ধর্মের নামে উন্মাদনা : সাম্প্রতিক বাস্তবতা ও ইসলাম

সাজ্জাদ আকবর

চলমান শতাব্দীতে ধর্মোন্মাদনার একটি ভয়াবহ দৃষ্টান্ত হচ্ছে ভারত। প্রাণঘাতী দাঙ্গার ইন্ধন যোগানো হচ্ছে প্রকাশ্যেই। সারা বিশ্বের চোখের সামনে ঘটনাগুলো ঘটতে শুরু করেছে। প্রকাশ্য যোগাযোগমাধ্যমে পুরুষদের প্রতি বিজেপি নারীনেত্রীর মুসলমান নারীদের জনসম্মুখে রাস্তায় গণধর্ষণের আহ্বান, নেতার মুসলিমমুক্ত ভারত গড়ার প্রকাশ্য ঘোষণা, শাসকদলের সভাপতির ‘মুসলিম বাঙালিদেরকে’ বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করার হিংস্র হুমকি, বিতর্কিত এনআরসি দিয়ে মুসলিমদেরকে বহিষ্কারের দুরভিসন্ধি, মুসলমান হওয়ার ‘অপরাধে’ ও গোমাংস ভক্ষণের ছুতোয় সত্য-মিথ্যা বানোয়াট অভিযোগে যত্রতত্র মুসলমান নিবর্তন-নিধনের উসকানি-েএসব যেন মহামারি আকার ধারণ করেছে ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশধারী ভারত রাষ্ট্রে। প্রতিকারের চেষ্টার শতগুণ বেশি সেই উসকানি। তার ওপর সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রের। ভয়াবহ দাঙ্গার আশঙ্কায় টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে ভারতজুড়ে। বাসা-বাড়ি থেকে নিয়ে শহর-নগর পর্যন্ত কোথাও নিরাপত্তা বোধ করছে না ভারতীয় মুসলিমরা। অপরাধীদের নামে লোকদেখানো মামলা হচ্ছে, কিন্তু বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না। এ সবই ঘটছে সারা দুনিয়ার সামনে। অপরাধীরা অপরাধ করে সেটা ভিডিও করে সদম্ভে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিচ্ছে তারা আসলে কী করতে চায়।

এতকিছুর পরও বিশ্বসম্প্রদায় নীরব। সত্যি বলতে কি, সারা পৃথিবীটাই হিংসার লেলিহান গোলকে পরিণত হয়েছে। জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ ও শত্রুতা অগ্নিশিখার মতো জ্বলছে। দেশে দেশে সীমান্তে সীমান্তে উন্মাদনার আগুন, ধুম্রপুঞ্জ। ভাষিক, ভৌগোলিক ও নৃতাত্ত্বিক বিচ্ছিন্নতার বোধ থেকে তৈরি হচ্ছে দেয়ালের পর দেয়াল। ধর্মের নামে চলছে অধর্মের রাজত্ব। ধ্বংস, উচ্ছেদ, জাতিগত নিধন ও অব্যাহত অবিচার চলছে ধর্মকে কেন্দ্রে রেখে। বিকৃত হওয়া ধর্ম দিয়ে যুদ্ধবিমানের তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। কোনো জাতির মানুষের চেয়ে গরু কিংবা কুকুর যেন অধিক মূল্যবান। আর কোনো জাতির যে-কোনো একজনের জীবন অপর জাতির হাজারো জীবনের চেয়ে যেন দামি। ধর্মতাড়িত ঘৃণা ও বর্ণবাদ-নির্দেশিত এই অবিচার বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠা নিয়েই আজ বিদ্যমান। প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য সর্বত্রে একই ধ্বংসযাত্রা। সভ্যতাগর্বী ইউরোপও কি কম ধর্মান্ধ? বুকে-পিঠে ধর্মনিরপেক্ষতার ছাপ লাগালেও ধর্মান্ধতায় তারাও কম যান না। কট্টর মুসলিমবিদ্বেষী ট্রাম্পকে ক্ষমতায় বসালো কারা? আমেরিকার সাধারণ জনগণ নয়, সিনেটররা। ইসরায়েলকে জাতিরাষ্ট্র স্বীকৃতি দিয়ে শত বছরের দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের ওপর পেড়েক লাগিয়ে ইহুদিদের দখলদারিত্বের সমর্থন দিচ্ছে কারা?

হতবাক করা ব্যাপার হলো, ইউরোপের অভিবাসন-বিদ্বেষের মূলে আছে এই ধর্মান্ধতা। পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় যুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের বিপন্ন মানুষেরা জীবন রক্ষার আশ্রয় খুঁজতে প্রাণ হাতে পাড়ি জমায় ইউরোপের উদ্দেশ্যে, তখন মানবাধিকারের ধ্বজাধারীরা নোঙর করার আগেই সাগরে ডুবিয়ে দেয় শরণার্থীদের নৌযান। যারা তীরে ভিড়ে, তারাও পায় না নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা। তারা আক্রমণের শিকার হয় মসজিদে, পথেঘাটে। মধ্যযুগীয় ক্রুসেডের চেতনা নিয়ে তাদের ওপর হামলে পড়ে সন্ত্রাসীরা। নিরাপত্তা যদি পেতে হয়, তাহলে ধর্মপরিচয় বদলাতে হবে। হতে হবে খ্রিষ্টান। অবিশ্বাস্য মনে হলেও বাস্তবতা এটাই। কিছুদিন আগের সানডে টাইমসের একটি রিপোর্ট দেখুন। শিরোনাম- Asylum seekers get baptised to stay in Britain. ( ব্রিটেনে আশ্রয় পাওয়ার জন্য শরণার্থীরা খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা নিচ্ছে।)

খবরে বলা হয়েছে, বৃটিশ হোম অফিস শত শত মুসলিম শরণার্থীর বৃটেনে থাকার আবেদন মঞ্জুর করেছে তারা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর। এই নবদীক্ষিত খ্রিস্টানের অধিকাংশই ইরানের মুসলমান। তারা যুক্তি দেখাচ্ছে ধর্মান্তরিত হবার ফলেই তাদের বৃটেনে বসবাস করতে হবে। নইলে ইসলাম ধর্ম ত্যাগের কারণে দেশে ফিরে গেলে প্রাণদণ্ডের মতো শাস্তিও তারা পেতে পারে। কথা হচ্ছে, বৃটেনের মতো পশ্চিমা সেক্যুলার রাষ্ট্রগুলো শরণার্থী ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে, খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর তারা কেন দরজা খুলে দিচ্ছে? খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করলেই একজন বিদেশি মুসলমানের কেন এদেশে থাকার অনুমতি সহজেই মিলে যায়, সেটাই প্রশ্ন। এটা কি বিপন্ন ও আশ্রয়প্রার্থী মানুষের অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়ে তাদেরকে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার জন্য চাপ প্রদান নয়?

ভারতে বিশেষ করে বাংলাদেশে বৃটিশদের ক্ষমতা দখলের পর নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং সাঁওতাল, গারো প্রভৃতি অনগ্রসর দারিদ্র্য-পীড়িত সম্প্রদায়গুলোকে খ্রিষ্টান মিশনারীরা উন্নত জীবন যাপনের লোভ দেখিয়ে ধর্মান্তরকরণ শুরু করেছিলো। এরই ফলে গড়ে উঠেছিলো অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়৷ আজকের বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলসহ সারা পৃথিবীতেই খৃষ্টানদের এমন ধর্মব্যবসা চলছে অব্যাহতভাবে৷

এ প্রসঙ্গে প্রথম মোগল সম্রাট বাবরের কথা মনে পড়ছে। ভারত শাসনে পুত্র হুমায়ুনকে উপদেশ দিতে গিয়ে এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন–‘দারিদ্র্য ও ক্ষুধার সুযোগ নিয়ে যে ধর্মান্তরকরণের ব্যবস্থা করা হয়, তা ধর্মের প্রচার নয় বরং ধর্ম অবমাননা৷ অতএব তুমি ভয় বা দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে ভারতের বিশাল হিন্দু সমাজকে ইসলামে দীক্ষিত করার চেষ্টা করো না। বরং সুশাসন দিয়ে তাদের মন জয় করার চেষ্টা করো।’

হ্যাঁ, বাবরপুত্র হুমায়ুন উপদেশ মেনে চলেছিলেন। এবং তাঁর রাজত্ব বিশাল বিস্তৃত ও শান্তিময় হয়ে উঠেছিলো। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব শ্রেণী-ধর্মের মানুষের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল তাঁর রাষ্ট্র। আর এটা সম্ভব হয়েছিলো ইসলামি আদর্শের কল্যাণে। ইসলামের ইতিহাস কানায় কানায় ভরা আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থার আলোকিত সব নমুনা দিয়ে। সারা পৃথিবীতে ইসলাম যখন প্রবল প্রতাপে প্রতিষ্ঠিত ছিলো, চারদিকে মুসলিমদের ছিলো জয়-ঝংকার তখনও ইসলামের এই রাজনৈতিক সামাজিক ব্যবস্থা অমুসলিমদের পীড়িত করেনি। কারণ ইসলামের ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় উদারতা ও সহনশীলতা মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রের চরিত্রে পরিণত হয়। অমুসলিম প্রজারা নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তার উদ্যানে উপনীত হয়। মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রে দয়া, অনুগ্রহ ও সহমর্মিতার অবারিত বুকে তারা লাভ করে আশ্রয়। ইসলামের যে রাষ্ট্র সমাজ ও সভ্যতা তার ভিত্তিমূলে নিহিত মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও দায়িত্ব। তার আত্মায় প্রবাহিত ঐশ্বরিক মহিমা ও কল্যাণবোধ। এর জীবনচর্চায় ঘৃণা নয় আছে খোদার সকল সৃষ্টির প্রতি প্রেম। বিদ্বেষ নয়, আছে সার্বজনীন ঐক্য। বিভেদ নয়, আছে সহযোগিতা ও কল্যাণী যৌথতা। বৈষম্য নয় আছে অবধারিত সাম্য ও সৌষম্য।

এখানে খলিফা ওমর রা. জিযিয়া দিতে অক্ষম বৃদ্ধ ইহুদিকে ভিক্ষা করতে দেখে ব্যথিত হন। নিজের ঘরে নিয়ে নিজ হাতে খাওয়ান তাকে। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে আদেশ করেন, জিযিয়া দিতে অক্ষম অমুসলিম নাগরিকদের ভাতা দেয়ার জন্য, যা তাদের পরিবারের প্রয়োজন পুরণে যথেষ্ট হয়।

এখানে একই বর্মের মামলায় ছিনতাইকারী ইহুদির সাথে সমানভাব আদালতে দাঁড়াতে হয় বর্মের মালিক খলিফা আলী রা.-কে। খলিফা হবার কারণে আলাদা অনুকম্পা তিনি পাননি, চাননি৷
ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্র অজ্ঞ ওমূর্খতাপ্রসূত ধর্মোন্মাদনাকে যেভাবে প্রত্যাখ্যান করে, তেমনি ধর্মব্যবসার পথও রুদ্ধ করে দেয় কঠোরভাবে। ভিন্নধর্মের প্রতি মানুষের হীনতা, আবিস্কার, হিংস্রতা, ও উৎপীড়নের ওপর জারি করে নিষেধাজ্ঞা। তাদের জানমাল ও ইজ্জতের মূল্যকে ও মর্যাদাকে করে প্রতিষ্ঠিত। এ ভিত্তিতে ইসলামি সভ্যতার সোনালি সময় হয়েছে অতিক্রান্ত। শত শত বছর ধরে শান্তি ও নিরাপত্তার চাতালে মুসলিম সভ্যতা আশ্রয় দিয়েছে অমুসলিম জনগোষ্ঠীকে। দিয়েছে আবাস ও আশ্রয়। কিন্তু আজকের বিশ্বে ধর্মোন্মাদনার শিকার হতে হচ্ছে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে হীনতা ও হিংস্রতা নিয়ে ক্ষমতাবানরা ঝাঁপিয়ে পড়ছে দুর্বল মুসলিমদের ওপর। বাড়ছে জাতিবিদ্বেষ। বাড়ছে ধর্মব্যবসা ও ধর্মীয় সন্ত্রাস। এর ফলে মুসলমানদের মধ্যে জন্ম নিতে পারছে আইএস-জাতীয় সহিংস ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীগুলো। যা পরিণতিতে মুসলিম জনপদগুলোকে আরও বিপন্নতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এর সুযোগে যুদ্ধ ও গণহত্যাকে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে দেশে দেশে। ফলত মানবতার দুর্দশা বাড়ছে বৈ কমছে না। কিন্তু এ পরিস্থিতির অবসান কি জরুরি নয়? এজন্য ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মব্যবসা থেকে বেরিয়ে আসা অপরিহার্য নয়? আসুন ইসলামের মানবকল্যাণ, মানবপ্রেম ও সহমর্মিতার শিক্ষাকে অবলোকন করি। শান্তি, সম্প্রীতি ও নিরাপত্তার একটি সমাজ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

লেখক : অধ্যয়নরত, ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট এন্ড রিসার্চ, ঢাকা

আগের সংবাদগণগ্রেপ্তারের ফলে স্থান সংকুলান হচ্ছে না কাশ্মীরের কারাগারগুলোতে, বন্দীদের পাঠানো হচ্ছে অন্য রাজ্যে
পরবর্তি সংবাদলাব্বাইক ধ্বনিতে মুখর হবে আজ আরাফাতের ময়দান