ধর্মীয় সমাজ : অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও প্রযুক্তি প্রশ্নে মাওলানা ইউসুফ সুলতানের সাথে আলাপ

( মাওলানা ইউসুফ সুলতান। বিশিষ্ট ইসলামি অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ।  চিফ ইনফ্রাস্ট্রাকচার অফিসার ও শারিয়াহ এডভাইজার, ইথিস ভেঞ্জারস। কো-ফাউন্ডার, আই এফ অ্যাকাডেমি অ্যান্ড কনসালটেন্সির। সাবেক সহকারী মুফতি, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ। তরুণ আলেম এ অর্থনীতিবিদের মুখোমুখি হয়েছিল ফাতেহ টোয়েন্টি ফোর। বাংলাদেশের ধর্মীয় সমাজের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, নতুন উদ্যোগ, ব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্রীয় ভূমিকা ও প্রযুক্তি —নানা বিষয়ে কথা হয়েছে। উঠে এসেছে এ বিষয়ক বিস্তারিত আলাপ। এবং আরও নানা কিছু। ইফতেখার জামিলের নেওয়া সাক্ষাৎকার  শ্রুতিলিখন করেছেন কাজী মাহবুবুর রহমান ও গ্রন্থনা করেছেন  সালমান মুহাম্মদ । ) 

 

ফাতেহ 

হাইয়াতুল উলইয়ার পরীক্ষায় এ বছর প্রায় সাতাশ হাজারের মতো শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছে, এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সংখ্যা বাড়লেও কর্মসংস্থানের প্রশ্ন জোরালো হয়ে উঠছে, বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

ইউসুফ সুলতান 

আলহামদুলিল্লাহ, খুব চমৎকার এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। মাদরাসা থেকে যারা পড়াশুনা শেষ করছেন, তাদের কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ কী হবে, সে প্রসঙ্গে প্রশ্ন। আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি, যারা মাদরাসা থেকে পড়াশুনা শেষ করেন তারা ভবিষ্যতে ইমাম হন অথবা মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন, এটাই হচ্ছে তাদের মূল পেশা। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা হলো, এভাবে সকলের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। কেননা, যে হারে মাদরাসা থেকে ছাত্ররা গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করছেন, সেই হারে মাদরাসা কিংবা মসজিদ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না এবং এটা হওয়া সম্ভবও না। ফলে আজ হোক বা কাল হোক, বর্তমানে আমাদের যে সীমাবদ্ধতা আছে, সেটা দিন দিন আরও প্রকট হবে। তাই সংকট উত্তরণের ব্যবস্থা নিয়ে আমাদেরও ভাবতে হবে।

প্রত্যেক ব্যাকগ্রাউন্ডেই বেকারত্বের সমস্যাটা থেকে যাচ্ছে। এটা সব দেশেই হচ্ছে। আমরা যদি শুধু চাকরির কথা চিন্তা করি, তবে এ ক্ষেত্রে শুরুতেই আসবে সরকারি চাকরি, এই জায়গাটাও কিন্তু সীমিত। আর এটা একসময় শেষ হয়ে যাবে। এ জন্য আধুনিক সময়ে প্রত্যেকটা দেশই বেশি বেশি উদ্যোক্তা তৈরি করার চেষ্টা করছে। উদ্যোক্তা তৈরির জন্য তারা যেসব কাজ করছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে শিক্ষা-সিলেবাসে ব্যাপক পরিবর্তন৷ এটা এ জন্য যে, তাদের শিক্ষার্থীরা যেন শুরু থেকেই উদ্যোক্তা হবার মানসিকতা নিয়ে বড় হয়। একজন উদ্যোক্তার মূল বৈশিষ্ট্য তার মানসিকতা। উদ্যোক্তা ঝুঁকি নিতে পারেন, সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন ও সামনের দিকে ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে যেতে পারেন৷ যিনি উদ্যোক্তা নন, তিনি এই কাজগুলো করতে পারেন না। এই অল্প কিছু পার্থক্যই তাদের দুজনকে আলাদা করে দেয়। রাষ্ট্রগুলো খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছে, আমাদের ঐতিহ্যগত যে চাকরির বাজার আছে, সেগুলো যদি আমরা আরও প্রসারিত করতে না পারি, তা হলে গ্রাজুয়েটদের চাহিদা আমরা পূরণ করতে পারব না।

আমি আবার কথার শুরুতে ফিরে যাচ্ছি, উদ্যোক্তা তৈরির যতগুলো ধাপ আছে, যেমন শিক্ষা-কারিকুলামে পরিবর্তন এবং ইউনিভার্সিটি লেভেলে ছাত্রদের হাতের কাছে উদ্যোক্তা হওয়ার সকল উপকরণ পৌঁছে দেওয়া; আমরা সিলিকন ভ্যালির কথা মাঝে মাঝেই শুনি, হারভার্ড ইউনিভার্সিটির কথা আলোচনা করি, এর কারণ হলো এই ইউনিভার্সিটিগুলো উদ্যোক্তা তৈরির কারখানা। ফেসবুক গুগলসহ আরও বড় বড় উদ্যোগগুলো কিন্তু ছাত্ররা ইউনিভার্সিটি থেকে লালন করে এসে পরবর্তী সময়ে বাস্তবে রূপ দেয়। যা হোক, উদ্যোক্তা তৈরির জন্য শিক্ষা-কারিকুলামে পরিবর্তনের পাশাপাশি ছাত্রদের উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য সকল উপকরণ তাদের হাতের কাছে রাখতে হবে। যেমন: আমি উদ্যোক্তা হতে হলে আমাকে বাজার সম্পর্কে জানতে হবে; আমি এখন কোন প্রোডাক্ট বাজারে আনব, কোন প্রোডাক্ট এই মুহূর্তে ব্যবসায় সফল হবে, এটা আমাকে জানতে হবে। এ ছাড়া মার্কেট-ব্যবস্থাপনা সম্পর্কেও জানতে হবে।

ফাতেহ 

একজন উদ্যোক্তার প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কী, একটু বলবেন?

ইউসুফ সুলতান 

উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। এক নম্বর হলো, ফান্ডিং। জন্মগতভাবে কোনো উদ্যোক্তা অর্থসম্পন্ন ব্যক্তি হয়ে জন্ম নেন না। উদ্যোগ সফল করার জন্য উদ্যোক্তা এবং অর্থদাতা উভয়ের সম্মিলন ঘটাতে হবে। এটাকে ইসলামের পরিভাষায় মুদারাবা বলা হয়। আমাদের নবিজীও তার স্ত্রী হজরত খাদিজার সঙ্গে মুদারাবা করেছেন, বিবাহের পূর্বেই। এই মুদারাবাই পরবর্তী সময়ে কিছু পরিবর্তন হয়ে `ভেঞ্চার ক্যাপিটাল’ নামে পরিচিত হয়েছে। এর কাছাকাছি আরও কিছু শব্দে এটাকে পরিচিত করা হয়, তবে এই নামটাই বেশি খ্যাতি লাভ করে। এটা নিয়ে ইউনিভার্সিটিগুলোতে অনেক কাজ হচ্ছে। শিক্ষাকারিকুলামেও বিষয়টা আছে৷ আবার বিভিন্ন সময়ে এই বিষয়ের উপর বিভিন্ন কোর্স অফার করা হয়। সেখানে আইডিয়া পিচ শেখানো হয়। অর্থাৎ যিনি ফান্ডিং করবেন তার সঙ্গে উদ্যোক্তা কীভাবে যোগাযোগ করবেন। কারণ ফান্ড যারা দিচ্ছেন তারা ব্যবসার সম্ভাবনা দেখে ফান্ডিং করেন৷ এখন হয়তো এই আইডিয়া থেকে সফলতা আসছে না, যেহেতু একেবারে নতুন আইডিয়া, কিন্তু ভবিষ্যতে আসবে৷ এইরকম সম্ভাবনার ভিত্তিতে তারা ফান্ডিং করে থাকেন। এটা হচ্ছে প্রথম বিষয়, যা একজন শিক্ষার্থীকে ব্যবসায় সফল হওয়ার পদ্ধতিগুলো দেখিয়ে দেয়।

দ্বিতীয় হচ্ছে, ইউনিভার্সিটিগুলো ফান্ডদাতাদের সাথে আগে থেকেই চুক্তিবদ্ধ হয়ে থাকছে যে, তাদের ছাত্ররা ভবিষ্যতে নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে গেলে যেন তারা ফান্ড দিতে পারে। এটা আগে ছিল না, এখন হচ্ছে। আর ছাত্ররাও যেন আরও নতুন আইডিয়া নিয়ে আসতে পারে, সে জন্য তারা বিভিন্ন সময়ে ছাত্রদের নিয়ে কনফারেন্স করছে। সেখানে ছাত্ররা তাদের আইডিয়াগুলি উপস্থাপন করছে। অপরদিকে ওই কনফারেন্সে ফান্ডদাতাদেরও ইনভাইট করা হয়, যাতে তারা ছাত্রদের আইডিয়াগুলো শুনে কনফারেন্সে ভালো নির্বাচিত আইডিয়াগুলোতে ফান্ডিং করতে পারে এবং ব্যবসা সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এভাবে একই সঙ্গে বহুমুখী পদক্ষেপ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ছাত্রদের জন্য এবং ছাত্রদের আইডিয়ার পেছনে ফান্ডিং প্রবাহিত করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কাজগুলো সফল করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও ইউনিভার্সিটিকে একটা অর্থায়নের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।

ফাতেহ 

আমাদের দেশে এ ব্যাপারে কতটুকু গুরুত্ব আরোপ করা হয়?

ইউসুফ সুলতান 

আমাদের দেশে এখনো ভেঞ্চার ক্যাপিটালের ফান্ড সেভাবে গড়ে ওঠেনি। আমাদের দেশে ‘পাঠাও’ কিছুদিন আগে একটা বৈদেশিক ভেঞ্চার ক্যাপিটাল থেকে ফান্ড পেয়েছে। আমাদের দেশে এই কালচারটা এখনো সেভাবে তৈরি হয়নি৷ এই যে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল, যাকে আমি মুদারাবা এবং মুশারাকার সাথে তুলনা করলাম, উন্নত দেশগুলোতে তারা এই জায়গাকে যথেষ্ট শক্তিশালী করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

শক্তিশালী করার অর্থ হলো, দুই জায়গায় কাজ করা। একদিকে উদ্যোক্তাদের উঠিয়ে নিয়ে আসা, তাদেরকে সুযোগ করে দেওয়া, যেন তারা নতুন নতুন উদ্ভাবন যেগুলো সমাজ পরিবর্তনে সহায়তা করবে, সেটা করতে পারে। অপরদিকে যারা ফান্ডিং করবে, তাদের নিরাপত্তা দেওয়া। উভয়পক্ষকেই নিরাপত্তা দেওয়া। তাদেরকে আইনগত সমর্থন দেওয়া। উদাহরণস্বরূপ একজন নতুন উদ্যোক্তা, যিনি একটি নতুন উদ্ভাবন নিয়ে আসবেন, সরকার তাকে কোনো রকম বাধা দেবে না। এতে মানিলন্ডারিং হচ্ছে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হচ্ছে, এসব বলে কোনো সমস্যা করবে না। অর্থাৎ একটা ওপেন ফ্লো তৈরি করে রাখবে, যেন তারা বিনিয়োগ করতে পারে। এতে যারা বিনিয়োগ করবে, তাদের মানসিকতায় একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

ফাতেহ 

তাদের মানসিকতা বলতে ঠিক কী বুঝাচ্ছেন ?

ইউসুফ সুলতান 

তাদের মানসিকতা বলতে কী বুঝাচ্ছি, যেমন ধরুন, আমাদের দেশে যখন আমরা কোথাও বিনিয়োগ করি, তখন আমাদের মানসিকতা এই রকম থাকে, আমরা আমাদের বিনিয়োগ ফেরত পাব। যদি না পাই তা হলে যিনি উদ্যোক্তা, তার বিরুদ্ধে মামলা করব; কিন্তু ‘ভেঞ্চার ক্যাপিটাল’ বা মুদারাবায় লসের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। লাভ এবং লস উভয় ঝুঁকি এখানে আছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে দেখি, যখন তারা ১০ টা ভেঞ্চার ক্যাপিটালে বিনিয়োগ করে, হয়তো সেখান থেকে একটা বা দুটায় লাভবান হয়। তারা ভালো করেই জানে, আমার এতগুলো বিনিয়োগের মধ্যে হয়তো একটা লাভবান হবে এবং বাকিগুলো লস হবে।

তারা এমনভাবে বিনিয়োগ করে, যেন ওই একটা লাভ দিয়েই বাকি লসগুলো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়। অর্থাৎ সেখানে ঝুঁকিসহ বিনিয়োগ করার একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। এই যে তিনমুখী প্রকল্প, একদিকে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করা, উদ্যোক্তার জন্য পরিবেশ তৈরি করা এবং সরকারের দিক থেকে আরেকটা কাজ করার আছে, সেটা হচ্ছে যারা ফান্ড দিবে, তাদের ফান্ডিংটা ট্যাক্সমুক্ত রাখা৷ আমাদের দেশেও ট্যাক্সের সুবিধা তৈরি হয়েছে কিনা, এটা আমার সঠিক জানা নেই। তাদের জন্য এই কাজগুলো সরকারকে করতে হবে। এবং আরও কিছু সুবিধা দিতে হবে, যেন তারা নতুন করে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হয়।

ফাতেহ 

এর সাথে ধর্মীয় সমাজের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

ইউসুফ সুলতান 

জি, এবার আমি মাদরাসার প্রসঙ্গে আসি। আমরা আলহামদুলিল্লাহ কোরআন হাদিস পড়ছি ও দ্বীনের শিক্ষা অর্জন করছি। এটাকে আমরা পড়াশুনার সর্বোচ্চ মানদণ্ড ধরতে পারি, কিন্তু এর অর্থে এই নয় যে, আমাদের কেবল ইমাম বা শিক্ষকই হতে হবে। এর বাইরেও দেশের অর্থনীতিতে আমাদের অবদান রাখার কথা চিন্তা করতে হবে। আমাদেরকে যখন অর্থনীতিতে অবদান রাখার প্রশ্ন করা হয়, তখন আমরা ডিফেন্সিভ ভঙ্গিতে চলে আসি এবং আমরা আমাদের নৈতিকতার বিষয়গুলো তুলে ধরি। সেটা ঠিক আছে। কিন্তু অর্থনীতিতে অবদান রাখা বলতে বুঝায়, আমরা এমন কিছু সার্ভিস দিচ্ছি, যেটা অর্থনীতিতে গিয়ে যোগ হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে আমাদের অবদান একটু কমই৷ আমরা ওয়াজ মাহফিল করছি এবং সেই উপলক্ষ্যে কিছু ছোট ছোট উদ্যোক্তা উপকৃত হচ্ছে, কিন্তু জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখার মতো কোনো কাজ হয়তো আমরা করতে পারতাম, কিন্তু এখন আমরা করতে পারছি না। চাইলে আমরা সেটা করতে পারি।

আমাদের মাদরাসার একটা বড় ল্যাকিং, অবশ্য আমি একে ল্যাকিং বলব না, আমাদের পূর্ববর্তীরা যখন মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন, তখন এটার দরকার হয়নি, কিন্তু এখন মাদরাসার কারিকুলামে কিছু ব্যবসায়িক বিষয় যোগ করা খুবই দরকার। কীভাবে ব্যবসা শুরু করা হয়, কীভাবে বিনিয়োগ গ্রহণ করা হয়, ম্যানেজমেন্ট কীভাবে হয়। সামনে আরও একটি প্রশ্ন আসবে, যা ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। ম্যানেজমেন্ট কিন্তু মাদরাসায় পড়ানো হয় না, এটা আমরা বিবিএতে পড়াতে দেখি। কোরআন এবং সুন্নাহর মাঝে সামষ্টিকভাবে সবই আছে, কিন্তু পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থার আলোকে ম্যানেজমেন্টের যে রূপ দাঁড়িয়েছে, সেই রূপে কিন্তু মাদরাসার সিলেবাসে ম্যানেজমেন্টের কোনো পাঠ নেই।

ম্যানেজমেন্ট, ব্যবসা পরিচালনা, একাউন্টিং, এইগুলোর কিছু পাঠ মাদরাসাশিক্ষার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। এটা মূল কারিকুলামে যুক্ত হতে পারে, অথবা এটার উপর তাখাসসুস হতে পারে। অথবা এটার উপর ওয়ার্কশপ হতে পারে। আমরা তিন মাস পর পর একটা করে ওয়ার্কশপ করব, সেখানে আমরা ইউনিভার্সিটির শিক্ষকদের দাওয়াত করে আনব, অথবা আমাদের দেশে যারা সফল উদ্যোক্তা, সফল ব্যবসায়ী তাদেরকে এনে আমরা ওয়ার্কশপ করব৷ বহির্বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও আমরা এমনটা দেখি। তাদের যেই ফিল্ড সেই ফিল্ডের বাইরে তারা অন্য কোনো ফিল্ড থেকে স্পেশালিস্ট ইনভাইট করে এনে তাদের লেকচার শুনেন, এতে মানুষের বহুমুখী চিন্তার দ্বার খুলে যায়। মানুষ নতুন করে ভাবতে শেখে।

মাদরাসাগুলোতে যদি আমরা এই কাজটা করতে পারি, তা হলে দেখা যাবে, আমাদের ভেতর থেকে নতুন করে চিন্তা করার মতো ব্যক্তি উঠে আসবে, যারা দেশের মূলধারার অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবে। আপনি যেমনটা বলেছিলেন, কৃষিতে ফিরে যাবার সুযোগ নেই, কৃষি হচ্ছে একেবারে রিয়েল ইকোনমি। আমরা আদতে যত কিছু করছি, সবকিছুই কিন্তু কৃষির জন্যই করছি। খাদ্য উৎপাদনের জন্য করছি। কৃষিতে সংযুক্ত হওয়া সবার পক্ষে সম্ভব না এবং এর জন্য দক্ষতারও প্রয়োজন আছে। এটা দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রক্রিয়া৷ কেউ চাইলে ব্যক্তিগতভাবে এই দক্ষতা অর্জন করে আসতে পারেন। কৃষিকেও কেউ আধুনিকভাবে ভাবতে পারেন, যদি তার সেই দক্ষতা থাকে। মোটকথা, আমি যেটা বলার চেষ্টা করেছি সেটা হলো, আমাদের শিক্ষার্থীদের নতুন উদ্যোক্তা হওয়ার যে উপায়গুলো আছে বা একটা প্রতিষ্ঠানকে টেকসই করার যে উপায়গুলো থাকে, যেমন আমি ম্যানেজমেন্টের কথা বলেছি, অর্থনৈতিক বিষয়ের কথা বলেছি, একাউন্টিংয়ের কথা বলেছি, এগুলো যখন আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিব, তখন আমরা দেখতে পাব, আমাদের শিক্ষার্থীরা নিজেদের কর্মসংস্থান নিজেরাই তৈরি করে নিচ্ছে।

একটা গ্রুপ অবশ্যই ইমাম এবং শিক্ষক থাকবে৷ কিন্তু প্রতি বছর সাতাশ হাজার ছাত্র গ্রাজুয়েট হচ্ছে, এরা কিন্তু ঘুরেফিরে সেই একই অর্থব্যবস্থায় ঢুকে যাচ্ছে এবং বাধ্য হয়ে তাদেরকে সেখান থেকেই একটা আয় বের করে আনতে হচ্ছে। এভাবে কত দূর অগ্রসর হওয়া যাবে, এই বিষয়টা আলাদা করে আমাদের ভাবতে হবে।

ফাতেহ 

অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতার সাথে যদি মিলানো হয়, তা হলে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে আমাদের দেশীয় ব্যবস্থার সংকট মূলত কোথায়, দক্ষতা ও যোগ্যতার সংকট নাকি কৌশলগত সংকট? রাষ্ট্রের দায় এখানে কতটুকু?

ইউসুফ সুলতান 

আপনি রাষ্ট্রের দায়ের কথা বলেছেন, আমি আগের প্রশ্নে রাষ্ট্র-বিষয়ে অনেক কথা বলে ফেলেছি। রাষ্ট্র হচ্ছে একটা ফ্যাসিলিটেটর বা পুরো বিষয়টাকে প্রস্তুতকারী বলা যায়৷ রাষ্ট্র শুধু সুযোগ তৈরি করে দেবে, অন্য কিছু করবে না। এই সুযোগটা রাষ্ট্র কীভাবে তৈরি করবে? রাষ্ট্র উদ্যোক্তা ফ্রেন্ডলি-ব্যবস্থা তৈরি করবে। ‘উদ্যোক্তা ফ্রেন্ডলি করা’ বলতে অনেকগুলো বিষয়কে বুঝায়। কিছুদিন আগে আপনাদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আমি বিজনেস ফ্রেন্ডলিকরণের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে বলেছিলাম, বিশ্বব্যাংকের ডাটা অনুসারে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক নীচে। এর অর্থ হলো, বাংলাদেশে নতুন কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলা বা এটার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন তার অবস্থা বাংলাদেশে অন্যান্য দেশের তুলনায় যথেষ্ট খারাপ। বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি, সম্ভবত মাস দুয়েক আগে নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলার ক্ষেত্রে ফিস থেকে শুরু করে অন্যান্য স্তরেও একটা ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে, এটা বেশ প্রশংসাজনক। এর মাধ্যমে আমরা আশা করতে পারি, বাংলাদেশের নতুন উদ্যোগ গ্রহণের সংস্কৃতিতে বেশ উন্নতি হবে৷

তবে এই সুবিধাটুকু ছাড়া রাষ্ট্রের আরও কিছু কাজ করার আছে, যেমন: নতুন ব্যবসায়ী বা নতুন ব্যবসায় বিনিয়োগকারীদের কর মওকুফ করে দেওয়া এবং বিভিন্নরকম ফান্ডিংয়ের ব্যবস্থা করা। যেমন: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হয়তো আলাদা ফান্ডিং থাকতে পারে, তারা এভাবে কাজটা করল, নতুন যারা আসবে তাদেরকে কিছু বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে ঋণ দিল। এখন হচ্ছে টেকনোলজির যুগ। যেসব দেশ টেকনোলজিতে ভালো করছে তারা বেশি এগিয়ে যাচ্ছে। চায়নার কথাই ধরা যাক। বিশ-পঁচিশ বছর আগেও তাদের ৭৫% পার্সেন্ট মানুষ দরিদ্রসীমার নীচে ছিল। এই পঁচিশ-ত্রিশ বছরে তারা সেটা এক পার্সেন্টের নীচে নামিয়ে এনেছে। এর পেছনে মূল শক্তি হচ্ছে টেকনোলজি। আমরা আজ হুয়াওয়ে, আলি বাবার কথা শুনি। এই ধরনের কোম্পানি পুরা চায়নাকে পরিবর্তন করে ফেলেছে। মালয়েশিয়াতেও এরূপ আছে।

ওখানকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একটা ব্যবস্থা আছে sand box নামে। এর দ্বারা তারা বুঝিয়ে থাকে, দেশে যারা অর্থবান্ধব কোনো নতুন আইডিয়া আনবে, যেমন কোনো একটা মোবাইল এ্যাপ, যার মাধ্যমে টাকা সাশ্রয় হবে, এ রকম কোনকিছু, তা হলে ওই sand box থেকে তারা সীমিত পর্যায়ে দুই বছরের সুযোগ পাবে। sand box এর অধীনে তারা দুই বছর তাদের কাজটি পরীক্ষা করার সুযোগ পাবে এবং এ সময়ের মধ্যে তারা আইনগত কোনো জটিলতায় পড়বে না। আমাদের দেশে এমন কিছু কেউ করা শুরু করলে সেটা মানিলন্ডারিং আইনের অধীনে চলে যাবে৷ কিন্তু মালয়েশিয়ার sand box তাকে এই সুবিধাটা দিবে, কোনো আইনি জটিলতা হবে না। স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ চালিয়ে যাবে। দুই বছর পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন চিন্তা করবে, তার এই আইডিয়া যদি উপকারী হয় তা হলে এই আইডিয়ার জন্য প্রতিবন্ধক আইনগুলো তারা সংশোধন করবে।

মালয়েশিয়াতে এ রকম আরও একটি উদ্যোগ আছে, সেটার নাম ‘মালয়েশিয়া ডিজিটাল ইকোনমি কর্পোরেশন’। ডিজিটাল অর্থব্যবস্থা জোরদার করার একটা উদ্যোগ৷ এটা একটা সরকারি উদ্যোগ। এই উদ্যোগের মাধ্যমে তারা অনেক কিছু করছে। একটা হলো, এর মাধ্যমে তারা বিদেশি ফান্ড নিয়ে আসছে। অনেক বিদেশি ফান্ডদাতা মালয়েশিয়ান সম্ভাবনাময় কোম্পানিগুলোকে কোনো লাভ ছাড়াই, গিফটের মতো ফান্ড দিচ্ছে। কারণ তারা জানে, এই কোম্পানিগুলো ভালো করলে আল্টিমেটলি তাদের অর্থব্যবস্থারই উপকার হবে। আমাদের দেশে আমরা এখনো এ ধরনের উদ্যোগ দেখছি না। এটা হচ্ছে রাষ্ট্রের দায়। প্রো-একটিভ হচ্ছে, যে নিজ থেকে এগিয়ে আসে। অন্যান্য দেশে সরকার বা অন্যান্য রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারকে উদ্বুদ্ধ করে, তোমরা নতুন নতুন কাজ করো, তারা এক্ষেত্রে প্রো-এক্টিভ। এমন না যে উদ্যোক্তারা তাদের কাছে গিয়ে আইনের সংশোধন ও নানান সুযোগ সুবিধা চায়, বরং রেগুলেটররাই যা যা করা দরকার তা তাদের জন্য সুবিধাজনক করে দেয়। কারণ তারা এটা জানে, এই বাজারটা হিট করে দিতে পারলে এখান থেকেই অনেক অর্থ ও কর্মসংস্থান তৈরি হবে, যা রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে দক্ষতা ও যোগ্যতা। আমাদের দেশে এটার খুব অভাব। ভার্সিটিগুলো যে অনার্স মাস্টার্সের অফার করে, এর দ্বারা আসলে নতুন কর্মসংস্থান তৈরির মতো দক্ষতা অর্জন হয় না। আমাদের দেশের সর্বস্তরেই দক্ষতা ও বিনিয়োগের কালচার এবং বিনিয়োগের নিরাপত্তা তৈরি করতে হবে৷ বিনিয়োগের নিরাপত্তা বলতে বুঝানো হয়, যারা নতুন কোনো উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছে, তাদের তথ্য বা ইনফরমেশনের উপর সাধারণ মানুষের একটা ন্যূনতম আস্থা যেন তৈরি হয়৷ অনেকেই আছে যারা ফ্রড। রাষ্ট্র দায়িত্ব নিয়ে এদের রুখে দিয়ে মানুষের আস্থা ফেরাতে হবে। উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী উভয়কে আইন, কর ও ট্যাক্স ইত্যাদির মাধ্যমে রাষ্ট্রকে সহায়তা করতে হবে। এভাবে করতে পারলে আমরা নতুন নতুন কর্মসংস্থান পাব ইনশাআল্লাহ।

ফাতেহ 

বাংলাদেশে ধর্মীয় পরিসরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্র ইমামতি ও শিক্ষকতা। তবে এসব ক্ষেত্রে শিক্ষক নিবন্ধনেরে মতো কোনো সমন্বিত পরীক্ষা বা পদায়নের ব্যবস্থা নেই। ফলে অনেক ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। গ্রামের দিকে কেউ যেতে চাচ্ছে না। বেতন-ভাতা-সুবিধা নিয়েও অভিযোগ আছে। এই অবস্থার সংস্কার কতটা জরুরি ও কীভাবে সম্ভব?

ইউসুফ সুলতান 

এটা খুবই চমৎকার প্রশ্ন এবং আগেও এ বিষয়ে কিছু আলোচনা এসেছে। আমরা আমাদের সবচেয়ে উপর স্তরের কাজ ধরে নিই ইমামতি এবং শিক্ষকতা। আমাদের একটা স্ট্যান্ডার্ড মান নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান থাকা উচিত৷ সেটা আলাদা বোর্ড হতে পারে৷ হাইয়াতুল উলইয়া হতে পারে। আপনি স্বজনপ্রীতির কথা বললেন। এখানে দুটি দৃষ্টিকোণ আছে। একদিকে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো করে চালানো। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সিস্টেম আমাদেরকে ফলো করতে হবে৷ তাদের প্রতিষ্ঠান কীভাবে ভালো চলছে, এ ব্যাপারে লক্ষ করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেক সময় মানদণ্ড নির্ধারণের একটা বোর্ড থাকে। এটাকে বোর্ড অফ ট্রাস্টি বলা হয়। এর মাধ্যমে তাদের পদক্ষেপগুলো স্বচ্ছ হয়। যখন তাদের কোনো পোস্টে লোক প্রয়োজন হয়, তখন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় এবং যোগ্য প্রার্থীকেই চাকরিতে নিয়োগ দেয়। মাদরাসায়ও এই ব্যবস্থাগুলো আসা দরকার, তবে আসতে সময় লাগবে এটাও বাস্তবতা। কারণ মাদরাসাগুলো সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান না। পরিচালনা এবং আর্থিক অবকাঠামোর দিক থেকে একেকটা প্রতিষ্ঠান একেকরকম।

কওমি মাদরাসাকে আমি প্রাইভেট ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান বলতে পারি। প্রথমে প্রাইভেট ব্যাখ্যা করি, প্রাইভেট কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান হলো একজন উদ্যোক্তা একটা প্রতিষ্ঠান শুরু করবেন এবং কোম্পানি আইনের আওতায় সেটা পরিচালনা করবেন৷ পরিচালক তার প্রতিষ্ঠানটি সামনে এগিয়ে নিতে এবং মানুষের সামনে এর স্বচ্ছতা রক্ষার জন্য যেই পন্থাগুলো অবলম্বন করেন, মাদরাসায় একজন পরিচালককে সেটা করতে হবে ৷ যেহেতু এটা ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান, কেউ না কেউ এখানে জমি দান করেছেন, তাই একটা মাদরাসাকে প্রাইভেট কোম্পানি এবং ওয়াকফ এই দুই দিক রক্ষা করেই পরিচালনা করা উচিত। যারা ভাড়া বাড়িতে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা বা পরিচালনা করেন, এটা সম্পূর্ণ একজন উদ্যোক্তার দৃষ্টিতে দেখা উচিত৷

আপনি যে বিষয়টা উল্লেখ করেছেন, স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে; দেখুন, যখন একজন উদ্যোক্তা নিয়োগ দেবে, তার কিন্তু রিসোর্স সীমিত। তার অর্থ ও সময় সবকিছুই সীমিত। এর মধ্যে সে চেষ্টা করবে সবচেয়ে দক্ষ লোকগুলো নিয়োগ দিতে, নতুবা তার লস হবে৷ তার স্বজনপ্রীতি করার সুযোগ নেই। সে যদি ভালো স্টাফ নিয়োগ দেয়, তা হলে তার প্রোডাক্টের মান বৃদ্ধি পাবে৷ আমরা শিক্ষাকে যদি একটা প্রোডাক্ট ধরি, তা হলে একজন ভালো শিক্ষক একজন ভালো স্টাফ। শিক্ষক ভালো হলে শিক্ষার কোয়ালিটি বাড়বে, এই দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখা হয়, তা হলে স্বজনপ্রীতি থেকে শুরু করে আরও অনেক সমস্যাই কমে যাবে৷ আর ওয়াকফ করা মাদরাসাগুলোকে একটা প্রফেশনাল কোম্পানি আইনে পরিচালনা করা উচিত। আন্তর্জাতিক বা জাতীয় মান অনুসারে তার পরিচালনা সিস্টেম একেবারে স্বচ্ছ থাকবে। আমাদের সমন্বিত পরীক্ষাব্যবস্থা নেই, এটা হাইলাইট করা হচ্ছে, কিন্তু আমার মনে হয়, এটা না থাকলেও আমাদের অনেক কিছু করার আছে।

ফাতেহ 

যে কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মক্ষমতা অনেকটা তার পরিচালনার ওপর নির্ভর করে। মাদরাসাগুলোতে পরিচালনা নিয়েও একটা বিশৃঙ্খলা আছে। প্রতিষ্ঠাতা মুতাওয়াল্লি-মুহতামিমের হস্তক্ষেপের একটা সুযোগ থাকে। এসব পদের কোনো মেয়াদ বা স্থলাভিষিক্তির ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট পদ্ধতি বা নিয়ম নেই। এসব কারণে অনেক সময় বিতর্কের সৃষ্টি হচ্ছে। এই ব্যাপরটা কীভাবে দেখেন?

ইউসুফ সুলতান 

প্রথমত আমি আগের প্রশ্নে যা বলেছি, যে কোনো ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানকে প্রফেশনালি ম্যানেজ করতে হবে। আমাদের দেশে অনেক ট্রাস্টি ইউনিভার্সিটি আছে। ট্রাস্টকে আমরা অনেকটা ওয়াকফের মতোই মনে করতে পারি। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যামব্রিজ, সম্ভবত অক্সফোর্ডও ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশেও অনেক ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান আছে। মানুষ সেখানে টাকা দিচ্ছে, ফান্ড হচ্ছে। আবার সেই ফান্ড পরিচালনার জন্য একটা ট্রাস্ট বোর্ড হচ্ছে। এটাকে বোর্ড অফ ট্রাস্টি বা ওয়াকফ বোর্ড বলতে পারি আমরা। তারা কিন্তু ওয়াকফ বা ট্রাস্টের জন্য যা ভালো হয়, সে সিদ্ধান্তই গ্রহণ করে থাকে। তাদের মতোই কিন্তু আমাদের মাদরাসাগুলো ওয়াকফের উপর প্রতিষ্ঠিত। আমরা যদি তাদের নিয়মগুলো কিছুটা পরিমার্জন করে আমাদের প্রতিষ্ঠানে কাজে লাগাতে পারি, তা হলে সেটা আমাদের জন্য ভালো হবে।

তাদের বোর্ড অফ ট্রাস্টির একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ বা সময়সীমা থাকে। একটা বোর্ড কত দিন থাকবে, বোর্ডে কার কী দায়িত্ব, কী সীমাবদ্ধতা, সব সেখানে অফিসিয়ালি উল্লেখ আছে৷ আমাদের দেশে শুধু ওয়াকফকৃত সম্পত্তির ব্যাপারে আইন আছে, ওয়াকফের প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ব্যাপারে কোনো আইন নেই। তাই আমরা ট্রাস্টকে ফলো করতে পারি।

প্রশ্নের মধ্যে যে বিষয়টা এসেছে- বিশৃঙ্খলা। এর কারণ হলো, এ ক্ষেত্রে আমাদের কোনো আইন নেই৷ তাই যে যার মতো স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা করছে। আইন না থাকা অবস্থায় এটা স্বাভাবিক। এ জন্যই আইন এবং আইনের বাস্তবায়ন প্রয়োজন৷

তা ছাড়া আরও একটা বিষয় আছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমাদের ম্যানেজমেন্টের উপর কোনো পড়াশুনা নেই এবং কোনো অভিজ্ঞতাও নেই। ফলে আমাদের কেউ যখন মুহতামিম হয়ে যান বা কোনো দায়িত্ব তার উপর চলে আসে, তখন তাকে নতুন করে সবকিছু শিখতে হয়। কেউ যদি সময়ের সাথে শিখে ফেলেন, তা হলে সেটা তার যোগ্যতা, কিন্তু কেউ যদি শিখতে না পারেন তা হলে স্বাভাবিকভাবে তিনি তার ন্যাচারাল স্বভাব-চরিত্র এখানে ব্যবহার করবেন। তার রাগ ও আনন্দ ইত্যাদির প্রভাব তার প্রতিষ্ঠানের উপরে পড়ে। যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তার পড়াশুনা থাকত তা হলে অনেক বিশৃঙ্খলাই আমরা দেখতাম না, যেমন: জেনারেল লাইনের অনেক জায়গায় আমরা এই বিশৃঙ্খলাটা দেখি না। আবারও আমি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলব, সেটা শিক্ষা-কারিকুলামের অন্তর্ভুক্ত হোক বা তাখাসসুস হোক, ওয়ার্কশপ হোক, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ম্যানেজমেন্ট অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

ফাতেহ

এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। আপনি অর্থনীতির পাশাপাশি প্রযুক্তি নিয়েও কাজ করেন। প্রযুক্তি ইসলামি জ্ঞানব্যবস্থায় কতটা প্রভাব রাখতে পারবে বলে মনে করেন? আমরা দেখছি যে, হাদিসের তাখরিজের কাজ এখন অনেকটা সহজ হয়ে গেছে। আপনি রবো শরিয়া অ্যাডভাইজারের প্রকল্পের কথা লিখেছেন। ফিকহের অন্যান্য ক্ষেত্রেও আমরা এর বিস্তৃতি দেখতে পারি। এটা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

ইউসুফ সুলতান 

আসলে আমাদের দেশে যখন প্রযুক্তির কথা বলা হয়, তখন এর দ্বারা খুব সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয় বুঝানো হয়, তবে প্রযুক্তিটা আরও ব্যাপক। এটা আমাদের যে কোনো বিষয়কে আরও অনেক সহজ করে দিতে পারে। প্রযুক্তিকে ইংরেজিতে বলে enabler, যার অর্থ, যা অন্য কোনো বিষয়কে সহজ করে তোলে। এটা সবধরনের প্রসেসের মধ্যেই অবদান রাখতে পারে। শরিয়ার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। যেমন আপনি হাদিসের তাখরিজের কথা বললেন। যখন আমরা একটা হাদিসের ইবারত লিখি, তখন সে একটা এলগরিদমের ভিত্তিতে অর্থাৎ বিভিন্ন সূত্র কাজে লাগিয়ে ওই হাদিসের একটা মান বলার চেষ্টা করে। হয়তো কিছু ক্ষেত্রে বিখ্যাত মুহাদ্দিসিগণের মতের বিপরীত হতে পারে, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফলাফল কাছাকাছি। এই প্রযুক্তি বর্তমানের মিলেনিয়াল প্রজন্ম অর্থাৎ যাদের বয়স পঁয়ত্রিশের নিচে, বিভিন্ন রিপোর্টের মাধ্যমে জানা যায় এই প্রজন্ম তাদের সকল কাজ মোবাইলের মাধ্যমেই করতে চায়। কেনাকাটা, গাড়িভাড়া ইত্যাদি সকল কাজই তারা মোবাইলে করতে চায়। এই বিষয়টা যদি আমরা মাথায় রাখি, তবে আমাদের ভাবতে হবে, এই প্রজন্মের কাছে আমরা শরিয়ার বিষয়াদি পৌঁছে দিতে চাইলে আমাদেরকে প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হবে।

যেমন ধরুন, আমরা জাকাতের কথা বলি। আমরা চাইলে কিন্তু শরিয়া স্কলার, মুফতি, আলেমে দ্বীন এবং ওয়েব ডেভেলপার, প্রোগ্রামার তাদের সহায়তায় জাকাত এ্যাপ বানাতে পারি। মোবাইল এপ্লিকেশন থাকবে। যার মাধ্যমে কেউ জাকাত হিসাব করতে পারবে। আগের বছরের জাকাত সেভ করা থাকবে, পরবর্তী বছরের জাকাত এন্ট্রি করতে পারবে৷ তার কত টাকা জাকাত এসেছে সেটা দেখতে পারবে, কাকে জাকাত দিয়েছে, কত দিয়েছে সেটাও দেখতে পারবে৷ মোটকথা মানুষকে জাকাত আদায়ের কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে জাকাতের সম্পূর্ণ প্রসেস তার নখদর্পণে নিয়ে আসার ব্যবস্থাও করতে হবে।
তারপর আমরা উত্তরাধিকারের এপ্লিকেশন বানাতে পারি। একটা লোক মারা যাওয়ার পরে তার কে কে আছে সেটা এবং সম্পদের পরিমাণ উল্লেখ করলে এ্যাপ থেকেই কে কতটুকু পাবে তার সঠিক হিসাব করে দেবে (বাংলাদেশে এমন একটা এ্যাপ তৈরি হয়েছে)।

আমরা হালাল ব্যবসার কথা বলি; কেউ যদি নতুন ব্যবসা শুরু করে, ব্যবসাটা কি হালাল রয়েছে নাকি হারাম হয়ে গেছে, এটা বুঝার জন্য কিছু প্রশ্ন রাখা যেতে পারে৷ এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলে প্রশ্নগুলোর পেছনে যে সূত্র রয়েছে, সেই সূত্রের ভিত্তিতে এ্যাপই বলে দেবে, তার ব্যবসাটা হালাল হচ্ছে নাকি হারাম হচ্ছে। হালাল ফুড নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক দেশে এপ্লিকেশন তৈরি হয়ে গেছে। সেই এ্যাপ দিয়ে খাবারের বার কোড স্ক্যান করলে পণ্যের উপাদান অনুযায়ী জানা যায় খাবারটা হালাল কিনা। এভাবে বিভিন্ন বিষয়, যেমন মাসআলা-মাসায়েল ইত্যাদি বিষয়গুলো যখন আমরা মানুষের হাতের মুঠোয় নিয়ে যেতে পারব তখন বলা যাবে, আমরা প্রযুক্তিকে কাজে লাগাচ্ছি।

ফাতেহ 

রবো শরিয়া অ্যাডভাইজারের প্রকল্পের ব্যাপারে কিছু বলবেন?

ইউসুফ সুলতান 

আর রবো শরিয়া অ্যাডভাইজারের প্রকল্পের কথা লিখেছিলাম, সেটা নিয়ে এখন বিশ্বব্যাপী আলোচনা হচ্ছে। এটাকে যদিও কেউ কেউ রোবট বলে থাকে, তবে এটা হচ্ছে কিছু সূত্রের সমষ্টি। একজন ইসলামি অর্থনীতিবিদ তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা এবং আন্তর্জাতিক ফতওয়ার ভিত্তিতে তিনি এই সূত্রগুলো প্রণয়ন করেছেন। রবো এডভাইজার হচ্ছে, এই প্রোগ্রাম যখন কম্পিউটারে বা এপ্লিকেশনে দেওয়া হবে, তারপর সেটাতে যখন কোনো কোম্পানির পূর্ণাঙ্গ তথ্য দিয়ে দেওয়া হবে, এই কোম্পানির লাভ কত, ঋণ কত ইত্যাদি, তখন সে নিজে থেকেই জানিয়ে দেবে এই কোম্পানি শরিয়া মোতাবেক রয়েছে কিনা। অনেকেই আশাবাদ প্রকাশ করছেন রবো এডভাইজার বাস্তবায়িত হয়ে গেলে শরিয়া স্কলারদের আর কোনো দায়িত্বই থাকবে না, আমি সেই জায়গায় একটু দ্বিমত করেছিলাম। আমি সেই আর্টিকেলে বলেছিলাম রবো এডভাইজার যতই এলগরিদমের ভিত্তিতে বলুক না কেন, সর্বশেষ সিদ্ধান্তটি দেওয়ার জন্য শরিয়া এডভাইজার বা মুফতি সাহেবের প্রয়োজনীয়তা থেকেই যাবে।

মুফতি সাহেবকে পুরাপুরি চিত্র থেকে বের করে দেওয়া সম্ভব না। কারণ শরিয়ার সববিষয় একেবারে বাইনারি না। শুধু সাদা এবং কালো, আর কিছু নেই- এ রকম না। কম্পিউটার যেমন শুধু জিরো এবংওয়ান বুঝে, শরিয়ার সবকিছু এত সরল না। কখনো কখনো সাদা এবং কালো অথবা শুন্য এবং ওয়ানের মাঝামাঝিও কিছু বিষয় থেকে যায়। একটা বিষয় শুধু জায়েজ বা নাজায়েজেই সীমাবদ্ধ থাকে না। একজনের জন্য জায়েজ আরেকজনের জন্য জায়েজ না, এইরকমও অনেক বিষয় আছে। প্রেক্ষিত ভিন্ন হলে অনেক কিছুই ভিন্ন হতে পারে৷ ফলে শরিয়া এডভাইজার বা মুফতি সাহেবের প্রয়োজনীয়তা থেকেই যাবে।

মূল কথা ছিল প্রযুক্তি বা সহজিকরণ। এখন আমাদেরকে সহজিকরণের কথা চিন্তা করতে হবে। আগে মানুষ মুফতি সাহেবের কাছে আসত। এখন হয়তো জীবনযাত্রা বদলে গেছে, তারা আসে না৷ আবার মিলেনিয়াল যে প্রজন্মের কথা বললাম, তারা আসতে চায় না। আমাদের দায়িত্ব হবে তাদের আঙুলের কাছে সব পৌঁছে দেওয়া। আর প্রশ্নের একটু অংশ ছিল অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রযুক্তির বিস্তৃতি। হ্যাঁ, সেটা হতে পারে, বুয়ুয়ের ক্ষেত্রে, মিরাছের ক্ষেত্রে, হজের ক্ষেত্রেও আমরা প্রযুক্তির ব্যবহার করতে পারি।

ফাতেহ

বাংলাদেশে ইসলাম চর্চার পরিমাণ খুব কম নয়। আমরা এখন ওয়াজ মাহফিল ও জুমার খুতবা অনলাইনে আসতে দেখছি। ফতওয়ার কাজও অনলাইনে আসছে। এটা কীভাবে আরও কার্যকর ও ফলপ্রসূ করে তোলা যায়?

ইউসুফ সুলতান 

আসলে আমাদের তরুণ প্রজন্ম সবকিছু খুব সহজে হাতের কাছে চায়। তাই আমাদেরকে আরও বেশি ক্রিয়েটিভ হতে হবে, যেন আমরা তাদের হাতের কাছে সব পৌঁছে দিতে পারি। আপনি লক্ষ করলে দেখবেন, ইউটিউবে এখন মানুষ ওয়াজ মাহফিল থেকে আস্তে আস্তে বের হয়ে স্ট্রাকচারড কন্টেন্টের দিকে যাচ্ছে। আগে মানুষ অবসর সময়ে ওয়াজ ছেড়ে রাখত। যেসব ওয়াজের মধ্যে অনেক অপ্রয়োজনীয় তথ্য থাকত৷ আমাদের বর্তমান প্রজন্মের কাছে মনে হচ্ছে এগুলো সময়ের অপচয় ছাড়া কিছু নয়। এখন তারা এমন ভিডিওর দিকে ঝুঁকছে, যেখানে একটা নির্দিষ্ট বিষয়ের আলোচনা আছে। লিখিত স্ক্রিপ্ট আছে এবং সেটা খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। মোটকথা, মানুষ এখন নির্ভরযোগ্য এবং প্রয়োজনীয় তথ্য চায়। আর মানুষ এখন খুব অস্থির। খুব অল্প সময়ে অনেক কিছু পেতে চায়। আমরা যদি একটা এক-দেড় ঘন্টার ওয়াজ আপলোড করি, তা হলে কেউ হয়তো দুই মিনিট, কেউ পাঁচ মিনিট, কেউ সর্বোচ্চ ১০ মিনিট দেখবে, কিন্তু পুরোটা দেখা বা শোনার লোক খুব কম।

কিন্তু আমরা যদি পুরা কন্টেন্টটাকে একটা পরিশীলিত রূপ দিয়ে পাঁচ মিনিটের একটা ভিডিওতে প্রকাশ করি, তা হলে দেখা যাবে, কয়েকগুণ বেশি মানুষ পুরো ভিডিওটি দেখবে। আমাদের তরুণ আলেমদের করণীয় হলো এই ট্রেন্ডগুলো ফলো করা। একটা সময় ইউটিউব ছিল। আমরা দীর্ঘসময় ইউটিউবে পার করলাম। এখন পটোকাস্টের যুগ আসছে। পটোকাস্ট হলো শুধু অডিও। ইউটিউব হচ্ছে ভিডিও। ভিডিও দেখতে হলে অন্য সবকিছু বন্ধ রেখে দেখতে হয়। কিন্তু অডিও অন্য কাজের পাশাপাশি শোনা যায়। তাই মানুষ এখন পটোকাস্টের দিকে ঝুঁকছে। আমাদের নতুন প্রজন্মের আলেমদের কাছে এই নতুন ট্রেন্ডগুলো পরিষ্কার থাকতে হবে, যেন তারা নতুন পদ্ধতিতে মানুষের কাছে দাওয়াহ নিয়ে যেতে পারে।

ফাতেহ 

আপনি এখন Shari’ah-Tech Consultant at Ethis Ventures হিসেবে কর্মরত আছেন। আপনার সাম্প্রতিক কিছু অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করবেন?

ইউসুফ সুলতান

আসলে Shari’ah-Tech Consultant আমার অনেক পুরনো পদবি। এই মুহূর্তে আমি ইনফ্রাস্টাকচার ও শারিয়ার প্রধান হিসেবে আছি। প্রথমে শরিয়ার কথা বলি, এটাকে একটা ইসলামি অর্থায়ন কোম্পানি বলা যায়৷ ইসলামি ফিনটেক কোম্পানি। আমাদের কোম্পানির মাধ্যমে মানুষ বিভিন্ন হাউজিং প্রজেক্টে বিনিয়োগ করে থাকে। লো কস্ট হাউজিং যেগুলো, অর্থাৎ মধ্যবিত্ত যেন কিনতে পারে এমন কস্টের মধ্যে সেই বাড়িগুলো বানানো হয় সরকারি সহায়তায়। বিনিয়োগকারী এবং ডেভেলপার এই দুইয়ের মাঝে কখনো মুদারাবার ভিত্তিতে, কখনো মুশারাকার ভিত্তিতে এই ব্যবসাটা হয়। আমার দায়িত্ব হচ্ছে এই জায়গাগুলোতে শরয়ি বিষয়গুলো নিশ্চিত করা। একই সাথে আমি লিগ্যাল দিকগুলোও দেখছি ইদানীং। আমাদের কাজগুলো আমরা সিঙ্গাপুর আইনের অধীনে পরিচালনা করে থাকি। আমাদের কাজগুলো সিঙ্গাপুর আইন অনুযায়ী হচ্ছে কিনা, বা যে ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়েছে, সে ডকুমেন্ট আইন অনুযায়ী হচ্ছে কিনা, সে কাজটাও আমাকে করতে হয়।

একই সাথে একটা প্রজেক্ট শুরু হওয়ার আগে ডেভেলপার যে কাজটা শুরু করতে যাচ্ছেন, এটা সম্পূর্ণ শরিয়াসম্মত কিনা, এটা আমাকে দেখতে হয়। গ্রাউন্ডে আমরা যে বাহাসা ইন্দোনেশিয়া করছি অর্থাৎ ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় যে চুক্তিটা করছি, সেটা শরিয়াসম্মত হচ্ছে কিনা এইসব বিষয় দেখতে হয়। আবার কাজ চলাকালীনও অনেক সময় এমন বিষয় এসে পড়ে, যা শরিয়া লঙ্ঘন করে। আমাদের দেশের মতো সেখানেও অনেক সময় ঘুষ আদান-প্রদান হয়, সেইগুলোর শরয়ি সিদ্ধান্ত দিতে হয়। আবার কাজ শেষে যদি সেটা মুদারাবা বা মুশারাকার ভিত্তিতে হয়, তা হলে সেটার প্রফিট একচুয়ালাইজেশন করতে হয়। এসব অবশ্য অন্য টিম প্রস্তুত করে৷ আমি শুধু এপ্রুভ করি বা কোনো সমস্যা থাকলে ঠিক করে দিই। মোটকথা ইনভেস্টমেন্ট রিলেটেড শরয়ি অনেক ধরনের কাজ আমাকে করতে হয়।

আপনি হয়তো জানবেন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান এওফি থেকে আমি CSAA সার্টিফিকেট গ্রহণ করেছি। বাংলাদেশে হয়তা এটাই প্রথম। আসলে CSAA সার্টিফিকেটটা ফিনান্সিয়াল ইন্সটিটিউশন অর্থাৎ ব্যাংক বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কথা চিন্তা করে প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু যখন আমরা একেবারে প্রকৃত বিনিয়োগে যাই, সেখানে এমন অনেক মাসআলা চলে আসে, যেটা এই স্ট্যান্ডার্ডগুলোতে নেই। তখন আমাদেরকে একেবারে ক্ল্যাসিকাল ফিকহি কিতাব থেকে অধ্যয়ন করে রেজুলেশন ইস্যু করতে হয়। আমাদের ডেভেলপার বা বিনিয়োগকারী তারা সেটা মেনে থাকেন। এটা হচ্ছে শরিয়া এবং লিগ্যাল, এখানে আমি কাজ করছি।

পাশাপাশি ইনফাস্টাকচারের কাজে আমার যেই টিম তারা একাউন্ট, ফাইন্যান্স, এইচআর, টেকনোলজি এবং এডমিন ইত্যাদি বিষয়গুলো দেখছে। আমি তাদেরকে ম্যানেজ করে থাকি। ম্যানেজ করার ক্ষেত্রে প্রাচীন পদ্ধতি হলো হাইরার্কি সিস্টেম। একজন বস থাকবে, তার আন্ডারে আরেকজন বস, তার আন্ডারে আরেকজন, সব এইভাবে। অধীনস্থতা আর কি। যেই পদ্ধতিটা আমরা অনুসরণ করে থাকি, সেটা অধীনস্থতা না৷ আমরা সবাই একসাথেই কাজ করি। আমরা যখন একটা ম্যাপ তৈরি করি তখন আমরা সবাই একই পর্যায়ে থেকে কাজ করছি, তবে জাস্ট তাদেরকে লিড দিচ্ছি। প্রত্যেকেই যার যার কাজ করছে। এজ-এ লিডার আমার কাজ হলো, তার কাজ যেন সে সহজে করতে পারে সেই ব্যবস্থা করে দেওয়া। কোথাও বাধা আসলে বাধা দূর করা। কোনো জায়গায় সে লো হয়ে গেলে বা মোটিভেশন হারিয়ে ফেললে তাকে মোটিভেট করা। মোটকথা সে যেন তার কাজে সচল থাকে সেই জায়গাটা দেখা হলো আমার দায়িত্ব।

আরেকটা কাজ আমাকে দেখতে হয়, সেটা হলো এক্সটার্নাল কলাবরেশন অর্থাৎ বাহিরের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করা। সেই জায়গা থেকে আমি এখন এওফির সাথে একটা কলাবরেশনে যুক্ত আছি। এর আগে আইডিবির সাথে কাজ করেছি। মালয়েশিয়ার কয়েকটা ব্যাংকের সাথেও কাজ করেছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সিকিউরিটিজ কমিশনের সাথেও কাজ করা হয়েছে। আরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথেও কাজ করেছি। বর্তমানে ibfim নামের একটা কোম্পানির সাথে কাজ করছি। মোটকথা শারিয়া লিগ্যাল, ইনফাস্টাকচারের পাশাপাশি আমাকে অনেক সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে কলাবরেশনের কাজে যুক্ত থাকতে হয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনারে যেতে হয়। সেই সুবাদে আন্তর্জাতিক বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ তৈরি হচ্ছে, এটা ভবিষ্যতে কাজে লাগবে আশা করি। বাংলাদেশেও এগুলো নিয়ে আমার কাজ করার ইচ্ছা আছে। ওআইসি, এওফি ইত্যাদি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে একটা বড় স্থানে আমি বাংলাদেশকে দেখতে চাই ইনশাআল্লাহ। এই হচ্ছে মোটামুটি আমার অভিজ্ঞতার কথা।

ফাতেহ

যারা ধর্মীয় শিক্ষা থেকে প্রযুক্তি খাতে যেতে চাচ্ছেন, তাদেরকে ঠিক কী পরামর্শ দেবেন?

ইউসুফ সুলতান 

এটাকে যদি আমি শাব্দিক অর্থে ধরে নিই, তা হলে হয়তো আপনি তাদের প্রোগ্রামার হওয়ার কথা বলছেন, অর্থাৎ যারা কোডিং করবেন। এটা জরুরি না, তবে কোডিংয়ে যদি কেউ যেতে চায় তবে যেতে পারে৷ এ ক্ষেত্রে আমি একটা সতর্কতা দিচ্ছি, কোডিংয়ে রাত দিন পুরো সময়টাকে ইউজ করতে হবে। আপনি হয়তো সেভাবে কোরআন-হাদিস চর্চা করার সুযোগ আর পাবেন না। সবাইকে আসলে প্রোগ্রামার হওয়ার দরকার নেই। আমাদের দেশে প্রচুর প্রোগ্রামার আছে। এখন যেটা প্রয়োজন সেটা হলো, আমি প্রথম প্রশ্নে যেটা বলেছি, উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা লালন করা। একজন মাদরাসা গ্রাজুয়েট যদি উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা লালন করে, তা হলে তিনি একজন প্রোগ্রামারকে সঙ্গে নিয়ে নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে সক্ষম হবেন। হতে পারে পাঠাওয়ের মতো নতুন কোনো উদ্যোগ আমাদের মাদরাসার অঙ্গন থেকে চলে আসতে পারে, যা সমগ্র জাতিকে উপকৃত করবে। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের প্রোগ্রামার হতে হবে আমি সেটা মনে করি না।

মাদরাসা শিক্ষার্থীদের নিজস্ব একটা রোল আছে সমাজে প্লে করার। নিজস্ব একটা দায়িত্ব আছে। সেই জায়গা থেকে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা অন্যান্য প্রোগ্রামারদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে পারে। এরপরেও যদি কেউ প্রযুক্তি খাতে আসতে চায়, তা হলে আসতে পারে, এটা একটা হালাল জায়গা। হালালভাবে আয়ের একটা ভালো সুযোগ আছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি প্রোগ্রামারদের ভালো চাহিদা আছে। ঘরে বসেই অনেক আন্তর্জাতিক কোম্পানিতে কাজ করার একটা সুযোগ আছে৷ এটা একটা হালাল আয়ের ব্যবস্থা হতে পারে। এটাতে আমি ব্যক্তিগতভাবে বাধা দিচ্ছি না, তবে খুব বেশি উৎসাহিতও করি না, আবার নিরুৎসাহিতও করি না।

ফাতেহ 

জাযাকুমুল্লাহ। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আসসালামু আলাইকুম।

ইউসুফ সুলতান 

আপনাদেরও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ওয়া আলাইকুমুস সালাম।

 

আগের সংবাদকারাগারে ঈদের স্মৃতি
পরবর্তি সংবাদমাহে রমজানের উদ্দেশ্য : আমাদের ‘মুহাসাবাহ’