনার মূল উদ্দেশ্যও তাই।

যেমন, বাংলাদেশের মতো ধর্মীয় রক্ষণশীল একটি মুসলিম সমাজে নারীদের সম্পর্কিত অনেক আয়াত, হাদিস ও ফিকহি বিধান নিয়ে খোলামেলা আলোচনা ক্রমেই একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হয়ে পড়ছে। সেখানে পলিটিক্যাল কারেক্টনেস বজায় রাখা কিংবা বিশেষ কোন কোন শ্রেণীর মনস্তত্ত্ব মাথায় রাখার ব্যাপার সামনে আসছে। ধরুন কোন জন-পরিসরে, চাই সেটা ওয়াজের ময়দানে কিংবা  সাধারণ কোন ফেইসবুক পোস্টে, আপনি বললেন, ইসলাম নারীর জন্য তার স্বামীর আনুগত্য কে আবশ্যক করে দিয়েছে। কোন যৌক্তিক ও শরঈ কারণ ব্যাতীত স্বামীর অবাধ্যতা করা তার জন্য বৈধ নয়, সে এতে গুনাহগার হবে। কিংবা সেই হাদিসটা পাঠ করলেন,যেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি আমার পর এই উম্মতের পুরুষদের জন্য নারীর চাইতে বড় আর কোন ফিতনা রেখে যাইনি। কিংবা প্রসঙ্গ ক্রমে সেই আয়াতের কথা বললেন, যেখানে আল্লাহ্‌ স্বামীদের কে ক্ষেত্র বিশেষে স্ত্রীদের শাসনের অধিকার দিয়েছেন, সীমিত প্রহার কিংবা শয্যা পৃথক করার মাধ্যমে।

নিঃসন্দেহে এগুলো শরিয়াহর নুসুস এবং অকাট্য বিধান। কিন্তু এতটুকু বলার জন্য আমি নিশ্চিত আপনি বিভিন্ন দিক থেকে চ্যালেঞ্জ ও ঘোরতর আপত্তির মুখোমুখি হবেন।  এবং চ্যালেঞ্জগুলো সেক্যুলার লিবারেল ফেমিনিস্ট হিসেবে বিখ্যাত এমন কারও কাছ থেকে আসবেনা, তাদের প্রসঙ্গ বাদই থাক, বরং খোদ ধর্মীয় মুসলিমদের মধ্য থেকেই আসবে। যারা হয়তো ধর্মের আচরনীয় ও পালনীয় বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে পালন করে, এবং শরিয়াহর কোন বিধানকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করেনা, কিন্তু এমন নির্জলা কথা শুনার জন্যও তারা মানসিকভাবে প্রস্তুত না। এর ফলে তাদের মাঝে বিভিন্ন স্তরের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কেউ উদ্ধত্যের চরম শিখরে পৌঁছে এগুলো কে সরাসরি অস্বীকার করবে, এবং এই সদম্ভ ঘোষণা দিবে যে- এসব ছাড়াই আমি দ্বীন পালন করবো। কেউ হয়তো এক নিদারুণ অস্বস্তি ও দ্বিধায় ভুগতে থাকবে, সত্যিই কি আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূল এমন  “পক্ষপাতমূলক” কথা বলতে পারেন?   আবার কেউ এই কথাগুলোর তুলনামূলক সহজ ও তাঁর মনোবৃত্তির কাছাকাছি হয় এমন ব্যখ্যার জন্য মরিয়া হয়ে ছুটবে। এবং কোথাও পেয়ে গেলে এর সত্যাসত্য যাচাই না করে এবং বাস্তবতা উপেক্ষা করে সেটাকেই আঁকড়ে ধরবে।

বাংলাদেশে এই অধ:পতিত ও বিপদজনক চিন্তা প্রবণতার ব্যাপক বিকাশ কখন ও কিভাবে ঘটেছে, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল । কিন্তু আমার ব্যাক্তিগত অনুমান হলো গত দশকের যে সময়টা থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং সকলের অংশগ্রহণ ঘটেছে, পৃথিবীর সকল প্রান্তের সবধরণের মানুষ একই প্লাটফর্মে উঠে এসেছে, ঠিক সে সময়ে আমরা এমন একটা প্রজন্মের সরব উত্থান টের পাই। কারণ যোগাযোগ মাধ্যমের সহজলভ্যতায় মানুষের চিন্তা ও  আদর্শের অবাধ বিনিময় লক্ষ্যণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। হয়তো এরই সূত্র ধরে এ দেশের প্রেক্ষাপটেও আমদানি হয়েছে “ইসলামিক ফেমিনিজম” বা ইসলামী নারীবাদ নামক প্রপঞ্চটির। এবং যথারীতি কয়েকজন মানুষের অগ্রণী ভূমিকা ও প্রচেষ্টায় এর ব্যাপক বিস্তার ও বিকাশ ঘটেছে। বর্তমানে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলিম নারীদের মাঝে এই চিন্তা প্রবণতা দ্রুত হারে ছড়িয়ে পড়ছে এবং যেকোন পর্যায়ে তারা এর মাধ্যমে প্রভাবিত হচ্ছেন।

এ দেশে নারীবাদ বহু বছর ধরেই  চর্চিত হয়ে আসছে। কিন্তু সেটা একটা বিশেষ শ্রেণী বা চিন্তা ঘরানার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো, নির্দিষ্ট করে বললে কামালিস্ট বা র‍্যাডিক্যাল সেক্যুলারপন্থিদের মাঝে। জনপরিসরে পশ্চিম  থেকে আমদানিকৃত  এই মতবাদটি কখনও জনপ্রিয়তা পায়নি। বরং ধর্মের সাথের এর সংঘাতের ব্যাপারটি স্পষ্ট থাকায় মানুষ খুব সহজেই একে এড়িয়ে যেতে পারতো। কিন্তু একই মতবাদ যখন ইসলামের পোষাক পরিহিত হয়ে আসলো তখন আমরা ভিন্ন চিত্র দেখতে পেলাম। যে রক্ষণশীল ধর্মীয় সমাজের  লোকেরা, বিশেষত নারীরা নিজেদের কে এই মতবাদ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন নিজেদের দ্বীন, ঈমান ও সমাজ রক্ষার জন্য, তারাও নামে বেনামে একে গ্রহণ করা শুরু করলেন। কেউ আংশিক, কেউ পুরোপুরি। তাদের  কেউ নিজেকে মুসলিম নারীবাদি পরিচয়ে ব্যাক্ত করেন, আবার কেউ এই পরিচয় অস্বীকার করেন তবে এর এজেন্ডাগুলোর সাথে দ্বিধাহীন ঐক্যমত পোষণ করেন এবং এগুলোর জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই করেন। বর্তমানে সংখ্যায় তারা বিপুল।

নারী, নারীবাদ ও ইসলামী নারীবাদ

দ্বিতীয়  বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সমাজ, সাহিত্য, শিল্প ও দর্শনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। ধর্ম, নৈতিকতা, মূল্যবোধ কিংবা সামাজিক আচার আচরণ, তথা যেসব বিষয়ের উপর ভিত্তি করে একটি সভ্যতার বৈশিষ্ট্য ও পরিচয় নির্মিত হয় , সেইসব পুরাতন ভিত্তিমূলকে তারা চূর্ণ বিচূর্ণ করে নতুন এক সমাজ দর্শন নির্মান করতে চেয়েছেন।  এরই ধারাবাহিকতায় পশ্চিমে নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের উত্থান ঘটে, গত শতকের ষাটের দশকে। বিখ্যাত ফরাসি লেখিকা সিমন দ্যা বেভ্যুওয়ার ( Simone de Beauvoir)  এর “দ্বিতীয় লিঙ্গ” ( The second sex) এবং কেইট মিলেট ( Kate Millet) এর ‘’লৈঙ্গিক রাজনীতি” (Sexual Politics) নামক বইগুলো এই আন্দোলনের ইশতেহার ও রোডম্যাপ তৈরী করে দেয়।  নারীবাদের প্রথম তরঙ্গ থেকে এই তরঙ্গের পার্থক্য আকাশ পাতাল। ইউরোপিয়ান সমাজে নারী সত্ত্বাকে যে দৃষ্টিতে দেখা হতো তার বিবেচনায় নারীবাদের প্রথম তরঙ্গের দাবী ও চাওয়া ছিলো একেবারেই মৌলিক এবং যৌক্তিক। কিন্তু দ্বিতীয় তরঙ্গের নারীবাদ কোন সীমা পরিসীমার ধার ধারেনি। তারা একাধারে ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র এবং মানুষের স্বভাবজাত গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য সবকিছুর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। খোদ নারী সত্ত্বাকে অস্বীকার করে তারা ঘোষণা করলেন, নারী বলতে কিছু নাই, এটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের তৈরী ধারণা। কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, সমাজ তাকে নারী বানায়। যাকে তারা সামাজিক নির্মান বা Social construction হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। এর ভিত্তিতে গোটা আন্দোলনের মূল লক্ষ্য তিনটি পদক্ষেপে বর্ণনা করা যায় এভাবে-

Construction

Deconstruction

Reconstruction

অর্থাত তারা প্রথমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, নারী হলো সমাজের তৈরী করা ধারণা। আদতে নারী বলে আলাদা কিছুর অস্তিত্ত্ব নাই, বরং সকলেই মানুষ হিসেবে সমান। তারপর নারী সত্ত্বার সেই সামাজিক নির্মাণের বিনির্মাণ বা Deconstruction করতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান ও মতবাদের উপর ভিত্তি করে এই নারী-ধারণা টিকে আছে সেগুলো থেকে নারীকে মুক্ত করতে হবে। তথা ধর্ম, সমাজ , ইতিহাস প্রতিষ্ঠিত নৈতিক মূল্যবোধ ইত্যাদি। সেসব প্রতিষ্ঠানের বিনাশ ঘটাতে হবে। কারন সেগুলো টিকে থাকা মানেই পিতৃতন্ত্র টিকে থাকা। তারপর আসে পুনঃনির্মাণ বা Reconstruction এর ধাপ। অর্থাৎ নারী পরিচয় ও সত্ত্বাকে পুনঃনির্মাণ করতে হবে। যেখানে থাকবেনা কোন ধর্মীয়, সামাজিক, রাষ্ট্রিয় কিংবা পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানের প্রভাব। এসব কিছু থেকে মুক্ত হয়ে নারী হবে তার হৃদয় ও দেহের একান্ত অধিকারী, নিজ রাজ্যে একাকি স্বাধীন মুক্ত ও বাধাহীন।

এই উদ্দেশ্যে তারা পরিবার, বিবাহ, সন্তানধারণ এবং সকল সামজিক ও  ধর্মীয় রীতিনীতির বিরুদ্ধে জোর আওয়াজ উঠালেন। পুরুষ ও পুরুষতন্ত্র থেকে মুক্তিই হয়ে উঠলো হলো নারীর চূড়ান্ত লক্ষ্য।তাদের দৃষ্টিতে কোন পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ঘর সংসার করা ,সন্তান লালন পালন  করা, সমাজের প্রথা অনুযায়ী বাধ্য হয়ে চলা নারীর জন্য চূড়ান্ত অপমান ও পরাজয়ের ব্যাপার।  এর সাথে সাথে গর্ভপাতের বৈধতা ও নারীদের যৌন স্বাধীনতার দাবীও উঠলো জোরেশোরে। এর প্রভাবে গোটা ইউরোপের সমাজ ও পরিবার ব্যবস্থাগুলো ধ্বসে পড়তে থাকে। এবং মানুষের আজীবনের লালিত  ধর্ম ও নৈতিক মূল্যবোধগুলো  বিলীন হতে থাকে।

বেভ্যুয়ারের সেই বই  এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সকল প্রান্তে নারীবাদের সবচে শক্তিশালী এবং লক্ষ্যভেদী গ্রন্থ হিসেবে পাঠ করা হয়। বেভ্যুয়ার যে স্বাধীন নারী সত্ত্বার নির্মান করতে চেয়েছেন সেই গ্রন্থে , সেটাই সকলের কাছে রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। যেন ইউরোপের নিপীড়িত নারীকূলের মুক্তির অন্যতম আলোকবর্তিকা হিসেবে আবির্ভুত হয়েছেন তিনি।

কিন্তু সত্যিই কি বেভ্যুয়ার নারীর মুক্তি ও কল্যাণ চেয়েছেন? আমরা দেখি তিনি প্রচন্ডভাবে নারী-বিদ্বেষী ছিলেন।  নারীর স্বত্ত্বা ও সৃষ্টিগত পরিচয়, কোনটাই তার পছন্দনীয় ছিলোনা। ফলে তিনি চেয়েছেন নারী সত্ত্বাকে নির্মূল করে সকলেই যেনো একজন যথার্থ পুরুষ হয়ে উঠে। সমাজের আর দশজন পুরুষের ন্যায় নারীও একজন পুরুষ হিসেবেই বাঁচবে। এমন বিকৃত নারীবিদ্বেষী চিন্তাকে কিভাবে উগ্র পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা হিসেবে আখ্যায়িত না করে নারীর মুক্তি হিসেবে কল্পনা করা যায়? বেভ্যুয়ার নিজে তার ব্যক্তি জীবনের পুরোটাতেই একাধিক পুরুষের নির্ভরতায় কাটিয়েছেন। জ্যা পল সার্ত্রের মতো ফ্রান্সের প্রভাবশালী চিন্তক ও দার্শনিকের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠেছেন। আজীবন সার্ত্রের পরিচয়ে পরিচিত হয়েছেন, তার জ্ঞান থেকে “আলোকিত” হয়েছেন। নিজে বই লিখে বিখ্যাত হওয়ার আগ পর্যন্ত সার্ত্রের দেয়া বিপুল “খরপোষে” আরামদায়ক জীবন কাটিয়েছেন।  তার বিখ্যাত বই দ্যা সেকেন্ড সেক্স লেখার পর অর্থ এবং খ্যাতী উভয়ই লাভ করলেন এবং সার্ত্রে কে বাদ দিয়ে নিজের মতো করে জীবন যাপন শুরু করলেন। সে সময়ে আমেরিকার এক ইহুদি লেখক নেলসন আলগ্রীনের সাথে তার সম্পর্ক গড়ে উঠে। নিউ ইয়র্কের কয়েক মাস দেখা সাক্ষাতের পর যে যার গন্তব্যে ফিরে যান।    একজন প্যারিসে অপরজন নিউইয়র্কে। কিন্তু সেই সম্পর্কের গভীরতা প্রগাঢ় হয় পত্র চালাচালির মাধ্যমে। সেইসব পত্রাবলী যখন পরবর্তীতে প্রকাশিত হয়ে আমাদের সামনে আসে সেখানে আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক  বেভ্যুয়ারকে দেখতে পাই। বিপ্লবী, বিদ্রোহী,  সবকিছু ভেঙে চুড়ে ফেলা বেভ্যুয়ার নন তিনি।  যার আন্দোলন ও লেখায় অনুপ্রাণিত হয়ে হাজারো নারী স্বামী, সন্তান, পরিবার ও সমাজের বন্ধন চ্ছিন্ন করে নিজেকে মুক্ত করে ফেলতে চায়, সেই বেভ্যুয়ারকে দেখা যায় সেখানে কিশোরীসুল্ভ আবেগ নিয়ে  নিজেকে একজন  একান্ত অনুগত বাধ্য প্রেমিকা হিসেবে নিবেদন করছেন তার প্রেমিকের কাছে । যার একমাত্র স্বপ্ন হলো স্বামীর সেবা করে সুখি ও সৌভাগ্যবান হওয়া।  ঠিক একজন গ্রামীন কিশোরী যেভাবে স্বামী সন্তান সহ নিজের সুখী ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে আনন্দিত হয়, তিনি যেন তারই প্রতিচ্ছবি।  সেইসব পত্রাবলীতে নিজেকে সম্বোধন করতেন “ ছোট্ট ব্যাঙছানা” নামে।

দ্যা সেকেন্ড সেক্স বইয়ে বেভ্যুয়ার যে বিপ্লবী ও বন্ধনহীন স্বাধীন নারী সত্ত্বার নির্মান করেছেন, তিনি নিজে কেন সেই নারী হতে চাননি? কেন নিজে আজীবন একজন পুরুষের গলগ্রহ হয়ে থেকে আবার অপর আরেকজন পুরুষের আদরের “ছোট্ট ব্যাঙ ছানা” হয়ে থাকতে হলো? এটা কিসের তাড়না?  নারীবাদি আন্দোলনের পুরো প্রকল্পটির বাস্তবতা বুঝার ক্ষেত্রে আমাদের জন্য এই প্রশ্নটা জরুরী। এর মাধ্যমে আমরা নারীবাদ ও নারী সত্ত্বার মাঝে বিদ্যমান সম্পর্কের বিশ্লেষণও করতে পারবো।

মুসলিম বিশ্বে নারীবাদ নতুন কোন বিষয় না। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপে যখন এই আন্দোলন অস্তিত্ত্ব লাভ করলো এর অব্যবহিত পরেই অনেক মুসলিম দেশে এর উপস্থিতি  বেশ জোরালোভাবেই টের পাওয়া গেলো। তখনকার ইউরোপিয়ান উপনিবেশ শাসিত ইন্ডিয়া, আরব ও আফ্রিকান মুসলিম দেশগুলোতে উপনিবেশভক্ত একশ্রেণীর  এলিট ছিলেন, যারা গতকালের ইউরোপে আবিষ্কৃত যেকোন চিন্তা বা মতবাদকে পরদিনই নিজের দেশে আমদানি করতেন আলোকায়নের নামে। তাদের হাত ধরেই নারীবাদের আগমনও ঘটে । মিশরের বিখ্যাত আইনজীবী ও লেখক কাসেম আমীন তার “নারীর মুক্তি” ( তাহরীরুল মারআহ) বইটি প্রকাশ করেন ১৮৯৯ সালে। বইটি তখন সব মহলেই হৈচৈ ফেলে দেয়।  একই সময়ে মিশর, সিরিয়া ও লেবাননের যেসব “সংস্কারপন্থি” ধর্মীয় পন্ডিত ছিলেন তারাও এ বিষয়ে লেখালেখি শুরু করেন। জামালুদ্দীন আফগানী, মোহাম্মাদ আব্দুহু, রশিদ রেজা, রিফায়া তাহতাবী প্রমূখ ছিলের অগ্রণী ভূমিকায়। তারা ইসলামে নারী প্রশ্নে এমন সব প্রস্তাবনা সামনে আনলেন যা ইউরোপের নারীবাদি আন্দোলনের বিচারেও অনেক অগ্রগামী ছিলো। যদিও তারা “নারীবাদ” নাম গ্রহন না করেই এই আন্দোলন চালিয়েছেন। তাদের সাথে ছিলো ঔপনিবেশিকদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতার হাত। মিশরের ইংরেজ শাসক লর্ড ক্রোমার মুসলিম নারীদের দুঃখ আর ব্যাথা বেদনার কাহিনী লিখতে লাগলেন এবং নিজেকে তাদের উদ্ধারকারী হিসেবে উপস্থাপন করতে লাগলেন। যদিও ক্রোমারের নিজের দেশ ইংল্যান্ডে তখনও নারীদের ভোটাধিকারই দেয়া হয়নি। অন্যান্য অধিকারের কথা বাদই থাক।

কিন্তু হুবহু ইউরোপের আদলে মুসলিম দেশগুলোতেও নারীবাদী আন্দোলন সংঘটিত ও সুসংহত হয়ে উঠতেও খুব বেশি সময় লাগেনি। যারা সরাসরি পশ্চিমা সেক্যুলার নারীবাদকে গ্রহণ করেছেন এবং ইসলামের প্রতি উপর্যপুরি হামলা চালিয়েছেন। নাওয়াল সা’দাবি, হুদা শা’রাবি, দোরিয়া শফিক, কিংবা সামীরা মুসার মতো নারীবাদী চিন্তকরা সেক্যুলার জায়গা থেকে ধর্ম ও আরব সমাজের তির্যক সমালোচনা করেছেন।

নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের উত্থানকালীন সময়েই এর আরও বেশকিছু শাখা প্রশাখা গড়ে উঠেছে, বিশেষত অ-ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে। Black Feminism, Radical Feminism, Marxist Feminism, liberal Feminism, Post Colonial Feminism ইত্যাদি। কিন্তু দিনশেষে এর সবগুলোই লক্ষ্য ও আদর্শের বিচারে এক ও অভিন্ন। হয়তো পার্থক্য কেবল নাম ও চর্চার ধরণে। এরই ধারাবাহিকতায় নব্বইয়ের দশকে Islamic Feminism নামক ধারণার উদ্ভব ঘটে, প্রধানত ইরান ও আরবে। এর বাইরে আমেরিকান নারীবাদি লেখিকা মার্গট বাদরানকেও এর উদ্ভাবক হিসেবে ধরা হয়। ১৯৯৫ সালে তার বই “ইসলামে নারীবাদ” ( Feminism In Islam) এ তিনি এই ধারণা প্রস্তাব করেন। একটা মজার ব্যাপার হলো সেক্যুলার নারীবাদ কিংবা ইসলামি নারীবাদ, এর সকল এক্টিভিস্ট, চিন্তক ও লেখক পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত রয়েছেন। হয় তারা সেসব দেশে বসবাস করেন, নতুবা সেসব দেশের কোন বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন, অধ্যাপনা করান,  কিংবা অন্য কোন এজেন্সিতে কর্মরত আছেন। ইসলামী নারীবাদ কিভাবে সরাসরি পশ্চিমা সেক্যুলার নারীবাদেরই মূদ্রার অপর পিঠ, সেটা বুঝতে গেলে এই তথ্য আমাদের কাজে লাগবে। এবং পূর্বে আমরা যা বলেছি, নারীবাদের সকল শাখা প্রশাখা মিলিয়ে মূলত একটি সেক্যুলার নারীবাদই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন নামে, এর বাস্তবতাও টের পাওয়া যায়।

সেই নব্বই দশক থেকেই আমরা মুসলিম দেশ  বা সমাজগুলোতে দুই ধরণের নারীবাদের চর্চা দেখি। সেক্যুলার র‍্যাডিক্যাল নারীবাদ, ও ইসলামি নারীবাদ। বাংলাদেশে ইসলামী নারীবাদের চর্চার ব্যাপকতা থাকলেও এর একাডেমিক বা জ্ঞা্নগত কোন ভিত্তি এখনও তৈরী হয়নি। ফলে সুনির্দিষ্টভাবে এর বিচার বিশ্লেষণ করা মুশকিল। তাদের  বক্তব্য, দাবী দাওয়া, কিংবা লক্ষ্য উদ্দেশ্যের সুসংহত কোন বয়ান আমার নজরে পড়েনি । মূলত অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে কেন্দ্র করেই  আবর্তিত হচ্ছে তাদের এই আন্দোলন। সেখানে তাদের গতিবিধি ও কার্যক্রম লক্ষ্য করলে বুঝা যায় ইসলামী নারীবাদ নামক যে প্রপঞ্চটি রয়েছে সেটারই একান্ত ভোক্তা তারা। এর বাইরে তাদের নিজস্ব কোন বয়ান নাই।

সুতরাং, ইসলামি নারীবাদ কী, এবং মূলধারার সেক্যুলার নারীবাদের সাথে এর পার্থক্য কোন জায়গায়, এই প্রশ্নে আসা যাক। সেক্যুলার নারীবাদ নিজেকে ধর্মের বৃত্তের বাইরে রেখে ধর্ম সমাজ ও সংস্কৃতির ক্রিটিক করে। এগুলোকে পিতৃতান্ত্রিক হওয়ার অভিযোগে খারিজ করে দেয়। তারা মনে করে ধর্ম পিতৃতন্ত্রের আবিষ্কৃত সিস্টেম, যার আবিষ্কারই হয়েছে নারীকে দমন ও শাসন করার জন্য। সুতরাং পিতৃতান্ত্রিক জুলুমের সিস্টেম দূর করতে গেলে হয় ধর্মকে আমূল সংশোধন ও সংস্কার করতে হবে, নতুবা একে পুরোপুরি বাদ দিতে হবে।

অপরদিকে ইসলামি নারীবাদ মনে করে, ইসলাম একজন নারীকে একজন পুরুষের মতোই সমান অধিকার, ক্ষমতা ও ব্যাক্তিস্বাধীনতা দিয়েছে। নারী ও পুরুষের মাঝে আচরণ ও বিধানগত কোন পার্থক্য রাখেনি। কিন্তু ইসলাম অবতীর্ন হয়েছে ঘোরতর পুরুষতান্ত্রিক একটি সময় ও সমাজে। ফলে সেসময়ের মানুষ ইসলামকে যেভাবে বুঝেছে সেই বুঝাপড়াটা সার্বিকভাবে পুরুষতন্ত্রের বুঝাপড়া। সেখানে নারীর কোন অংশগ্রহণ ছিলো না। পুরুষতন্ত্রের হাত ধরে ইসলামের যে ব্যখ্যা আমাদের পর্যন্ত এসেছে সেখানে নারী নিতান্তই গৌণ ও অনুল্লেখযোগ্য, কখনও তুচ্ছ ও হীন। ইসলামে এই পিতৃতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটেছে এর পূর্বের দুই ধর্ম তথা ইহুদি ও খৃষ্ট ধর্ম থেকে। সুতরাং ইসলামি নারীবাদ ইসলামকে পিতৃতন্ত্রের প্রভাব থেকে মুক্ত করতে, এবং ইসলাম নিয়ে চিন্তা করার সম্পূর্ণ নতুন প্রস্তাবনা তৈরী করতে চায়। ইসলাম, যা কুরআনের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে মানুষের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে, সেই কুরআন বুঝার জন্য আল্লাহ্‌ ও তাঁর বান্দাদের মধ্যকার যে মানবীয় মাধ্যম রয়েছে সেগুলো বাদ দিয়ে বুঝতে হবে।

মিশরের নারীবাদী লেখিকা রাফা’ত হাসান মনে করেন, নারীর অধিকার প্রশ্নে হাদিসের চাইতে কুরআন বেশি ইনসাফ করেছে। এবং হাদিস সেই ইনসাফের ক্ষেত্রগুলোকে সঙ্কোচন করে দিয়েছে।

আমেরিকান নারীবাদী লেখিকা আমিনা ওয়াদুদ এর মতে – ইসলামের সার্বজনীন ও সর্বকালীন বিধান হওয়ার অধিকার কেবল কুরআনেরই রয়েছে। কারণ কুরআন এর স্থান ও কালের কোন সীমানা নেই। বরং সকল যুগের সকল মানুষের জন্যই একে প্রেরণ করা হয়েছে। সুতরাং প্রত্যেক যুগে সে যুগের দাবী ও চাহিদা অনুযায়ি কুরআন কে বোঝা ও এর বিধান প্রয়োগ করা খোদ কুরআনেরই দাবী। সেজন্য কুরআনকে ব্যাখ্যার নির্দিষ্ট কোন কাঠামো নেই, বরং একে উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। এর বিপরীতে হাদিস বর্ণিত হয়েছে একটা নির্দিষ্ট সময়ের নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে উদ্দ্যেশ্য করে। এর সার্বজনীন কোন মূল্য নেই। উপরন্তু হাদিসে বিকৃতি ও বাহিরের হস্তক্ষেপ অনুপ্রবেশ করায় এটা সর্বৈভ সন্দেহযুক্ত।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে ইসলামী নারীবাদের প্রথম এবং প্রধান দাবীই হলো কুরআনের পূনঃর্পাঠ নির্মান করা, এবং সেটা হবে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। আর এই পূনঃপাঠ নির্মান করতে গিয়ে ইসলামের যে অপরাপর জ্ঞান শাখা রয়েছে সেগুলোকে প্রত্যখ্যান করা। এ ক্ষেত্রে তাদের বিখ্যাত কয়েকটি বইয়ের শিরোনামের দিকে লক্ষ্য করলে ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হবে। আমিনা ওয়াদুদের বইয়ের নাম – Quran and Women: Reading the sacred text from a Women’s perspective)

পাকিস্তানি-আমেরিকান লেখিকা আসমা বারলাসের বইয়ের নাম-  Believing Women in Islam: Unreading Patriarchal interpretations of the Quran

মরক্কোর বিখ্যাত নারীবাদী চিন্তক ফাতেমা মেরনিসির বইয়ের নাম- The Veil and The Male Elite: A Feminist Interpretation of Women rights in Islam

এর বাইরে ইউরোপ, আরব ও এশিয়ায় যে অসংখ্য কাজ হচ্ছে ইসলামি নারীবাদ নিয়ে, সেগুলোর বক্তব্যও প্রায় একই। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হলো, তারা প্রত্যেকেই ইসলাম কে বা কুরআনকে বিশেষ একটা মতবাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস করেছেন । সুতরাং শুরুতেই এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় তাদের এই পাঠ নিরপেক্ষ ও যথাযথ হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই। কোন বিষয়ে পূর্ব সিদ্ধান্ত ও দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে আপনি যদি সেখানে নিরপেক্ষ সত্যের সন্ধানে যান তাহলে সেটা নিতান্তই এক হাস্যকর প্রচেষ্টা হবে বটে।

অথবা তারা যদি মনে করেন তাদের নিজেদের মতো করে সত্য কে তৈরী করবেন, কুরআনের টেক্সটকে তার স্বভাব ও মর্মগত অর্থের বাইরে এনে নিজের মতো করে অর্থ দান করবেন, তাহলে সেটা হবে তাদের স্বনির্মিত সত্য, আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে অবতীর্ণ সত্য না।

ইসলামী নারীবাদ হাদিসকে অস্বীকার ও মেনে নেয়ার মাঝামাঝি জায়গায় ঝুলে আছে। তাদের কেউ হাদিসকে পুরোপুরি বর্জন করার পক্ষে, যেহেতু হাদিসকে গ্রহণ করলে কুরআনের ব্যখ্যায় পর্যাপ্ত স্বাধীনতা লাভ করা যায়না। আবার কেউ হাদিসকে আংশিক গ্রহণ করার পক্ষে। অর্থাৎ যেসব হাদিস তাদের নারীবাদী রুচি ও চাহিদার অনুগামি হবে সেসব হাদিস গ্রহন করা হবে, এর বিপরীত হলে সে হাদিস বর্জন করা হবে। হাদিস গ্রহণ ও বর্জনের ক্ষেত্রে এই উম্মতের মহান মনিষীরা যেসব মূলনীতি ও শাস্ত্রের উদ্ভাবন ঘটিয়েছিলেন এবং যেগুলো ইসলামের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত অনুসৃত হয়ে আসছে সেসব মূলনীতি ও শাস্ত্রের প্রয়োজন হয়না তাদের। বরং কোন হাদিসের ক্ষেত্রে যদি মনে হয় এমন কথা রাসূল সাঃ এর জন্য বলা শোভনীয় না, তাহলে সেই হাদিস বর্জনের জন্য এতটুকুই যথেষ্ঠ। শাস্ত্রের বিচারে সেটা যত বিশুদ্ধ হাদিসই হোক।

ইসলামি নারীবাদ ফিকহে ইসলামিকে পুরুষতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সবচে বড় দায়ী হিসেবে সাব্যস্ত করে। তারা মনে করেন, ফুকাহায়ে কেরাম ইসলামের প্রকৃত ব্যাখ্যা বাদ দিয়ে নিজেদের পিতৃতান্ত্রিক মনোভাবের জন্য ভয়াবহ রকমের পক্ষপাতিত্ত্ব করেছেন। এবং নিজেদের সেইসব পক্ষপাতমূলক মতামতই শরিইয়াহর বিধান হিসেবে উম্মতের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। তারা আল্লাহ্‌ ও তাঁর বান্দার মাঝে প্রতিবন্ধক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছেন। সম্প্রতি রীতা ফারাজ নামক এক লেবানিজ নারীবাদী লেখিকা একটি বই লিখেছেন, বইয়ের নাম হলো “ ইমরাআতুল ফুক্বাহা ওয়া ইমরাআতুল হাদাসাহ”, অর্থাৎ মুসলিম ফকীহদের নির্মিত নারী ধারণা এবং আধুনিকতায় নারী ধারনা। সেখানে তিনি দেখাতে চেয়েছেন ফকীহরা কিভাবে নিজস্ব ইজতেহাদ ও বিধান প্রণয়নের মাধ্যমে নারীর কর্তাসত্ত্বাকে সম্পূর্ণরূপে নাই করে দিয়েছেন। অত:পর  পশ্চিমা  আধুনিকতা সেই হারানো কর্তাসত্ত্বাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এসেছে।

ফিকহে ইসলামীর সাথে সামান্যতম সম্পর্কও রাখেন এমন যে কেউ এটা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, ফকীহগণ যখন শরিয়তের কোন হুকুম অনুসন্ধান করতেন  তখন তাদের সামনে কেবলই কুরআন ও হাদিসের টেক্সট থাকতো। সেই টেক্সট থেকে যে নির্দেশনা পেতেন কেবল তারই অনুসরণ করতেন। সেই নির্দেশনা নারী বা পুরুষের পক্ষে নাকি বিপক্ষে যাচ্ছে সেটা তাদের বিবেচ্য বিষয় ছিলোনা। টেক্সট এর বিদ্যমান অবস্থায় নিজস্ব কোন চিন্তা, মতবাদ বা অভিরুচি সেখানে প্রয়োগ করার বিন্দুমাত্র সুযোগও ছিলোনা। এমন কোন প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাদের এই বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্বস্ততা ও সততার কারণেই আজ পর্যন্ত তারা এই উম্মাহর সর্বোচ্চ সম্মানীত ইমাম ও পথ প্রদর্শক। এককভাবে কাউকে আমরা ভুল ত্রুটির উর্ধ্বে মনে করিনা, কিন্তু তাদের সম্মিলিত ও সমষ্টিগত যে প্রচেষ্টা রয়েছে ফিকহে ইসলামী নামক ইসলামের গুরুত্ত্বপূর্ণ একটি জ্ঞানস্তম্ভ নির্মানে , সেখানে একদল উন্মাদ অন্ধের এলোপাথাড়ি লাঠি চালনায় সামন্য আঁচড়ও পড়বেনা।

শেষ কথা

আমেরিকান মুসলিম একটিভিস্ট ড্যানিয়েল হাকীকাতজু তার এক লেখায় দেখিয়েছেন ইসলামি নারীবাদ কিভাবে  চারটি ধাপ অতিক্রম করে শেষপর্যন্ত ধর্মহীন সেক্যুলার নারীবাদে পরিণত হয়। ইসলামী নারীবাদ আর সেক্যুলার নারীবাদের মধ্যকার দূরত্ত্ব খুব সামান্যই এবং অতি সহজেই মানুষ সেই দূরত্ত্ব অতিক্রম করে ফেলে। উভয়ের পার্থক্য উনিশ আর বিশ। প্রথমে মনে হতে পারে ইসলাম নারীকে তার যথাযথ অধিকার দিয়েছে ঠিকই কিন্তু এর ব্যাখ্যাকারগণ একে পুরুষতান্ত্রিক ও নারীবিরোধী বানিয়েছেন। সেখান থেকে একটা পর্যায়ে গিয়ে গোটা ইসলাম, কুরআন হাদিসকেও পুরুষতন্ত্রের বানানো বলে মনে হবে। এর অসংখ্য দুঃখজনক উদাহরণ আমরা প্রতিনিয়তই দেখছি। ইসলামী নারীবাদই এখন দ্বীন ত্যাগের সবচে বড় দরোজায় পরিণত হয়েছে মুসলিম নারীদের জন্য। আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূল সাঃ  থেকে কোন বিধান আসার পর এর অর্থ ও মর্ম অনুধাবনের আগে  তারা সেখানে সর্বাগ্রে নারী স্বার্থের তালাশ করেন। আল্লাহ্‌র আনুগত্যের চাইতে নিজেদের “স্বার্থ” রক্ষাই মূখ্য হয়ে দাড়িয়েছে তাদের জন্য। এর জন্য তারা বানিয়ে নিয়েছেন নিজের মন মতো কিছু পদ্ধতি। যেমন বাংলাদেশের প্রথম সারির একজন ইসলামি নারীবাদী এক্টিভিস্টের বক্তব্য হলো – আমি নিজেকে ইসলাম ধর্মের একজন স্বাধীন নাগরিক হিসেবে কল্পনা করি। কারণ ইসলামই আমাকে  এই স্বাধীনতা দিয়েছে।  সুতরাং আমার সামনে যা কিছুই আসুক আমি নিজের সেই প্রাপ্ত স্বাধীনতার সাথে সেটাকে মিলিয়ে দেখি। যদি দেখি উভয়টা কোনভাবে  সাংঘর্ষিক হচ্ছে তাহলে নিশ্চিতভাবেই বুঝে নেই এখানে ঝামেলার কিছু আছে এবং সেটা গ্রহণযোগ্য না। সেটার জন্য আমি আমার স্বাধীনতাকে কম্প্রোমাইজ করবোনা।

এটা যদি ইসলাম হয় তাহলে প্রবৃত্তির অনুসরণ কাকে বলে? নুসূসে শরিয়াহ এবং আহকামে শরিয়াহ কে যাচাই বাছাই করার এমন উদ্ভট মানদন্ড ইতিপূর্বে আর কেউ আবিষ্কার করেছে বলে মনে হয়না। মোটাদাগে বাংলাদেশের ইসলামী নারীবাদ এখনও এই স্তরেই রয়ে গেছে। অর্থাৎ তারা দ্বীন ও ধর্মের কথা বলেন, ইসলামের মহত্তের কথাও প্রচার করেন, কিন্তু সেটা সিলেক্টিভ এবং স্বার্থবাদী। সেই স্বার্থের পাল্লায় মেপে ইসলামের বিধানাবলী ও নুসুস কে গ্রহন ও বর্জন করেন। ইসলামের পদ্ধতিগত যে শাস্ত্রীয় জ্ঞান রয়েছে , সেখানে তারা নিতান্তই ব-কলম। তবুও উম্মাহর সকল ইমাম, ফকীহ, মুফাসসীর , মুহাদ্দিস ও ভাষাবিদদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে নিজেরাই নেমে পড়েছেন সেইসব জ্ঞানের ময়দানে। যেন ঢাল নাই, তলোয়ার নাই, তবু নিধিরাম সর্দার।

বিগত কয়েক শতকে ইসলামের বিরুদ্ধে সবচে বেশি যে অস্ত্রটি ব্যাবহার করা হয়েছে তা হলো ইসলামে নারীর অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন। নারীই হলো সাংস্কৃতিক ও সভ্যতা কেন্দ্রিক লড়াইয়ের প্রধান হাতিয়ার। মুসলিম নারীরা কিভাবে পুরুষতন্ত্রের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে নিদারুণ নিপীড়িত ও বঞ্চিত জীবন যাপন করছে, সেটা প্রমাণ করাই তাদের মূখ্য উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নারী প্রশ্নে পরাজিত হয়েছে ইউরোপের স্বেচ্ছাচারী চার্চ, হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা কুসংস্কারাচ্ছন্ন ইহুদী ধর্ম। কারণ জয়ী হওয়ার মতো নৈতিক যোগ্যতা তাদের ছিলো না। ব্যাতিক্রম শুধু ইসলাম। এবং কেবল ইসলামই এখন পর্যন্ত  মানব জাতীর জাগতিক ও ইহজাগতিক সকল যাত্রার  পরম নিরাপদ গন্তব্য । নারী-  পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই আমরা আল্লাহ্‌র দাস। আমাদের নেই নিজস্ব কোন অধিকার আর কল্পিত স্বাধীনতার জন্য ব্যকুলতা। কারন আমাদের মুক্তি নিহিত তাঁর দাসত্ত্বেই।

 

আগের সংবাদআজানের সময় পূজামণ্ডপে বাদ্যযন্ত্রের শব্দ সহনীয় রাখার নির্দেশ
পরবর্তি সংবাদএবছর পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের অভিযানে ১০০ ফিলিস্তিনি নিহত